যুদ্ধাহতের ভাষ্য: ৪৩ ‘দেশের জন্য রক্ত না দিলে কি রক্তের মর্ম বুঝবে’

সালেক খোকনসালেক খোকন
Published : 13 Dec 2015, 09:15 AM
Updated : 13 Dec 2015, 09:15 AM

''আমগো সংসারডা ছিল বড়। পাঁচ ভাই-বোন। আমি তিন নম্বর। বাপের জমিজমা ছিল না। মাইনসের জমিত ঘর তুলি থাকতাম। ফুলমতি গ্রামের মেম্বার ছিল আবদুল জব্বার। উনি থাহনের জায়গা দেয়। বাবা মাইনসের খেতে হালটাল বইত। আগাছা তুলত। মায়েও অন্যর বাড়িত কাম কইরা আমগো খাওয়াইত।''

''বার-তের বছর হইলে আমিও কাজ করি। কফুর আলী, সিরাজ, আবুল, উনাদের গরু চড়াইতাম। মাঠে গরু ছাইড়া দিয়া হাডুডু আর গোল্লাবাড়ি খেলতাম। ধরলা সাঁতরাইয়া গোরকমন্ডল চর, খলিমাড়ির চরে গিয়া উঠতাম। গরুর লেজ ধইরা নদী পার হইয়া আবার ফিরা আসতাম।''

''দুই বছর খাটছি বিনা পয়সায়। খালি খাবার আর কাপড়চোপড় দিত। এরপর আবুল মিয়া দেয় বছরে একশ টাকা। পরে বাইড়া হইছে তিনশ। কিন্তু কামও বাড়ে। সঙ্গে হাল চাষও করতে হইত।''

''আমগো দিন গেছে অভাবে। কুনু দিন ভাত খাইতে না পারলে আটার জাউও খাইছি। তহন মঙ্গা ছিল। কার্তিক মাস আইলেই কাজ নাই। ইউনিয়নের মধ্যে নঙ্গরখানা খুলত। রান্না কইরা খিচুড়ি দিত। এহন তো মঙ্গা নাই। থাকলেও মাইনসে কেয়ার করে না। কামের সুযোগ আছে। গার্মেন্টের কামে লোক শহরে চইলা যায়। নদী ভাঙ্গায় এহন কিছু সমস্যা হয়, কিন্তু মঙ্গা হয় না।''

শৈশব ও কৈশোরের নানা স্মৃতির কথা এভাবেই বলছিলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ হাফিজ আলী শেখ। তাঁর পিতার নাম মোহাম্মদ কাজিম আলী শেখ এবং মাতা রহিতুন নেছা। বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ি উপজেলার ফুলমতি গ্রামে। এক সকালে আমরা পা রাখি তাঁর গ্রামের বাড়িতে, যুদ্ধদিনের গল্প শুনতে। হাফিজ শেখ তখন ছিলেন গ্রামের একজন সাধারণ খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ। রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। কিন্তু জীবনসংগ্রামী এই মানুষটির জীবনপ্রবাহ পাল্টে দেয় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। গ্রামের শমসের আলীর রেডিওতে ভাষণটি শোনেন তিনি। বঙ্গবন্ধু বললেন, 'রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দিব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব…।' এখনও এই ভাষণ তাঁকে আনমনা করে দেয়। শুনলেই উদ্দীপনায় দাঁড়িয়ে যায় শরীরের লোমগুলো।

[যুদ্ধদিনের গল্প বলছেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ হাফিজ আলী শেখ:

তাঁর ভাষায়: ''ওইখান থাইকাই সাহস হইয়া গেল। শেখের লাইগাই তো যুদ্ধে গেছি। আর দেশও স্বাধীন হইছে।''

কথার পিঠে আমাদের কথা চলে। মুক্তিযোদ্ধা হাফিজ জানালেন মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববতী সময়ের নানা ঘটনার কথা–

''তহন জয়নাল মন্ডলের বাড়িত চাকর খাটি। তার শালি সোনাবান বেগমকে দিয়াই উনি আমায় বিয়া করান। যুদ্ধ তহন বাধি গেছে। কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর থাইকা লোকজন বাড়িঘর ফালাইয়া আমগো গ্রামে আশ্রয় নেয়। গ্রামটা ছিল নদীর ওপারে। আমরা নৌকা দিয়া লোকজন পাড় করি। মানুষের কান্না আর কষ্ট দেইখা তহন মন খুব খারাপ হইত।''

