আইএস, পশ্চিমা বিশ্ব ও ধর্মীয় সংঘাতের রাজনীতি

বিজন সরকার
Published : 26 Nov 2015, 07:11 AM
Updated : 26 Nov 2015, 07:11 AM

বিশ্ব-সমাজ ক্রমশ বিভাজনের গভীরে যাচ্ছে। এই বিভাজন আপাতদৃষ্টে রাজনৈতিক নয়, বিশ্বাসগত। ফলে রাজনীতির হাতিয়ারও হচ্ছে বিশ্বাস। বিশ্বের সামনে জলবায়ু পরিবর্তনের চেয়েও যেন এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে এসব আদর্শ-উদ্ভূত সন্ত্রাস মোকাবেলার বিষয়টি।

ধর্মীয় সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ এবং তার ফলে রাষ্ট্রগুলির প্রতিক্রিয়ার কাঠামোগত চরিত্র বিচিত্র। বিশ্বাসের বিভাজনে কোনো সীমারেখা থাকছে না। বিভাজন নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন হয়ে পড়ছে। আমরা ক্রমশই অমানবিক ও অসহনশীল হয়ে উঠছি। মালির রাজধানী বামাকোর র‌্যাডিসন হোটেলে জঙ্গিরা বন্দিদের কাছ থেকে কোরানের আয়াত শুনতে চেয়েছে। যারা বলতে পেরেছেন তাদেরকে স্বেচ্ছায় মুক্তি দিয়েছে। ২০১৫ সালের এপ্রিলেই একদল শরণার্থী নৌকায় লিবিয়া থেকে ইতালি যাচ্ছিলেন। খ্রিস্টান বলে ওদের বার জনকে সাগরে ফেলে দেওয়া হয় তখন। ইসলামিক স্টেস্টে বসবাসকারী অমুসলিমদের জন্য প্রথম শর্ত: 'অমুসলিম ট্যাক্স' দিতে হবে। সেটা দিতে ব্যর্থ হলে দ্বিতীয় শর্ত: তাদেরকে ধর্ম পরিবর্তন করতে হবে। যদি ধর্ম পরিবর্তন না করে তবে তৃতীয় শর্ত: দেশ ত্যাগ করতে হবে। সেটিও না পারলে তাদেরকে হত্যা করা হয়। এমনকি ভিন্ন মাযহাবের অনুসারী মুসলিমরাও মুক্তি পায়নি এসব থেকে। কার্যত, আইএসের রাজধানী রাক্কা এখন সুন্নি ধর্মাবলম্বীদের শহর।

আবার বিশ্বের রাজতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্রগুলি আন্তঃধর্মীয় হিংসা-বিদ্বেষের সাপেক্ষে রাষ্ট্রের কথিত অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করে। এশিয়ার বহু দেশ, বিশেষ করে মুসলিমপ্রধান দেশগুলো থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সিস্টেমেটিক পদ্ধতিতে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, অথচ রাষ্ট্র নীরব। কারণ, এখানে রাষ্ট্র একটি গরিষ্ঠ সাধারণ গুণনীয়কের হিসাব করে। আর সেটি হল সংখ্যাগরিষ্ঠের বিশ্বাস। ফলে ধর্মীয় সন্ত্রাস সব সময় আইনের ঊর্ধ্বে থেকে যায়। রাজনৈতিক দলগুলি এশিয়ার রাজনৈতিক মানদণ্ডে 'সঠিক' থাকার চেষ্টা করে বলেই ধর্মীয় সন্ত্রাস আইনের আওতায় আনা যায়নি।

ভারতের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির সক্ষমতার কারণে অন্যান্য দেশের মতো ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ভারত ছাড়তে হয়নি; তবে দেশটিতে ক্রমবর্ধিষ্ণু আন্তঃধর্মীয় বিদ্বেষ রাজনীতিতে স্থায়ীভাবে পুঁজি করার একটি ভয়ঙ্কর ধরনের প্রবণতা দৃশ্যমান। গো-মাংস নিষিদ্ধ করার মতো সিদ্ধান্ত নিতে দেখা গেছে সেখানকার কয়েকটি রাজ্য সরকারকে। আফগানিস্তান, ইরাক, লেবানন থেকে অধিকাংশ ধর্মীয় সংখ্যালঘুকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আর পাকিস্তান নামক দেশটিতে তো ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তাদের কিশোরী-তরুণীদের ওপর যৌন-সন্ত্রাস চলছে অবলীলায়। সেখানকার আশি শতাংশ সংখ্যালঘু মেয়েই এ রকম সন্ত্রাসের শিকার। জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করায় রাষ্ট্রের অলিখিত অনুমোদন রয়েছে; কারণ রাষ্ট্র সব সময় এমন ঘটনায় নির্বিকার থাকে।

