শর্মিলা বসুর মিথ্যাচার

শুভাশীষ দাশ
Published : 31 August 2011, 02:21 PM
Updated : 31 August 2011, 02:21 PM

শর্মিলা বসু অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের একজন গবেষক। তার দাবী- তিনি ১৯৭১ সালে সংঘটিত বাংলাদেশ-পাকিস্তান যুদ্ধের ওপর বিস্তারিত গবেষণা করেছেন। নিরপেক্ষভাবে তার কাজ পর্যালোচনা করলেও পাকিস্তান দেশটির প্রতি অন্ধ আনুগত্য টের পাওয়া যায়। তিনি মূলত শোষকের অত্যাচারের পক্ষে কলম ধরেন, সাফাই গান। তাদের অত্যাচার ও গণহত্যার পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য একপেশে তথ্য হাজির করে তত্ত্ব প্রকাশ করেন। একাত্তরের যুদ্ধের গায়ে তিনি গৃহযুদ্ধের তকমা লাগান, যুদ্ধের মধ্যে পাকিস্তানি হানাদারদের বর্বরতা খুঁজে পান না, ধর্ষণ আদৌ কোনো পাকিস্তানি সৈন্য করেছে কিনা সেই ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেন। একাত্তরের যুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের দায় পাকিস্তানিদের দিক থেকে সরিয়ে তথাকথিত বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের দিকে তাক করাই তার গবেষণাকর্মের মূল উদ্দেশ্য।

শর্মিলা বসু() আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতায় মাঝে সাঝে প্রবন্ধ লিখেন। এছাড়া তার বেশিরভাগ কাজ ইংরেজিতে। গুজরাট দাঙ্গার সময় কলকাতার 'দা টেলিগ্রাফ' পত্রিকায় তিনি বেশ কিছু কলাম লিখেছেন। তার গবেষণার একটা প্রধান আগ্রহ ১৯৭১ সালের যুদ্ধ; তবে ইতিহাসের অনুগত না থেকে ইতিহাস বিকৃতির নির্লজ্জ কাজ ধারাবাহিকভাবে করে যাচ্ছেন হার্ভাডের ডিগ্রী আর অক্সফোর্ডের চাকুরির ওজন দিয়ে। ভারতীয় জার্নাল ইকোনোমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলিতে প্রকাশিত তার দুটি গবেষণাপত্রের সীমাহীন মিথ্যাচার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। প্রথমটি প্রকাশিত হয় ২০০৫ সালের অক্টোবর মাসে। প্রবন্ধের শিরোনাম: 'অ্যানাটমি অফ ভায়োলেন্স: অ্যানালাইসিস অফ সিভিল ওয়ার ইন ইস্ট পাকিস্তান ইন ১৯৭১'; পরের গবেষণাপত্রের নাম: 'লুজিং দা ভিক্টিমস্‌: প্রবলেমস্‌ অফ ইউজিং উইম্যান অ্যাস্‌ ওয়েপানস্‌ ইন রিকাউন্টিং দা বাংলাদেশ ওয়ার'; এটি প্রকাশিত হয় একই জার্নালে (সেপ্টেম্বর ২০০৭ সালে)।

শর্মিলা বসুর গবেষণা একটি বিশেষ উপপাদ্যকে আগে স্থির করে পরে সেটিকে প্রমাণ করতে এগিয়েছে। মূল উপপাদ্যটি হলো: ১৯৭১ সালের যুদ্ধ-পূর্ববর্তী পূর্ব পাকিস্তানিদের বাঙালি জাতীয়তাবাদ ছিল সশস্ত্র ও উগ্র এবং এদের অবাঙালি হত্যাকাণ্ড পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদী গুণ্ডারাই প্রথম করেছে বলে সেটা দমন করতে পাকিস্তান সামরিক শক্তি প্রয়োগ করতে বাধ্য হয়। মূল উপপাদ্যকে ঘিরে তার আরো কিছু বক্তব্য আছে। জাতিবৈরিতায় পাকিস্তানিদের চেয়ে বাংলাদেশের জনগণ এগিয়ে ছিল। গণহত্যা ও ধর্ষণের সংখ্যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যে অনেকগুণ বাড়িয়ে বর্ণিত আছে। ১৯৭১ সালে অবাঙালি হত্যাকাণ্ড পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি হত্যাকাণ্ডের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। তিনি তার প্রথমদিকের গবেষণাতে এই উপপাদ্য ও অন্যান্য বক্তব্য সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দিয়েছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত তার বই 'ডেড রেকনিং: মেমোরিজ অফ দা ১৯৭১ বাংলাদেশ ওয়ার'- এ তার যাবতীয় অনুসিদ্ধান্ত নানারকম পক্ষপাতদুষ্ট বরাত টেনে পাকিস্তানের পক্ষে যায় এমন উপসংহারে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছেন।

শর্মিলা বসুর মোক্ষম আবিষ্কার- একাত্তর-পূর্ব বাংলাদেশিদের স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি-দাওয়া কোনো অর্থেই অস্ত্রশস্ত্রহীন ছিল না-বরং সেটা ছিল সশস্ত্র। 'অ্যানাটমি অব ভায়োলেন্স' গবেষণাপত্রে তিনি লেখেন-
প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে লেখা মেমোতে হেনরি কিসিঞ্জার (মার্চ ১৩, ১৯৭১) লিখেছেন- এখানে দুটি প্রধান সমস্যা আছে। ১। শেখ মুজিব এক ধরণের গান্ধিবাদী অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেছেন যেটাকে দমন-পীড়ন হিসেবে উল্লেখ করা যায় না।
২। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক ক্ষমতা এই অঞ্চলে ঘটা বিদ্রোহ দীর্ঘকালের জন্য দমানোর জন্য যথেষ্ট নয়।

কিসিঞ্জার তার দ্বিতীয় পয়েন্ট ঠিকঠাক উল্লেখ করলেও তার প্রথম বক্তব্যে গলদ আছে। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ঘটা এই বিদ্রোহের সাথে গান্ধিবাদী অহিংস আন্দোলনের কোনোপ্রকার মিল নেই। এই বিপ্লব ছিল গর্ব সহকারে বলার মতো সশস্ত্র এবং সামরিক। নানা লোকের আত্মজীবনীতে এই বিপ্লব কতোটা সশস্ত্র ছিল সেটার আন্দাজ পাওয়া যায়। বাঁশ, রড নিয়ে করা মিছিল, বোমাবাজি, আসল কিংবা নকল অস্ত্র নিয়ে করা মহড়ার অসংখ্য ছবি পাওয়া যায়। এইসব ছবি ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে প্রদর্শনের জন্য রাখা পর্যন্ত আছে। (বোস ২০০৫)

এর পক্ষে তিনি বেশি যুক্তি দেখান না। তার মতে, একাত্তর-পূর্ব জমায়েতগুলোতে বাঙালিদের হাতে লাঠি, লোহার ডাণ্ডা, রাইফেল এইসব ছিল। ফলে এটাকে কোনো অর্থেই গান্ধির অহিংস আন্দোলনের সাথে তুলনা করা যাবে না। এই বক্তব্যের পক্ষে বলতে গিয়ে তিনি কিসিঞ্জারের বক্তব্যকে নাকচ করতে সাহসী হয়েছেন। একটু সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান থাকলে, শর্মিলা বসু এই অর্থহীন উপপাদ্যের পেছনে এতো জান লড়িয়ে দিতেন না। একাত্তরের পঁচিশে মার্চে সংঘটিত অতর্কিত হামলায় তথাকথিত সেই সশস্ত্র বাঙালি কেন পড়ে পড়ে মার খেয়েছে সেটার কারণ খোঁজা প্রয়োজন ছিল। তার মনে এই প্রশ্ন কখনো জাগেনি- কেন দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে গিয়ে বাংলাদেশিদের সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছিল।

