বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগারদের বিরুদ্ধে ইসলামপন্থীদের জেহাদ

Published : 5 Jan 2016, 04:18 AM
Updated : 5 Jan 2016, 04:18 AM

[নয়াদিল্লি-ভিত্তিক লেখক-সাংবাদিক সামান্থ সুব্রামনিয়াম ২১ ডিসেম্বর, ২০১৫ ''The Hit List: The Islamist war on secular bloggers in Bangladesh'' নামে একটি নিবন্ধ লিখেন নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিনে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের মতামত-বিশ্লেষণের পাঠকদের জন্য এটির বাংলা অনুবাদ করেছেন ড. আবদুস সেলিম ]

ফেব্রুয়ারির ছাব্বিশের এক অপরাহ্নে অভিজিৎ রায় ঢাকায় বসে বাংলাদেশি সংবাদ ও মন্তব্য ওয়েবসাইট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জন্যে একটি কলাম রচনা শেষ করছিলেন। কলামটির বাংলা শিরোনাম 'কেন কোনো কিছু না থাকার বদলে কিছু আছে?'

লেখাটিতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তি সম্বন্ধে রচিত তাঁর নতুন পুস্তকের অংশবিশেষ সম্বলিত হয়। বিয়াল্লিশ বছর বয়সের রায়ের কাজে ধর্মের চেয়ে বিজ্ঞানই ছিল অধিকতর গ্রহণীয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের প্রফেসর এমিরিটাস অজয়ের সঙ্গে এসব বিষয়ে তাঁর বিশেষ মিল ছিল। "ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে আমার তেমন দুশ্চিন্তা নেই," অজয় রায় আমাকে বলেছিলেন, ''তিনি তাঁর কাজ করুন, আমি আমার।"

অভিজিৎ অবশ্য তাঁর বাবার চেয়ে আরও বেশি সরব ছিলেন। তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাসকে এক ধরনের ভাইরাস বলে বিবেচনা করতেন যা মানুষের ভেতরে সংক্রমিত হয়ে এক চরম বিরোধিতায় জড়িয়ে পড়তে প্রণোদনা দেয়। একবার তিনি লিখেছিলেন, "ধর্মের প্রতিষেধক হল বিজ্ঞানমনস্কতা সৃষ্টি করা।"

অভিজিৎ রায় ও তাঁর স্ত্রী ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিতে কর্মরত রাফিদা আহমেদ আটলান্টাতে বাস করতেন। ওরা দুজন দুজনের প্রেমে পড়েন ব্লগের মাধ্যমে ২০০১ সালে। রায় তখন 'মুক্তমনা' নামে একটি যৌথ ব্লগ তৈরি করেন। সেখানে রায়ের একটি পোস্ট ছিল, ধর্ম আসলে রূপকথা ছাড়া কিছু নয়। ব্লগটির সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হয়ে রাফিদা রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

তারপর, ২০০৬ সালে রায় আটলান্টায় চলে আসেন সফটওয়্যার আর্কিটেক্টের কাজ নিয়ে। কিন্তু তাঁর মূল আসক্তি ছিল ব্লগ পোস্টে। তাঁর রচিত অনেক গ্রন্থেই ধর্মকে এক ধরনের অন্ধবিশ্বাস রূপে একাধিকবার বাতিল করেছেন রায়– শুধু তার নিজ ধর্ম হিন্দু নয়, ইসলামকেও– যে ধর্মটি সুন্নি-অধ্যুষিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম। "ও ছিল মহা আড্ডাবাজ," ওর বাবা বলেছিলেন। যদিও আড্ডাবাজ শব্দটি উনি 'গুলতানি' অর্থে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু এর ভেতর যুক্তিতর্কের বিষয়টিও অন্তর্নিহিত ছিল।

মুক্তমনার মন্তব্য বিভাগটি প্রায়শ ইসলামপন্থীদের রোষানলের কারণ হয়ে ওঠে। ফলে রায়কে তাদের সঙ্গে উষ্ণ বিতর্কে জড়িয়ে পড়তে হয়েছে। তাঁর নিজস্ব মনোভাবও তাঁর প্রতিপক্ষ তার্কিকদের মতোই অনমনীয় ছিল, ধর্মে বিশ্বাসীদের কোনো গ্রহণযোগ্য কিংবা বিশ্বাসযোগ্য যুক্তি যে থাকতে পারে সেটা তিনি মেনে নিতে পারতেন না।

একবার এক মন্তব্যকারী দাবি করেন এই বলে যে, কোরান বিজ্ঞানের অসীম জ্ঞানভাণ্ডার। বিপরীতে তিনি প্রশ্ন রেখেছিলেন, তাহলে ইসলামি বিশ্ব 'বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এত পিছিয়ে কেন?' বলেছিলেন, 'এমনকি শুধু ইসরায়েলেও সারা মুসলিম বিশ্বের চেয়ে বর্তমানে বেশি সংখ্যক বিজ্ঞানী রয়েছেন।' তাঁর বাবা তাঁর 'অতি আবেগপ্রবণতার' ব্যাপারে একাধিকবার তাঁকে সতর্ক করেছেন। ফেসবুকে এক উগ্রপন্থী লিখেছিল, "অভিজিৎ রায় আমেরিকায় থাকে। তাই তাকে এই মুহূর্তে হত্যা করা সম্ভব নয়। কিন্তু ও ফিরে এলে ওকে অবশ্যই হত্যা করা হবে।"

রায় যখন তাঁর বাবা-মাকে লেখেন যে, তিনি ফেব্রুয়ারিতে দেশে আসতে চান, ওঁর বাবা ওঁকে নিষেধ করেন। "ঢাকা এখন খুব ভাল জায়গা নয়। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে," অজয় রায় বলেছিলেন, "আমি তোমাকে জানিয়েছি, তুমি একজন চিহ্নিত ব্যক্তি। এখানে তোমাকে নাস্তিক হিসেবে ব্যাপক পরিচিত ও প্রচার করা হয়েছে।"

