জঙ্গিরা যে বার্তা পৌঁছে দিল

রণেশ মৈত্র
Published : 22 Jan 2016, 06:27 PM
Updated : 22 Jan 2016, 06:27 PM

ব্রাহ্মণবাড়িয়া একটি ক্ষুদ্র শহর। কিন্তু নানা দিক থেকে সমৃদ্ধ। তার সাংস্কৃতিক অঙ্গন থাকে সদামুখরিত। তার দুধ, মাছ, মাংস প্রভৃতি উপাদেয় খাদ্যের কথা ছোটবেলায় বাপুজনের কাছে শুনেছি। রেলওয়ে স্টেশন হিসেবেও এখানকার স্টেশনটি গুরুত্বপূর্ণ। তাই ট্রেন চলাচল, লোক চলাচলও সর্বদা শহরটাকে প্রাণবন্ত করে রাখে। কয়েক বার ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনটি দেখারও সুযোগ হয়েছে। তবে একবার ন্যাপ বা গণফোরামের কোনো এক কর্মসূচি উপলক্ষে সামান্য তিন-চার ঘণ্টার জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে অবস্থান করেছিলাম। সময়-স্বল্পতার কারণে তখন সবার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার বা শহরটা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার অবকাশ মেলেনি।

আমার কাছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান এবং ব্যাপক অর্থে বাংলাদেশের প্রগতিশীল বাম রাজনীতির অন্যতম শীর্ষনেতা, তৎকালীন পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ওয়ালী খানের নেতৃত্বাধীন) মস্কোপন্থী ন্যাপের যুগ্ম সম্পাদক, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শহীদ দেওয়ান মাহবুব আলী খানের স্মৃতি আজও অম্লান। সে কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাটি অত্যন্ত পবিত্র বলেই শ্রদ্ধার চোখে দেখি। তদুপরি ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর জন্মভূমি হিসেবে দেশে বিদেশে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এক বিশেষ গৌরবময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে পরিচিতি ও খ্যাতি অর্জন করেছে। ধীরে ধীরে এতদিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাংস্কৃতিক অঙ্গনও মুখরিত একটি অঙ্গনে পরিণত হয়।

কিন্তু এই সব অর্জন, গৌরব ও অহংকারের বিষয়গুলি আজ যেন এক নিমেষেই স্তব্ধ। একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদক আবদুন নূর লিখেছেন:

''গান শোনার নেশায় একেবারে ছোটবেলায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। গান শিখলেন মাইহারের রাজদরবারে। ক্রমে তাঁর খ্যাতি ছড়াল বিশ্বজুড়ে। বিশ্বজয় করে এই সুরসম্রাট গত শতকের ষাটের দশকে ফিরে এসেছিলেন মাতৃভূমিতে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের কুমার শীল মোড়ে ছিমছাম একটা বাড়ি করে এখানেই থিতু হতে চেয়েছিলেন; পারলেন না। ততদিনে গানের শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গানের মানুষটিকে ধরে রাখার মতো অনুকূল পরিবেশ নষ্ট হতে চলেছে। আলাউদ্দিন খাঁ আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছেড়ে চলে গেলেও তাঁর স্মৃতিবিজড়িত ঐ বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করা হয় আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গন। এখানে একটি ছোট্ট যাদুঘরে ছিল তাঁর ব্যবহৃত সরোদসহ কিছু বাদ্যযন্ত্র। ধর্মবর্ণনির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ এই বাড়িটিকে এতকাল গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখে এসেছে। কিন্তু মঙ্গলবার মাদ্রাসা ছাত্রদের তাণ্ডবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গর্বের ধন আলাউদ্দিন খাঁর স্মৃতিচিহ্ন ধ্বংস হয়েছে।''

সেই খবরেই দেখতে পেলাম, হামলাকারীরা সংগীতাঙ্গনের জাদুঘরে রক্ষিত ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ব্যক্তিগত সরোজ, বেহালা, এসরাজ, সৌদি আরবের বাদশার দেওয়া জায়নামায, ভারতের মাইহার রাজ্যের রাজার দেওয়া গালিচাসহ যাবতীয় বাদ্যযন্ত্র ও আসবাব পুড়িয়ে দিয়েছে। সুরসম্রাটের নিজের হাতে আত্মীয় ও শিক্ষকদের কাছে লেখা অনেক চিঠি ও ছবিও পোড়ানো হয়।

