বিদায় ২০১৫: স্বাগতম ২০১৬

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন
Published : 2 Jan 2016, 03:10 AM
Updated : 2 Jan 2016, 03:10 AM

২০১৫ সালে বাংলাদেশ অর্থনীতির অগ্রগতি, সামাজিক উন্নয়ন, রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ এবং সাংস্কৃতিক পুনরুত্থান প্রত্যক্ষ করেছে। চুয়াল্লিশ বছর আগে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং গৌরবে উজ্জ্বল দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম যে আদর্শ ও উদ্দেশ্য নিয়ে সফলতা লাভ করেছিল, তারই আলোকে ২০১৫ সালের একটি মূল্যায়ন এবং ২০১৬ সালের পূর্বাভাস, এমনকি করণীয়-বর্জনীয় সম্পর্কে আলোচনা করা যেতে পারে।

২০১৫ সনের সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং এর সামাজিক রূপান্তরে বিশ্ববাসী আগের পাঁচ ছ' বছরের মতো বিস্মিত না হয়ে অভ্যস্ত হয়ে একে 'বাংলাদেশ-বৈশিষ্ট্য' (Bangladesh Phenomenon) হিসেবে মেনে নিয়েছে। বর্তমান অর্থবছরে জিডিপির বার্ষিক প্রবৃদ্ধি শতকরা সাত ভাগ ছাড়িয়ে যেতে পারে। সিএনএন মানিগ্রাম বলছে, ২০১৫ সালে পাঁচটি দ্রুততম প্রবৃদ্ধির দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ২০১৯ সালে দেশটি গণচীন ও ভারবর্ষের সঙ্গে দ্রুততম প্রবৃদ্ধির তিনটি দেশের মধ্যে থাকবে।

যুক্তরাষ্ট্রের পিইইউ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতে, আগামী পঁচিশ বছরে পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটির মাপে পৃথিবীর তেইশতম অর্থনীতি হবে (বর্তমানে চৌত্রিশতম) বাংলাদেশ এবং অর্থনীতির আকারে মালয়েশিয়া ও অস্ট্রেলিয়াকে ছাড়িয়ে যাবে। মাস্টার কার্ডের জরিপ অনুসারে, ২০১৫ সালের শুরুতে এশিয়া প্যাসিফিকের ১৬টি দেশের মধ্যে কনজুমার কনফিডেন্স ইনডেক্সের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ১৬.৯ শতাংশ যা ৮৩.৩ পয়েন্টে পৌঁছে গেছে। দেশের শতকরা ৭২ ভাগ লোক নিজের আর্থসামাজিক অবস্থানে সন্তুষ্ট এবং ভবিষ্যতের সমৃদ্ধি সম্পর্কে আশাবাদী।

যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেট দলীয় থিংক ট্যাংক ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশন হিসাব করছে যে, ডিজিটাল বাংলাদেশের সফল ও কৃতসংকল্প পথপরিক্রমায় বাংলাদেশ ২১টি দেশের মধ্যে মোবাইল সক্ষমতায় দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। ২০১৬ সালে ফোর জি শুরু হয়ে গেলে অবস্থানটি আরও মজবুত হবে।

এদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সঞ্চালনার সক্ষমতার ইতিবাচক প্রবাহ আর্থসামাজিক অগ্রগতি দ্রুততর করেছে। বস্টট কনসালন্টিং গ্রুপ বিসিজি ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডের মতো কয়েকটি দেশের সঙ্গে তুলনা করে দেখিয়েছে যে, বাংলাদেশে এখন এক কোটি বিশ লাখ লোক বার্ষিক পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার উপার্জনকারী ভোক্তাপণ্যের শক্তিধর চাহিদার উৎস যা ফি বছর শতকরা দশ ভাগ হারে বাড়বে। অর্থাৎ ভোগ্যপণ্য উৎপাদনে বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ খুবই চমৎকার ক্ষেত্র।

অন্য একটি গবেষণা মতে, বাংলাদেশে দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ও হার কমছে (বর্তমানে শতকরা ২৪ ভাগ) অর্থাৎ দারিদ্র পিছনে ফেলে ভোগ্যপণ্য চাহিদা বৃদ্ধিকারী মধ্যবিত্তের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। দেশে কোটিপতির সংখ্যা এখন প্রায় ৫৪,০০০ এবং প্রতি বছর আরও পাঁচ হাজার লোক নতুন করে কোটিপতি হচ্ছেন।

