নারীদের হেনস্তা, পুরুষের বিকৃত রুচি ও আইনের ফাঁক

প্রিসিলা রাজপ্রিসিলা রাজ
Published : 7 August 2011, 02:11 PM
Updated : 7 August 2011, 02:11 PM

পুরুষতন্ত্রে নারী নির্যাতনের হরেক রূপ। দেশ-কাল-সমাজ ভেদে তার চেহারা আবার বদলে যেতেও পারে। আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির সমাজে এর প্রধান রূপগুলোর সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। বৌয়ের ওপর স্বামীর নির্যাতন, কখনও সেখানে স্বামীর সঙ্গে অন্য নারীকূল অর্থাৎ শাশুড়ি, ননদ ইত্যাদি যোগ হয়, কখনও তা ছাত্রীকে শিক্ষক বা প্রধান শিক্ষক কর্তৃক ধর্ষণ, কখনও অধীনস্থ কর্মীর সহকর্মী বা উর্ধ্বতন কর্মকর্তা কর্তৃক ধর্ষণ বা অন্যান্য প্রকারের যৌন হেনস্তা। সামাজিক অবস্থান, বৈবাহিক অবস্থা ইত্যাদি ভেদে সেসব নিপীড়ন বিভিন্ন রূপ নেয়। এসব নির্যাতনের অন্দরতম বার্তাটি মানবসমাজকে আচ্ছন্নকারী এক ঘৃণ্য স্ববিরোধী মূল্যবোধ।

প্রসঙ্গত মূল্যবোধ মানেই ইতিবাচক কিছু না, আমাদের বহু মূল্যবোধ আমাদের নেতির পথ দেখায়। সেই মূল্যবোধ আমাদের এই জানায়, সন্তান ধারণের জন্য প্রকৃতি পুরুষকে যে সামর্থ্য দেয়নি, প্রয়োজনীয় যে বিশেষ প্রত্যঙ্গগুলো দেয়নি, তার দায় নারীকেই নিতে হবে এবং সেজন্য যেভাবে সম্ভব, যতভাবে সম্ভব, শারীরিক ও মানসিক পীড়ন তাকে সয়ে যেতে হবে। পুরুষতন্ত্রে নারীর নিয়তি এই যে, এই পীড়নের সবচেয়ে বড় হাতিয়ারটি নারী নিজেই। আত্মপীড়ন, ব্যক্তি নারীর নিজের ওপর এবং সমষ্টি নারীর ওপর, পুরুষতন্ত্রের কাঠামোয় নারীর 'সারভাইভাল টুল এন্ড স্ট্র্যাটেজি'।

ভারী গৌরচন্দ্রিকার জন্য পাঠকের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিই। কয়েকদিন ধরে কেবলই লিখতে চেয়েছি এবিসি রেডিওর নারী সাংবাদিকের ওপর পান্থপথের ফার্নিচার দোকানের মালিক সাইফুর রহমান সাপ্পু এবং সাহাদত হোসেন সেকুর আক্রমণ নিয়ে। সেদিন পত্রিকায় (৫ই আগস্ট) দেখলাম গতকাল আসামী দু'জন বীরদর্পে জামিন নিয়ে বেরিয়ে গেছেন। লোক দু'টিকে কেন আদালতে যেতে হলো সেটি একবার দেখে নিই: সাপ্পু ৩১শে জুলাই সাংবাদিক ভদ্রমহিলা পান্থপথ দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর গায়ে মটরসাইকেল তুলে দেন। তিনি তার প্রতিবাদ জানালে সাপ্পু অশালীন ব্যবহার করেন এবং তাঁর মাথায় হেলমেট দিয়ে আঘাত করেন। আহত সাংবাদিক সাহায্যের জন্য চীৎকার করলে সাপ্পুর ভাই সেকুসহ আরো কয়েকজন এসে তাঁকে কিলঘুঁষি মেরে জখম করেন।