সাতচল্লিশে বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সংখ্যা ৩২ শতাংশ হলেও আজ সে হার ৭ থেকে ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। রাষ্ট্র হিন্দু ধর্মাবলম্বীদেরকে 'রাষ্ট্রের শত্রু' মনে করে তাদের ৭৫ শতাংশ স্থায়ী-অস্থায়ী সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ধর্মীয় সংখ্যাগুরুদের হাতে দিয়েছে। বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত একটি ধর্মীয় সন্ত্রাসের বিচার হয়েছে, সে নজির নেই। আর মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মতত্বের রাজ্যগুলির উদাহরণ নাই-বা দিলাম। সেখানে একটিমাত্র ন্যারেটিভ গোটা সমাজের মস্তিস্কে স্থায়ী হয়ে আছে। সেটি হল, সুন্নি ওয়াহাবিজম, যাতে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ও ভিন্নমতাবলম্বীদের পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট মনে করা হয়। ফলে এদেরকে হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ বা আগুনে পুড়িয়ে মারা– সব কিছুই বিশ্বাসের যুক্তিতে 'সঠিক'!

উদার হিসেবে পরিচিত পশ্চিমা বিশ্বও তার সামাজিক কাঠামো ক্রমশ অসহিষ্ণু করে তুলছে। উগ্র ইসলামিক রাজনীতির কারণেই কি তারা প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠছে কি না, তার ব্যাখ্যা এ প্রেক্ষাপটে করা দুরূহ। তবে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের বিশ্বাস, সহনশীলতা, শ্রদ্ধার জায়গাটি ক্রমশ অবিশ্বাস ও অশ্রদ্ধায় ভরে উঠছে। নির্মোহ বাস্তবতা হল, এখন মুসলিম সম্প্রদায়ের ভিতরেই গোত্রভিত্তিক দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে উঠছে। এই বিভাজক কোষটির অভ্যন্তরে রয়েছে সালাফিজম এবং ওয়াহাবিজব (পরিভাষা দুটিতে তেমন ফারাক নেই) নামের দুটি বিষাক্ত নিউক্লিয়াস।

প্যারিসের সাত হামলাকারীর অন্তত দুজন সিরিয়ার শরণার্থী, এ তথ্য জানার পর পশ্চিমা দেশগুলির শরণার্থী গ্রহণ প্রকল্প এখন প্রশ্নের মুখে। দেশগুলির ডানপন্থী সমাজের বক্তব্য হল, শরণার্থী যারা আসছে তারা মুসলিম এবং তাদের সিংহভাগের বয়স পনের থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে। এ বয়সটি সামরিক বাহিনীতে কর্মরত থাকার সময়। শরণার্থীদের মধ্যে শিশু, নারী ও বৃদ্ধের সংখ্যা নিতান্ত নগণ্য। তাই সন্দেহ দানা বাঁধছে শরণার্থীদের সঙ্গে বহু ইসলামিক জঙ্গি ইউরোপে প্রবেশ করছে কি না তা নিয়ে। আপাতদৃষ্টে, পশ্চিমের রাজনৈতিক দলগুলি দ্রুতই ডানপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে বলে মনে হচ্ছে। দলগুলি মনে করছে, পলিটিক্যালি কারেক্ট থাকা মানেই নিজেদের বিপন্ন করে তোলা। তাই ডানপন্থা এখন ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার সমাজে দ্রুত প্রসারিত রাজনৈতিক বাস্তবতা।

দশ হাজার সিরীয় শরণার্থী গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত বারাক ওবামার জন্যও বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। দেশটির অধিকাংশ (৩২ জনেরও বেশি) গভর্নর নিজ নিজ প্রদেশে শরণার্থী গ্রহণ করার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। কেবল রিপাবলিকান দলের নন, ডেমোক্রেটিক দলেরও কজন রয়েছেন এদের মধ্যে। রিপাবলিকান দল থেকে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন-প্রত্যাশীরা জঙ্গিদের মদদ দেয় এমন মসজিদ বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দিচ্ছেন। দেশটির গোয়েন্দা সংস্থাগুলি জঙ্গিদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সরকারকে সতর্ক করেছে। সংস্থাগুলি জানিয়েছে, ইতোমধ্যেে আড়াইশ আইএস জঙ্গি আমেরিকাতে এসেছে।

তবে প্রেসিডেন্ট ওবামা সিরিয়ান শরণার্থী নেওয়ার ব্যাপারে এখনও অনড় অবস্থানে রয়েছেন। সমালোচকরা বলেন, ওবামা প্রশাসনে সুন্নি আরবপন্থী প্রভাবশালীদের সংখ্যা বেশি। তাই গত সাত বছরেও এ প্রশাসন স্থির মধ্যপ্রাচ্য নীতি নির্ধারণ করতে ব্যর্থ হয়। অনেকের মতে, সুন্নি আরবপন্থীদের চাপের কারণেই মার্কিন প্রশাসন সিরিয়ার সঙ্কট ভয়াবহ করে তুলেছে, বিশেষ করে শরণার্থী সমস্যাটি। সুন্নি আরব রাষ্ট্রগুলির উদ্দেশ্য ছিল, শরণার্থী ইস্যু কাজে লাগিয়ে পশ্চিমা বিশ্বকে চাপে রেখে বাশার আল আসাদকে হটানো। ওবামা প্রশাসন ইচ্ছে করলেই ন্যাটো ও মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন সহযোগী দেশগুলিকে সঙ্গে নিয়ে সিরিয়াতে একটি নো-ফ্লাই জোনের আওতায় নিরাপদ এলাকা গড়ে তুলতে পারত, যেখানে আঞ্চলিকভাবে শরণার্থীদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা যেত। কেন সে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, সেটাই এখন প্রশ্ন।

এ বিষয়ে পশ্চিমা ডানপন্থী রাজনৈতিক সমাজ ও মিডিয়া থেকে একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তাদের বক্তব্য হল, আমেরিকার বন্ধুপ্রতীম মধ্যপ্রাচ্যের ধনী সুন্নি দেশগুলি পশ্চিমা দেশগুলিতে সালাফিজম ও ওয়াহাবিজম ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যই ওবামাকে কৌশলে সিরিয়া সম্পর্কে দ্বিধাগ্রস্ত করে রেখেছিল। ওবামা প্রশাসন সঠিক সময়ে পদক্ষেপ নিতে পারেনি। শরণার্থী সমস্যা তৈরি হওয়ার আগেই গোয়েন্দা রিপোর্ট ছিল, শরণার্থী সেজে পাঁচ হাজার আইএস জঙ্গি আমেরিকাতে এবং বিশ হাজার সারা ইউরোপে প্রবেশ করার পরিকল্পনা করছে।

উত্তর আমেরিকার আরেক বড় দেশ কানাডা চলতি বছর থেকে পঁচিশ হাজার সিরিয়ান শরণার্থী নেবে বলেছিল। প্যারিস হামলার ফলে নিরাপত্তার কারণে জাস্টিন ট্রুডোর পরিকল্পনা পিছিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। অন্যদিকে শরণার্থী ইস্যুতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অধিকাংশ দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রাদেশিক গভর্নরদের অবস্থানের সমান্তরালের রয়েছেন।

ওদিকে, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি কেবল শরণার্থী নিতে অনাগ্রহী তা নয়, নিজেদের দেশকে কীভাবে ইসলামীকরণের হাত থেকে রক্ষা করা যায়, তা নিয়েও চিন্তিত। পোল্যান্ড সাড়ে পাঁচ হাজার সিরিয়ান শরণার্থী নেওয়ার কথা বললেও এখন পিছিয়ে যাচ্ছে। হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান রাখঢাক না করে তাঁর অবস্থান বহু আগেই পরিষ্কার করেছেন। তাঁর মতে, ''ইউরোপে খ্রিস্টান মূল্যবোধের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন হওয়ার পথে। আমরা আর মুসলিম চাই না। আমাদের সেই অধিকার রয়েছে যে, আমরা আর কোনো মুসলিমকে স্বাগত জানাব কী জানাব না সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার।''

