জাতির ভবিষ্যত না অন্ধকারের বিনির্মাণ

জায়েদুল আহসান পিন্টু
Published : 29 Nov 2015, 03:45 AM
Updated : 29 Nov 2015, 03:45 AM

হঠাৎ করেই আমার একমাত্র ভাগ্নির ফোন পেলাম। "মামা, দোয়া কর, কাল আমার পরীক্ষা।"

"এইটুকুন মেয়ে, তোর আবার কীসের পরীক্ষা", একটু বিস্মিত হয়েই বললাম।

"মামা, তোমরা সাংবাদিক, জান না কাল থেকে পিএসসি পরীক্ষা? আমি তো এবার পিএসসি দিচ্ছি। মামিকে দাও, দোয়া নিই।"

আমার সঙ্গে কথা ওখানেই শেষ।

যথারীতি পরদিন আবার ফোন। "কী রে, আবার কী হল?"

ভাগ্নিটি এবার অঝোরে কাঁদছে। কিছুই বলতে পারছে না। আমি আতঙ্কিত। কোনো অঘটন না তো? কান্না সামলাতেই পারল না শিশুটি। তার মা ফোন হাতে নিয়ে জানাল, মেয়ে তার পরীক্ষা দিয়ে এসেই কাঁদতে বসেছে। প্রথমে মা ভেবেছিল পরীক্ষার হলে লিখতে পারেনি কিছু, তাই হয়তো লজ্জায় এই কান্না। বিষয়টি মোটেও সে রকম নয়। ভাগ্নিটি আমার কাঁদছে এত দিন এত কিছু পড়ে পরীক্ষার হলে নিজে থেকে কিছুই লিখতে পারেনি বলে। শিক্ষকরা পরীক্ষার হলে এসে সব প্রশ্নের উত্তর যেভাবে বলে দিয়েছেন, তাদেরকে সেভাবেই লিখতে হয়েছে। এ তো গেল প্রথম দিনের পরীক্ষা। দ্বিতীয় দিনেও শিক্ষকরা হাতে লিখিত উত্তর নিয়ে এসে পরীক্ষার্থীদের বলে দিয়েছেন।

ভাগ্নিটি আমার দশ কী এগার বছরের হবে। জীবনের প্রথম স্কুল পরীক্ষায় বসেছিল। মনমতো লিখতে না পেরে কান্নায় ভেঙে পড়ল। এবার তার দাবি, ''মামা, তোমরা না সাংবাদিক। টিভিতে বলে দাও আমি আর পরীক্ষা দিব না।''

ভাগ্নিকে কীভাবে সান্তনা দিই বুঝতে পারছিলাম না। কী এক অনৈতিক প্রতিযোগিতা চলছে শিক্ষা খাতে! খোঁজ নিয়ে দেখলাম, জনপ্রতিনিধিরাও বিষয়টি জানেন এবং তারা এটির অনুমোদন দিয়েছেন। আরও জানলাম, খবর পেয়ে সরকারের পক্ষ থেকেও একজন কর্মকর্তা পরীক্ষা কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন। তিনিও বেশ কিছুদিন ধরে পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন-ফাঁস নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা করছেন। দেশের এমন কোনো পাবলিক পরীক্ষা নেই, যা প্রশ্ন-ফাঁসের অভিযোগ থেকে মুক্ত। আর ভর্তিপরীক্ষার প্রশ্ন তো ফাঁস হচ্ছেই। দেশের প্রায় সব বিশিষ্ট ব্যক্তি এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। জাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু বলেই কেউ চুপ করে থাকতে পারেননি। সরকারের পক্ষ থেকে বরাবরই নানা ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার কলম ধরেছেন অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। লেখার মাধ্যমেই শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ জবাবও দিয়েছেন। এসব উদ্বেগ প্রকাশের পরই আমরা নানা উদ্যোগ দেখতে পেয়েছি।

এ পর্যন্ত আমরা দেখেছি, প্রশ্ন প্রণয়ন থেকে বিতরণ পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা, কয়েক সেট প্রশ্ন তৈরি করা, ট্রেজারি কিংবা থানার ভল্ট ছাড়া আর কোথায়ও প্রশ্ন না রাখা, ট্রেজারি ও ভল্টের ক্ষেত্রে একসঙ্গে দুটি তালা বাধ্যতামূলক করা, বিজি প্রেসে সিসিটিভি বসানো, পরীক্ষা চলাকালে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, কোচিং সেন্টার ও পরীক্ষা কেন্দ্রের পার্শ্ববর্তী ফটোকপির দোকান বন্ধ রাখা, বোর্ডের সেরা ২০ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকা ঘোষণা না করা, এমসিকিউ প্রশ্নের নম্বর কমিয়ে আনা ইত্যাদি। শিক্ষামন্ত্রী এসব ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি প্রশ্ন-ফাঁস-সংক্রান্ত আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করার কথাও বলেছেন। আর শিক্ষা সচিব হুমকি দিয়েছেন ক্রসফায়ারের।