মুক্তিযোদ্ধা হাফিজ আলী ওই সময় ব্যবসার জন্য দুইশ টাকা পান জয়নালের কাছ থেকে। ভারতের বর্ডার তখন খোলা। কুচবিহার থেকে চাল, আটা, লবণ কিনে এনে তিনি বিক্রি করতেন নাওডাঙ্গা বালারহাটে। কিন্তু সেই ব্যবসায়ও তাঁর লাভ হয় না। তাঁর ভাষায়:

''নতুন বেপসিক। সবাই চইলা যায় পুরানদের কাছে। মাইনসে ৫ সের বেচলে আমি বেচি ১ সের। দুইএকজনরে এমনি দিয়া দেই। তাই লাভ হয় না।''

মুক্তিযুদ্ধে গেলেন কোন সময়টায়?

হাফিজ আলীর উত্তর:

''১৯৭১এর জুলাই মাস তহনও শেষ হয় নাই। আমগো ওইখানে আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন ইউনুস সাব। বালারহাটে টিনপিটা দিয়া তিনি একদিন কইলেন, 'মুক্তিযুদ্ধে যারা যাইবেন যোগাযোগ করেন।' সব ফালায়া এক রাইতে আমি ঘর ছাড়ি। নতুন বউ জানলে কান্নাকাটি করব। তাই তারে বইলা যাই নাই। পায়ে হাইটা বর্ডার পার হইয়া চইলা আসি ভারতের গিতালদা বাজারে। সঙ্গে ছিল চল্লিশ টাকা। রাত পোহালে বাসে কইরা চইলা যাই দিনহাটা ইয়ুথ ক্যাম্পে। বয়স তহন ২২ বছর। নাম লিখাইতে একটা থাল আর চাদর দিল। ওখানে খাই দাই আর দৌড়াদৌড়ি করি। ১৫ দিন পর আমগো নিল কুচবিহারে। পরে টাপুরহাট হয়ে পাঠায়া দিল শিলিগুড়ি মুজিব ক্যাম্পে। ২৫ দিন চলে ট্রেনিং। রাইফেল, স্টেনগান, এলএমজি চালানো শিখায় ভারতীয় শিখরা। আমগো কোম্পানির কমান্ডার ছিল নাজমুল হুদা।''

কোথায় কোথায় অপারেশন করলেন?

তিনি বলেন, ''অস্ত্র দিয়া পাঠায়া দেয় ৬ নং সেক্টরে, ভুরুঙ্গামারির সাহেবগঞ্জে। মেজর নওয়াজেশ ছিলেন ক্যাম্পের দায়িত্বে। ৭ দিন পর যাই বাকভান্ডার গ্রামে। ওখানে ডিফেন্সেরও একটি দল ছিল। বিডিআরের আরব আলী সুবেদার আর লেফটেন্যান্ট সামাদ সাহেব কমান্ড করতেন। গেরিলা ছিলাম। আগে খোঁজখবর নিয়া রাস্তাঘাটের নকশা আঁকতাম। অপারেশন হইত রাতে। হুইসেল দিয়া আমগো রাতে উঠাইত। তহন মার্চ করতাম রেইকি ম্যানের সঙ্গে সঙ্গে। অন্য রাস্তায় যাওয়ার অনুমতি ছিল না। অপারেশন করি তিনটা, ভুরুঙ্গামারী থানা, জয়মনিরহাট আর রায়গঞ্জ ব্রিজে।''

অপারেশনের বর্ণনা শুনি মুক্তিযোদ্ধা হাফিজ আলীর জবানিতে। তাঁর ভাষায়:

''ভুরুঙ্গামারী থানায় পাকিস্তানি আর্মিদের শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। আমরা তিনটা কোম্পানি একসঙ্গে সেখানে অপারেশন করি। ওরা টিকতে পারে না। ভুরুঙ্গমারী থানা দখলের পর জয়মনিহাটের দিকে এগোই। ওখানে কাস্টমসে ছিল ওগো ক্যাম্প। আমরা তিনটি কোম্পানি এক হয়ে মার্চ করি। কাভারিং কোম্পানি, ফায়ারিং কোম্পানি আর ভারতীয়রা ব্যাকিং কোম্পানি। আমি ছিলাম ফায়ারিং কোম্পানিতে। খুব সহজে আমরা জয়মনিরহাট দখলে নিই। অতঃপর দুইদিন রেস্ট। এর মধ্যে আরেক কোম্পানি দিঘলটারি গ্রাম দখলে নিয়ে বাঙ্কার বসায়। আমরাও তখন ওখানে পজিশন নিই। পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে রায়গঞ্জ ব্রিজের ওপারে ঘাঁটি গাড়ে।''

