শহীদের সংখ্যা-বিতর্ক: প্রয়োজন ডিনায়াল ল

মোজাম্মেল খানমোজাম্মেল খান
Published : 23 Dec 2015, 10:23 AM
Updated : 23 Dec 2015, 10:23 AM

"মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে। বলা হয়, এত লক্ষ লোক শহীদ হয়েছে। এটা নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে যে, আসলে কত শহীদ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে। শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি। তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে মুক্তিযুদ্ধ হত না।"

হ্যাঁ, কথাগুলো বলেছেন একটি বড় রাজনৈতিক দলের প্রধান খালেদা জিয়া যিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানের সেনা ছাউনিতে ছিলেন এবং তাঁর সাধের পাকিস্তান ভাঙার জ্বালা এখনও ভুলতে পারেননি। বহু আলোচিত যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে নিজের আগের বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করে তিনি বলেন:

"যারা প্রকৃত রাজাকার, যারা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সত্যিকারভাবে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করেছে, অত্যাচার করেছে, হত্যা করেছে, তাদের শাস্তি হতে হবে, বিচার হতে হবে। তবে তাদেরকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। সেই বিচার আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ও স্বচ্ছ হতে হবে।"

হ্যাঁ, তিনি সেই সরকারপ্রধান যিনি সব প্রটোকল ভঙ্গ করে মুক্তিযুদ্ধকালীন সেই বিভীষিকাময় সময়ে দখলদার বাহিনীর যে সামরিক অফিসার তাঁকে, মানে 'স্বাধীনতার ঘোষকের' স্ত্রীকে 'রক্ষা' করেছিলেন, সে অফিসারের মৃত্যুতে শোকবাণী পাঠিয়েছিলেন। বিদেশের কিছু ভাড়াটিয়া প্রতিষ্ঠান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কে বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে ঠিক একই ধরনের বক্তব্য দিয়ে আসছে। দুবছর আগে খালেদা জিয়া 'ওয়াশিংটন টাইমস'এ যে নিবন্ধ লিখেছিলেন তাতেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কে তিনি যে অভিমত দিয়েছেন তার বর্তমান বক্তব্যেও সেটারই হুবহু প্রতিফলন ঘটেছে।

২০০৭ সালের ৩ ডিসেম্বর উলফাত আজিজ নামের এক সাহসী মুক্তিযোদ্ধা যখন 'জাতীয়তাবাদী' দীক্ষায় দীক্ষিত হননি তখন এক মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ করে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের দাবি জানিয়েছিলেন। সেদিন তিনি এ-ও বলেছিলেন যে, যারা এ বিচারের বিরোধিতা করবে বা বিচার নিয়ে প্রশ্ন তুলবে তাদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করা হবে। সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম নামের আরেক খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধাও ওই সভায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়ে জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়েছিলেন।

সেই একই উলফাত আজিজ ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর বিএনপিতে যোগদান করে 'জাতীয়তাবাদী' চেতনায় দীক্ষিত হলেন। খালেদা জিয়া যে সভায় উপরোক্ত বক্তব্য দিচ্ছিলেন, সেখানে গর্বভরে সভাপতিত্ব করছেন তিনিই।

১৬ ডিসেম্বর বঙ্গভবনে আমন্ত্রণ পেয়েও ঢুকতে পারেনি সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, এটা দুঃখজনক। কিন্তু আজকে খালেদা জিয়ার পাশে বসে যে ইব্রাহিম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সমালোচনা করে এবং শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাদের নেত্রীর অমৃতবাণী শুনলেন, তার কি বিজয় দিবসে বঙ্গভবনে আমন্ত্রণ পাওয়ার নৈতিক অধিকার রয়েছে?

বাকস্বাধীনতা নিঃসন্দেহে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা। এটা জনস্বার্থে জনগণের মাঝে বিভিন্ন এবং বৈচিত্র্যময় মতামত পরিবেশনে উৎসাহ দেয়। কিন্তু সব ধরনের স্বাধীনতার মতো এটা শর্তহীন নয় এবং সেটা উচিতও নয়। বাকস্বাধীনতা একদিকে অন্য কারও প্রতি ঘৃণা প্রকাশের সম্ভাব্য অস্থিতিশীল প্রভাব থেকে মুক্ত হতে হবে এবং অন্যদিকে, অন্যের আবেগ বা অনুভূতিতে যেন আঘাত না করে, সে ধরনের সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া দরকার। উপরন্তু, কানাডিয়ান বিচারপতি এম এ বাইন্ডারের ভাষায়, "মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অবশ্যই ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সত্যের কাছে আত্মসমর্পণ করবে।"

বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতা নেই বলে যারা চিৎকার করেন তারা কি জানেন পৃথিবীর কোন প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক দেশে সে দেশের স্বীকৃত ইতিহাস নিয়ে এ ধরনের বল্গাহীন বক্তব্য দিয়ে রাজনীতি করা যায়?