বসু তার প্রথম গবেষণাপত্রে যুদ্ধাপরাধী ও গণহত্যার নায়ক জেনারেল নিয়াজি, জেনারেল মিঠার বই থেকে রেফারেন্স দিয়েছেন। একাত্তর সালের আগস্টের পাঁচ তারিখে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রকাশিত শ্বেতপত্রের কথাও উল্লেখ করেছেন। খুনে পাকিস্তানি জেনারেলদের কথাকে তিনি মানতে রাজী আছেন। অথচ একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তানে নেমে আসা বর্বর গণহত্যার মুখে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর ভাষ্যকে তিনি এক কথায় মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেন। পাকিস্তান সরকার তাদের শ্বেতপত্রে বাংলাদেশের মানুষের বর্বরতার গল্প লিখে পৃথিবীকে দেখাবে। সেখানে সত্যের লেশমাত্র থাকবে না- এটা বুঝতে খুব একটা কষ্ট করা লাগে না। অ্যান্থনি মাসক্যারেনহাসের 'দি রেপ অব বাংলাদেশ' বইটির কথা প্রায়শ এনেছেন। তবে তার ব্যবহার উপযোগী বাক্যগুলো-ই কেবল উল্লেখ করেছেন। মাসক্যারেনহাস পাকিস্তানিদের বর্বরতার সচিত্র বিবরণ দিয়েছেন। সেগুলো এড়িয়ে গেছেন তিনি।

শর্মিলা কেস স্টাডি করেছেন বলে তার গবেষণাপত্রে (বোস ২০০৫) উল্লেখ করেছেন। তার মতে, ২০০৩-২০০৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থান সরেজমিনে তদন্ত করে উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। এতো উপাত্ত একা সংগ্রহ করা বেশ শ্রমসাধ্য। কিন্তু কোনো সহযোগির নাম তিনি উল্লেখ করেননি। পশ্চিম পাকিস্তানে কোনো যুদ্ধ ঘটেনি। শর্মিলা বসু বাংলাদেশে যুদ্ধ শেষ করে পাকিস্তানে ফেরত যাওয়া হানাদার বাহিনীর সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন, তাদের কথাবার্তাকে ধ্রুব সত্য ধরে নিয়ে তার উপাত্তের পাল্লা ভারি করেছেন। এই ধরনের কেস স্টাডির বিস্তারিত বিবরণ থাকা প্রয়োজন। স্থান, কাল, পাত্র- এই তিনটি খুব নির্ধারিত করে দেয়া না থাকলে এইসব কেস স্টাডি কতোটা কল্পনা কতোটা বাস্তব সেটা নিয়ে সন্দেহ করা যায়। গবেষণা করতে গিয়ে কতোটা নিচে নামা সম্ভব সেটা শর্মিলা বসুর দ্বিতীয় গবেষণাপত্রটি পড়লে বোঝা যায়। সেখানে স্বাধীনতার দলিলপত্রে প্রকাশিত প্রত্যক্ষদর্শী সুইপার রাবেয়া খাতুনের বয়ান নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী সম্পর্কে লিখেছেন-

কাছের একটা পাটকলের শ্রমিকনেতা আহসান্নুল্লাহ আহমেদ নামের একজনের সাথে ফেরদৌসীর প্রণয় ছিল। খুলনাতে পাকিস্তানি সেনারা প্রবেশ করার পরে আহাসানুল্লাহ ঐ জায়গা ছেড়ে পালানোর পরামর্শ দেয়। ফেরদৌসীর মা আর ভাইবোনেরা চলে গেলেও তিনি থেকে যান। … পাকিস্তানিদের কর্তৃক কথিত ধর্ষণের পরেও তিনি তার পরিবারে কাছে পালিয়ে চলে যান নি, বরং অফিস করেছেন। ফেরদৌসী সেই সময় বন্দী ছিলেন না। বাসায় থাকতেন, অফিসে যেতেন, এমনকি ইচ্ছে হলে যশোর ক্যান্টনমেন্টে ঘুরে আসতেন। সেনারা তাকে সিনেমায় নিয়ে যেত, জেনারেল ম্যানেজারের বাসায় ডিনারে আমন্ত্রণ করতো, ফোন করতো। …(বোস ২০০৭)

শর্মিলা বসুর কথাবার্তার ভঙ্গি এতো বিকৃত যে এর বিপরীতে প্রত্যুত্তর দেয়ার ইচ্ছে হয় না। সেই একই গবেষণাপত্র মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান মণ্ডলের কথাবার্তাকে ঘুরিয়ে তাকে অভিযুক্ত করেছেন। নয়নিকা মুখার্জির একটা গবেষণাপত্র ভুলভাবে ব্যাখা করেছেন। আখতারুজ্জামান মণ্ডল ও নয়নিকা মুখার্জির প্রতিবাদ পরে সেই জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁরা দুজনেই তুলোধুনো করেন শর্মিলা বসুর মিথ্যাচারকে। শর্মিলা বসু এর প্রত্যুত্তর করেননি। ফলে প্রথম গবেষণার কেস স্টাডিতে মিথ্যা তথ্য প্রবেশ করানোর ব্যাপারে সন্দেহ বাড়ে। তাই বলা যায়, স্বাধীনতা যুদ্ধের পঁয়ত্রিশ বছর পরের বিশেষ মিশনে নামা শর্মিলা বসুর অপরিচ্ছন্ন কেস স্টাডি সত্য নির্ধারণের ব্যাপারে কোনো ভূমিকাই রাখে না।

বসু তার 'লুজিং দা ভিক্টিমস্‌: প্রবলেমস্‌ অফ ইউজিং উইম্যান আস ওয়েপনস্‌ ইন রিকাউন্টিং দা বাংলাদেশ ওয়ার' পেপারে বলেছেন-
১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। যুদ্ধের শুরুর দিকে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাসদস্যের সংখ্যা ছিল বিশ হাজার (সিআইএ পরিচালক রিচার্ড হেমসের আনুমানিক হিসাবমতে), ডিসেম্বরে সেটা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় চৌত্রিশ হাজারে। এছাড়া ছিল আরো এগারো হাজার পুলিশ এবং বেসামরিক লোকজন (শর্মিলা বসুর সাথে নিয়াজির সাক্ষাৎকারে প্রাপ্ত তথ্য)। পূর্ব পাকিস্তানের ওপর ধর্ষণের বন্যা নিয়ে যারা মন্তব্য করেন তারা এটা চিন্তাও করেন না এতো কম সামরিক লোকজন নিয়ে এখানের বিপ্লব দমন করার চেষ্টা করা হয়েছিল যেখানকার জনসংখ্যা পশ্চিম পাকিস্তানের সব প্রদেশের জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। (বোস ২০০৭)

বইয়ের সূত্র দেখলে এর পেছনের উদ্দেশ্য আর ঢাকা থাকে না। নিয়াজির মতো একজন যুদ্ধাপরাধীর বই বা কথাবার্তা থেকে তিনি প্রয়োজনমাফিক মিথ্যা টুকে নেন। একাত্তরের ডিসেম্বরের ষোলো তারিখে পাকিস্তানি সৈন্যদের সংখ্যা ৯০,০০০ বা তার চেয়ে বেশি ছিল সেটা নানা জায়গায় উল্লেখ আছে। সেগুলো এড়িয়ে তাঁকে তথ্য নিতে হয় নিয়াজির কাছ থেকে।