ইউরোপের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি সংযুক্ত খিলাফতের অধীনে বড় হোক, সেটি ইউরোপবাসী চায় কিনা তা নিয়েও তিনি ইউরোপীয়দের প্রতি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন।

পশ্চিম ই্উরোপের দেশগুলির মধ্যে ফ্রান্সে ডানপন্থী নেতা মেরিন লি পেনের নেতৃত্বে ন্যাশনাল ফ্রন্টের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। এই ফ্রন্ট ২০১১ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তৃতীয় দল হিসেবে স্থান করে নেয়। অভিবাসন, ইসলামিকরণ, ধর্মীয় রীতিতে পোশাক পরিধান ও খাবার গ্রহণ, ফ্রান্সে আরব বিশ্বের বিনিয়োগসহ বহু বিষয়ে দলটির কট্টর অবস্থান রয়েছে। প্যারিসে হামলার পর ফ্রান্সের সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ এবং উগ্র ইসলামের বিরুদ্ধে দেশে-দেশে যুদ্ধ ঘোষণার আহ্বান জানান তিনি। লি পেনের বিরুদ্ধে ইসলামবিরোধী প্রচারণা চালানোর অভিযোগে আদালতে ট্রায়াল চলছে। তারপরও আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য ফ্রান্সের স্থানীয় নির্বাচনে তাঁর দল অভাবনীয় সফলতা পাবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

ফ্রান্সে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদের জনপ্রিয়তা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। গত অক্টোবরে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল মাত্র ১৭ শতাংশ। এমন অবস্থায় দেশের ১১ শতাংশ মুসলিম সংখ্যালঘুর উপর আগের মতো নজর দেওয়ার ঝুঁকি তাঁর না নেওয়ারই কথা। কারণ সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যায়, ফ্রান্সে বসবাসকারী মুসলিম সম্প্রদায়ের ৬০ শতাংশ আইএসকে কোনো না কোনোভাবে সমর্থন করে। দেশটির প্রায় সত্তর শতাংশ অপরাধ ঘটছে মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকদের দ্বারা।

ইউরোপে বসবাসিকারী মুসলিম সম্প্রদায়ের একটি বিশাল অংশ শরিয়া আইনের পক্ষে। ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে রয়েছে শরিয়া কোর্ট ও ইসলামিক জোন। ২০৩০ সালের মধ্যেই ব্রাসেলস ও অ্যান্টিয়ার্পের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ হবে মুসলিম। বেলজিয়ামে বসবাসিকারী মুসলিম সম্প্রদায়ের অধিকাংশই শরিয়া আইনের পক্ষে।

নেদারল্যান্ডেও একই অবস্থা। ডানপন্থী দল 'পার্টি অব ফ্রিডম'এর জনপ্রিয়তা এ কারণেই বাড়ছে। ২০০৪ সালে জন্ম নেওয়া এই পার্টির প্রধান গ্রেট উইল্ডারস ইউরোপে ইসলামবিরোধী রাজনীতির অগ্রদূত হিসেবে পরিচিত। ২০১০ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে দলটির অবস্থান ছিল তৃতীয়। ধারণা করা হয়, আগামী নির্বাচনে নেদারল্যান্ডের শাসনভার ফ্রিডম পার্টির হাতে চলে যেতে পারে। দলটি বলছে, হেগে গির্জার চেয়ে মসজিদের সংখ্যা বেশি, যদিও দেশটির জনসংখ্যার ৮ থেকে ১০ শতাংশ মুসলিম। দলটির মূল দাবি, দেশে 'ডি-ইসলামাইজেশন' করা।