এক অপারেশনে মারাত্মকভাবে রক্তাক্ত হন মুক্তিযোদ্ধা হাফিজ আলী শেখ। পাকিস্তানি সেনাদের পুঁতে রাখা মাইনের আঘাতে উড়ে যায় তাঁর বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচের অংশ। ফলে পঙ্গুত্ব মেনে নিয়েই কেটে যাচ্ছে এই যোদ্ধার জীবন। ক্র্যাচ আর কৃত্রিম পা-ই তাঁর একমাত্র ভরসা।

কী ঘটেছিল রক্তাক্ত ওই দিনটিতে? প্রশ্ন শুনে আনমনা হন হাফিজ আলি। নানা কষ্ট ভর করে তাঁর মনে। করুণ একটা ছাপ ফুটে ওঠে তাঁর চোখে-মুখে। অতঃপর তিনি বলেন:

''দিঘলটারিতে থাকতেই নির্দেশ আসে রায়গঞ্জ ব্রিজ অপারেশনের। দুধকমল নদীর উপর এ ব্রিজ। ওখানে পাকিস্তানি আর্মি আর রাজাকারদের ক্যাম্প ছিল। আমাদের গ্রামের কলিমুদ্দিন ও আবদুল ছিল নামকরা রাজাকার। ওরাও ছিল ওই ক্যাম্পে। ২৪ অক্টোবর, ১৯৭১। রাত পোহালেই ঈদ। আমরা এগোই রাত ৩টায়। ব্রিজের এপারে ছিল ঈদগাহ মাঠ। পরিকল্পনা ছিল অ্যামবুস করে বসে থাকব। ওরা সকালে ঈদের নামাজ পড়ে যখন ব্যাক করবে আমরা তখন ফায়ার দিব।''

''লেফটেন্যান্ট সামাদ ব্রিজের মাথায় এগিয়ে যায়। পেছন পেছন আমিও। হঠাৎ একটা কুকুর দেখে ফেলে আমাদের। ঘেউ ঘেউ করতেই ওরা বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়ে। সঙ্গে সঙ্গে একটা গুলি এসে লাগে সামাদ সাহেবের মাথায়। খানিক গোঙানি দিয়ে তার দেহ নিথর হয়ে মাটিতে পড়ে থাকে। তাকে আনতে আমি এগিয়ে যাই। রাস্তার পাশে কাঁচা রাস্তা। সেখানে পুঁতে রাখাছিল পাকিস্তানি সেনাদের মাইন। পা পড়তেই হঠাৎ বিকট শব্দ। আমি ছিটকে গিয়ে পড়ি রাস্তার নিচে।''

''তখনও বৃষ্টির মতো গুলি চলছে। মাঝে মধ্যেই ছড়াবাত্তি মেরে ওরা আমাদের অবস্থান দেখে নেয়। অতঃপর শুরু হয় আর্টিলারি নিক্ষেপ। কোনো কোম্পানিই পজিশন নিতে পারে না। তখনও বুঝি নাই পা নেই। আমি দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। কিন্তু না, বাঁ পা মাটিতে পড়ছে না। আমি কাত হয়ে পড়ে যাই। খেয়াল করে দেখলাম বাঁ পা উড়ে গেছে। পিনপিনিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। ভেবেছি মরে যাব। কাঁপতে কাঁপতে ঘাড়ে থাকা গামছা দিয়ে পা বেঁধে দিই। অতঃপর গড়িয়ে পেছনে সরে আসি।''