রায় ও রাফিদা তবু বাংলাদেশে যান, শহরের কেন্দ্রস্থলের কাছাকাছি তাদের পারিবাসিক বাড়িতে ওঠেন। তাঁর কলাম লেখা শেষ করে রায় একুশে বই মেলায় যেতে প্রস্তুত হন।। এই বই মেলায় বাংলা ভাষা সাহিত্য উদ্যাপনে প্রতি ফেব্রুয়ারিতে শত শত বই-বিক্রেতা ও প্রকাশক একত্রিত হন। রাফিদা এবং অভিজিৎ, অভিজিতের প্রকাশক আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে শিশুদের জন্যে লেখা বইয়ের দোকানগুলো ঘুরে দেখেন। ফেসবুকে দেওয়া একটা ছবিতে দেখা যায়, তাঁরা খোলা মাঠে বসে আছেন, রায় লাল রঙের কুর্তা পরে নিচের দিকে তাকিয়ে আর তাঁর পাশে রাফিদা কাগজের ব্যাগ থেকে জলখাবার বের করছেন।

আটটার দিকে, তাদের ভাড়া করা গাড়ির দিকে যখন এগুচ্ছিলেন ওঁরা, একটি অল্পবয়সী ছেলে রায়ের কাছে বখশিশ চায়। একশ টাকার একটা নোট দিয়ে রায় ওকে ধমকে বাসায় চলে যেতে বলেন। যে লোকগুলো রায়কে তাড়া করে (দ্রুত?) চাপাতি দিয়ে মেরেছিল, রাফিদা তাদের চেহারা মনে করতে পারেন না। ওরা তাদেরকে বাধা দিয়েছিল কি না সে কথাও তাঁর মনে পড়ে না। রাফিদার মাথায় একাধিক আঘাত লাগে। তাঁর বুড়ো আঙুলও কাটা পড়ে।

পরে ছবিতে তিনি লক্ষ্য করেছেন, কিছু পুলিশ ঘটনার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু তারা বাধা দেয়নি। রায় রাস্তার ধারে পড়ে যান, মুখ থুবড়ে। ইত্যোবসরে তাঁর আক্রমণকারীরা তাদের অস্ত্রগুলো ফেলে রেখেই পালিয়ে যায়। যতক্ষণে তাঁর বাবা ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে পৌঁছান, ততক্ষণে রায়ের মৃত্যু হয়েছে।

টুইটারে রায়ের হত্যার দায় স্বীকার করেছে আনসারউল্লাহ্ বাংলা টিম, বাংলাদেশের এক ইসলামিক জঙ্গি গোষ্ঠী। রায় আমেরিকার নাগরিক ছিলেন, টুইটে বলা হয়, তাঁকে হত্যা আইসিসের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণের প্রতিশোধ। এক বাংলাদেশি পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, এই গ্রুপ উপমহাদেশের আল কায়েদার 'ঘনিষ্ঠ আত্মীয়' এবং এটি অন্ততপক্ষে আরও পাঁচটি ধর্মনিরপেক্ষ কণ্ঠের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত– প্রথমটি ২০১৩ সালে এবং পরবর্তী সবগুলো রায়কে হত্যার পর ঘটে। অর্থাৎ মোটামুটিভাবে এক মাস পরপর একটি করে হত্যাকাণ্ড।

অক্টোবরে যখন ঢাকায় যাই, এগার সপ্তাহ্ পর্যন্ত এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি এবং যে লেখকদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয় তারা সবাই এক অশনি সংকেতের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিল। ফিরে আসার তিন দিন পর খবর পাই রায়ের প্রকাশককে তার অফিসে হত্যার চেষ্টা হয় এবং শহরের অপর এক অংশে আরেক প্রকাশক ও দুজন ব্লগার আক্রমণের শিকার হন।

যে ছজন মারা গেছেন তাদের চার জন চুরাশি 'নাস্তিক ব্লগারের' তালিকায় ছিলেন যেটি ২০১৩ সালে নাম-ঠিকানাবিহীনভাবে সংবাদপত্রগুলোতে পাঠানো হয়। প্রায় প্রতিটি আক্রমণেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয় চাপাতি। দুই ডজন সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, কিন্তু হত্যাকাণ্ড সম্বন্ধে এত সব সংশয় জগদ্দলের মতো ভারি হয়ে আছে এবং সরকার বিষয়টি এমনভাবে মোকাবিলা করছে যে, ঢাকা শহর ষড়যন্ত্র-তত্ত্বের সূতিকাগারে পরিণত হয়েছে। কিছু কিছু ব্লগার– যাদের নাম ওই চুরাশি জনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত– সন্দেহও প্রকাশ করেছেন সম্ভবত রাষ্ট্রের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলোই এই হত্যার নির্দেশ দিয়েছে।

রাফিদা কিংবা রায় কেউ বাংলাদেশের এই জিঘাংসু চরমপন্থা প্রবণতা সঠিক অনুমান করতে পারেননি। "আমি মনে করি না দূরে ছিলাম বলে আমরা বিষয়টা ধরতে পারিনি, "রাফিদা আমাকে বলেছেন, "আসলে আমার মনে হয় এটি একটি তাৎক্ষণিক পরিবর্তন, তবে বিষয়টি বেশ দীর্ঘ সময় ধরেই প্রস্তুতি নিচ্ছিল।"

মারা যাবার পর রাফিদা বলেছিলেন, কয়েক দিন আগে, রায় তাঁকে তাঁর ছেলেবেলায় বেড়ে ওঠার জায়গাগুলো দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। "আমরা ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়িয়েছি। ছোটবেলায় ও যেখানে থাকত সে জায়গা ও আমাকে দেখিয়েছে, যে স্কুলে প্রথম পড়েছে সেখানে নিয়ে গেছিল। ও বলত, 'আমার পাড়ায় আমাকে কে মারবে বল?' ''