মহানগর হাকিম আনোয়ার শাহাদত এ মামলায় জামিন দিয়েছেন এই বলে যে, যে ধারায় মামলা হয়েছে তা জামিনযোগ্য। রাষ্ট্রপক্ষের উপপরিদর্শক জামিনের বিরোধিতা করতে গেলে তাঁকে হাকিম সাহেব থামিয়ে দেন। আরেক আইনজীবীকেও তিনি কথা বলতে অনুমতি দেননি। পত্রিকার বিবরণ পড়ে আমার মনে যে প্রশ্নগুলো জেগেছে: এই ঘটনা কি আর দশটা মারামারির ঘটনার মতো? জানতে পেরেছি আক্রমণের শিকার ভদ্রমহিলা বয়সে তরুণ। এখন, তরুণ নারী পথচারীর গায়ে মটরবাইক তুলে দেওয়া, তাকে অশালীন কথা বলা– ঘটনার মূল তো এটাই। এই দেশে পথেঘাটে নারীর অশেষ লাঞ্ছনার যেসব ঘটনা প্রতিদিন ঘটে চলেছে হাকিম সাহেব কি সেটা বিবেচনায় রেখেই আসামীদের জামিন দিয়েছেন? আমাদের আদালত মেয়েদের নিরাপত্তা বিষয়ে এত বিজ্ঞ সিদ্ধান্ত নিলে তো হয়েইছে!

কিছুদিন আগে চলচ্চিত্রনির্মাতা ফৌজিয়া খান তাঁর কর্মস্থলে যাওয়ার সময় এক ভয়াবহ ঘটনা ঘটে। তিনি তখন সময় টেলিভিশনে কাজ করতেন। কাঁঠালবাগানে অবস্থিত সময় অফিসে ঢোকার ঠিক আগে একটি লোক তাঁর গায়ে নোংরা স্পর্শ করে। ফৌজিয়া তখন লোকটিকে ধরে ফেলেন ও চ্যালেঞ্জ করেন। লোকটি তার উত্তরে তাঁকে আরো আঘাত করে, আশেপাশের লোক এসে হাজির হয় এবং তারাও যথারীতি লোকটির পক্ষ নেয়। এ অবস্থায় ফৌজিয়া পুলিশের ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ফোন করে সাহায্য চান। তাঁকে বলা হয় লোকটিকে ধরে রাখতে যতক্ষণ না সেখানে পুলিশ পৌঁছায়। পুলিশে খবর দিতে দেখে এবং গণমাধ্যমে কাজ করেন শুনে দোষী লোকটি এবং আশপাশের লোকজন ততক্ষণে ফৌজিয়াকে অনুরোধ-উপরোধ ও তোয়াজ করতে শুরু করেছে তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। ইতিমধ্যে লোকটি জানিয়েছে সে কাঁঠালবাগানে অবস্থিত হামদর্দের কর্মী। পুলিশ আসা পর্যন্ত যাতে লোকটিকে ধরে রাখা যায় সেজন্য ফৌজিয়া সহকর্মীকে ফোন করেন। সহকর্মীর এই লাঞ্ছনা শুনে তাঁর অফিসের অনেক সহকর্মী নেমে আসেন এবং লোকটিকে ধরে অফিসে নিয়ে যান। কিছু পরে একজনমাত্র পুলিশ এসে হাজির হন। ইতিমধ্যে লোকটি হামদর্দে তার সহকর্মীদের ফোন করলে তাদের বিশাল একটি দল এসে সময় টেলিভিশনে চড়াও হয়, জিনিসপত্র ভাঙচুর করে, ছেলে কর্মীদের তো মারেই, মেয়ে কর্মীদের সঙ্গে নোংরা আচরণ করে এবং ফৌজিয়াকে সেই লোকটি, তার তখন বীরপুঙ্গব চেহারা আবার ফিরে এসেছে, এবং তার সহকর্মীরা প্রবল মার দিতে দিতে বলতে থাকে তাকে তারা ধর্ষণ করবে। হয়ত তারা তা করতও যদি না সময় কর্তৃপক্ষ তাদের থামাতে সমর্থ হতেন। ফৌজিয়াকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে সময় কর্তৃপক্ষ হামদর্দের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। পরবর্তীকালে তাঁরা ফৌজিয়াকে জানান হামদর্দ থেকে লোকটির চাকরি গেছে।