বিশ্ব ব্যাংকের হিসাবে বাংলাদেশ এখন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ আর জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির আরও বেশি অর্থবহ মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশে নিম্ন মধ্যম পর্যায়ে (এইচডিআই ভ্যালু ০.৫৭০) উঠে এসেছে। প্রশ্ন উঠেছে, স্বল্পোন্নত দেশ বা লিস্ট ডেভেলপড কান্ট্রির বিড়ম্বনা থেকে উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ে উঠে আসা উচিত কিনা এবং তাতে কত সময় লাগতে পারে। অবশ্যই ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্থাৎ স্বাধীনতা সুবর্ণজয়ন্তীর বছর ২০২১ সালের আগেই মধ্যম আয়ের উন্নয়নশীল দেশ তথা মধ্যম মানব উন্নয়ন সূচকে উঠে আসার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিতে হবে এবং যদি সাম্প্রতিক অগ্রগতির ধারা অব্যাহত থাকে তবে তা অর্জিত হবেই।

সামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় সকল ক্ষেত্রেই সূচকের শীর্ষ অবস্থানে। বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধি শতকরা ১.১৩ ভাগ, নারীর প্রজনন প্রবণতা ২, শিশুমৃত্যুর হার হাজারে ৩৪, প্রাথমিকে ভর্তির হার প্রায় শতভাগ, ঝরে পড়ার হার শতকরা ৩০ এবং হ্রাসমান, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ছাত্রছাত্রীর অনুপাত জনমিতির অনুরূপ, উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরতদের সংখ্যা প্রায় ৩০ লক্ষাধিক এবং জন্মকালীন গড় আয়ু প্রায় বায়াত্তর। ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরামের হিসাবে জেন্ডার-প্যারিটি ইনডেক্সে ২০১৫ সালে ১৪৫ টি দেশের মধ্যে সূচক ৬৪তম (২০১৪ সালে ছিল ৬৮তম) ভারতের অবস্থান ১০৮। নারীর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ প্রায় শতকরা চল্লিশ ভাগ।

বাংলাদেশের কৃষি ও মৎস্য খাতের ধারাবহিকতা চমৎকারিত্বের দাবিদার। ১৯৭২ সালে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল ১ কোটি টন; ২০১৫ সালে তা ৩.৭৫ কোটি টন। গত পচিশ বছরে আলুর মোট ফলন ৯ লক্ষ ম্যাট্রিক টন থেকে ৮৩ লক্ষ টনে উঠে এসেছে (পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম আলু উৎপাদনকারী দেশ)। ভারত ও রাশিয়া বাংলাদেশের আলু রপ্তানিতে ক্রমবর্ধমান আগ্রহ দেখাচ্ছে। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন পৃথিবীতে ৫ম; বার্ষিক চাহিদা ৪১ লক্ষ টন, উৎপাদন প্রায় ৩৮ লক্ষ টন। তন্মধ্যে ইলিশ ৩৮,০০০ টন।

২০১৫ সালের সূচনাটি মোটেও সুখকর হয়নি। নিয়মতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষে আইনের শাসন ও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার বাধ্যবাধকতায় প্রচণ্ড বেআইনি প্রতিরোধ ও হানাহানির মুখে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি যে নির্বাচন হয় তার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারম্যান ৬ জানুয়ারি 'আন্দোলন' শুরু করেন। অবরোধ ও হরতাল হয় এর নিত্যসাথী। কিন্তু নেতাগণ থাকেন পর্দান্তরালে।

সে সুযোগে এবং হিংসাত্মক আন্দোলনের ছত্রছায়ায় জঙ্গি, সন্ত্রাসী, যুদ্ধাপরাধী গ্রেনেড, অগ্নি, হত্যা, ধ্বংস, ককটেল অস্ত্র ব্যবহার করে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। বিএনপি চেয়ারম্যান ৫৯ জন সহকর্মীসহ ৯৩ দিন অবরুদ্ধ করে রাখেন নিজেকে বিএনপির গুলশান কার্যালয়ে। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটে, নিহত হন শতাধিক, ধ্বংস হয় মূল্যবান ধন-সম্পত্তি, ধীর গতি হয়ে পড়ে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির চাকা, হুমকির মুখে পড়ে দেশের ভাবমূর্তি।

আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুতে শোক জানাতে গিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিএনপি অফিসে 'অবরুদ্ধ' মাননীয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতই পাননি; তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় দরজা থেকেই। ঘটে ২০১৪ সালে শেখ হাসিনা কর্তৃক বহু চেষ্টার পর টেলিফোনে সংলাপ আমন্ত্রণে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পুনরাবৃত্তি। এদিকে সহিংসতা বন্ধ না করার ঘোষণা না দিয়েই স্বার্থান্বেষী মহল সংলাপের ডাক দিতে থাকে।

তবে পরিস্থিতির স্বস্তিদায়ক পরিসমাপ্তি ঘটে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আদালতের শরণাপন্ন হয়ে জামিন নিয়ে বাসভবনে ফিরে যাবার মাধ্যমে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিসহ সকল গঠনমূলক কর্মকাণ্ডে আসে প্রচণ্ড গতি। ২৭ এপ্রিলের ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ও চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দেশি-বিদেশি সকলকে অবাক করে দিয়ে বেলা এগারোটায় বিএনপি নির্বাচন বয়কটের ডাক না দিলে ফলাফল ভাগাভাগি হত কি না তা বলা মুশকিল।

২০১৫ সালে আটষট্টি বছরের পুরনো ছিটমহল সমস্যার সমাধানে জনমনে দারুণ আশা ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। জাতিসংঘের ৭০তম অধিবেশনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে 'চ্যাম্পিয়নস অব দ্যা আর্থ' এবং "আইসিটি টেকসই উন্নয়ন' পুরস্কারে ভূষিত করে। তাছাড়াও তাঁকে খাদ্য উৎপাদনের সাফল্যে এফএও পুরস্কার প্রদান করা হয়। ওয়াশিংটনের দ্য ফরেন অ্যাফেয়ার্স ম্যাগাজিনে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ জন চিন্তাবিদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ১৩তম স্থান দিয়ে বিরল সম্মানে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে।

বিশ্ব ব্যাংকের বোকামিপ্রসূত ঋণ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে অসমসাহসী নেতৃত্বে শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করেন। ১২ ডিসেম্বর প্রায় ৬.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই প্রমত্ত ও উত্তাল পদ্মা পাড়ি দিতে স্বপ্নের এই পদ্মা সেতুর মূল কাজ উদ্বোধন করেন। পরিকল্পিত সময়ের আগেই ২০১৮ সালে সেতুর কাজ সমাপ্ত হবে বলে বিশ্বাস– দক্ষিণ বাংলার বিশাল সম্ভাবনাময় জনগোষ্ঠী ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির সম্ভার মূলধারায় সংযুক্ত হয়ে আর্থ-সামাজিক সমৃদ্ধির পালে নতুন শক্তি জোগাবে।

২০১৫ সালে দেশের আইনশৃঙ্খলা ও নিোপত্তা পরিস্থিতি বিশ্ব পরিমণ্ডলে নন্দিত হয়েছে। দ্য ইনস্টিটিউট ফর ইকনমিকস অব পিস ২৩টি বিবেচনা ক্ষেত্রে ১৬২টি দেশে যে জরিপ সম্পন্ন করেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৪তম (শ্রীলংকা ১১৪, ভারতবর্ষ ১৪৩, পাকিস্তান ১৫৪)। পক্ষান্তরে, শতাধিক বৎসরের ঐতিহ্যবাহী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের GALLUP SURVEY ১৪১টি দেশে জরিপ চালিয়ে যে ফলাফল পেয়েছে, তাতে সিঙ্গাপুর (৮৯ পয়েন্টস), উজবেকিস্তান (৮৮), হংকং (৮৭), ইন্দোনেশিয়া (৮৭), শ্রীলংকার (৭৯) পরেই ৭৮ পয়েন্ট নিয়ে পৃথিবীর ৬ষ্ঠ নিরাপদতম দেশ বাংলাদেশ। দেশ অস্থিতিশীল করার সকল প্রচেষ্টাই যে ব্যর্থ হয়েছে এসব মূল্যায়ন তার সাক্ষ্য বহন করে।

যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের ল অব ল্যান্ড অনুসারে আত্মপক্ষ সমর্থনের সম্পূর্ণ সুযোগ দিয়ে প্রকাশ্যে বিচারকাজ চলছে। কয়েকজন পালের গোদার মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয় ২০১৫ সালে। এতে জনমনে স্বস্তি আসে। আইন মান্যকারী, দেশপ্রেমিক, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত হয়েছেন। দ্রুততম গতিতে সিলেট ও খুলনায় শিশুহত্যার বিচার হয়েছে। এ সকল কারণে দেশের শতকরা ৭৩ ভাগ লোক বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতা সম্পর্কে আস্থাশীল।

একটি দক্ষ, চৌকষ, স্বচ্ছ, সৎ ও ন্যায়ের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সক্ষম সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি গড়ে তোলার লক্ষ্যে সাহসী সরকার অষ্টম বেতন কাঠামোতে শ্রেণি-বৈষম্য দূর করে বেতন প্রায় দ্বিগুণ করেছে এবং অন্যান্য যুক্তিগ্রাহ্যের অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করেছে। দেখা দিয়েছে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা। ক্যাডার-নন্ ক্যাডার ইস্যু ও শিক্ষকমণ্ডলীর যে সকল দাবি ন্যায়সঙ্গত, যেমন অধ্যাপকবৃন্দকে দ্বিতীয় গ্রেডে/স্কেলে (সপ্তম বেতন কাঠামোতে তৃতীয় গ্রেড/স্কেলে ছিলেন) অবস্থান দিয়ে পদ সৃষ্টি ও পদোন্নতির মাধ্যমে প্রথম গ্রেডে যাবার ব্যবস্থা করে এই অভূতপূর্ব উদ্যোগের সুফল পূর্ণভাবে ঘরে তোলা সম্ভব ও উচিৎ হবে।

রাত পোহালেই ২০১৬ সাল। আগামী তিনশত ছেষট্টি দিনের প্রথম দিনেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যার্থীদের হাসিমুখ বিজয় উৎসবে ৩৩ কোটি বই বিনামূল্যে পৌঁছে যাবে।

২০১৬ সালে আরও উন্নতি ঘটুক ঈর্ষণীয় বিদ্যুৎ উৎপাদনের অগ্রগতিতে। ২০২৫ সালের পর পরিবেশবাদীদের চাপে সম্ভবত কয়লাবিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করে দিতে হবে। তাই বাংলাদেশের উন্নত জাতের বিটুমিন জাতীয় কয়লাকে ওপেন পিটের শতকরা ৯০ ভাগ উৎপাদনশীল বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রক্রিয়ায়, স্বচ্ছ নীতি-কৌশল ও ন্যায়সঙ্গত প্রণোদনা দিয়ে অবিলম্বে শুরু করতে হবে।

রামপালের ১২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্লান্টের বিষয়ে স্পষ্ট ঘোষণা দেওয়া যেতে পারে যে, অত্যন্ত দক্ষ প্রযুক্তি ও পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিত করেই কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে।

গ্যাস ক্ষেত্রের উন্নয়নে ব্যাপক মনোযোগ ও বিনিয়োগ অচিরেই সুফল দিতে পারে। তবে গ্যাসের ব্যবহারে বিদ্যুৎ উৎপাদন খুবই অলাভজনক; এর বদলে গ্যাস দিয়ে শিল্পায়নে যেতে হবে।

উপআঞ্চলিক সহযোগিতায় জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে যাবার সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় যেতে হবে। ২০২৫ সালের মধ্যে সৌরবিদ্যুৎ, বায়োগ্যাস বিদ্যুৎ ও অন্যান্য নবায়ণযোগ্য উৎস থেকে শতকরা ১০ ভাগ বিদ্যুৎ আহরণ করে ২৫০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। তবেই কর্মসংস্থান তথা দারিদ্র নিরসনের উপায় হিসেবে ব্যাপক শিল্পায়ন প্রচেষ্টা সফল হবে।

উল্লেখ্য যে, বস্ত্র শিল্পে বিপুল প্রচেষ্টা প্রয়োজন যাতে উন্নতমানের আধুনিক প্ল্যান্টে কাপড় বুননে গতি আসে। গ্যাসও ২২০ ভোল্টেজ বিদ্যুতের উচিত মূল্যে দিতে পারলে এ খাত ফরওয়ার্ড ও ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজে বিপ্লব আনতে পারবে। কাঁচা তুলা আমদানিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় একটি দেশ– ভালো লক্ষণ বৈকি! তবে সরকারিভাবে সেন্ট্রাল অ্যাপলুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন করে বড় বড় বস্ত্র মিলকে ভাড়ায় সার্ভিস দিতে হতে পারে।