ঢাকাতে হত্যা বিষয়ে যে কোনো আলোচনা ঘুরেফিরে ১৯৭১ সালের ঘটনার দিকে পরিবর্তিত হয়। ওই সালেই বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় যার মূল কারণ ছিল বাঙালি উদারপন্থা প্রায়শ পাকিস্তানের অতি-ইসলামপ্রীতি ও উর্দু সংস্কৃতির সঙ্গে এক অসহযোগ অবস্থান বিরাজ করত। এখন যেখানে বিস্তৃত এলাকা জুড়ে একুশে বই মেলা হয়, সেই সরোওয়ার্দী উদ্যানে ১৯৭১এর মার্চ মাসে শেখ মুজিবুর রহমান প্রায় বিশ লক্ষ মানুষের সমাবেশে আইন অমান্য আন্দোলনের এবং পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন বাংলাদেশে পরিণত করার গণআহ্বান জানান। এই বক্তৃতা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মাহেন্দ্রক্ষণ রূপে চিহ্নিত এবং এর পোস্টার ঢাকার একাধিক বসার ঘরের দেয়ালে এখনও চোখে পড়বে।

ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশিরা যাকে 'মুক্তিযুদ্ধ' বলে আখ্যায়িত করে তাকে ওই উদ্যানের জাদুঘরে স্মারক হিসেবে স্থান দিয়েছে। এই জাদুঘরের প্রায় মাটির ভেতর পোঁতা গ্যালারির কঠিন কংক্রিট ঢাকার দারুণ ঘর্মাক্ত উষ্ণতা উপেক্ষা করে এখনও নৃশংসতার সাক্ষ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেয়ালের একটি অংশ জুড়ে রয়েছে এক বা একাধিক শবদেহের স্তূপের আলোকচিত্র যার অধিকাংশই দেখতে অগ্নিদগ্ধ মানুষের মতো।

কিছু হিসাব বলে, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী নয় মাসব্যাপী যুদ্ধে পাঁচ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছে। কিন্তু অধিকাংশ বাংলাদেশির, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের– যে রাজনৈতিক দলের প্রধান ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান– বক্তব্য হল, ওই সময়কালে প্রায় ত্রিশ লক্ষ মানুষ হত্যা করা হয়েছে। অনেকে বিষয়টি গণহত্যা বলে দাবি করে। ১৯৭১এর ডিসেম্বরের প্রথমদিকে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর হস্তক্ষেপে পাকিস্তানের পরাজয় ত্বরান্বিত হয়। দুসপ্তাহ পর সরোওয়ার্দী উদ্যানে দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রধান আত্মসমর্পণ করে এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনে সফল হয়।

যুদ্ধের সময়ের সন্ত্রাস এবং পাকিস্তানের সঙ্গে যে বাঙালিরা সহযোগিতা করেছে তাদের বিষয়টি বাংলাদেশের রাজনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে থাকে। 'রাজাকার' বা যার প্রকৃত অর্থ স্বেচ্ছাসেবী শব্দটি এক সময় পাকিস্তান সমর্থকদের জন্য প্রযোজ্যও ছিল। কিন্তু বর্তমানে সেটি বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডারে স্থান পেয়েছে নিন্দনীয় ও মর্যাদাহানিকর গালিরূপে।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধ বিচার আদালত প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসে। প্রাথমিকভাবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং জাতিসংঘ একে স্বাগত জানালেও অল্প সময়ের ব্যবধানে পর্যবেক্ষকরা সন্দেহ প্রকাশ করতে শুরু করেন যে, সরকার বিরোধী দলকে শায়েস্তা করার জন্য আদালতকে ব্যবহার করছে।

২০১১ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মন্তব্য করেছে যে, সরকারি কর্মকর্তারা আসামিপক্ষের উকিল ও সাক্ষীদের বিভিন্ন উপায়ে হয়রানি করছেন। ট্রাইব্যুনালের তিন সদস্য বিচারক প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এবং তাদেরই জোট-সদস্য ও ইসলামপন্থী দল জামায়াতে ইসলামীর সদস্যদের মৃত্যুদণ্ড ও দীর্ঘমেয়াদী কারাদণ্ড প্রদান করেন। ১৯৭১ সালে এই জামায়াতে ইসলামী স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিল।

এ সত্ত্বেও ২০১৩ সালে এক বিরূপ সমালোচনা জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে যে, আওয়ামী লীগ অর্থের বিনিময়ে জামায়াতের প্রতি ক্ষমাশীল মনোভাবের এক গোপন সমঝোতা করেছে অর্থের বিনিময়ে। একজন জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে একাধিক হত্যাকাণ্ড এবং এগার বছরের মেয়েকে ধর্ষণের অপরাধ প্রমাণিত হবার পরও তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদানের রায় দেওয়া হয়। ওয়েব সাইট সামহোয়ার ইন ব্লগের এক লেখক — যার নাম হত্যা-তালিকায়ও অন্তর্ভুক্ত– আমাকে বলেছেন, মৃত্যুদণ্ড ছাড়া অন্য যে কোনো শাস্তি আমরা বিশেষ ছাড় বলে মনে করি।

তিনি বলেন, 'জনগণ মনে করে আওয়ামী লীগ টাকা নিয়েছে' শিথিল শাস্তি প্রদানের বিনিময়ে। এই ধারণায় বিশ্বাসী হয়ে প্রতিবাদ জানাবার জন্য কয়েক ডজন ব্লগার এবং ছাত্র সংগঠন সরোওয়ার্দী উদ্যানের উত্তর দিকের চৌরাস্তায় অবস্থিত শাহবাগের সামনে অবস্থান নেয়। ফলে শাহবাগ ব্লগারদের প্রতীকরূপে পরিচিতি পায় এবং সংগঠন শক্তির উদাহরণে পরিণত হয়। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় থেকে এই জনসমাবেশ কয়েক হাজার ছাড়িয়ে যায় যাদের অন্যতম দাবি ছিল জামায়াত নিষিদ্ধকরণ এবং আরও অধিক সংখ্যায় মৃত্যুদণ্ড প্রদান।