অর্থাৎ এই ভয়াবহ ঘটনার মূল হোতা চাকরি খুইয়েই পার পেয়ে গেছে, যদি হামদর্দ কর্তৃপক্ষ সময়কে মিথ্যা না বলে থাকে। সময় কর্তৃপক্ষ, ফৌজিয়া বা হামদর্দ কেউই লোকটার বিরুদ্ধে মামলা করেননি। সময় টেলিভিশন করতে পারত যেহেতু তার কর্মী অফিসে আসার পথেই আক্রান্ত হয়েছেন এবং বিষয়টি তার সব নারীকর্মীর নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত। ফৌজিয়া করতে পারতেন যেহেতু তিনি নিজে আক্রান্ত। করতে পারতেন হামদর্দ কর্তৃপক্ষ কারণ লোকটি প্রতিষ্ঠান হিসাবে তাঁদের সুনামের ক্ষতি করেছে। ফৌজিয়া নিজে মানসিক ও শারীরিকভাবে এতটাই বিপর্যস্ত ছিলেন যে বিষয়টি নিয়ে তাঁর পক্ষে আর আগানো সম্ভব হয়নি।

প্রতিষ্ঠান দু'টি কেন লোকটিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাল না তা আমার জানা নেই। শুধু এটুকু বলতে পারি লোকটির যাতে আরো কঠোর শাস্তি হয় সেজন্য গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান হিসাবে সময় টেলিভিশন আরো অনেক কিছু করতে পারত। এটি তার করা উচিত ছিল বলে আমি মনে করি কারণ এ ধরনের একটি ঘটনার সঠিক প্রচারণা, দায়ী ব্যক্তির শাস্তি সমাজে অনেক ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। পথেঘাটে মেয়েদের যে নিত্য লাঞ্ছনাকে আমরা সকলেই প্রতিকারহীন বলে মেনে নিয়েছি। আবার আমাদের মধ্যে অনেকেই এসবকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনকে চোখ ঠেরে স্বস্তি পেতে চেষ্টা করেন।

কোনো গণমাধ্যম তার নারীকর্মীদের ক্ষেত্রে এসব ঘটনা প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা রাখলে, প্রচারে নামলে আমরা সকলেই বিষয়টির ব্যাপকতা সম্পর্কে সজাগ হই, মেয়েরা প্রতিবাদের সাহস পান, আর জননাঙ্গসর্বস্বতায় ভুগতে থাকা অসুস্থ এসব লোক বুঝতে পারে তারা যা করছে তা অপরাধ এবং এজন্য তাদের দায়ী থাকতে হবে।

নারী সংবাদকর্মীদের একত্রিত হওয়ার প্রসঙ্গ আসে এখানেই। আমাদের এই চরম বৈরী সামাজিক পরিবেশে নারী সংবাদকর্মীরা পেশার কারণে যত তুচ্ছই হোক না কেন কিছু ক্ষমতার অধিকারী। ফলে ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তাঁদের পক্ষেই সম্ভব এসব ঘটনার বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা। তবে তা করতে হলে ঐক্যবদ্ধভাবে করতে হবে কারণ একার প্রতিবাদ আমাদের খুব বেশ দূর নিয়ে যাবে না।

রাস্তাঘাটে নারীর লাঞ্ছনার সবচেয়ে বড় বিপদের দিক আমার অভিজ্ঞতায় আশেপাশের মানুষের–বেশীর ভাগই তাঁরা পুরুষ এবং কী আশ্চর্য সেখানে নারীও অনেক সময় যোগ দেন– লাঞ্ছনাকারীর পক্ষাবলম্বন। পথে লাঞ্ছনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে কতবার যে এই গণবিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। আর আক্রান্ত মেয়েটির বিরোধিতা করতে গিয়ে জনগণের সে কী উত্তেজনা! কত তার রূপ! বেশীর ভাগেরই অবশ্য লোকটি কীভাবে মেয়েটিকে অপমান করেছিল তা জানার উদগ্র কৌতুহল। উদ্দেশ্য তাদের স্পষ্ট, মেয়েটিকে দিয়ে ঘটনাটি বলিয়ে অশ্লীল গল্প শোনার নোংরা কৌতুহল মেটানো। মেয়েটি যদি তা বলতে অস্বীকার করে তবে তাদের সম্মানে আঘাত লাগে। মেয়েমানুষের এত সাহস! এতগুলো পুরুষ মানুষ যা জিজ্ঞেস করছে তা বলতে অস্বীকার করছে আবার তাদেরই প্রতিবেশী, সহকর্মী কিংবা সতীর্থের বিরুদ্ধে কথা বলছে। এদিকে এত সমর্থনে পুষ্ট হয়ে দোষী লোকটির সাহস বেড়ে গেছে। যদিও বা মেয়েটির প্রথম প্রতিবাদে সে কিছুটা কাবু হয়েছিল আশেপাশের মানুষের সমর্থনে তার ছিঁটেফোঁটাও আর থাকে না। এবং যেহেতু তাকে কেন্দ্র করেই ঘটনা সে দ্বিগুণ বিক্রমে আবার মেয়েটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এদেশে, বিশেষ করে ঢাকা এবং যে কোনো জনবহুল বাজার জাতীয় এলাকায় এসব পরিস্থিতিতে মানুষের আচরণ এত একরকম, এত ছকে ফেলা যে আমার মাঝে মাঝে মনে হয়েছে এর যেন বা একটা গাণিতিক প্যাটার্নই রয়েছে।

