তথ্য অধিকার আইনের অভিজ্ঞতা নিয়ে আরেক কিস্তি

ওমর শেহাব
Published : 9 Dec 2015, 08:47 AM
Updated : 9 Dec 2015, 08:47 AM

কিছুদিন আগে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাপারে তথ্য অধিকার আইনের অধীনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কিছু খোঁজখবর করেছিলাম। সেই অভিজ্ঞতার কথা গত অক্টোবরের ৫ তারিখে এই মতামত বিশ্লেষণ পাতায় জানিয়েছিলাম। কাজটি খামোখা করিনি। আশা ছিল গণমাধ্যমের কেউ না কেউ এই সূত্রগুলো ব্যবহার করে জোরদার অনুসন্ধান করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের 'পেটের ভাত চাউল করে' দিবে।

এই দেড় মাসে আমরা অনেক কিছু জেনেছি। অন্তত একবার জ্বালানিবিহীন বিদ্যুৎ উৎপাদনের খবর জেনেছি (পুরোপুরি অবৈজ্ঞানিক এই বিষয়ে সব সময় কোনো না কোনো আগ্রহী সাংবাদিক পাওয়া যায়), ইঁদুরের সেলফি তোলার খবর জেনেছি, কোন যুদ্ধাপরাধী ফাঁসির আগে কীসের ঝোল দিয়ে ভাত খেল তা জেনেছি, এমনকি যুদ্ধাপরাধী পরিবারের একই রকম কুৎসিত চিন্তাভাবনার অধিকারী সদস্যদের বিশাল বয়ানও শুনেছি! কেউ কি মনে করতে পারেন খুব বিখ্যাত কেউ না হলে পত্রিকাগুলো কখনও যুদ্ধাপরাধের শিকার পরিবারের সদস্য যারা মামলাগুলোতে সাক্ষ্য দিয়েছেন তাদের বিশাল বয়ান ছাপিয়েছে?

আমরা যেটি জানতে পারিনি তা হল,

১. শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যদের, যাদের নাম এখন সবাই জানে, এ কাজে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কী কী ছিল;

২. তদন্ত কমিটির ২৩টি সুপারিশ;

৩. কমিটির সদস্যদের মতের কত শতাংশ এই ২৩টি সুপারিশে প্রতিফলিত হয়েছে;

৪. সাক্ষাতকার নেওয়া বিশিষ্ট ব্যক্তিরা কে ছিলেন;

৫. তাদের মতের কত শতাংশ এই ২৩টি সুপারিশে প্রতিফলিত হয়েছে।

এমনিতে সব সময় খিটিমিটি লেগে থাকলেও বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে গণমাধ্যমের একটি বড় অংশের একটি ব্যাপারে অবশ্যই মিল রয়েছে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ব্যাপারটি দু পক্ষেরই প্রাধান্যের একেবারে নিচের দিকে। সরকার শিক্ষা খাতে জিডিপির আনুপাতিক বরাদ্দ কমিয়েই যাচ্ছে। গণমাধ্যমও প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধের ব্যাপারে সরকার যে গড়িমসি করছে সেটি ধামাচাপা দিয়েই যাচ্ছে।

এর মধ্যে দেশে মেডিকেলের ভর্তিপরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় এবং আবারও প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। তখন পত্রিকায় দেখলাম স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলছেন, তিনি নিজে তদন্ত করে জেনেছেন প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। আমি খুব অবাক হলাম যখন আবিষ্কার করলাম সেই সংবাদ সম্মেলনে একজন সাংবাদিকও এই তথ্য জানতে চাননি যে, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ফৌজদারি অপরাধ তদন্ত করার প্রশিক্ষণ আছে কিনা। যদি না থাকে তাহলে তো ওনার তদন্তে কী পাওয়া গেল তাতে কিছুই আসে যায় না। প্রশ্নপত্র ফাঁস একটি ভয়ংকর অপরাধ আর এটির সুরাহা পেশাদার তদন্ত কর্মকর্তা ছাড়া সম্ভব নয়। সাংবাদিকরা কেন এই ব্যাপারটি মন্ত্রীকে ধরিয়ে দিলেন না সেটি একটি রহস্য।