নৈতিক বাধ্যবাধকতার (অনেকেই আবার জার্মানির শ্রমশক্তির অভাবের কথা উল্লেখ করেন) কারণে এখন পর্যন্ত জার্মানি সিরিয়ান শরণার্থী নিতে ইচ্ছুক। তবে প্যারিসে হামলার পরে চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মের্কেল ভোটের হিসাবে পিছিয়ে পড়ছেন। সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ার জন্য তাঁর উপর চাপ বাড়ছে। রাজনৈতিক ক্ষতি ঠেকাতে তাঁকেও নিষেধাজ্ঞার পথে যেতে হতে পারে। আইএস জঙ্গিরা তাঁকে হত্যা করতে চাচ্ছে। হুমকির কারণে জার্মানির হ্যানোভারে জার্মানি-হল্যান্ড প্রীতি ম্যাচ বাতিল করে দেওয়া হয়েছে, যেখানে তাঁর উপস্থিত থাকার কথা ছিল। আইএসসহ অন্যান্য জঙ্গিদের হুমকির তালিকায় ফ্রান্সের পরই রয়েছে জার্মানি। প্রায় ৭৬০ জন জার্মান আইএসে যোগ দিতে গিয়েছিল যাদের ২০০ জন ফিরে এসেছে দেশে। গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুযায়ী, যারা সিরিয়াতে গিয়েছে তাদের অধিকাংশের জন্ম জার্মানিতে এবং এদের বয়স ২০ থেকে ২৫এর মধ্যে। উল্লেখ্য, এদের মধ্যে প্রায় শ দেড়েক নারী। এসব কারণে জার্মান সমাজেও মুসলিম-বিদ্বেষ প্রসারিত হচ্ছে। মূলধারার রাজনীতির যত আপত্তি বা সমালোচনাই থাকুক না কেন, সেখানে ইসলামবিরোধী পেগিডা আন্দোলন ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

দৃশ্যত, নাইন ইলেভেনের পর পশ্চিমা বিশ্বে ধর্মীয়-বিদ্বেষ, সরাসরি বললে, মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষের শুরু হলেও অবস্থা তখন তেমন গুরুতর ছিল না। আইএসের উত্থানের পর পশ্চিমা সমাজ খুব দ্রুত প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। ধর্মীয় জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের কারণে পশ্চিমা দুনিয়া কেবল নয়, এশিয়ার মুসলিম রাষ্ট্রগুলিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এটি সহজেই অনুমেয় যে, এসব রাষ্ট্র আরও কয়েক দশক এই ক্ষতির শিকার হবে।

আইএসের উত্থানের পর ভূরাজনীতির সমীকরণ, শত্রু-মিত্র নির্ধারণ পদ্ধতি পাল্টে গেছে। এখন পশ্চিমা ডানপন্থী সমাজ ও মিডিয়া পশ্চিমা বিশ্বের আদর্শিক মূল্যবোধের সঙ্গে উগ্র ইসলামের একটি যুদ্ধ চলছে বলে প্রচার করছে। ফলে নতুন মাত্রার এই বিভাজন যে বিশ্বকে ভয়ানকভাবে অস্থিতিশীল করে তুলবে তাতে সন্দেহ নেই।

এখানে একটি বিষয় গভীরভাবে পর্যালোচনা জরুরি। নাইজেরিয়ার বোকো হারাম আইএসের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে। বলা যায়, মানুষ-হত্যার পরিসংখ্যানগত দিক দিয়ে ওরা অনেক অনেক বেশি পৈশাচিক। তবু কেন পশ্চিমাদের চোখে আইএস বেশি বড় হুমকি?

আইএসকে জঙ্গি সংগঠন বলার চেয়ে একটি পরিপূর্ণ রাষ্ট্রব্যবস্থা বলাই উচিত। তাদের নিয়মিত সেনার সংখ্যা ত্রিশ হাজারের বেশি। পঁচিশ হাজার বিদেশি আইএসের বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরত। তাদের রয়েছে যোগাযোগ, রাজস্ব, ডাক ও চিকিৎসা ব্যবস্থা। ফলে তারা অতি সহজেই ধর্মভীরু মানুষদের কথিত ইসলামিক খেলাফতে নিয়ে যেতে পারছে। পশ্চিমা বিশ্বের হোম-গ্রোন সন্ত্রাসীদের নিয়ে যে কোনো দেশে হামলা করার মতো নেটওয়ার্ক তাদের রয়েছে, যা অন্য কোনো সংগঠনের নেই। পশ্চিমের গোয়েন্দাদের ধারণা, বিশ্বব্যাপী আইএসের প্রতি অ্যাপলজিস্টের সংখ্যা দুশ থেকে আড়াইশ মিলিয়নের মতো। এ কারণেই পশ্চিম আইএসের কারণে বেশি চিন্তিত।