শর্মিলা বসুর দ্বিতীয় গবেষণাপত্রে আছে-
চৌত্রিশ হাজারের মতো অল্প সংখ্যক সামরিক লোকজন নিয়ে আট/নয় মাসে এতো বিশাল সংখ্যার মেয়েদের ধর্ষণ করার ব্যাপারটা হিসেবে মেলে না। গেরিলা ও ভারতীয় জান্তাদের সাথে যুদ্ধের সময় বাদ দিয়ে বাকি সময়টুকুতে তাদের অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ধর্ষণে ব্যতিব্যস্ত থাকার কথা। (এই হিসেবে প্রত্যেক সেনা গড়ে ছয় থেকে বারো জনকে ধর্ষণ করেছে। প্রতিদিন ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৭৫৫ থেকে ১,৫০৯।) (বোস ২০০৭)

তার অদ্ভুত হিসেবে ৩৪,০০০ জন পাকিস্তানি হানাদার সদস্য (বা তার চেয়েও কম) পূর্ব পাকিস্তানে ধর্ষণে অংশ নিয়েছে। প্রকৃত ৯০,০০০ সংখ্যার কথা উল্লেখ করলে গাণিতিক হিসেব পাল্টায়। তখন জনপ্রতি ধর্ষণের ভিক্টিমের সংখ্যা ৬ থেকে ১২ এর বদলে ২ থেকে ৪ হয়। এখানে আরো একটা ব্যাপার- যুদ্ধ চলেছে ২৬৫ দিন। ২৬৫ দিনে দুই থেকে চারজন নারীর উপর পাশবিক অত্যাচারের হিসাবটা বরং কষ্টকল্পনা।

২০১১ সালে মার্চের পনেরো তারিখে ওয়াশিংটন ডিসির উইড্রো উইলসন সেন্টারে 'ডেড রেকোনিং' বইটি নিয়ে একটা বুক ইভেন্ট হয়েছে। বইয়ে কী কী অধ্যায় থাকবে সে সম্পর্কে আর সেগুলোর নির্যাস সম্পর্কে আলোচনা করে তিনি বাঙালিদের অসহনীয় জাতিবৈরী আচরণের মনগড়া ব্যাখ্যা দেন।
বইটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি উপপাদ্যের কথা আবারো জোর গলায় বলেন-
একাত্তর পূর্ববর্তী বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম কখনোই নিরস্ত্র ছিল না। ইতিহাসে এই সত্যকে মিথ্যাচারে ঢেকে দেয়া হয়েছে। আমার বই এই সংগ্রাম কতোটা সশস্ত্র আর বিপ্লবী ছিল সেটার আসল ইতিহাস বের করে এনেছে।(৪)
এক জায়গায় বলেন-

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী আদর্শে ঘটা বিপ্লব ও সন্ত্রাস ছিল নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী। কোনো জাতীয় নেতার অধীনে সুবিন্যস্ত পথে এই সংগ্রাম এগোয় নি। জাতীয় নেতৃত্ব তখন একটা দ্বিচারী ভূমিকায় নেমেছিল। একদিকে জনগণকে উত্তেজিত করে রাখার কাজ তারা করেছে, অন্যদিকে ক্ষমতার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে দরদস্তুর করেছে। (৫)
শর্মিলা বসু ইয়াহিয়া, ভুট্টোদের দ্বিমুখী আচরণের কোনো হদিস দেখেন না। যা কিছু দেখেন সব বাঙালি জাতীয়তাবাদিদের দ্বিচারিতা। তার কথাবার্তা, লেখালেখি এতোটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও একপেশে দেখে তাকে পণ্ডিত হিসেবে মানা তো দূরের কথা বরং একজন গণ্ডমূর্খ ও যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পদলেহনকারী ভাড়াটে লেখক বলে মনে হয়।

পাকিস্তানি জেনারেলদের প্রতি শর্মিলার বাড়তি আকর্ষণ আছে। গণহত্যাকারী এই বর্বরদের হত্যাকাণ্ড নিয়ে বাংলা ভাষায়, ইংরেজি ভাষায় প্রচুর বই ছড়িয়ে আছে। একাত্তরে ছড়িয়ে থাকা সত্যমিথ্যার মধ্যে তিনি পাকিস্তানি জেনারেলদের কথার মধ্যে সত্যতা বেশি পান। খুঁজেপেতে সেটাই প্রকাশ করেন। যখন তিনি একাত্তরের যুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর যুদ্ধাপরাধকে অস্বীকার করেন আর সেটা প্রমাণ করতে চান সেসব যুদ্ধাপরাধীদের বক্তব্য দিয়ে তখন তার বক্তব্যকে জোরালোভাবে প্রতিহত করার প্রয়োজন দেখা দেয়। একাত্তরের যুদ্ধে শোষক শোষিতের সমীকরণকে পাল্টে দেয়ার একটা দায় তিনি কাঁধে নিয়েছেন। এর পেছনে কারা তাকে চালিত করছে সেটা নিয়ে নানারকম বক্তব্য পাওয়া যায়। একাত্তর নিয়ে বক্তব্যের নতুনত্বের জন্য পাকিস্তানপন্থী ব্লগ, পত্রিকা তার কথাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে। শর্মিলা বসু পাকিস্তানি জেনারেলদের গুণগান প্রথম করেছিলেন পাকিস্তানের 'দা ডেইলি টাইমস্‌' পত্রিকায়। 'দা কারেজাস্‌ পাকিস্তান আর্মি স্ট্যান্ড অন দা ইস্টার্ন ফ্রন্ট' শিরোনামের এই লেখায়(৬) তিনি যুদ্ধাপরাধী নিয়াজি সম্পর্কে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন-
নিয়াজি সমরাঙ্গনে অত্যন্ত পারদর্শিতা দেখানোয় ১৯৪৪ সালে আসাম-বার্মা ফ্রন্টে ব্রিটিশেরা তাকে যুদ্ধক্ষেত্রেই সামরিক ক্রস দিয়ে পুরস্কৃত করে। অন্য একটা কারণে তাকে ডিএসও খেতাব দেয়ার কথা ছিল, কিন্তু জুনিয়র হওয়ার কারণে সেটা পাওয়া হয়নি। ব্রিটিশ সামরিক প্রতিরক্ষা দপ্তর তার অকুতোভয় সাহসিকতা সম্পর্কে বলেছে- "তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে আক্রমণ চালান অত্যন্ত নিঁখুতভাবে, এতে প্রতিপক্ষ হতচকিত হয়ে পড়ে। ফলে জয় অর্জন করা তার জন্য সময়ের ব্যাপার মাত্র।" ব্রিটিশেরা তার সামরিক দক্ষতা নিয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল। যুদ্ধে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে কীভাবে নিজের সেনাবাহিনী নিয়ে প্রতিপক্ষকে কোনঠাসা করা যায় সেই ব্যাপারে তার দক্ষতা ছিল কিংবদন্তিসম।

নিয়াজির মতো একজন যুদ্ধাপরাধীর সামরিক গুণের বর্ণনা করে বিস্তারিত লেখা শর্মিলা বসুর পক্ষেই সম্ভব। নিয়াজি কেবল গণহত্যার জোয়ার বইয়ে দিয়েছেন তা নয়, ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করানোর পেছনে তার প্রত্যক্ষ ইন্ধন ছিল। এই জঘন্যতম লোকটির বিকৃত মানসিকতার কথা বিস্তারিত আছে হাসান আব্বাসের 'পাকিস্তান'স ড্রিফট টু এক্সট্রিমিজম: আল্লাহ, দা আর্মি অ্যান্ড আমেরিকা'স ওয়ার অ্যান্ড টেরর' বইটিতে। একটা জায়গার কথা উল্লেখ করি। সেটুকু পড়েই নিয়াজির পরিকল্পনা কিছুটা আন্দাজ করা যাবে।