তখন আমি ভাবলাম, এমনও তো হতে পারে যে, আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী আসলে ঝানু গোয়েন্দা ফেলুদার মতো ফিল্ডনোট নেন এবং সেগুলো ঠিকমতো বিশ্লেষণ করে আসল সত্য বের করে ফেলেন। তারপর ঠিক করলাম, তথ্য অধিকার আইন যেহেতু আছে, কাজেই সেটি ব্যবহার করে মন্ত্রী সাহেবের তদন্ত কতটুকু নিয়মতান্ত্রিক ছিল সেটি বের করি। সেই যে অনেক বছর আগে শার্লক হোমস আর ফেলুদার ভক্ত হয়েছিলাম, তারপর আর কখনও বড় কোনো গোয়েন্দার দেখা পাইনি। ভাবছিলাম এবার বুঝি সেই দুঃখ ঘুচল!

মন্ত্রণালয়ে নিচের চিঠিটি পাঠিয়েছিলাম:

"আমি ২০১৫ সালের ৪ অক্টোবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের একটি সংবাদ সম্মেলনের উপর প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানতে পারি মেডিকেলের ভর্তিপরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজে তদন্ত করেছেন। সংবাদে জনাব নাসিমকে নিম্নলিখিতভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে: 'অভিযোগ পাওয়ার পর আমি নিজে ইনকোয়ারি করেছি। ইনকোয়ারি করে নিশ্চিত হয়েছি, সামান্যতম কোনো ফাঁক-ফোকর নেই। এর কোনো সুযোগও নেই। যে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে, তা সঠিক নয়।… পরীক্ষার দিন আমি অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলেছি, সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছি, কেউ আমাকে প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করেনি। ফাঁস সত্যিই হয়ে থাকলে সেদিন করেনি কেন?'

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এই তদন্ত প্রক্রিয়া সম্পর্কে নিম্নলিখিত তথ্যগুলি জানতে চাই আমি:

১. এই তদন্ত কমিটির আনুষ্ঠানিক নাম;

২. এই তদন্ত কমিটির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যদের নাম;

৩. এই কমিটির এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বৈঠকের সংখ্যা;

৪. যে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে তাদের সংখ্যা;

৫. যে সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে তাদের সংখ্যা।

আগের বারের মতোই আমি এমন কোনো তথ্য জানতে চাইনি যেটি তদন্তাধীন বা গোপনীয় বিষয় বলে এড়িয়ে যাওয়া যাবে। তাছাড়া, কোনো একটি নির্দিষ্ট বছরের ফাঁসের ঘটনা যেনতেনভাবে ধরে ফেলার পরিবর্তে আমাদের যদি এটি প্রতিরোধে একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা থাকে যেটি যে কোনো বছরই একই মানের কাজ করবে সেটি অনেক ভালো হবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সাড়ে পাঁচ মাস লাগালেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মাত্র দেড় মাসেই আমাকে উত্তর দিল। সবার আগ্রহের কথা ভেবে নিচে সেটি হুবহু তুলে দিচ্ছি।

আমার কাছে মনে হয়েছে স্বাস্থ্যমন্ত্রী যেভাবে পরীক্ষার দিন কয়েকটি হল ঘুরে খোঁজখবর করলেন, সেটিকে ঠিক সত্যিকার অর্থে তদন্ত বলা যায় না। কারণ একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তদন্ত কর্মকর্তা (পুলিশ বা অন্য কেউ) অন্য কাজের অংশ হিসেবে এটি করবেন না। তাছাড়া উনি ফিল্ডনোট নিবেন। আমার প্রশ্নের উত্তরে পাওয়া তথ্য থেকে বোঝা যাচ্ছে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বা তাঁর সহকর্মীরা কতজন অভিভাবক বা সাংবাদিকের সঙ্গে কী কী কথা হয়েছে এসবের ফিল্ড নোট নেননি। সে ক্ষেত্রে একে বড়জোর প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগের ব্যাপারে মন্ত্রীর কৌতূহলের প্রকাশ বলা যেতে পারে, কিন্তু কোনোভাবেই তদন্ত বলা যায় না। কাজেই সেখানে কী ফল মিলল সেটি আমাদের আশঙ্রকা পক্ষে গেল না বিপক্ষে গেল এটি অবান্তর।