শিল্পায়নে ঔষধ, চামড়া, খেলাধুলার সরঞ্জাম, হালকা যন্ত্রপাতি, জাহাজ নির্মাণ, মটরসাইকেল, বাইসাইকেল, আসবাবপত্র, প্রসাধনী ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। পাটের থলে ব্যবহারে খুবই কড়াকড়ি করতে হবে। উৎপাদন ও রপ্তানিতে বহুমাত্রিকতা আনা হোক ২০১৬ সাল থেকেই। রেলের ব্রডগেজীকরণ, ডাবল ট্রেকিং ও বিদ্যুতায়নও শুরু হোক নতুন বছরেই।

বাংলাদেশে এখন সময়ের দাবি, শক্তিশালী একটি পরিকল্পনা কমিশন স্থাপন, বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির আরও ক্ষমতায়ন, যৌক্তিক ও প্রবৃদ্ধি সহায়ক মুদ্রানীতি ও বেসরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার সকল উপায় সন্ধানে। বাংলাদেশে জাতীয় সঞ্চয় সামষ্টিক আয়ের শতকরা ৩১ ভাগ আর সামষ্টিক আয়ের বিনিয়োগের হার শতকরা ২৯ ভাগ। এই রহস্যের অন্যতম বড় কারণ সম্পদ ও মূলধন পাঁচার।

ওয়াশিংটনের গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি জিএফআইএর হিসাবে ২০০৪ থেকে ২০১৩, এই দশ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৫৫৮৮ কোটি ডলারের মূলধন পাচার হয়ে গেছে। এর মধ্যে ২০১৩ সালে এই পাচারের পরিমাণ প্রায় ৯৬৬ কোটি ডলার। এ সর্বনাশা অপরাধ রোধ করতেই হবে। উচ্চ শিক্ষা কমিশন ও অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল স্থাপন হোক ২০১৬ সালে। ট্যানারি শিল্প যেন অবশ্যই সাভারে স্থানান্তরিত হয় অবিলম্বে।

এ নিবন্ধ রচনার সময় বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা উত্তেজনায় সারা দেশে ২৩৪টি পৌরসভায় দলীয় প্রতীকে পৌর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ২০টি দল অংশগ্রহণ করছে যার মধ্যে বৃহত্তম দুটো দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এ নির্বাচন শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠুভাবে ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হবে বলেই আশা। এরপর রাজনীতি ক্ষেত্রে যে অস্বস্তি রয়েছে তা দূর করে বড় এ দুটি দল দেশের আর্থ-সামাজিক সাংস্কৃতিক অগ্রগতিতে বিপুল শক্তি সৃষ্টি করতে পারবে।

রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি যদি বাস্তবতা মেনে নিয়ে ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে প্রতিযেগিতা করার ঘোষণা দেয় এবং সরকারি দল আওয়ামী লীগ যদি কৃতসংকল্প দৃঢ়তায় নির্বাচন কমিশনকে আরও শক্তিশালী (বর্তমান কমিশনেরর সবাই আগামী দু'বছরের মধ্যেই অবসর নেবেন) করে এবং নির্বাচন পদ্ধতিতে আরও স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ করার উদ্যোগ নিতে পারে, তাহলে কিন্তু আগামী দু'বছরে সামষ্টিক অর্থনীতির শতকরা ৮ ভাগ প্রবৃদ্ধি এবং ২০২১ সালে শতকরা ১০ ভাগে উঠে আসবে। সৃষ্টি হবে গণতান্ত্রিক সমৃদ্ধি।

তখন নজর দিতে হবে বৈষম্য নিরসনে। সামজিক ন্যায়বিচার ও সুরক্ষা-বলয় শক্তিশালী করার প্রয়োজন হবে। এভাবেই দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে সোনার বাংলা গড়ে তোলার ঢেউ লাভ করবে ২০১৬ সালের প্রচণ্ড একটি ইতিবাচক ধাক্কা।