তিনি ছোটখাট, স্বাস্থ্যবান, বিরল চুলের এক চল্লিশ বছর বয়ষ্ক মানুষ। শাহবাগ থেকে কয়েক মাইল দূরে এক কফি শপে তার সঙ্গে যখন সাক্ষাত হয়, তখন তার পরনে ছিল 'এভরিথিং উইল বি ফাইন' লেখা একটি টি-শার্ট। তার সঙ্গে তার বন্ধু, প্রাক্তন ছাত্রনেতা এবং শাহবাগ প্রতিবাদের অন্যতম প্রতিনিধি অন্য একজনও ছিলেন। তার মুখে ছিল হালকা-পাতলা ফুরফুরে দাড়ি। ওর ইংরেজি বলার ভঙ্গি ছিল দ্বিধান্বিত আর কথা বলার সময় দৃষ্টি ছিল দূরে। মনে হচ্ছিল, যেন তিনি তার শব্দগুলো স্মৃতির অতল থেকে সেঁকে তুলছেন।

দুজনই অপ্রতিরোধ্য সংলাপী মানুষ। দুজনই স্মৃতি রোমন্থনের প্রতিযোগিতায় যেন সর্বদা নিয়োজিত। মাঝেমাঝেই ওরা কোনো বিষয়ে নিশ্চিত হবার জন্য নিজেদের মধ্যে বাংলাতে কথা বলছিলেন।

আমি ওদের জানালাম শাহবাগের উদারপন্থী প্রতিবাদীরা যে মৃত্যুদণ্ডের দাবি করছে সেটা বিসদৃশ মনে হচ্ছে। 'মৃত্যুদণ্ড আসলে আমাদের লক্ষ্য নয়', তিনি উত্তরে বললেন। এরপর তার জটিল যুক্তি ছিল, ''আমরা আসলে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।''

অন্যজন উৎসাহী হয়ে জানালেন, ''যদি সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হত আমরা সেটাই চাইতাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে এই মানুষগুলো, এই যুদ্ধাপরাধীরা বাংলাদেশে রাজার হালে আছে। এদের আমরা মনেপ্রাণে ঘৃণা করি।"

প্রথমজন ব্লগিং শুরু করেন ২০০৬ সালে– সামহোয়ার ইন ব্লগের বিশাল সংখ্যক বাঙালি ব্লগার হবার অনেক আগে থেকে। এই ব্লগের সদস্য সংখ্যা এখন কয়েক হাজারেরও বেশি।

২০০৬ সালে বাংলাদেশে ফেসবুক ছিল না, ফলে ব্লগই ছিল ভালো সামাজিক মাধ্যম যার সাহায্যে দেশে ও বিদেশে ছড়িয়ে থাকা সদস্যদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন হত। প্রথমজনের বাড়ি দক্ষিণাঞ্চলের বরিশালে। তার বাবা ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। ফলে প্রতি তিন বছরে তাদের স্থানান্তরিত হতে হত। বরিশাল কলেজে সাহিত্যে পড়াশুনা শেষ করে তিনি কাজের খোঁজে ঢাকায় আসেন। তিনি কবিতা লেখেন, পত্রিকা বের করেন, কিন্তু ব্লগ আবিষ্কারের আগে তার কোনো পাঠক ছিল না। অধিকাংশ মুক্তমনা শহুরে যুবকদের অবস্থা তার মতোই।

"সবার জন্যেই এটা একটা নতুন কিছু ছিল," বলেন, ''একটি উন্মুক্ত জায়গার সন্ধান পেলাম আমরা। যারা ধর্মের সমালোচক ছিল তারা দ্বিধাহীন এবং বাধাহীনভাবে তাদের বক্তব্য প্রকাশের সুযোগ পেল।"

একটি পোস্টে তিনি এভাবে ইসলামি মৌলবাদীদের চিন্তা-চেতনার ব্যঙ্গ করেছিলেন, "আমার গোষ্ঠীর বাইরের সব মানুষ কুকুরের চেয়েও ইতর প্রাণি। আমার যুদ্ধ তাদের বিরুদ্ধে যারা আমার সহোদর নয়। তাই আমি অমুসলমানদের যে কোনো ভুল কাজ খুঁজে বের করি… আল্লাহ্… আমাদের সৌভাগ্যবান করেছেন ওদেরকে তরবারির আঘাতে নিঃশেষ করার সুযোগ দিয়ে।"

যখন ব্লগারদের উপর হামলা শুরু হয়, তখন তিনি পোস্টটি সরিয়ে ফেলেন।

বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক ব্লগের মন্তব্য বিভাগ ব্যক্তিক আক্রমণের স্থানে পরিণত হয়। সামহোয়ার ইন ব্লগের একটি পোস্টের প্রতিপাদ্য ছিল ইসলাম ও সন্ত্রাসবাদ। একজন ক্রুদ্ধ পাঠক তার প্রতিক্রিয়াতে লিখলেন, ইসলাম সম্বন্ধে লেখক সম্পূর্ণ অজ্ঞ এবং তিনি ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তার এই ঔদ্ধত্যের মাসুল প্রাণ দিয়ে দিতে হবে। টোপ ফেলা এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতি-টোপ ফেলা– বাংলাদেশে এই হল ইন্টারনেটের স্বাভাবিক পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া এবং বিষয়টি হাসির খোরাকই থাকতে পারত যদি ওইসব মর্মান্তিক ঘটনা না ঘটত।

প্রতিহিংসা যে মানুষের জীবন-মরণের সংকটে রূপান্তরিত হতে পারে তার প্রথম আভাস মেলে শাহবাগ প্রতিবাদের এক মাস আগে জানুয়ারি ২০১৩তে। আসিফ মহিউদ্দিন নামের এক ব্লগার ওই দিন ছুরি ও চাপাতি হাতের তিন ব্যক্তির দ্বারা আক্রমণের শিকার হন। মহিউদ্দিন নিরিশ্বরবাদী। সামহোয়ার ইন ব্লগে তিনি ঈশ্বরকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন এভাবে: 'সর্বশক্তিমান শুধু নামেই, কিন্তু বাস্তবে সম্পূর্ণ নির্জীব।' মহিউদ্দিন ঘাড়ে গভীর আঘাত পেয়ে বেঁচে গিয়েছিলেন সে যাত্রা।