এ পর্যায়ে এসে মনে হচ্ছে কেন এই কথাগুলো সাংবাদিক সম্মেলনে কেউ তুললেন না সে প্রশ্ন তোলাও অবান্তর। কারণ যার এটি তোলার কথা তিনি হয়তো এই মুহূর্তে কোনো বিদেশি ট্যাবলয়েড থেকে বাঁদরের সেলফি তোলার খবর অনুবাদে ব্যস্ত!

আমি জানি আমাদের গণমাধ্যমের একটি অংশ এখন সম্প্রতি দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের কুলখানি আর চেহলামে কী কী খাওয়ানো হবে তার প্রতিবেদন তৈরিতে রাতদিন কাজ করছেন। এর বাইরে যারা সত্যিকারের পরিশ্রমী সাংবাদিক তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আপনারা এই পেশা ভালোবাসেন, এটি আপনাদের জীবিকা। কাজেই আমরা বিনয়ের সঙ্গে নিচের দাবিগুলো করতেই পারি:

১. এরপর থেকে যদি কোনো মন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন যে, তিনি পরীক্ষার হলে ঘুরে ঘুরে তদন্তের কাজ শেষ করেছেন তাকে শক্ত ভাষায় বুঝিয়ে দেওয়া যে, কেন্দ্রে কেন্দ্রে ক্যামেরা নিয়ে ঘোরা আর ফৌজদারি অপরাধের তদন্ত করা এক নয়। শেষেরটি পেশাদারদের কাজ।

২. স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি যেসব আলামত তদন্তের কাজে ব্যবহার করেছে তার সঙ্গে আমাদের সবার কাছে যেসব আলামত সংরক্ষিত আছে তার কতটুকু মিল সেটি বের করা।

এই মুহূর্তে শিক্ষা বিটে সাংবাদিকতার যে দুরবস্থা চলছে সেটি সাংবাদিকদেরই দূর করতে হবে। আমরা যারা সাংবাদিক নই তারা বাইরে থেকে এসে সেটি করে দিয়ে যাব না। আর প্রশ্ন-ফাঁস বন্ধে সরকারের গড়িমসির অনুসন্ধানের চেয়ে বড় কোনো কাজ আপনাদের থাকার কথাও নয়।

শেষ করার আগে আরেকটি ব্যাপার জানিয়ে দিই। পর পর দুটি মন্ত্রণালয়ে তথ্য অধিকার আইনের অধীনে তথ্য জানতে পেরে আমার উৎসাহ বেড়ে গেছে। আমি নিশ্চিত, এই লেখা পড়ে আরও অনেকের মধ্যেই এ নিয়ে আগ্রহ তৈরি হবে। অনুরোধ করব, বিশেষ করে গণমাধ্যমের কর্মীদেরকে, আপনারা এটি আরও বেশি বেশি ব্যবহার করুন, অনুসন্ধান করুন, সত্য বের করে নিয়ে আসুন আর সরকারের মধ্যে ঘাঁপটি মেরে বসে থাকা দুর্বৃত্ত কর্মকর্তাদের বুঝিয়ে দিন কত কলমে কত রিপোর্ট!

ওমর শেহাব: ডক্টরাল ক্যান্ডিডেট, ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড, বাল্টিমোর কাউন্টি; সদস্য, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটিজি ফোরাম (আইসিএসএফ)।