আবদুন নূরের খবরের ভাষ্যে সংস্কৃতিকর্মীদের বক্তব্য উঠে এসেছে। তারা মনে করছেন, অজুহাত খোঁজা হচ্ছিল এমন একটি ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর। সাহিত্য একাডেমীর সভাপতি জয়নুল হোসেন নূরকে বলেছেন, আগেও অন্তত দুবার এমন কাণ্ড ঘটিয়েছিল এই মৌলবাদী চক্র, সেই ঘটনা ১৯৯৮ ও ২০০১ সালের। সেই দুবার কয়েক দফা তাণ্ডবের পরও সাংস্কৃতিক কোনো প্রতিষ্ঠানে হামলা হয়নি। তখন তাদের হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল বিক্ষিপ্ত। এবারের হামলার মূল লক্ষ্য ছিল কলাকেন্দ্রগুলো।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিদগ্ধজনদের অনেকেরেই মত, এককালে দেশের সংস্কৃতির রাজধানী হিসেবে পরিচিত শহরটিতে আবার সংস্কৃতিবান্ধব পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। শহরের ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কুল মাঠে প্রতিষ্ঠিত শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বর কেন্দ্র করে প্রায় সব সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যালয়। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ বাংলা ভাষার মর্যাদার দাবিতে পাকিস্তানের গণপরিষদে প্রথম সোচ্চার হয়েছিলেন। তাণ্ডবের দিন তাঁর পবিত্র ছবির অবমাননা করা হয় এ মাঠে। চলে বই পোড়ানোর মহোৎসব।

নূর কথা বলেছেন তিতাস আবৃত্তি সংগঠনের পরিচালক মনির হোসেন ও জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া শাখার সাধারণ সম্পাদক অরুণাভ পোদ্দারের সঙ্গে। সবাই বলেছেন এই ন্যাক্কারজনক ঘটনা কোনোভাবেই মেনে না নেওয়ার বিষয়ে তাদের অঙ্গীকারের কথা।

অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম যে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মতো একটি জেলা শহরে (সাবেক মহকুমা শহর) দিনের বেলায় উজ্জ্বল সূর্যালোকে এমন মারাত্মক কর্মকাণ্ড চালানো হলেও, কী শাসক দল কী ছোটবড় রাজনৈতিক দল বা জোট, সবাই ছিল নিরব, নিথর, নির্বাক। নিজে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একজন প্রবীণ কর্মী হিসেবে ঘটনাটি খুবই দুঃসহ বলে মনে করছি। সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর বাড়িঘর বা তাঁর নামে সৃষ্ট সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, অপরাপর সাংস্কৃতিক সংগঠনের অফিসগুলির যে ব্যাপক ধ্বংস সাধন করা হয়েছে, তা কি এমন নিরবে সহ্য করার মতো?

এত দুস্কৃতিকারীরা উৎসাহিত। তারা ওই মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষককে দিয়ে মামলা ঠুকে দিয়েছে তার ছাত্রহত্যার বিচার চেয়ে। বলেছেন, সেদিনের ধ্বংসলীলার সঙ্গে মাদ্রাসাগুলির ছাত্র-শিক্ষকদের কোনো রকম সংশ্রব নেই। সংবাদপত্রসমূহে প্রকাশিত এই ঘটনার বিবরণগুলি তিনি দিব্যি মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেও মন্তব্য করতে পিছপা হননি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নেতৃবৃন্দ স্পষ্টতই বলেছেন যে, উগ্র ধর্মান্ধ, ঘোর সাম্প্রদায়িক, জঙ্গিবাদী-ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলোর ইন্ধনে একটি আকস্মিক মৃত্যুর ব্যাপার অতি বড় ঘটনার রূপ দিয়ে এই ধ্বংসযজ্ঞ। উদ্দেশ্য? তাদের আসল লক্ষ্য হল, সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপকতর প্রসার এবং জঙ্গিবাদের নবউত্থান ঘটিয়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করা। আর এটা বুঝেও যদি রাজনৈতিক দলগুলি (ক্ষমতামান দলটিসহ) চুপচাপই থাকেন, তবে বলতেই হবে, সামনে ঘোর দুর্দিন বাঙালি জাতির জন্য অপেক্ষা করছে।

এখন তাই জাতীয় ভিত্তিতে প্রতিবাদের দিন– প্রতিরোধের সময়। ওরা গায়ে পড়ে লড়াই শুরু করে দিলই প্রগতির শক্তি কি ঘরে বসে বসে থাকবে? মনে রাখা প্রয়োজন, ওরা ফ্যাসিবাদী শক্তি, গণতন্ত্রের চরম শত্রু। বিন্দুমাত্র ছাড় ওদেরকে দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। এতে জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম, বিএনপিসহ তাবৎ সাম্প্রদায়িক শক্তি উৎসহদাতা নিশ্চয়ই। কোনো সংগঠিত উগ্রবাাদী গোষ্ঠীর সহায়ক ও পৃষ্ঠপোষকতার ভূমিকা না থাকলে ঐ ছেলেরা এত বড় ঘটনা ঘটাতে সাহসী হত না।

পুলিশ কী করছে সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। টেলিভিশন চ্যানেলগুলিতে কয়েক দিন যাবত ছবিগুলি দেখানো হয়েছে। তার ফুটেজ দেখেই তো কারা এটা ঘটল, মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকরা না কি অন্য কেউ, তা অত্যন্ত সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব। জানি না পুলিশ কেন তাদেরকে চিহ্নিত করতে গ্রেপ্তার ও দেশবাসীকে সত্য ঘটনা জানাতে এগিয়ে আসছে না।

এগুলি আদৌ শুভলক্ষণ নয়। সুন্দর সভ্য একটি দেশ গড়ার জন্য দরকার প্রতিরোধ, সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ।