‘পাকিস্তান শব্দটাই অরুচিকর’

Published : 4 Dec 2015, 05:42 PM
Updated : 4 Dec 2015, 05:42 PM

ভুল ধারণার উপর জন্ম নেওয়া পাকিস্তান নামক ব্যর্থ রাষ্ট্রটির ঔদ্ধত্য ও মিথ্যাচার কেবল আমাদেরকেই নয়, একাত্তরে তাদের বর্বর ভূমিকা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল যে কোনো দেশের নাগরিককেই বিস্মিত করবে তাদের রাষ্ট্রপক্ষীয় নির্লজ্জ বিবৃতি। শুধু রাষ্ট্রপক্ষই নয়, এমনকি সে দেশের 'জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান'ও রাষ্ট্রীয় সুরে গলা মিলিয়ে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায়ে।

পাকিস্তান একটি বিকারগ্রস্ত রাষ্ট্র। মনে পড়ছে মওলানা আবুল কালাম আজাদ 'পাকিস্তান'এর ধারণাটি 'অরুচিকর' বলে অভিহিত করেছিলেন। তাঁর যুক্তি ছিল এই যে:

"এ কথা স্বীকার না করে পারছি না যে, পাকিস্তান শব্দটাই আমার কাছে অরুচিকর। এ থেকে মনে হয় পৃথিবীর কতকাংশ শুদ্ধ আর বাকি সব অশুদ্ধ। শুদ্ধ আর অশুদ্ধ বলে এলাকা ভাগ করা ইসলাম-বহির্ভূত; এর সঙ্গে বরং সেই গোঁড়া ব্রাক্ষণ্যের মিল বেশি, যা মানুষ আর দেশকে শুচি আর ম্লেচ্ছে ভাগ করে– এই ভাগাভাগি ইসলামের আদত ভাবকেই নস্যাৎ করে। ইসলামে এ ধরনের ভাগাভাগির কোনো স্থান নেই এবং পয়গম্বরের বাণী হল, 'খোদা আমার জন্য সারা দুনিয়াকেই মসজিদ বানিয়েছেন।'"

[মওলানা আবুল কালাম আজাদ, 'ভারত স্বাধীন হলো'; ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান; প্রকাশকাল: ২০১০; পৃ: ১৩৮]

ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতির প্রাজ্ঞ পুরুষ মওলানা আজাদ থেকে এই উদ্ধৃতি দেওয়ার মাধ্যমে এটাই পরিষ্কার করে তুলে ধরা হচ্ছে যে, পাকিস্তান জন্ম থেকেই ভুল ও মিথ্যার ক্লেদে বন্দি একটি রাষ্ট্র। এমনকি যে-ইসলামি জিগির তুলে এর জন্ম, সেই ইসলামেরই ধারণার বিপরীতে তার অবস্থান।

পাকিস্তান নামক বর্বর ও অরুচিকর রাষ্ট্রটি সম্পর্কে কথা বলা মানেই ভাষিক রুচি বিসর্জন দিয়ে কথা বলা। কারণ, এটি এতই অসুস্থ ও উন্মাদ এক রাষ্ট্র যার সম্পর্কে খিস্তি ব্যবহার না করে কোনো বাস্তব ধারণা দেওয়া সম্ভব নয়।

১৯৪৭ সালে ভারত-ভাগের পর থেকেই পাকিস্তান এ-অঞ্চলের বাঙালি জনগোষ্ঠী সম্পর্ক অতিশয় হীন ধারণা পোষণ করত। সূচনা থেকেই এই জাতিকে শোষণ ও নির্যাতন করে এসেছে বাংলাদেশের অভ্যুদয় পর্যন্ত। একাত্তরে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তারা যে অপরাধ করেছে তা ইতিহাসে নজিরবিহীন। ভিত্তিও, আলোকচিত্র ও তথ্যাকারে তা পৃথিবীর নানান দেশে, নানান ভাষায় সংরক্ষিত আছে জেনেও পাকিস্তান গণহত্যার দায় অস্বীকার করার নির্লজ্জ মিথ্যাচার করেছে সম্প্রতি। এর আগেও তারা বিভিন্ন সময় এ ধরনের কাজ করেছে। আর কেবল এতেই তারা থেমে থাকেনি, এমনকি সভ্য রাষ্ট্রের সব রকম শিষ্টাচার উপেক্ষা করে তারা আমাদের অভ্যন্তরীন বিষয়েও নাগ গলানোর ধৃষ্টতা দেখিয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নিন্দা জানিয়ে। যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি পাকিস্তানের এই দরদ শুধু এটাই প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশকে নিয়ে তাদের ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে।