তারপর ফেব্রুয়ারিতে, যখন শাহবাগ প্রায় তার শক্ত অবস্থানে, আহমেদ রাজীব হায়দার নামে আর এক ব্লগারকে তার বাসার কাছে পাঁচ আনসারুল্লাহ সদস্য হত্যা করে। হত্যার আগের রাতে তারা হায়দারের বাসার সামনে ক্রিকেট খেলেছিল সুযোগের স্থান নির্বাচনের উদ্দেশ্যে।

২০১৩ সালের বসন্তে এক রক্ষণশীল দল, হেফাজতে ইসলাম ঢাকায় দুটি বিশাল সমাবেশ করে। তাদের অন্যতম দাবি ছিল 'নাস্তিক ব্লগারদের' মৃত্যুদণ্ড। যখন চুরাশি জন ব্লগারের তালিকা সংবাদপত্র ও সামাজিক মিডিয়াতে প্রচার শুরু হয়, তিনি তার নাম সেই তালিকায় দেখতে পান। তিনি আবিষ্কার করেন তালিকাটি নির্ভুল নয়; কারণ হায়দারের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল যদিও তিনি তখন মৃত। উপরন্তু তালিকাটিতে পুনরাবৃত্তি ছিল, যেমন একই নাম দুই জায়গায় উল্লেখ ছিল– এক স্থানে ব্লগার হিসেবে এবং অন্য স্থানে ব্লগের নিয়ন্ত্রক হিসেবে।

কিন্তু সবচেয়ে রহস্যময় বিষয় হল এর উৎসস্থল। সাংবাদিকরা কোনোভাবেই নিশ্চিত হতে পারেননি এই তালিকা ব্লগারদের নির্মূল করার অংশ হিসেবে হেফাজতের প্রস্তুত করা নাকি সরকারের। কারণ সরকার ইসলামের সমালোচক এই ব্লগারদের শাস্তি দিতে চায় বলে প্রচলিত ধারণা আছে। কিন্তু কেউ এই তালিকা প্রস্তুতের বিষয়টি স্বীকার করেনি।

এপ্রিলে পুলিশ চার ব্লগারকে গ্রেফতার করে খুবই খোঁড়া যুক্তিতে যে, তারা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া, আইন-শৃঙ্খলা ব্যাহত করা এবং পাঠকদেরকে ধর্ম বিষয়ে বিকৃত ও কলুষিত ধারণা প্রদানের মতো অপরাধে জড়িত ছিল। প্রতিষ্ঠিত মানবাধিকার আইনজ্ঞ সারা হোসেন আমাকে বলেন, "সাধারণভাবে এমন এক ভীতি বিরাজ করে যে, পুলিশ যে কোনো সময় আপনাকে ধরতে আসতে পারে। বাস্তবতা হল, রাষ্ট্র আপনাকে নিরাপত্তা দেবার মত শক্তি রাখে না। কিংবা আপনাকে নিরাপত্তা দিতে সম্ভবত ইচ্ছুকও নয়।"

পুলিশ তার অনুসন্ধানে আছে জানতে পেরে সেই ব্লগার নেপালে পালিয়ে যান। ফিরে আসেন এক মাস পর এই খবর পেয়ে যে, অন্যান্য ব্লগারদের জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। "পরবর্তী দুমাস সব কিছুই স্বাভাবিক ছিল, বলতে কি কিছুই ঘটেনি," তিনি জানান, ''২০১৪ সালেও শান্ত ছিল।"

তারপরই অভিজিত হত্যা। ফলে তিনি আবার সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। প্রতিদিন কাজে যাওয়া ছেড়ে দেন। ''আমি সম্পূর্ণভাবে বাসায় বন্দি থেকেছি।''

অল্প কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন, বাচ্চাদের নিয়ে বাইরে যান না। আত্মীয়-স্বজনরা তাকে এড়িয়ে চলেন। "এখন ওরা সবাই জেনে গেছে যে, আমি নিরিশ্বরবাদী, কারণ আমার নাম কাগজে ছাপা হয়েছে," তিনি বলেন।

"ওরা আমাকে পছন্দ করে না," সাম্প্রতিক ঘটনাবলী নিয়ে তিনি ব্লগিং ছেড়ে দিয়েছেন– ফেসবুকেও আর পোস্টিং দেন না। মাঝে-মধ্যে চলচ্চিত্র নিয়ে লেখালেখি করেন, কিন্তু তার মনের কথা হল, "রাজনীতি আর ধর্ম নিয়ে যদি লিখতে না পারি আমার মনে হয় আমার আর লেখার কিছু নেই।"

তিনি তার পায়ের জুতা বদলে ফেলেছেন।

আমি তার পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম। তিনি ফিতেবাঁধা কলা রঙের পাওয়ার মিকার পরে আছেন। "দৌড়াতে যাতে সুবিধে হয়, হ্যাঁ, যাতে দৌড়াতে সুবিধা হয়।"

ব্লগারদের জীবন-মৃত্যুর বর্ণনা সম্ভবত সামাজিক মিডিয়ার এক গুরুতর অসুস্থ রূপকল্প সৃষ্টি করবে। "এই জিনিসগুলো কী পরিমাণ দ্রুততার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে ভাবা যায় না", বল্লেন আর্টিকেল ১৯এর বাংলাদেশ অঞ্চলের পরিচালক তাহমিনা রহমান– মতপ্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কর্মরত একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান এটি– ''অনেক সময় দেখা যায় লেখাগুলো সুচিন্তিত নয়। ফলে এগুলোতে কটূক্তিপূর্ণ ভাবনার ছড়াছড়ি থাকে এবং অত্যন্ত কদর্যভাবে পাঠকদের সামনে সেগুলো হাজির হয়।"