নিয়াজি আগে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন ভারতীয় সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী দখল করার আগে তার মৃতদেহের ওপর দিয়ে তাদের যেতে হবে। এই প্রতিজ্ঞা আর আত্মসমর্পণের আগে বহু বাঙালি মেয়েদের জেহাদের নামে পাকিস্তানিদের ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে। নিয়াজি এই ধর্ষণকে স্বাভাবিক বলে মনে করেছেন। তার এই বক্তব্য সেইসময় শোনা গেছে- কেউ শুধু যুদ্ধ করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে আসবে আর বীর্যস্খলনের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে দৌঁড়াবে এটা তো হতে পারে না। (আব্বাস ২০০৫: ৬৬)

বুক ইভেন্টে তিনি আরো জানান- জেনারেল ইয়াহিয়াকে নিয়ে কামরুল হাসানের কার্টুন ছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। শত্রুপক্ষকে অহেতুক ছোটো করানোর ব্যাপারে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষের লোকজন এককাঠি সরেস বলে তার মত। পাকিস্তানি সৈন্যদেরকে বর্বর, হিংস্র হায়েনা, রক্তলোলুপ, দস্যু বলে ডেকে তাদের প্রতি জাতিবৈরি আচরণ করা হয়েছে বলে সেখানে বক্তব্য দিয়ে এসেছেন শর্মিলা বসু।

তার মতে, পাকিস্তানিরা বাঙালি জাতীয়তাবাদিদের সাথে এরকম রেসিস্ট আচরণ করতো না। পূর্ব-পাকিস্তানের সংগ্রামীদের মুক্তি, মিস্‌ক্রিয়েন্টয়ের বেশি কিছু বলে গালি দেয়ার সংবাদ শর্মিলা বসুর কান পর্যন্ত যায় নি। আর.জে. রামেলের বইতে দেখি পাকিস্তানিদের আচরণ কী ছিল-
পশ্চিম পাকিস্তানের বেশিরভাগ লোকের ধারণা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের লোকজনের সংস্কৃতি হিন্দুঘেঁষা। পূর্ববঙ্গের মুসলমানেরা ইসলামে দীক্ষিত হয়েছে অল্পদিন আগে, তাই তাদের মধ্যে এখনো হিন্দুয়ানি জোরেশোরে চেপে বসে আছে। এক অর্থে তারা হিন্দুই। এই ধারণাকে মাথায় পোক্ত করে রাখায় পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানে হত্যাযজ্ঞ চালানো সহজ হয়েছে। পাঞ্জাবি সেনারা হত্যাকাণ্ডের সময় বাঙালিদের মানুষ বলে গণ্য করতো না। ভেবে নিতো সাব-হিউম্যান বা অবমানব বলে। তাই তাদের ভাগ্যে জুটতো অমানুষিক নির্যাতন আর মৃত্যু। পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ডাকে বানর বা মুরগি বলে। নিয়াজি বলেন, 'এরা নিচু এলাকায় থাকা নিচু জাতের সব লোক'। নাৎসিদের কবলে ইহুদিদের যে অবস্থা হয়েছিল, পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদেরকেও সেইরকম কীটপতঙ্গ ভেবে মেরে ফেলার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। মুসলমানেরা যে রক্ষা পাচ্ছে তা কিন্তু নয়, তাদের ভাগ্য নির্ভর করছে পাকিস্তানি সেনাদের মর্জির ওপর। সন্দেহের কিছু ঘটলেই তাদের ভাগ্যে মৃত্যু। পাকিস্তানি সেনাদেরকে বাঙালি হত্যার বৈধতা দেয়া হয়েছে। ড্যান কোজিন নামের এক সাংবাদিকের বরাতে আমরা এক পাকিস্তানি সৈন্যের আস্ফালনের কথা জানতে পারি- 'আমরা যে কাউকে মেরে ফেলার ক্ষমতা রাখি। এই জন্য আমাদের কোনো জবাবদিহিতা করতে হবে না'। ক্ষমতার কী অপরিসীম ঔদ্ধত্য!(রামেল ১৯৯৬: ৩৩৫)

রামেলের বইতে উল্লেখ করা তথ্যের সূত্র আবুল মাল আব্দুল মুহিতের 'বাংলাদেশ: ইমার্জেন্স অফ আ নেশান' বই। জেনোসাইড নিয়ে অন্যান্য ইংরেজি বইতে রামেলের বইতে উল্লেখ করা বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি আছে। এন্টি- বেঙ্গলি রেসিজমের(৯) কথার উল্লেখ পাওয়া যায় বেশ কয়েকটি বইতে। শর্মিলা বসু এসব তথ্য উল্লেখ করার প্রয়োজন মনে করেন নি। অ্যান্থনি মাসক্যারেনহাসের বই থেকে, ১৯৭১ সালের জুনে প্রকাশিত তার সংবাদ থেকে বিহারি-হত্যার তথ্য বারবার উল্লেখ করেন। সেই একই বইতে পাকিস্তানি হানাদারদের বর্বরতার তথ্য তিনি কৌশলে এড়িয়ে যান।

অ্যান্থনি মাসক্যারেনহাস কুমিল্লার ১৬ ডিভিশন হেড-কোয়ার্টারে থাকাকালীন সময় বারবার একটা কথা শুনতে পেয়েছেন- 'আমরা পাকিস্তানের অখণ্ডতার জন্য যেকোনো ধরনের হুমকি মোকাবেলার প্রয়োজনে বিশ লক্ষ লোককে মেরে ফেলবো। এমনকি দরকার হলে পূর্ব পাকিস্তানকে আরো ত্রিশ বছর কলোনি হিসেবে ব্যবহার করবো'। পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব খান থেকে শুরু করে পাকিস্তানিদের আচরণে অ্যান্টি-বেঙ্গলি রেইসিজমের আভাস মেলে। (গার্লাক ২০১০: ১৩০)

পাকিস্তানিরা গালিতে অক্ষম একটা জাতি নয়, আর একাত্তরে তাদের হাতে ছিল সর্বময় ক্ষমতা, সাথে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র। কিন্তু শর্মিলা বসুর কল্পজগৎ আমাদের তথ্য দিতে চেষ্টা করে- একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে অমানুষিক অত্যাচার করার সময় তাদেরকে মধুর সম্ভাষণ করা হতো।

যুদ্ধের মধ্যে পাকিস্তানি শোষক শত্রুপক্ষকে করা খিস্তি খেউর নিয়ে শর্মিলার বসু তার মানবিকতা খরচ করেন। তবে একাত্তরে পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের অস্ত্রহীন মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বর্বর হত্যাকাণ্ড চালালে তার মানবিক অনুভূতিতে বাড়তি কোনো চাপ পড়ে না। খানসেনার (ইয়াহিয়া খানের দোসর সেনাবাহিনী বলে খানসেনা) মতো নিরীহ শব্দেও তিনি আহত হন। তিনি বলেন- শত্রুপক্ষকে এই গালি দেয়া হয়, কিন্তু সেই শত্রুপক্ষ এই গালিটি সম্পর্কে কিছু জানেই না।

এটাকে প্রমাণ করার জন্য তিনি সাহায্য নেন মাসক্যারেনহাসের প্রকাশিত সংবাদের-
সানডে টাইমসে প্রকাশিত মাসকারেনহাসের রিপোর্টটিতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কীভাবে পূর্ব পাকিস্তানে ঘটা বিপ্লবকে গলা টিপে ধরেছিল সেটার বিবরণ আছে। তবে সেখানে তিনি উল্লেখ করতে ভোলেন নি- "বাঙালিদের ঘৃণার কারণে অবাঙালিদের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে এই সহিংসতা শুরু হয়। তারপর গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী।" তার বর্ণনায় পাওয়া যায় বাঙালিদের দ্বারা বিহারি নির্যাতনের কথা। এই হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা পরবর্তীতে বাঙালি হত্যাকাণ্ডের প্রায় সম পর্যায়ের।

