জন্মদিনের চিঠি

শারমিন আহমদ
Published : 23 Dec 2015, 06:30 PM
Updated : 23 Dec 2015, 06:30 PM

আমার বারোতম জন্মদিনের একটি উপহার ছিল 'সুকান্ত সমগ্র'। পরাধীন ভারতের এক মুক্তিপিয়াসী এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে অন্তঃহীন বিদ্রোহী সুকান্তর কবিতাগুলি আমার মনে এতখানিই আলোড়ন তোলে যে, সেই জন্ম-উৎসবের রাতেই আমি কবিকে অভিনন্দন জানিয়ে এক চিঠি লিখে ফেলি। কবির ঠিকানা খুঁজতে গিয়ে জানতে পারি যে, এই প্রতিভাধর কবি মাত্র একুশ বছর বয়সে যক্ষ্মা ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করেছেন।

অনন্তলোকের কোনো অধিবাসীর কাছে লেখা আমার সেই প্রথম চিঠি আর পোস্ট করা হয়নি। তবুও কেন যেন সে সময় মনে হয়েছিল, সুকান্ত আমার চিঠিখানি পড়েছেন।

আমার আম্মা, সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন অমর্ত্যলোকবাসী হয়েছেন (২০ ডিসেম্বর, ২০১৩), দুবছর হল। ২৪ ডিসেম্বর, তাঁর ৮১তম জন্মদিনের চারদিন আগে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। তাঁর জন্মদিনের জন্যে নিয়ে আসা উপহারমালা আর তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয় না। সুদূর প্রবাসেও আসে না তাঁর আর কোনো চিঠি। তাঁর কাছে লেখা আমার অগুণতি চিঠি হৃদয়ের মুক্ত পাতায় কেবলি জমা হতে থাকে, প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ। আমার বিশ্বাস, সেই মুক্তিপাগল কবির মতোই তিনিও আমার চিঠিগুলি ঠিক ঠিকই পড়েছেন। অনন্তর ডাকঘরে প্রেরিত, তাঁর জন্মদিনের জন্যে লেখা, আজকের এই চিঠিও।

প্রিয় আম্মা,

শুভ জন্মদিন।

পৌষ মাসের পিঠার উৎসব এবং নরম শীতের আমেজ ভরা দিনটিতে আপনি পৃথিবীতে এলেন। আপনার নানির হাতে-বানানো সবুজ উলের জামাটির মধ্যে দিয়ে আপনার হংস-ধবল কোমল মুখখানি ফুটে রইল আলোকিত পদ্মের মতো। সেই জামাটি আমি ফ্রেমে বাঁধিয়ে রেখেছি। যতবারই ঐ পুতুলের মাপের জামাটির দিকে তাকাই, ততবারই মনে হয়, 'সৃষ্টির এ কী লীলাখেলা! আমার আম্মা কি এতটুকু বাচ্চা ছিল!' ঠিক যেমন আমার শিশুকালের ছবিগুলো দুহাতে ধরে আপনি স্নেহ-বিস্ময়ের আবেগতাড়িত কণ্ঠে বলতেন, 'রিপি কেমন করে বড় হয়ে গেল!'

আমার ধারণা, বসন্ত ঋতু যখন গ্রীষ্ম পেরিয়ে হেমন্তর দুয়ারে পৌঁছে, তখন মায়েরা আবারও হয়ে যায় শিশু আর মেয়েরা মা। সে কারণেই বোধহয় আমার প্রথম প্রকাশিত বই (হৃদয়ে রঙধনু) যা আপনাকে উৎসর্গ করি, তাতে রয়েছে আনন্দ গ্রহের অধিবাসী সেই মেয়ের গল্প, যে তার জন্মের আগেই খুঁজছে এক আদর্শ মাকে যিনি সন্তানকে দেবেন জ্ঞানের শক্তি ও শান্তির ঠিকানা।

নানা-নানি আপনার ভালো নাম রেখেছিল 'জোহরা'। আরবিতে যার অর্থ 'ফুটন্ত ফুল' বা 'জগতের ফুল'। ডাক নামেও ফুলের সুবাস। আমার ফুলের টব দুটি যখন সাদা লিলি ফুলে ভরে গেল তখন আমার সে কী আনন্দ! আমার প্রতিবেশি অ্যানি জিজ্ঞেস করল, ''তুমি লিলি ফুল এত পছন্দ কর!''

আমি বললাম, "লিলি আমার মায়ের ডাক নাম, আর সাদা তাঁর সবচেয়ে প্রিয় রঙ। আমার বাবার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছিল সাদা বেলি ফুলের গয়না পরে এবং বেলি ফুলের মালা বদল করে। আমার মা সোনার গয়না চাননি, চেয়েছিলেন শুভ্রতার প্রতীক সাদা বেলি ও তার সৌরভ।"

অ্যানি বিমুগ্ধ চিত্তে সে কথা শুনে বলল, "কী রোম্যান্টিক! কী অনন্য তোমার মা!''