খুনী ও যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানের বিশ্বব্যাপী পরিচিতি অসভ্য ও প্রতিক্রিয়াশীল এক রাষ্ট্র হিসেবে। এটি এমন এক দেশ যেখানে মিলিটারি একাডেমি কাকুলের পাশেই অ্যাবোটাবাদে আশ্রয় পেয়েছিল দুর্ধর্ষ অপরাধী ওসামা বিন লাদেন। অপরাধ ও মৌলবাদের এক উর্বর ভূমি পাকিস্তানের ভূখণ্ডে প্রবেশ করে এই অপরাধীকে হত্যাও করেছিল মার্কিন সামরিক বাহিনী। একদিকে নিজের দেশে একজন দাগী আসামিকে আশ্রয়দানের মতো অপরাধ যেমন তারা করেছে, অন্যদিকে বিদেশি সামরিক শক্তিকে অভিযান পরিচালনার সুযোগ দিয়ে নিজেদের সার্বভৌমত্ব বিলুপ্তির মতো অপমানও তারা হজম করেছে। এরকম একটি দেশ কোন অহংকারে আজ বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্যের নিন্দা করার সাহস পায়? সুপরিচিত সেই প্রবাদ–চোরের মার বড় গলা–এই দেশটির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য। অন্যায়, অবিচার, খুন, দুর্নীতির ক্লেদে নিমজ্জিত পাকিস্তানের কোনো নৈতিক অধিকার নেই বাংলাদেশের ব্যাপারে নাক গলানোর। বাংলাদেশের কাছে পরাজিত এই রাষ্ট্রটি এখন এতটাই নির্লজ্জ ও উদ্ধত ভঙ্গিতে কথা বলছে যেন ওদের পেছনে পরাজয় ও অপমানের কোনো অতীত নেই।

সামরিক প্রধানদের কাছে পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতা বা রাষ্ট্রপ্রধানরা কতটা মেরুদণ্ডহীন তার এক প্রমাণ দেখেছিলাম পাকিস্তানেরই ইংরেজি পত্রিকা ডনে ২০১৩ সালের ৫ জুনে প্রকাশিত এক সংবাদে (PM sharif's convoy stopped to let Army chief pass) যেখানে বলা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরীফের গতিরোধ করা হয়েছিল সামরিক প্রধানের গাড়ির বহর যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। পাকিস্তানের মতো দেশেই কেবল এ ধরনের আত্মমর্যাদাহীন ঘটনা ঘটতে পারে। গোটা রাষ্ট্রটি যে দুর্নীতিগ্রস্ত সামরিক বাহিনীর বুটের তলায় পড়ে আছে তা আর নতুন করে বলার কিছু নেই।

এ রকম একটি আত্মমর্যাদাহীন বিশ্ববেহায়া দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বাতিল করার যে দাবি সম্প্রতি আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণির পক্ষ থেকে উঠেছে তা আত্মমর্যাদাশীল বাংলাদেশ সরকারের আমলে নেওয়া উচিৎ। পাকিস্তানের সঙ্গে আমরা যদি সব ধরনের বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করি তাতে মনে হয় না বাংলাদেশ অর্থনৈতিক কোনো ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। যত দূর জানি, বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে আমরা যে-পরিমাণ রফতানি করি, সে দেশ থেকে বরং আমদানি করি অনেক বেশি। অতএব ওরাই বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। আর যদি ধরেও নিই যে, আমরাই বেশি ঝুঁকির সম্মুখীন হব, তাহলেও আমাদের সেটাই করা উচিত। একাত্তরে আমরা স্বাধীনতা অর্জনের যে ঝুঁকি নিয়েছিলাম সেই তুলনায় এই ঝুঁকি হবে খুবই সামান্য।

কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার আরও একটি যুক্তি হচ্ছে এই যে, এই সম্পর্কের মুখোশে ওরা আমাদের দেশে এখনও পর্যন্ত ষড়যন্ত্র কেবল অব্যাহত রাখছে তা নয়, তাকে আরও সুদূরপ্রসারী করার সুযোগ পাচ্ছে। পাকিস্তানের গর্ভজাত জঙ্গিবৃত্তি, সহিংসতা আর প্রতিক্রিয়াশীল তৎপরতা এদেশে প্রবেশের পথও উন্মুক্ত থেকে যাবে যদি এই সম্পর্ক ছিন্ন না করা হয়। ভুলে গেলে চলবে না যে, বিশ্বব্যাপী বড় বড় জঙ্গি সংগঠনগুলোর প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও লালনকারী এই পাকিস্তান।

সুতরাং একটি জঙ্গি ও যুদ্ধপরাধী রাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক রাখার প্রয়োজন আমাদের নেই।