মাসক্যারেনহাস পরবর্তীতে তার বইতে লিখেছেন- এই আন্দোলন ছিল অহিংস।
মার্চ ৩: আওয়ামী লীগ অহিংস এবং অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়। ইয়াহিয়া খানের ডাকা রাজনৈতিক নেতাদের সভার আহ্বানকে শেখ মুজিব নাকচ করে দেন।
মার্চ ৫: সামরিক বাহিনীর হাতে আওয়ামি লীগের তিনশত নেতাকর্মী ও অনুরাগী হত হয়।
মার্চ ৬: ইয়াহিয়া পঁচিশে মার্চ ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির ডাক দেন।
মার্চ ৭: শেখ মুজিব জনগণকে কর দেয়া বন্ধ করতে বলেন। সরকারি কর্মচারিদের আহ্বান করেন তার কথা মেনে কাজ করার জন্য। অ্যাসেম্বলিতে অংশগ্রহণের পেছনে চারটি শর্ত জুড়ে দেন। বাঙালি প্রতিরোধকারীদের ওপর গুলি চালাতে অপারগতা প্রকাশ করে ইস্ট বেঙ্গল রাইফেলস্‌।
মার্চ ১৯: সংবিধান নিয়ে ইয়াহিয়া মুজিব বৈঠক শুরু।
মার্চ ২১: ভুট্টো ঢাকায়। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সাথে বৈঠক। ইয়াহিয়া মুজিবের অপরিকল্পিত বৈঠক।
মার্চ ২২: ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি স্থগিত করেন ইয়াহিয়া।
মার্চ ২৫: আওয়ামী লীগ বুঝতে পারে, সংবিধান নিয়ে আলোচনা কালক্ষেপনমাত্র। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কর্তৃক হত্যাকাণ্ড শুরু। সেনাবাহিনীর নতুন নতুন বহরের আগমন। ইয়াহিয়া, ভুট্টোরা রাওয়ালপিণ্ডির উদ্দেশ্যে যাত্রা। গণহত্যা শুরু।(মাসকারেনহাস ১৯৭১: ১৬৪)

১৯৭১ সালে পঁচিশে মার্চের আগে কিছু বিচ্ছিন্ন ভাঙচুর হয়েছিল। কিন্তু সেটাকে বিহারি-গণহত্যা বলে চাপিয়ে, একাত্তরের যুদ্ধ শুরুর দায় বাংলাদেশের আমজনতার দিকে ঠেলে দেয়া একটা বিশেষ মহলের কন্সপির‍েসি থিয়োরি। এর বিপরীতে তথ্য-প্রমাণসহ বিস্তারিত লেখালেখি প্রয়োজন।
বসুর গবেষণাকর্ম আস্তাকুঁড়ে ফেলার জন্য বেশি পরিশ্রম করতে হয় না। তিনি জাঁদরেল গবেষকদের মতো ভেক ধরে বক্তব্য প্রদান করতে পারেন না, যা বলেন সেটা নাইভ আকারেই পেশ করেন। আর মিথ্যা বলার সময় একটু জোর গলায় বলে ফেলেন।

একটা অদ্ভুত ব্যাপার, একাত্তরের কাউন্টার ন্যারেটিভ চক্রের লোকজন তাদের লেখায় জাহানাম ইমামের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন। শর্মিলা একাত্তর-পূর্ব সশস্ত্র প্রস্তুতির প্রমাণ দিতে জাহানারা ইমামের বইয়ের তথ্যকে ব্যবহার করেছেন-
জাহানারা ইমাম তার একাত্তরের দিনগুলি গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন তার ছেলের ঘরে তিনি বোমা বানানোর সরঞ্জাম পেয়েছেন। (বোস ২০০৫)

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতকারী চলচ্চিত্র 'মেহেরজান' সিনেমার পরিচালক রুবাইয়াত হোসেন লিখেছেন-
যুদ্ধের বলি নারীদেরকে ভুলভাবে উপস্থাপনের দায় কেবল জাতীয়তাবাদীদের ওপর বর্তায় না, এর কিছুটা দায় এড়াতে পারবেন না জাহানারা ইমামও। গণ-আদালতে সাক্ষী দেয়ানোর জন্য কুষ্টিয়া থেকে তিনজন মহিলাকে ঢাকায় আনা হয়। গণ-আদালত নিয়ে এঁদেরকে প্রাথমিক ধারণাও দেয়া হয়নি। তাদের অনুমতি না নিয়ে তাদের ছবি পত্রিকায় পর্যন্ত ছাপিয়ে দেয়া হয়েছে।(হোসেন ২০০৯: ১০)

মজার ব্যাপার হচ্ছে, নয়নিকা মুখার্জি শর্মিলা বসুর মিথ্যা অপপ্রচারের বিরুদ্ধে কথা বলে আসছিলেন দীর্ঘদিন ধরে। কুষ্টিয়ার এই তিন বীরাঙ্গনার নাম কাজলি, ময়না ও রহিমা। ১৯৯০ সালে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুদ্ধকালীন ধর্ষণকে যুদ্ধাপরাধের আওতায় আনা হলে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১৯৯২ সালে একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিরুদ্ধে গণ আদালত তৈরি করা হয়। সেই সময় এই তিন বীরাঙ্গনাকে সবার সামনে উপস্থিত করানো হয়। নয়নিকা মুখার্জি গণ আদালতে সাক্ষী দেয়ার জন্য এই তিনজনের ওপর সামাজিকভাবে যেসব প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল তা নিয়ে একটা গবেষণা প্রবন্ধ (১২)লিখেছেন। জাহানারা ইমাম কোন পরিস্থিতিতে এটা না করে পারেননি, সেই ব্যাপারে খোঁজ নেয়ার প্রয়োজন মনে করেননি মুখার্জি।

'ডেড রেকনিং: মেমোরিজ অফ দা ১৯৭১ বাংলাদেশ ওয়ার'-এর বুক ইভেন্টে উইলসন সেন্টারে বক্তব্য দিয়েছেন সাংবাদিক আর্নল্ড জাইটলিন। বর্তমানে তিনি এডিটোরিয়াল রিসার্চ এন্ড রিপোর্টিং এসোসিয়েটস এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। পঁচিশে মার্চে তৎকালীন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংস অভিযানের কিছুটা তিনি দেখেছেন এবং এ সম্পর্কে ঢাকা ত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে রিপোর্টও পাঠিয়েছেন। জাইটলিন বসুর বইয়ের বক্তব্যকে এক কথায় ইতিহাসের বিকৃতি বলে অভিহিত করেছেন।

সুবির ভৌমিক তার (১৫) 'বুক, ফিল্ম গ্রিটেড উইথ ফিউওরি অ্যামাং বেঙ্গলিজ্‌' (২৯ এপ্রিল ২০১১) লেখায় একাত্তরের ইতিহাস বিকৃতির দায়ে অভিযুক্ত করেছেন শর্মিলা বসু ও মেহেরজান সিনেমার পরিচালক রুবাইয়াত হোসেনকে। সুবীর ভৌমিক একটা বাক্যে একাত্তরের যুদ্ধকে সিভিল ওয়ার বলার চেষ্টা করলেও তার লেখাটা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মূল ন্যারেটিভের পক্ষেই থেকেছে।

শর্মিলা বসু সুবীর ভৌমিকের লেখাটার প্রতিক্রিয়া(১৬) জানিয়েছেন আল জাজিরাতে (৯ মে ২০১১)। শর্মিলা বসু হালকা কিছু নতুন কথাবার্তা যোগ করে একই কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন সেই লেখায়।