যেহেতু বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের মতোই তাহমিনা রহমান অতি উৎকট ভাষা ব্যবহার তেমন পছন্দ করেন না। এ সত্ত্বেও তিনি সরকারের এই 'ধরি মাছ না ছুঁই পানির' মতো নীতির খোলাখুলি সমালোচনা করেন। তিনি মনে করেন সরকারের বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। নভেম্বরের মাঝ বরাবর সরকার দুজন যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে– এদের মধ্যে একজন জামায়াত সদস্য ও অন্যজন বিএনপি নেতা।

প্রতিবাদের সম্ভাবনা চিন্তা করে সরকার ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ এবং ভাইবারের কার্যক্রম দুই সপ্তাহের জন্যে বন্ধ করে দেয়। প্রায় পঁচাত্তর মিনিট সম্পূর্ণ ইন্টারনেটের কার্যক্রমও বন্ধ করে দেওয়া হয়।

এক অপরাহ্নে আমি বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে সাক্ষাত করি। বিশাল এক ডেস্কের অপর দিকে বসেছিলেন ইনু। দূরে দেয়ালে ছয়টা ছোট ছোট টেলিভিশন। সবগুলোই মিউটে রাখা। শুধু বড় একটিতে নিচু ভল্যুমে সংবাদ হচ্ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় ইনু দশ হাজার ব্যক্তিকে গেরিলা প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। সত্তরের শেষ প্রান্তে ক্ষমতাসীন মিলিটারি জান্তার বিরুদ্ধে বিপ্লবে জড়িত থাকার অপরাধে তাঁকে পাঁচ বছর জেল খাটতে হয়। বর্তমানে তিনি সমাজতান্ত্রিক দলের প্রধান এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ। বড়সড়, ঠাণ্ডা প্রকৃতির মানুষ। স্বভাবে বিনয়ী। আমি যুক্তরাজ্যের পাসপোর্টধারী জানতে পেরে উনি দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, রায়ের একজন হত্যাকারী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুক্তরাজ্যের নাগরিক।

ঢাকায় আসার পর শুনি দুজন বিদেশি, একজন ইতালিয় এবং একজন জাপানিকে সম্প্রতি হত্যা করা হয়েছে যার দায়ভার স্বীকার করেছে আইসিস। তারা আইসিসের বিরুদ্ধে 'ধর্মীয় যুদ্ধে জোটবদ্ধ দেশের নাগরিকদের' সতর্কীকরণে এ কাজ করে বলে দাবি করে। উন্নয়নকর্মী চেজারে তাভেল্লাকে গুলি করে হত্যা করা হয় যখন তিনি ঢাকার কূটনৈতিক এলাকায় জগিং করছিলেন।

অপরদিকে পাঁচ মাস আগে আগত কৃষিবিদ কুনিও হোশিওকে হত্যা করা হয় উত্তরাঞ্চলের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। আমার অবস্থানের মাঝামাঝি সময়কালে ঢাকায় শিয়া সম্প্রদায়ের এক সমাবেশে কঠিন নিরাপত্তা সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয় যার ফলে শতাধিক মানুষ আহত হয়। আইসিস এই ঘটনারও দায়িত্ব স্বীকার করে।

ইনু এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করেন ধর্মীয় উগ্রবাদীদের এবং জামায়াতের সঙ্গে তাদের সংযোগ আছে বলে মনে করেন। ইনু বলেন, জামায়াতের একটি গোপন সংস্থা আছে, "প্রায় সাত থেকে আট হাজার জামায়াত সদস্যকে আফগানিস্তানে পাঠানো হয়েছিল যখন বিন লাদেন ওখানে ছিল, এদের সবাইকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এবং এরা এখন দেশে ফিরে এসেছে। (এই বক্তব্যের– প্রায়শই যা সরকারের তরফ থেকে দেওয়া হয়– কোনো সময়ই প্রমাণীকরণ হয়নি) অন্যরাও সুন্নি বিপ্লবের প্রস্তুতি নিচ্ছিল'', ইনু বলেন, "শিয়াপন্থীরা নিপাত যাক, হিন্দুরা নিপাত যাক, এই হল তাদের স্বপ্রচার।"

সরকার জোর দিয়ে বলতে চায়, যদিও স্থানীয় সন্ত্রাসী দলগুলো আল কায়েদার আদর্শে উদ্ধুদ্ধ হতে পারে, আইসিসের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। যদিও আইসিসের দাবিগুলো সঠিক কি না কোনো সময় যাচাই করা হয়নি। কিন্তু আইসিসের ইংরেজি ভাষার সাময়িকপত্র দাভিকে 'বাংলাদেশে জিহাদের পুনরুত্থান' শীর্ষক এক প্রবন্ধে বলা হয়, বাংলাদেশের যোদ্ধারা 'আরও আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে।' এক আকর্ষণীয় অডিও ফাইল রেকর্ডিংএর মাধ্যমে সাউন্ড-ক্লাউডের শ্রোতাদের বাংলা ভাষায় গানের সুরেলা কণ্ঠে জেহাদে যোগদান ও খিলাফত প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানানো হয়।

হতে পারে আইসিস স্থানীয় ইসলামপন্থীদের নিজেদের লোক বলে দাবি করছে। মানবাধিকার আইনজ্ঞ সারা হোসেন আমাকে বলেন, এই দলগুলোর কর্মকাণ্ড বাংলাদেশে ধর্মীয়বাদের উত্থান বলে চিহ্নিত করা যাবে কি না তা বলা কঠিন। কিন্তু তিনি এ-ও বলেন, "প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা বলি, আজকাল যত হিজাব, দাড়ি, বিশ বছরের তরুণ-তরুণীদের যত নামাজ পড়তে দেখি আমার বিশ বছর বয়সকালে আমি তা দেখিনি।"