আগে শুনেছি এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার কয়েক ঘণ্টা আগে এমসিকিউ প্রশ্নপত্র ফাঁসের পর তা সমাধান করে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হত। সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর বলে দেওয়া ও পছন্দের কেন্দ্রে নিজ প্রতিষ্ঠানের আসন ব্যবস্থা করা হত। জিপিএ ফাইভসহ পাসের হার বাড়িয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বোর্ডের সেরাদের তালিকায় স্থান করে দিতেই এক শ্রেণির শিক্ষক, শিক্ষা-ব্যবসায়ী ও প্রতিষ্ঠান এ ধরনের অপরাধ করছে। বিষয়টি যে সরকার জানে না তা নয়। শিক্ষামন্ত্রী একবার সংবাদ সম্মলনে জানিয়েই দিলেন যে, ঢাকার বিএএফ শাহীন স্কুল ও কলেজ, টঙ্গির সফিউদ্দিন সরকার একাডেমি এবং বরগুনার আমতলীর এইচএসসি পরীক্ষা কেন্দ্রে এমসিকিউ প্রশ্ন বাইরে পাঠানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে।

শিক্ষামন্ত্রী তখন বলেছিলেন, কিছু শিক্ষক নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য তাদের ব্যবসার স্বার্থে বা অন্য কোনো স্বার্থে প্রশ্ন ফাঁস করছেন। এসব ব্যক্তি শিক্ষক নামের কলঙ্ক। যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত হয়েছে, সেগুলো ও তাদের শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এসব শিক্ষক এমন কর্মকাণ্ড করে পুরো শিক্ষক সমাজের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছেন। এরা প্রকৃত শিক্ষক নন, এরা ধান্দাবাজ।

গালাগাল যা দেওয়ার মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী সবই দিলেন। নানা উদ্যোগও নিলেন। কিন্তু ফলাফল হলটা কী? পঞ্চম শ্রেণির শিশুদেরকেও অনৈতিক শিক্ষাটা দেওয়া চলছে। এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষা কিংবা মেডিকেল, বুয়েট বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য প্রশ্নপত্র ফাঁস আর ক্লাস ফাইভের পরীক্ষায় শিক্ষকেরা উত্তর বলে দিয়ে ফলাফল ভালো করার যে প্রতিযোগিতায় নেমেছেন তা এক রকম নয়। সরকার হয়তো প্রশ্ন-ফাঁসের অভিযোগ থেকে রক্ষা পাবে। ফলাফল প্রকাশের পর সরকার বলতে পারবে তাদের আমলে শিক্ষার হার বেড়েছে। কিন্তু সরকার কি এটা একবারও ভেবেছে যে, পরীক্ষার হলে সব উত্তর বলে দিয়ে অনৈতিক শিক্ষায় একটি জাতি গঠনের কাজ চলছে। প্রশ্ন-ফাঁসের চেয়ে এটা কত ভয়ঙ্কর, সে হিসাব কি করেছেন শিক্ষামন্ত্রী?

গত কয়েক বছর ধরেই দেখছি পঞ্চম শ্রেণি থেকে শুরু করে এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হলে, `পাসের হার বাড়ছে', `জিপিএ ৫ বাড়ছে', `ফলাফলে আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে' এমন সব কথামালা প্রচার করে সরকার তাদের 'বিরাট অর্জন' বলে প্রচার চালায়। পরীক্ষার সাম্প্রতিক ফলাফলের সংখ্যাতাত্ত্বিক মান বলছে, শিক্ষার হার বেড়েছে। কিন্তু মান কি আসলেই বাড়ছে? এবারের পিএসসি পরীক্ষার হলের কাণ্ড আমাকে বলতে বাধ্য করছে শিক্ষার মান নিম্নগামী হবে। আমার আরও সন্দেহ হচ্ছে, পরীক্ষায় পাসের হার বাড়ানোর জন্য নরম হাতে খাতে দেখার নির্দেশনা, বেশি করে জিপিএ ৫ দেওয়ার নির্দেশনার যে অভিযোগ আছে, সেটি তাহলে সত্যি! যদি তাই হয়, এর থেকে বড় বিপর্যয় শিক্ষা ও জাতির জীবনে আর কী হতে পারে?

আমরা শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন, শিক্ষা আইন প্রণয়ন, শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়ানো, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, অবকাঠামোগত সুবিধা বাড়ানো, প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো, নকলরোধ নানা ব্যবস্থা, প্রশ্ন-ফাঁসে নানা ব্যবস্থা নিতে পারি। কিন্তু শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের নৈতিক শিক্ষা দিব কী করে? শুধু রাজনৈতিক ফায়দার নেশায় মত্ত রাজনীতিবিদ আর এক শ্রেণির শিক্ষক ও শিক্ষা-ব্যবসায়ীদের হাতেই কি বন্দি থাকবে একটি জাতির ভবিষ্যত? একজন শিশুর শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই যদি এমন প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া হয়, তাহলে কোনো কিছুতেই এ জাতি গঠন যে সম্ভব নয় তা কি রাজনীতিবিদরা বোঝেন না?

রাজনীতি যেখানে শিক্ষামুক্ত, সেখানে শিক্ষাকে একটি জ্ঞানের ক্ষেত্র হিসেবে গ্রহণ করে, শিক্ষাকে রাজনীতিমুক্ত করার কথা কে ভাববে?

জায়েদুল আহসান পিন্টু: প্রধান বার্তা সম্পাদক, দেশ টিভি।