শর্মিলা বসু একাত্তরের যুদ্ধকে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া আরব বিদ্রোহের সাথে তুলনার চেষ্টা করেছেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের রক্ষাকর্তা হয়ে হাজির হওয়াকে তিনি আরবদের বিদ্রোহে আমেরিকার ত্রাতা হিসেবে অবতীর্ণ হওয়ার তুলনা করেছেন। তার এই তুলনা, প্রতিতুলনা প্রায় হাস্যকর। তিনি আমাদের বোঝাতে চেষ্টা করেছেন একাত্তরে আমাদের অর্জিত স্বাধীনতা ভারতের উপহার দেয়া এক ধরনের প্যাকেজ স্বাধীনতা। এটা চরম আপত্তিকর ভাষ্য। মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ লোকের শহীদ হওয়া, অজস্র মহিলাদের ওপর নেমে আসা গণধর্ষণ, নয় মাসব্যাপী দেশের আনাচে কানাচে মুক্তিসংগ্রাম চালানো- তিনি এক মুহূর্তে ইরেজার দিয়ে মুছে ফেলে মনগড়া সূত্র বানিয়ে ফেলেন। একাত্তরে অন্যান্য পরাশক্তির উপস্থিতি তিনি বেমালুম চেপে গিয়ে অদ্ভুত একটা যোগসূত্র হাজির করেছেন। আরব বিদ্রোহের পেছনে সেখানকার লোকজনের অবদানকে খাটো করে খালি আমেরিকার দেয়া উপহার হিসেবে সূত্র কষতে শর্মিলা ছাড়া ভালো আর কে পারবেন? তিনি গণবিদ্রোহ, গণ-আন্দোলন এসবের অর্থ বোঝার চেষ্টা করেন না। শোষক শোষিতদের মধ্যে সম্পর্কের দুর্বিষহ ভাষ্য নিয়ে তার মাথাব্যথা নাই। তার হিসাব সহজ সরল। শোষকের নির্যাতনের বিরুদ্ধে শোষিতের বিদ্রোহকে নাকচ করে দেয়া। কাল্পনিক সূত্র দিয়ে স্বৈরশাসক, জেনারেল, গণহত্যাকারিদের অত্যাচারকে হালকা করতেই তার যাবতীয় আগ্রহ। নিজের মিথ্যাকে বহুবার উচ্চারণ করে পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করা প্রায় বাতিকে পরিণত করে ফেলা বসু একাত্তরের মূল বয়ানকে পুরো অস্বীকার করতে দৃঢ়ভাবে উদ্যোগী।

মিশরের তাহরির স্কয়ারে সিবিএস নিউজের বৈদেশিক প্রতিনিধি লারা লোগানের ওপর যে যৌন অবমাননার ঘটনা ঘটেছে সেটার সাথে একাত্তরের যুদ্ধ জয়ের পরে স্বাধীন বাংলাদেশে বিহারিদের ওপর নেমে আসা তাৎক্ষণিক আক্রমণের সাথে তুলনার একটা অপচেষ্টাও দেখা যায় তার লেখায়। এটাও ভয়ঙ্কর রকমের ভুল সম্পর্ক দেখানো। বিহারিরা একাত্তরে কীভাবে বীভৎস হত্যাকাণ্ড আর নির্যাতন করেছে সেটা নানা বইপত্রে আছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে বিহারিদের ওপর বিচ্ছিন্নভাবে নির্যাতন নেমে এসেছিল। এখানে লারা লোগানের সাথে বিহারিদের তুলনা আসে কীভাবে? তিনি কি বলতে চাইছেন, লারা লোগানও হোসনি মোবারকের দলের লোকদের সাথে মিলে বিদ্রোহীদের ওপর নির্যাতনে নেমেছিল? আরব বিদ্রোহের গায়ে তিনি 'তথাকথিত' তকমা লাগিয়ে দিয়েছেন তার লেখায়-
আরবে ঘটে যাওয়া বিপ্লবে পরাক্রমশালী বিদ্রোহীরা স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিতে একটা বড়ো গলতি করে ফেলেছে- সিবিএস-এর বৈদেশিক প্রতিনিধি লারা লোগানের ওপর তারা বর্বরোচিত যৌন উৎপীড়ন করার সাথে সাথে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছে। কায়রোর তাহরির স্কয়ারে হোসনি মোবারকের পতনের পরে উল্লসিত কিছু লোকের হাতে ঘটেছে এই ঘটনা। এই সংবাদ পত্রিকার হেডলাইন থেকে খুব তাড়াতাড়ি সরে গেছে, অথচ এই ধরণের বিদ্রোহ তৈরির উপস্থাপন প্রক্রিয়াকে ঠিকমতো প্রশ্ন করা উচিত। কারণ এর মধ্যেই শোষকের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও মুক্তিকামী মানুষের একটা প্রতীক হয়ে গেছে তাহরির স্কয়ার।

মিশরের তাহরির স্কয়ারে লারা লোগানের ওপর নেমে আসা নির্যাতন পুরো বিদ্রোহের ভাবমূর্তিকে নষ্ট করে- সেটা অংশতঃ ঠিক। কিন্তু এই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে সমস্ত মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামকে এক সেকেন্ডে মাটিতে মিশিয়ে দেয় না। এই সমস্ত মুহূর্তে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় থাকে আইন ও বিচার ব্যবস্থা। সেটার সুযোগ কিছু লোক নেয়। লারা লোগানের ওপর নেমে আসা নির্যাতন সেইরকম একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। সেটাকেই একমাত্র ঘটনা হিসেবে দাঁড় করিয়ে আরব বিদ্রোহকে বাতিল করে দেয়া মূর্খের কাজ। অদ্ভুত ব্যাপার- এই ঘটনার সাথে তিনি জোড়াতালি দিয়ে দিয়েছেন একাত্তরের সংগ্রামকে।
পৃথিবীর অন্যান্য জায়গার লোকজনও তাই নিজেদের দেশে তাহরির স্কয়ারের দাবি তুলছে। স্বৈরতন্ত্র থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মানবিক অধিকারের দাবী নিয়ে লড়তে থাকা মানুষগুলোর হাতে নিগৃহীত হবার একটা সাহসী চিত্র তুলে ধরেছেন লোগান। মিশরের নারী আর সেনাবাহিনীর কারণে তিনি তাদের হাত থেকে উদ্ধার পেয়েছেন। তার কাছে তাহরির স্কয়ার এক ভিন্ন অর্থে হাজির হয়।

এই ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারি- শোষকদের বিরুদ্ধে লড়তে থাকা লোকগুলো যে অহিংসা, গণতন্ত্র ও মানবিক অধিকারের প্রতিমূর্তি তা কিন্তু নয়। রাজনৈতিক ক্ষমতা বদল, গৃহযুদ্ধ সম্পর্কে আমাদের মধ্যে যেসব কথাবার্তা চালু সেগুলোকে আসল ঘটনা জেনে নিয়ে বুঝে নেয়ার ব্যাপারে আমাদের সতর্ক হতে হবে।

দক্ষিণ এশিয়ায় ১৯৭১ এক ধরনের প্রতীক হিসেবে হাজির হয়েছে: ১৯৭১ বা একাত্তর; ৭১ সংখ্যাটি দাঁড়িয়ে গেছে সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকামী জাতীয়তাবাদি মানুষের মুক্তিসংগ্রাম হিসেবে। আসলে কি কথাটুকু এতো সহজ? সময়ের সাথে সাথে বাংলাদেশের বিজয়ীদের মুখে নিজেদের জয় আর পাকিস্তানিদের বর্বরতার কথা প্রশ্নাতীতভাবে অবিরত শুনতে শুনতে সেটাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।