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের অধ্যাপক আমেনা মহসিনের মন্তব্য আরও সুনির্দিষ্ট। "মানুষ মধ্যপ্রাচ্যে যায় আর ফিরে আসে নতুন চিন্তা-চেতনা নিয়ে", মহসিন বলেছিলেন, "দেশে ওয়াহাবিপন্থীদের অর্থের ছড়াছড়ি।"

মহসিন বলেন তাঁর বাসার কাজের মেয়ে কিছু দিন আগে তার গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিল। ''যখন ফিরে এল দেখলাম সে বোরকা পরা শুরু করেছে", মহসিন বললেন, "সে মনে করে বোরকা পরায় তার সামাজিক অবস্থান বেড়ে গেছে।"

তিনি বলেন, "চট্টগ্রামের কাছাকাছি ঐ এলাকায় কম-বেশি সবাই হেফাজতকে সমর্থন করে।"

অতীতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদরা মৌলবাদী ইসলাম নিয়ে এতই বাড়াবাড়ি রকম সাবধানবাণী প্রচার করেছে যে, ''ধর্মনিষ্ঠরা ভাবতে শুরু করেছিল ইসলাম আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছে।"

আমি ইনুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সরকার ব্লগারদের কোনো তালিকা প্রস্তুত করেছে কিনা। তিনি বলেছিলেন, 'অফিসিয়ালি তেমন কোনো তালিকা প্রস্তুত করা হয়নি।' তবে তিনি স্বীকার করেন, নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর কাছে সম্ভবত উস্কানিমূলক ব্লগ লেখকদের একটি তালিকা থাকতে পারে। তিনি অস্বীকার করেন যে, হেফাজতে ইসলাম সরকারকে এমন একটি তালিকা দিয়েছে তাদের নাস্তিক হত্যার দাবির অংশ হিসেবে– "হেফাজতের সঙ্গে আমাদের আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ নেই।"

একই সঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতকারীদের বিচার করা রাষ্ট্রের অবশ্য কর্তব্য। কিছু কিছু ব্লগার 'মহানবী মুহাম্মদের বিরুদ্ধে অশ্লীল মন্তব্য করে' অপরাধ করেছে।

ইনু যুক্তি দেখান সরকার যোগ্যতার সঙ্গেই এইসব হত্যাকাণ্ড সমাধানে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। ইনুর অফিস থেকে আমি পরে এই হত্যাকাণ্ডের হালনাগাদ পাই যাতে উল্লেখ ছিল: রায়ের মৃত্যুর জন্যে সাত জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, হায়দারের হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছয় জনের বিচারকার্যে সর্বমোট পঞ্চান্নটি শুনানির মধ্যে আঠারোটি সম্পন্ন হয়েছে, ইত্যাদি। কিন্তু রাফিদা আহমেদ আমাকে বলেছেন যে, পুলিশের তরফ থেকে এ পর্যন্ত কেউ তাঁর কাছে বক্তব্য নিতে আসেনি। অপর এক ব্লগারের স্ত্রী– যিনি অগাস্ট মাসে তার স্বামীকে তাদের বাসায় হত্যার সময় উপস্থিত ছিলেন– আমাকে বলেন, পুলিশ চার জনকে তার সামনে শনাক্ত করার জন্য হাজির করেছিল, কিন্তু তাদের মধ্যে কাউকে তার চেনা মনে হয়নি।

সব কিছু দেখে মনে হয় সরকার হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে তার অবস্থান প্রায়ই পরিবর্তন করছে। ২০১৩ সালে হায়দার যখন খুন হন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে শহীদ বলে উল্লেখ করেছিলেন। মুজিবকন্যা হাসিনা আওয়ামী লীগকে সংখ্যালঘুদের অভিভাবক এবং তাদের উদারপন্থী মূল্যবোধের রক্ষক হিসেবে প্রস্তুত করেছেন। কিন্তু তিনি যে প্রধানত একটি মুসলিম-অধ্যুষিত জাতির শাসক সে ব্যাপারেও সম্পূর্ণ সচেতন। চারটি মৌলিক নীতির মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা বাংলাদেশের সংবিধানে লিপিবদ্ধ ছিল। কিন্তু ১৯৭৭ সালে তা পরিবর্তন করে কোরানের আয়াত 'বিসমিল্লাহহির রহমানের রাহিম' সংযুক্ত করা হয়। ২০১০ সালে, হাসিনা সরকারের আমলে সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা পুনঃলিপিবদ্ধ করে। কিন্তু তবু সরকারের আইনমন্ত্রী বলেন কোরানের আয়াত সংবিধানে থাকবে।

অতি সম্প্রতি হাসিনা লেখকদের ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত করে কোনো কিছু না লিখতে উপদেশ দিয়েছেন। যদিও তিনি নিজে জনসমক্ষে রায়ের হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানাননি, তাঁর উপদেষ্টা ও পুত্র সজীব ওয়াজেদ রয়টারকে বলেন, "আমরা এক সূক্ষ্ম দড়ির উপর দিয়ে হাঁটছি। আমাদের কেউ নাস্তিক বলুক সেটা আমরা চাই না।"

অপর এক উপদেষ্টা আমাকে বলেন, "আমরা যদি মহানবী মুহম্মদের (সা.) নামে আপত্তিকর মন্তব্য লেখার অনুমতি দিই, জনগণ আমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।"

তিনি আরও বলেন, "সবাই ভাববে আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতার এটাই আসল রূপ। এই হল বাস্তবতা। এটা লন্ডন বা নিউইয়র্ক নয়। এটা ঢাকা।"

সেপ্টেম্বরে নিরাপত্তা কর্মকর্তারা মোহাম্মদ আবুল বাসারকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা হিসেবে গ্রেফতার করে। তার বড় ভাই আনসারউল্লাহর প্রতিষ্ঠাতা, ২০১৩ সালে হায়দারের হত্যার দায়ে গ্রেফতার হলে বাসার দলটি পরিচালনার ভার নেয়। আনসারউল্লাহ অবশ্য বাসারকে তাদের নেতা হিসেবে অস্বীকার করে। তারা সরকারের দাবি 'দুঃখজনক' বলে বাতিল করে দেয়।

দুই সপ্তাহ পর প্রতিষ্ঠানটি বিদেশে বসবাসরত বিশ জন লেখকের একটি নিজস্ব হত্যা-তালিকা প্রকাশ করে। তালিকায় তাদের নাম-ঠিকানা মুদ্রিত ছিল আইসিসের কালো পতাকা লোগোর নিচে। এই তালিকায় ২০১৩ সালে বিদেশে চলে যাওয়া বেশ কিছু ব্লগারসহ রাফিদা আহমেদের নামও আছে। অন্যরাও দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা করছেন।

এক সন্ধ্যায় শাম্মী হকের সঙ্গে আমার সাক্ষাত হয়। শাম্মী বাইশ বছরের তরুণী। তিনি ব্লগে ইসলামে এবং অপরাপর ধর্মে পুরুষদের কর্তৃত্বের বিষয়ে একটি সমালোচনামূলক বক্তব্য লিখেছিলেন। শাম্মী আমার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় বলেছিলেন তিনি আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে দেশ ছাড়ার আশা করছেন।

শাম্মীকে ভীষণ অসহায় ও নার্ভাস দেখাচ্ছিল। তিনি জানালেন প্রতি রাতে তাকে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে হয়। যতক্ষণ আমার সঙ্গে কথা বলেছেন, বারবার শঙ্কিতভাবে জানালার বাইরে তাকিয়েছেন। অনলাইনে তাকে অনেক বার হুমকি দেওয়া হয়েছে। অগাস্টের শেষাশেষি একদিন শাম্মী যখন সবজি কিনতে বাজারে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ লক্ষ্য করেন দুজন লোক তাকে অনুসরণ করছে।

"আমি একটু ঘুরপথে একটা শপিং মলে ঢুকে পড়ি। লক্ষ্য করলাম ওরা দুজনও আমার পিছু পিছু সেখানে হাজির," শাম্মী বললেন। সেখানে ভাগ্যক্রমে ওর এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা। বন্ধুটি লুকিয়ে ওই দুজনের ছবি তুলে নেন। শাম্মী ছবিটা পুলিশকে দেখান এবং তারপর থেকে পুলিশ তাকে নিরাপত্তা দিচ্ছে। "পুলিশ আমার সঙ্গে এখানেও আছে," তিনি বললেন, ''কিন্তু ওদের চিনিয়ে দেওয়া মানা।"

শাম্মীর বন্ধু নিলয় চ্যাটার্জি, চল্লিশ বছরের ব্লগার, যুক্তিবাদীদের নিয়ে সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। নিলয়ও মূল হত্যা-তালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। মে মাসের মাঝামাঝি যখন এক ব্লগার হত্যার প্রতিবাদ র‌্যালি শেষে বাসায় ফিরছিলেন, তখন লক্ষ্য করেন, দুজন লোক তাকে অনুসরণ করছে। পুলিশের কাছে এ ব্যাপারে অভিযোগ করতে গেলে তাকে বলা হয়, 'দেশ ছেড়ে যত দ্রুত পারেন চলে যান।'

চ্যাটার্জি বিষয়টা ফেসবুকে লিখেছিলেন। পুরো গ্রীষ্মকাল চ্যাটার্জি নিস্কর্ম বসে থেকেছেন। এমনকি তার পৈত্রিক গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দুসপ্তা ছিলেন। ঢাকায় ফেরার কয়েক দিন পরেই এক অলস শুক্রবারের বিকেলে তিনি, তার স্ত্রী আশামণি এবং তার বোন তাদের ফ্ল্যাটের বসার ঘরে ছিলেন। চার জন লোক চাপাতি হাতে সেখানে ঢুকে পড়ে। চ্যাটার্জিকে হত্যা করার আগে তারা তার বোনদের জোর করে ব্যালকনিতে পাঠিয়ে দেয়। আশামণি আমাকে জানান, বসার ঘরে আবার ফিরে এলে দেখতে পান, 'জায়গাটা রক্তে ভেসে যাচ্ছিল।' একজন ঘাতক তার রক্তমাখা জামাটি অ্যাপার্টমেন্ট গেটের কাছে ফেলে রেখে তার ব্যাগ থেকে একটি নতুন জামা বের করে পরে অন্য সহযোগীদের সঙ্গে অপেক্ষমান অটোরিক্সা করে পালিয়ে যায়।

আশামণি কিছু দিনের জন্যে একটি এনজিওর অফিসের একটা বাড়তি ঘরে থাকেন। ঘাটের উপর অর্ধেক খোলা একটা পশমের ব্যাগ পড়ে ছিল। প্লাস্টিকের একটা চেয়ারে আশামণি বসে ছিলেন। সালোয়ার কামিজের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক। ডান হাতের বুড়ো আঙুলের একটি ক্ষতস্থানে হাত বুলাচ্ছিলেন। "গতকাল হাত কেটে ফেলেছি, বেশ ব্যথা লাগছে," তিনি বললেন, "ভাবলাম, নিলয় তাহলে কতটা ব্যথা পেয়েছিল।"

"নিলয় ভাবত আমাদের বাড়িটা খুবই নিরাপদ", আশামণি বলে চলেন, "কিন্তু এখন কোনো জায়গাই আমার কাছে নিরাপদ মনে হয় না।"

আশামণি দেশ থেকে পালিয়ে যেতে চান। কিন্তু রিফিউজি হতে তার ভালো লাগে না। "আমরা মুক্তচিন্তার মানুষরা যদি দেশে না থাকি, দেশ ছেড়ে চলে যাই ওই সব মৌলবাদীদের কাছে হেরে, তাহলে ওরাই তো দেশ চালাবার ভার তুলে নেবে নিজেদের হাতে। ওরাই তো জিতবে। কেন ওদের হাতেই সব ছেড়ে দেব?"