পথেঘাটে মেয়েদের গায়ে হাত দেওয়া, অযাচিত মন্তব্য করা একটা কঠিন সামাজিক রোগ। নারীকে ব্যক্তি হিসাবে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতে না পারা যেমন এর কারণ, তেমনি এর পেছনে কাজ করে প্রাইভেসি বা ব্যক্তির নিজস্ব পরিসর সম্পর্কে ধারণার নিদারুণ অভাব। আমাদের অনেকের মধ্যেই যে ধারণাটি শেকড় গেড়ে আছে তা হলো, অপরিচিত কারো সম্পর্কে তার সামনেই তার চেহারা, পোশাক, অলঙ্কার এমনকি তার শরীর নিয়ে কথা বলা আমাদের অধিকার। এতে যাকে নিয়ে কথা বলা হচ্ছে তার রাগ করার বা ক্ষুব্ধ হওয়ার কিছু নেই। এ ভয়ঙ্কর ভুল ধারণা ভাঙানোর প্রয়োজনীয় পাঠ আমাদের নিতে হবে, অন্যকে দিতে হবে।

পথে নোংরামির এই সর্বত্র বিরাজিত পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে ফলতঃ অনেক সময় লাগবে বলেই মনে হয়– সেটা আদৌ পারা যাবে কিনা নির্ভর করবে আমাদের একত্রিত চেষ্টার ওপর। নারী সংবাদকর্মীদের এক হওয়ার প্রয়োজনটা সেখানেই। আর এই প্রচেষ্টার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ আসামীদের আদালতে নিয়ে যাওয়া তো বটেই তবে তার চেয়েও দরকারী 'যেখানে নোংরা আচরণ সেখানেই প্রতিরোধ' এই নীতিতে অগ্রসর হওয়া। আমাদের মধ্যে অনেকে আছেন যাঁরা আক্রান্ত হলে যাবতীয় ঝুঁকি নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবাদ করেন, অনেকে আবার নানা কারণে তা পারেন না। কিন্তু আমরা এককভাবে প্রতিবাদ করতে পারি আর না পারি, একত্রিত হয়ে এসবের প্রতিবাদ করতে হবে। এক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ পন্থা হতে পারে, কোনো সংবাদকর্মী আক্রান্ত হলে তার পরপরই সেখানে সকলে একত্র হয়ে তার প্রতিবাদ জানানো।

শেষ করছি এবিসি রেডিওর সাংবাদিককে অভিনন্দন জানিয়ে যে তিনি জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করার সাহস দেখিয়েছেন এবং দায়ী ব্যক্তিদের আদালত পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়ার ধৈর্য্য রেখেছেন, সেই সঙ্গে ধিক্কার জানাই কলাবাগান থানার ওসি তাজউদ্দিন আহমেদকে যিনি মামলা নিতে অস্বীকার করেছিলেন এবং দায়িত্বশীল পদে কর্মরত অন্যান্যদের যাঁরা সাপ্পু ও সেকুর মতো অসুস্থ মানসিকতার লোককে বাঁচানোর জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

০৫.০৮.২০১১