তিনি বলতে চাইছেন, এই যে মুক্তি প্রত্যাশী মানুষগুলো- তারাও কিন্তু হোসনি মোবারক কিংবা গাদ্দাফির চেয়ে কোনো অংশে কম খারাপ না। যেহেতু এইসব গণ-আন্দোলনের লোকগুলো পরে নিজেরাই ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে যায়, তাহলে এই সব ক্ষোভ, বিদ্রোহ, ক্ষমতা থেকে অপসারণের মতো অপচেষ্টা না করে বরং ধর্ষিত, অপমানিত, শোষিত হয়ে থাকার চর্চা দেশে দেশে চালু করা উচিত। কারণ শেষ বিচারে সবাই এক একজন হোসনি মোবারক কিংবা গাদ্দাফি কিংবা একাত্তরের পাক হানাদার। শর্মিলা বসুর এই অনবায়নযোগ্য কর্কট তত্ত্ব বিশ্বের তাত্ত্বিক জগতে একটা বিরাট আবিষ্কার হিসেবে দাঁড় করানোর আরো ধারাবাহিক অপচেষ্টা তিনি করবেন সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছে।

শর্মিলা জন্মসূত্রে ভারতীয়। একাত্তরের যুদ্ধকে তিনি ভায়ে ভায়ে গ্যাঞ্জাম বলে মনে করেন। এটাকে সিভিল ওয়ার বলে চালানো তার প্রাত্যহিক প্রচেষ্টা। ভারতকে তিনি এই যুদ্ধের অনধিকার চর্চাকারি অপশক্তি হিসেবে দেখেছেন। তার এই দৃষ্টিভঙ্গি ভারতের আমজনতা খুব একটা পছন্দ করেনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান অস্বীকার করা যাবে না। তবে সেটা অল্প কয়েকটা দিক বাদ দিলে বন্ধুসুলভের চেয়ে খারাপ দিকে মোড় নেয়নি। আফগানিস্তান বা ইরাকে নেমে আসা প্যাকেজ স্বাধীনতার সাথে আরব বিদ্রোহের তুলনা চলে না। আর আরব বিদ্রোহের সাথে একাত্তরের যুদ্ধে নেমে আসা ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যার উল্লেখ না করে তুলনা করা পুরোপুরি বসু জঁনরার অপপ্রয়াস।

তিনি আল জাজিরাতে লিখেছেন-
আমার কয়েক বছরের গবেষণা নিয়ে 'ডেড রেকোনিং' গ্রন্থটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। এটার মূল প্রতিপাদ্য এক বছরের খানিকটা বেশি সময় ধরে সংঘটিত পূর্ব পাকিস্তানে ভায়ে-ভায়ে যুদ্ধ। পরবর্তীতে সেটা পাক-ভারত যুদ্ধে মোড় নেয়। যুদ্ধের সময়ের উভয় পক্ষের লোকজনের স্মৃতি নিয়ে এই প্রথম এই ধরনের গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। সাক্ষীরা তাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। এই বিবরণ একাত্তরের যুদ্ধ নিয়ে প্রচলিত সব ধারণাকে উড়িয়ে একটা নতুন বিতর্কের সূচনা করবে।

এক বছরের বেশি সময় ধরে বলার মধ্যে ভুলটা উদ্দেশ্য প্রণোদিত। তার কন্সপিরেসি থিয়োরি বলতে চায়- পঁচিশে মার্চের আগে পূর্ব পাকিস্তানে বিহারিদের ওপর নেমে আসা গণহত্যা থামানোর জন্য উপায় না দেখে পাকিস্তানি আর্মি নামাতে একরকম বাধ্য হয়েছিল। ফলে নিজের তত্ত্বকে রক্ষা করতে নয় মাসের যুদ্ধের মেয়াদ বাড়ানো শর্মিলা বসুর ঈমানি দায়িত্ব হয়ে যায়। ঈমানের সাথে তিনি সেটা করেন, করছেন।

বসু নিজের লেখায় তার গবেষণা নিয়ে নিজের ঢাক নিজে কয়বার বাজিয়েছেন। তার একমাত্র দাবী, একাত্তরে গণহত্যার নামে যেসব সুবিশাল সংখ্যা হাজির করা হচ্ছে সেগুলো বাংলাদেশের রটনা। হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞের প্রচলিত চিত্রের কিছুই আসলে ঘটে নাই বলে তিনি বিগত ছয়-সাত বছর ধরে প্রচারের চেষ্টা করছেন। তার এই কিম্ভূতকিমাকার গবেষণা বোদ্ধাদের প্রশংসায় ভেসে গেছে বলে তিনি দাবি করছেন। অথচ তার এই বই নিয়ে আলোচনা সভাতেই তার পাশে বসে আর্নল্ড জাইটলিন এই বইতে ইতিহাস বিকৃতি আছে বলে অভিযোগ করেছেন। শর্মিলা বসু আর রুবাইয়াত হোসেনেরা যখন জনতার চাপের গ্যাঁড়াকলে পড়েন, তখন তাঁদের মুখে আন্তর্জাতিক ভাড়া খাটা গবেষকদের প্রশংসার গল্প শোনা যায়। শর্মিলা বসুকে নিজের ঢোল নিজেকে বাজাতে দেই বরং-
বইয়ের অগ্রিম সংস্করণ পড়ে অনেকেই এই বই নিয়ে প্রশংসাসূচক মন্তব্য করেছেন। অনেকের মতে, এই বই একটা সাহসী পদক্ষেপ। অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে আমাকে প্রশংসা করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন এই বই লেখার ফলে প্রতিরূপ সমালোচনা মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত হতে। একজন মিথ ভঙ্গকারী গবেষক বইটি শেষ পর্যন্ত প্রকাশ হয়েছে দেখে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।

অন্যদিকে সমালোচনাকারিদের প্রতি তার উচ্চারণ বেশ কড়া-
বইটি যাঁরা পড়বেন একাত্তর সম্পর্কে তারা আরো বেশি কিছু জানতে পারবেন। একটা বিশেষ গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে অপতৎপরতা চালাচ্ছে, যাতে এই বই সাধারণ পাঠকের হাতে না যায়। অনেকে বই পড়ার আগেই বই নিয়ে লম্বাচওড়া কথা বলতে শুরু করে দিয়েছেন, এগুলো অর্থহীন সব কাজ-কারবার। তাদের বক্তব্যকে নাকচ করে দেয়া যায় খুব সহজেই। যারা বইটি পড়েন নাই, তাদের এই বই নিয়ে কোনোপ্রকার মন্তব্য করা সাজে না।

এগুলো অনাবশ্যক সতর্ক উচ্চারণ। সমালোচনাকারিদের অনেকেই তার লেখালেখির রেফারেন্স টেনে সমালোচনা করেছেন। বুক লঞ্চিং অনুষ্ঠান যারা দেখেছে, তারা শর্মিলার মুখে পাকিস্তান প্রীতির বয়ান নিজের কানেই শুনেছেন। ফলে বইয়ের মধ্যে কী মহার্ঘ্য লুকিয়ে আছে সেটার আন্দাজ কিছুটা করা যায়। কারণ তার সমীকরণের মধ্যে অস্পষ্টতা নাই। তিনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বর্বর হানাদারদের মানবিক করে দেখাতে চান। এর বিপরীতে একাত্তরে মুক্তিসংগ্রামীদের বর্বরতার কল্পজগৎ তৈরি করে বিশ্ব দরবারে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধ লাঘব করে সেটাতে নৈতিকতার প্রবেশ ঘটানোই তার মূল তাড়না।