২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) মুক্তিযুদ্ধে অফিসিয়াল মৃতের সংখ্যা চ্যালেঞ্জ করে ইতিহাস অবমাননার অপরাধে ব্রিটেনে জন্মগ্রহণকারী সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানকে দোষী সাব্যস্ত করে। মাননীয় বিচারক ২০১১ সালের একটি ব্লগ পোস্টে ইচ্ছাকৃতভাবে ইতিহাস বিকৃত করার অভিযোগে বার্গম্যানকে অভিযুক্ত করেন। ওই পোস্টে তিনি একাত্তরে মৃতের সংখ্যা অনেক কম বলে মতামত দেন এবং সরকারি সংখ্যার সমর্থনে কোনো প্রমাণ নেই বলে উল্লেখ করেন।

ট্রাইব্যুনালের প্রিজাইডিং বিচারক ওবায়দুল হাসান ডেভিড বার্গম্যানকে দোষী সাব্যস্ত করে দেওয়া তাঁর রায়ে বলেন:

"মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সরল বিশ্বাসে এবং জনস্বার্থে প্রয়োগ করা যেতে পারে। ডেভিড বার্গম্যানের তন্ন তন্ন করে খুঁজে এ সংখ্যা চ্যালেঞ্জ করার পিছনে সরল বিশ্বাস ছিল না এবং এটা তিনি জনস্বার্থ রক্ষার জন্য করেননি।"

ট্রাইব্যুনাল পুনর্ব্যক্ত করেন:

"মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদের সংখ্যা ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং এটা বাংলাদেশের জনগণের 'আবেগের সঙ্গে জড়িত'।''

ট্রাইবুনাল এছাড়াও এই সংখ্যা (তিরিশ লক্ষ) ট্রাইব্যুনালের দেওয়া আগের আদালতের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করে বলেন:

"যে কেউ এই গবেষণা করতে পারেন, কিন্তু তাদেরকে ট্রাইব্যুনালের মর্যাদায় আঘাত হতে পারে এমন ধরনের কোনো মন্তব্য করার ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।"

তার প্রতিক্রিয়ায়, বার্গম্যান আইসিটি অর্ডার তার 'বাকস্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সঠিক যাচাই-বাছাই করতে আগ্রহীদের জন্য বড় উদ্বেগের বিষয়' বলে আখ্যায়িত করে বলেন, তিনি এ আদেশে মর্মাহত। এরপর, ২০ ডিসেম্বর দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় বার্গম্যানের শাস্তিতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে বলে ৫০ জন নাগরিক এক বিবৃতি প্রদান করেন। এ বছরের ১৪ জানুয়ারি আইসিটি-২ ওই বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীদের কাছ থেকে ব্যাখ্যা দাবি করেন। আদালত তার আদেশে 'জনগণের সামনে ট্রাইব্যুনালের প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা ও মান খর্ব করার জন্য' এ বিবৃতি দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। আদালতের দৃষ্টিতে আরও মনে হয়েছে, বিবৃতিতে 'ট্রাইব্যুনালের শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা ও বার্গম্যানকে প্রদত্ত শাস্তির আদেশের যৌক্তিকতা নিয়ে' প্রশ্ন তোলা হয়েছে।

পরে ট্রাইব্যুনালের ২৬ জন বিবৃতিদাতা নিঃশর্তভাবে ক্ষমা চাওয়ায় তাদেরকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেও য়া হয়। অন্য ২২ জনকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় তারা প্রথমবারের মতো আদালত অবমাননা করেছিলেন বলে। কেবল জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে, যিনি ১৯৭১ সালে ঘটনাক্রমে ইতিহাসের সঠিক দিকে অবস্থান নিয়েছিলেন, দোষী সাব্যস্ত করে এক ঘণ্টার জন্য আদালতেই গ্রেফতার করে শাস্তি প্রদান করেন আইসিটি। সঙ্গে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে এক মাসের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। জাফরুল্লাহ চৌধুরী এ সাজার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন। উচ্চ আদলত এ সাজা বহাল রাখলে উনাকে ট্রাইব্যুনালে এসে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে সাজা থেকে নিস্কৃতি পেতে হয়।

জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সাজার পর আদালতে তিনি চরম অভদ্রতার প্রকাশ ঘটান। বিবৃতির প্রায় সব স্বাক্ষরদাতাই বার্গম্যানের ব্লগে কীভাবে আমাদের শহীদের সংখ্যা নিয়ে তাচ্ছিল্য করা হয়েছে, তিনি কীভাবে ট্রাইব্যুনালকে উপদেশ দিয়েছেন, তাদের কী করা উচিত এবং কী করা উচিত নয় (ভাবখানা বাংলাদেশ এখনও ব্রিটিশ কলোনি) এবং বার্গম্যানের সাজার রায় না পড়ে এবং সেটা বিন্দুমাত্র না জেনেই 'মতপ্রকাশের স্বাধীনতার' সপক্ষে বিবৃতি দিয়েছিলেন। এ প্রেক্ষিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।

এ সময় ইউরোপের ১৪টি দেশে প্রচলিত 'হলোকস্ট অস্বীকারের বিরুদ্ধে আইন'এর মতো 'গণহত্যা অস্বীকারের বিরুদ্ধে আইন' প্রণয়নের দাবিও তোলা হয়। ওই সব আইন অনুযায়ী, ১৯৩০ ও ১৯৪০এর দশকে নাৎসি জার্মানির দ্বারা ইউরোপে সুপরিকল্পিত জাতিগত সংখ্যালঘু হত্যার ঘটনা অস্বীকার করা আইনের লঙ্ঘন।

অনেক দেশে গণহত্যা অস্বীকার অপরাধ হিসেবে গণ্য করে বৃহত্তর আইনও হয়েছে। বেলজিয়ামে হলোকস্ট অস্বীকার ১৯৯৫ সালে অবৈধ হয়েছে। সেখানকার আইনে শর্ত দেওয়া হয়েছে, "দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান জাতীয় সমাজতান্ত্রিক শাসকদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যা অস্বীকার করা, একে নগণ্য বলা বা এতে ন্যায্যতা দেওয়ার প্রচেষ্টা করা হলে সে ব্যক্তি দণ্ডিত হবেন।"

জার্মানিতে 'প্রকাশ্যে বা জনসভায় জাতীয় সমাজতন্ত্রীদের শাসনাধীনে সংঘটিত অপরাধ অস্বীকার, লঘুকরণের প্রচেষ্টা বা অনুমোদন দেওয়া' দণ্ডনীয় অপরাধ। হাঙ্গেরির সংসদে হলোকস্ট অস্বীকার বা লঘুকরণের প্রচেষ্টা তিন বছর পর্যন্ত দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নে সরাসরি হলোকস্ট অস্বীকার নিষিদ্ধ না হলেও, গণহত্যা অস্বীকার, লঘুকরণের প্রচেষ্টা বা অনুমোদনের অপরাধে তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান সব সদস্য রাষ্ট্রকে ঐচ্ছিকরূপে প্রয়োগ করার অধিকার দেওয়া হয়েছে।

অনেকেই বাকস্বাধীনতার নামে কোনো এক বিশেষ উদ্দেশ্যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সংখ্যা নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছেন। এটা সুচতুরভাবে আমাদের জনগণের উপর সংগঠিত অপরাধের যৌক্তিকতা দানের প্রয়াসও বটে। আইসিটির মর্যাদা ও যৌক্তিকতা কমিয়ে এর বিচারপ্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ করার এক দুষ্ট অভিপ্রায়ও একে বলা যেতে পারে।

বর্তমান সরকার জনসাধারণের দীর্ঘ লালিত চাহিদার প্রতিফলন ঘটিয়ে একাত্তরে সংঘটিত গণহত্যার বিচার চালিয়ে যাচ্ছেন। একইভাবে জনগণের আরেকটি 'আবেগলালিত' দাবি হল, ইউরোপীয় দেশগুলিতে প্রণীত 'হলোকাস্ট অস্বীকারের বিরুদ্ধে আইন'এর আদলে 'গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির বিরুদ্ধে আইন' প্রণয়ন করবে এই সরকার যাতে ভবিষ্যতে আমাদের শহীদের সংখ্যা ও ত্যাগ কেউ অস্বীকার বা লঘু করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত হতে না পারে।

প্রস্তাবিত এ আইন কে কত বড় দলের নেত্রী সেটা বিবেচনায় না নিয়ে প্রত্যেক আইন ভঙ্গকারীর ক্ষেত্রে সমভাবে প্রয়োগ করা হবে। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ত্বের জন্য খেতাবপ্রাপ্ত কোনো মুক্তিযোদ্ধাও যদি আইন ভঙ্গ করেন, তবে তাদের সে খেতাব স্থগিত বা বাতিল করার বিধান এ আইনে রাখা যেতে পারে।

এমনটি কর গেলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে বিরাট ঢাল হিসেবে কাজ করবে এ আইন। সেটা শুধুমাত্র বর্তমান প্রজন্মের জন্য নয়, ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্যও আমাদের গৌরবময় ও স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাসের শান্তি, সত্য ও সততা প্রতিষ্ঠা করবে।

মোজাম্মেল খান: কানাডা-প্রবাসী অধ্যাপক।