আসলেই কী মহাভাগ্যই না আমাদের ভাইবোনদের, এমন অনন্য মা ও বাবার সন্তান হতে পেরে। আমার ধারণা, অনন্য তারাই যাদের বিশাল দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না অতি-ক্ষুদ্র ও নগণ্যর ব্যথা; মহৎ আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্দ্বিধায় যারা করেন আত্মত্যাগ এবং আত্মউন্নয়নের সুকঠিন সংগ্রাম আব্যহত রাখেন আজীবন। এমন মানুষেরাই হতে পারেন ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের আলোকিত পথনির্দেশক।

জাতির এক মহাদুর্যোগকালে আব্বু, তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সফল নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আর নেতৃত্বর চরম সংকটকালে (স্বাধীনতার বিরুদ্ধ শক্তির হাতে বঙ্গবন্ধু এবং আব্বুসহ চার জাতীয় নেতার নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর) আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের দায়িত্ব যখন আপনার কাছে ন্যস্ত হয়, তখন আপনি অসামান্য ত্যাগ, নিষ্ঠা, সাহস ও সততার সঙ্গে সেই দায়িত্ব পালন করেন। আপনি ছিলেন দুর্দিনের কাণ্ডারি এক অসাধারণ নারী। আপনি যে দৃষ্টি দিয়ে জীবনকে দেখতেন তা আমাদের জীবনসংগ্রামের মহত্তম সাথী হতে পারে; জীবনের ক্ষুদ্র পরিধিকে করতে পারে বৃহত্তর ও অর্থবহ।

আমার জন্মদিনে আপনার লেখা এই চিঠিটি সেই বৃহৎ জীবনবোধেরই এক সুগভীর প্রতিফলন।

"প্রিয় মা রিপি,

আমার ভালোবাসা, দোয়া প্রাণভরে তোমাকে জানালাম। তোমার জন্মদিন এসে গেল ২৯ ফেব্রুয়ারি, '৯২। আল্লাহ সর্বদিকে তোমার মহাকল্যাণ করুক, মঙ্গল করুক। এই কিছুমাত্র ক্ষণস্থায়ী জগতের কত লীলা খেলা দেখলাম, বুঝলাম, শুনলাম। মনের গভীরে উপলব্ধিবোধের তাগিদ অনুভব করছি। সেই সংগ্রামে একাকার হয়ে যাবার আকাঙ্ক্ষায় লালায়িত আমি। সে আর এক মহাজগত। এই জগতে বসবাস করেও তীক্ষ্ণ চেতনায় সেই জগতে অনুপ্রবেশ করা যায়। লক্ষ্য সে দিকেই, সে পথেই এগিয়ে নেবে।''

— তোমার আম্মা।''

অন্যত্র আর একটি চিঠিতে লিখেছিলেন:

"আত্মাকে প্রতিটি মহান কাজে নিয়োজিত রাখার সংগ্রামই প্রকৃত মানবজীবনের সংগ্রাম।"

নিঃস্বার্থ সেবা যে সেই মহৎ কাজেরই অবিছেদ্য অঙ্গ তার অগুণতি উদাহরণ তো আপনি প্রতিনিয়ত নিজ কাজের মধ্যেই রেখে গিয়েছেন। জাতি-ধর্ম-শ্রেণি-বর্ণের উর্ধ্বে মানুষকে আপনি কেমন অনায়াসেই আপন করে নিতেন। আপনার হাতের অতুলনীয় রান্নার স্বাদ এবং আপনার মমতাভরা নিজ হাতে পরিবেশনের স্মৃতি সাধারণ ও অসাধারণ সকলের মনই ছুঁয়ে যেত। আমাদের পুরো বাড়িটি ছিল গরিব-দুঃখী ও আর্তের ভরসাস্থল।

ছোটবেলায় আমি ছিলাম দুরন্ত, চঞ্চল। আমাকে শান্ত করার একটি উপায় ছিল, গল্প বলা। আর গল্পের ফাকে ফাঁকে আমাকে খাইয়ে দিতে পারলে তো কথাই নেই। সিংহ রাজা ও ময়না পাখির গল্প হতে, দেশ-বিদেশের কাহিনি, ইতিহাস কিছুই বাদ পড়ত না আপনার মনোমুগ্ধকর কথার ছন্দে। স্বদেশ-ভাবনা ও বিশ্বের সঙ্গে সেতুবন্ধন আমার হয়েছিল ওই গল্পগুলোর মধ্যেই।

ফুল, পাখি, প্রকৃতি ও প্রেমকে একই নিবিড়তায় ধারণ করে আমাদের জন্যে আপনি রেখে গেলেন নিজেকেই।

অনন্ত ভালোবাসা।

— আপনার স্নেহের রিপি।

সিলভার স্প্রিং, ম্যারিল্যান্ড

২১ ডিসেম্বর, ২০১৫