''সকালের দিকে আরও কয়েকটি দল এসে আমাদের উদ্ধার করে। রক্ত যেতে যেতে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। আমি জ্ঞান হারাই। যখন চোখ মেলি তখন জলপাইগুড়ি সামরিক হাসপাতালে। দেখলাম, বাঁ পাটা হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলা হয়েছে। সামাদ সাহেবসহ ৩ জন মারা গিয়েছিল ওই অপারেশনে। পরে চিকিৎসার জন্য আমাকে পাঠানো হয় পুনার খিরকি হাসপাতালে। ইন্দিরা গান্ধী ও তাজউদ্দিন আহমেদ দেখতে এসেছিলেন। হাসপাতালে বউয়ের কথা খুব মনে পড়ত। একদিন একজনকে দিয়ে চিঠি লিখেও গ্রামে পাঠিয়েছিলাম। সুস্থ শরীরে যুদ্ধে গেছি। ফিরেছি পঙ্গু হয়ে।''

নববধূকে ফেলে যুদ্ধে গিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা হাফিজ আলি শেখ। আমরা সে সময়কার অনুভূতি জানি তাঁর সহধর্মিনী সোনাবান বেগমের কাছ থেকে। তাঁর ভাষায়:

''স্বামীর যুদ্ধে যাওনের কথা শুইনা ভালো লাগে নাই। কিছুদিন তো তাঁর খোজই আছিল না। কান্নাকাটি করতাম। মাইসে কইছে বাইচা নাই। স্বাধীনের পর চিঠি পাইয়া আনন্দ লাগছে। বাইচা তো আছে। কিন্তু যহন ফিরল দেহি তার পা নাই। বাবা-মা আমায় দিবার চাইছিল না। আমি জোর করে গেছি। এক কাঁথাতে যদি ঝার যায়, সেটাই ভালো। বাঙালি মাইয়াদের তো বিয়া একবারই হয়।''

স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধা হাফিজ আলীর জীবনযুদ্ধের কাহিনি আরও করুণ আরও বেদনাদায়ক। বঙ্গবন্ধুর পাঠানো টাকায় কিছুদিন চললেও দেশের জন্য অঙ্গ দেওয়া এই মুক্তিযোদ্ধাকে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়েছে সস্ত্রীক নানা কাজ করেই। সে সংগ্রামের গল্প শুনি তাদের মুখে।

হাফিজ আলী বলেন:

''ও খাটত, আমি পঙ্গু হইয়াও খাটতাম। ও মাইনসের বাড়িত ধান বাড়ত। বঙ্গবন্ধুর অনুদানের টাকা দিয়া একটা গরু কিনছিলাম। গরুটাও বেইচা ফালায় ভাইয়েরা। এক পা নিয়াই ধরলা নদীত মাছ ধরতাম বাঁধ দিয়া। একদিন মাছ না ধরলে পেট চলত না। ৭৫ টাকা ভাতা, মাছ ধরা ও বউয়ের কাজ দিয়াই সংসার চলত।''

মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা বাড়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন:

''তালিকা বাড়ছে সবার দোষে। মন্ত্রী, মুক্তিযোদ্ধা, কমান্ডার সবাই টাকা খাইছে। ঘুষের যুগ। টাকা দিতে পারে নাই, তাই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হইয়াও সনদ পায় নাই। এমন ঘটনাও ঘটছে। উচিত হইত শেখ সাহেব থাকতেই তালিকা করা।''

যে দেশের জন্য রক্ত দিয়েছেন, সে দেশ কি মিলেছে?

মুচকি হেসে মুক্তিযোদ্ধা হাফিজের উত্তর:

''ওই দেশ কই। আগে তো চাকুরির যোগ্যতায় চাকুরি হইত। এহন হয় ঘুষের যোগ্যতায়। এমপি, মন্ত্রীরা চাকুরি দিত ভোটের কথা চিন্তা করে। এহন টাকা দেখে চাকুরি দেয়। ছোট ছেলেটা আইয়ে পাশ করার পর পুলিশে খাড়াইছিল। কুড়িগ্রামের জেলা কমান্ডার টুকু কইল চল্লিশ হাজার টাকা লাগব। পুলিশের বড় কর্তাদের দিতে হইব। ভাতার ওপর চলি। আমি তো টাকা দিতে পারব না। দিতে চাইলে ঘরবাড়ি বেইচাও হইব না। দেশটা তো এমন ছিল না!''