তার এই অভূতপূর্ব কাউন্টার-ন্যারেটিভের চোটে মুক্তিযুদ্ধের আসল ন্যারেটিভ ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাওয়ার স্বপ্নের ইঙ্গিতও তিনি দেন তার লেখায়।
ডেড রেকোনিং প্রকাশ পাবার পরেই জাতীয়তাবাদী মিথ নিয়ে যারা আস্ফালন করতো তাদের দিন বরবাদ হয়ে গেছে। রাজনীতি, মিডিয়া, অ্যাকাডেমিয়া সর্বক্ষেত্রে ১৯৭১ সালের এই বিশেষ বয়ান বলার মধ্যে নিজেদের পেশার উন্নয়ন ঘটানোর ব্যাপার জড়িত ছিল। বাংলাদেশের জনগণ ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর বলে দেয়া গল্প বহিঃবিশ্বে প্রধান বক্তব্য হিসেবে এতোদিন চলে এসেছে। এইসব গালগল্প সন্দেহাতীতভাবে গ্রহণযোগ্যতাও লাভ করেছে। এর বিপরীতে বলা বক্তব্যগুলো কেন জানি ধোপে টিকে নি।

শর্মিলা বসু আন্তর্জাতিক পাঠকের কাছে সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টাও করেছেন তার লেখায়। তার বই প্রকাশনা বানচালের গল্পও তিনি এক ফাঁকে করে ফেলেন। যেকোনো ধরনের গণআন্দোলনকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার পরে শেষমেষ তিনি হতে চান শহীদ শর্মিলা বসু।

ডেড রেকোনিং প্রকাশের শুরু থেকেই নানারকম বাধা-বিপত্তির মুখে পড়েছে। প্রথমত, বইটি যাতে সাধারণ পাঠকের কাছে না পৌঁছে সেটার চেষ্টা করা হয়েছিল। আন্তর্জালে লেখক তার মনমতো যেকোনো কিছু লিখে প্রকাশ করতে পারে। আমার লেখালেখির বিরুদ্ধে তারা ঘৃণার চর্চা চালিয়েছে দীর্ঘদিন। এদের কেউই আমার বই পড়েন নি। এমনকি মন্তব্যকারীদের কেউ আমার বই সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা রাখেন বলে আমার মনে হয় না। এদের দেখে মনে হয় "জ্ঞানই শক্তি" এই প্রাজ্ঞ-বাণীর প্রতি তাদের যথেষ্ট ভীতি আছে।

তিনি মনে করেন তার এই গবেষণা (যেটাকে তিনি সুশৃংখল গবেষণা ও একাত্তর নিয়ে মাঠ পর্যায়ের একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য গবেষণা বলে চালানোর চেষ্টা করেছেন তার লেখায়) বিশ্বকে একাত্তরের মূল ঘটনার সন্ধান দিবে। নিজের বইয়ের মার্কেটিং ভালোই করেছেন আল জাজিরাতে প্রকাশিত এই প্রতিক্রিয়াতে। পাঠক যাতে সত্যের সন্ধানে এই পবিত্র গ্রন্থ পাঠ করে সেটা বোঝানোর চেষ্টার কমতি নেই। এই নতুন বহি বাজারে আসার পর আরো আরো নয়া মেহেরজানের প্রসব ঘটবে, বিতর্কের সূচনা হবে, পাকিস্তানিদের প্রতি ভ্রাতৃপ্রতিম অনুভূতির জন্ম নিবে- তার এই সুদূরপ্রসারি স্বপ্নের কতোটা বাস্তবায়ন ঘটে সেটা ভবিষ্যতে বোঝা যাবে।

বসু ইঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন তার ন্যারেটিভ আন্তর্জাতিক গবেষকদের সপ্রশংস মনোযোগ পেলেও দক্ষিণ এশীয় গবেষকদের তুষ্ট করতে পারেনি। আসল ঘটনার কাছাকাছি থাকা সচেতন লোকজন এই শতভাগ বিশুদ্ধ অপগবেষণার বিপক্ষে কথা বলবেন- সেটাই স্বাভাবিক। শর্মিলার গবেষণাকে প্রশংসার দৃষ্টিতে না দেখার জন্য দক্ষিণ এশিয়ার গবেষকদের একহাত নেয়া লাগে। সেটাই করেছেন তিনি-
দক্ষিণ এশিয়ার লোকজন অপ্রত্যাশিত সত্যের মুখোমুখি হলে নিজেদের বাঁচাতে নানারকম ষড়যন্ত্রের আঁচ টের পায়। ডেড রেকোনিং প্রকাশের মধ্যে যারা এইসব ষড়যন্ত্রের আভাস পাচ্ছেন, তাদের উদ্দেশ্য বলি- এই বই লেখা হয়েছে প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানের ওপর ভিত্তি করে, বানোয়াট কিছু দিয়ে নয়।
নিজে দক্ষিণ এশীয় হওয়া সত্ত্বেও তিনি ভিন্ন আঙ্গিকে কথা বলার জন্য পুরো দক্ষিণ এশীয় লোকদের নিয়ে জাতিবৈরি মন্তব্য করতে দ্বিধা করেন না। তার কাছে একটা সহজ প্রশ্ন, পাকিস্তানের জেনারেলরা এশিয়ায় কোন অঞ্চলের অধিবাসী?
বসুর বই ডেড রেকোনিং-এর প্রতিটা পাতাতে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে খাটো করার প্রবণতা উল্লেখ করার মতো।

সূত্র:
১। http://www.politics.ox.ac.uk/index.php/profile/sarmila-bose.html
২। Bose, Sarmila, Anatomy of Violence: Analysis of Civil War in East Pakistan in 1971', Economic and Political Weekly, October, 2005
৩। Bose, Sarmila, ,Losing the Victims: Problems of Using Women as Weapons in Recounting the Bangladesh War Economic and Political Weekly September 22, 2007
৪। http://www.wilsoncenter.org/ondemand/index.cfm?fuseaction=home.play&mediaid=C5204DEE-B67A-FEB3-D58474D81BE22046
৫। http://www.wilsoncenter.org/ondemand/index.cfm?fuseaction=home.play&mediaid=C5204DEE-B67A-FEB3-D58474D81BE22046
৬। http://www.dailytimes.com.pk/default.asp?page=story_24-11-2003_pg3_5
৭। Abbas, Hassan, Pakistan's Drift to Extremism: Allah, the Army and America's War and Terror, ME Sharpe, NY, 2005
৮। Rummel, R.J., 'Death by Government', Transaction Publishers, London, 1996
৯। http://opinion.bdnews24.com/bangla/2011/07/15/বাঙালি-বিরোধী-জাতিবৈরিতা/
১০। Gerlach, Christian, Extremely Violent Societies: Mass Violence in the Twentieth-Century World, Cambridge University Press, 2010
১১। Mascarenhas, Anthony, The Rape of Bangla Desh, Vikas Publications, London, October 1, 1971
১২। Hossain, Rubaiyat, Trauma of the Women, Trauma of the Nation: A Feminist
Discourse on Izzat, Second International Conference on Genocide, Truth and Justice, 30-31 July, 2009
১৩। Mookherjee, Nayanika, 'Remembering to Forget': Public Secrecy and Memory of Sexual Violence in Bangladesh' in Journal of Royal Anthropological Institute (JRAI). 12 (2), June 2006: 433-450
১৪। Mookherjee, Nayanika, Love in the Time of 1971: The Furore over Meherjaan, Economic & Political Weekly ,March 19, 2011 vol XLVI no 12
১৫। http://english.aljazeera.net/indepth/opinion/2011/05/20115983958114219.html
১৬। http://english.aljazeera.net/indepth/features/2011/04/2011429174141565122.html

শুভাশীষ দাশ : গবেষক ও প্রাবন্ধিক।