ধর্মীয় জঙ্গিবাদ ও জঙ্গিবাদের উৎস নিয়ে দুটি প্রভাবশালী ন্যারেটিভ দেখা যায়। প্রথমটি মোটামুটি এ রকম: ইসলামের নামে যে ধর্মীয় সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ গত চার দশক ধরে চলছে, তার পিছনে আমরা কেবল আমেরিকা ও ইহুদিদের ষড়যন্ত্র খুঁজে বেড়াই। আমরা ছয়টি ধনী উপসাগরীয় রাষ্ট্রের জঙ্গি-প্রসবিত মৌলিক কর্মকাণ্ডে বিশেষ ধরনের দায়মুক্তি দিই এবং আইএস, আল-কায়েদা ও তালেবানসহ শত শত জঙ্গি সংগঠনের কর্মকাণ্ড 'ইহুদি ও পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্র' আখ্যা দিয়ে নিজেদের বিশ্বাসগত দায়িত্ব পালন করে থাকি।

আমাদের এই অবস্থানটি সরাসরি জঙ্গি-বান্ধব। জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি দীর্ঘদিন এই ন্যারাটিভ থেকে সুবিধা নিচ্ছে। প্যারিসে হামলার পরই তারেক রমদান, মেহেদী হাসানের মতো 'মুখোশধারী' মানুষেরা ইনিয়ে-বিনিয়ে জঙ্গি হামলা 'জাস্টিফাই' করছেন, যা মুসলিম সম্প্রদায়কে দিন-শেষে আইএসের আদর্শের দিকে টানবে। এই বিপথগামী ন্যারেটিভের মোকাবেলা করার জন্য শত শত মাজিদ নেওয়াজ ও মাহাথির মুহাম্মদের মতো ব্যক্তিকে সামনেে এগিয়ে আসতে হবে।

দ্বিতীয়ত, মুসলিম সম্প্রদায়ের বিষয়ে একটি অতি-সরলীকৃত ন্যারাটিভের নির্মাণ। এই ন্যারেটিভ হল এ রকম, মুসলিম মানেই সন্ত্রাসী। এটিও ধর্মীয় জঙ্গি-বান্ধব এবং সমাজে বিভাজন তৈরির বড় নিয়ামক। পশ্চিমা বিশ্ব এখন উগ্র ইসলামের ভয়ঙ্কর প্রভাব দেখতে পাচ্ছে। অথচ বিভিন্ন উগ্র সংগঠনকে প্রণোদনা দিয়ে ইসলামের ভেতরকার সামরিক আদর্শটি সামনে নিয়ে আসার কাজটি করেছে ওরাই। এর কারণ ছিল আবার দুটি। এক: সমাজতান্ত্রিক আদর্শের রাজনীতিকে মোকাবেলা করা; দুই: মধ্যপ্রাচ্যের খনিজ সম্পদ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেওয়া।

পশ্চিমা নেতৃত্ব রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে থেকে বিশ্বাসগত বিভাজনের বাই প্রডাক্ট আইএসের মতো দানবকে সামরিক ব্যবস্থাপনায় নির্মূল করতে চাচ্ছে। কার্যত এটি সম্ভব নয়। রণহুঙ্কার দিয়ে উগ্র মৌলবাদের বিনাশ করা যায় না। আদর্শ একবার জেগে উঠলে নির্মূল করা কঠিন। পশ্চিমারা এখনও সমাজতান্ত্রিক আদর্শ ধ্বংস করতে পারেনি। সমাজতন্ত্র একটি রাজনৈতিক আদর্শ। অপরপক্ষে আইএসের প্রেরণার মূল উৎস বিশ্বাসগত, যার ভিতরে রয়েছে একটি সামরিক আদর্শ। এলটিটি কিংবা নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড মিলিটারি গ্রুপকে সামরিকভাবে মোকাবেলা করা গিয়েছিল; কারণ তাদের উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক।

সামরিক হামলা করে ব্যক্তি-বিশেষ অথবা আইএস কিংবা অন্যান্য ধর্মীয় জঙ্গি সংগঠনের সামরিক কাঠামো ধ্বংস করা হয়তো সম্ভব। কিন্তু বিশ্বাস?

বিজন সরকার: ভাষা গবেষক; রাজনৈতিক বিশ্লেষক।