আগের নেতারা সৎ ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন:

''এহন স্বার্থবাদী নেতা বেশি। তাই আওয়ামী লীগের সময় অন্য দলের ছেলেদের চাকরি বেশি হয়। টাকা নাই, তাই দলে ভালো নেতারও গুরুত্ব নাই। আওয়ামী লীগকে ভালোবাসি, শেখ মুজিবকে ভালোবাসি। কিন্তু আওয়ামী লীগের এই সব নেতাদের ভালোবাসি না। এইসব নেতারা দলের জন্য ক্ষতিকর। এদের দলে না রাখাই ভালো।''

দেশ এখন কেমন চলছে বলে মনে করেন?

হাফিজ বলেন:

''অনেক ভালো চলছে। গরীবের জন্য দেশ এগোচ্ছে। গরীব কৃষকের সরকার আওয়ামী লীগ। কিন্তু দুর্নীতিটা শক্ত হাতে ঠেক্তিই হইব। নেতাদের অন্যায়েরও শাস্তি দিতে হইব।''

স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রী হয়েছিল রাজাকাররা। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তখনকার অনুভূতির কথা জানান তিনি। তাঁর ভাষায়:

''আমার মতো দেশের জন্য জিয়া তো পা হারায় নাই। তার পরিবারের কয়জন একাত্তরে শহীদ হয়েছে? দেশের জন্য রক্ত না দিলে কি রক্তের মর্ম বুঝবে? জিয়া প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হইলে কি রাজাকারগো মন্ত্রী বানাইতে পারত? সে ও তার দল তো দেশের ইতিহাসটাই পাল্টাইয়া ফালাইছে!''

স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর ভালোলাগার অনুভূতি জানতে চাই আমরা। উত্তরে মুক্তিযোদ্ধা হাফিজ আলী বলেন:

''দেশ স্বাধীন। মন্ত্রী, এমপিরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষ। বঙ্গবন্ধুর মেয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী। এটা ভাবলেই ভালো লাগে।''

খারাপ লাগে কখন?

''যখন দেহি ইসলাম রক্ষার নামে হুজুররা লাফালাফি করছে, মানুষ মারছে। ওইটা আবার কোন ধরনের মুসলমান, যে মুসলমান হইয়া আরেক মুসলমানরে চাপাতি দিয়া হত্যা করে। উচিত এদের শক্ত হাতে দমন করা।''

দেশে চিহিৃত রাজাকারদের বিচার হচ্ছে। দুদিন আগেও ফাঁসি হয়েছে রাজাকার মুজাহিদ ও সাকা চৌধুরীর। মুক্তিযোদ্ধাদের বুকে জমানো কষ্টগুলো ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। দেশে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে আইনের শাসন। মুক্তিযোদ্ধা হাফিজ মনে করেন এর পুরো কৃতিত্বটাই বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার। তাঁর মতে, ক্ষমতাধর রাজাকারদের বিচার এদেশে করা যাবে, এমনটা মানুষ স্বপ্নেও ভাবেনি। সেটা সম্ভব করেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের দোয়া তাঁর সঙ্গে থাকবে।

নতুন প্রজন্মের মাঝে যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থাকে, যদি দেশপ্রেম থাকে, তবে এদেশ একদিন অনেক উন্নত হবে– এমনটাই বিশ্বাস যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হাফিজ আলী শেখের। বুকভরা আশা নিয়ে নতুন প্রজন্মের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন:

''আমাদের রক্তের বিনিময়ে এ্ই দেশ স্বাধীন হইছে, এ্টই তোমরা ভুইলা যাইও না। দেশকে ভালোবাসবা। তোমাদের হাত দিয়াই সোনার বাংলা তৈরি হইব।''

সংক্ষিপ্ত তথ্য:

নাম: যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ হাফিজ আলী শেখ।

ট্রেনিং নেন: ২৫ দিনের ট্রেনিং নেন ভারতের শিলিগুঁড়ির মুজিব ক্যাম্পে।

যুদ্ধ করেছেন: ৬ নং সেক্টরে। ভুরুঙ্গামারী থানা, জয়মনিরহাট আর রায়গঞ্জ ব্রিজ এলাকায়।

যুদ্ধাহত: ২৪ অক্টোবর, ১৯৭১। রাত তখন ৩টা। কুড়িগ্রামে রায়গঞ্জ ব্রিজ অপারেশনের সময় রাস্তার পাশে পুঁতে রাখা পাকিস্তানি সেনাদের মাইনের আঘাতে উড়ে যায় তাঁর বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচের অংশ।

ছবি ও ভিডিও: সালেক খোকন।

সালেক খোকন: লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক।