মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড বনাম মানবতাবোধ

সৈয়দ জাহিদ হোসেন
Published : 23 Nov 2015, 03:59 AM
Updated : 23 Nov 2015, 03:59 AM

এই তো সেদিন রাত জেগে অপেক্ষা করছিলাম যুদ্ধাপরাধী মুজাহিদের রিভিউ পিটিশনের রায় শোনার জন্য। কানাডা-প্রবাসী হবার কারণেই এ বিড়ম্বনা। কিছুটা অপ্রত্যাশিতভাবেই সাকা চৌধুরীর পিটিশনের ফয়সালাও একই সঙ্গে পেয়ে গেলাম সেই রাতে। বিশেষ করে সাকা চৌধুরীর অর্থ-বিত্ত ও পেশীশক্তি তথা তার জাতীয়-আন্তর্জাতিক প্রতিপালকদের প্রভাব-প্রতিপত্তির পরিধি সর্বজনবিদিত। আর তাই চূড়ান্ত রায় ঘোষিত হবার আগ পর্যন্ত বিচারপ্রার্থী তথা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের প্রকৃত সমর্থক কোনো মানুষই হয়তো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছিলেন না। যাহোক, শেষাবধি সমস্ত ষড়যন্ত্র তত্ত্বের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে উভয়ের ক্ষেত্রে ন্যায্য রায় ঘোষিত হয়েছে।

রায় ঘোষণার পর থেকে শুরু হল এক নিদারুণ অপেক্ষা। দিনে-রাতে, কাজের ফাঁকে বা অবসরে আন্তর্জালে বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোর খবর দেখতে থাকি ঘুরেফিরে। উদ্দেশ্য একটাই– রায় কার্যকরের ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি হল কিনা! সাকা আর মুজাহিদের ক্ষেত্রেই যে শুধু এমনটা হচ্ছে, তা নয়। এর আগেও অন্য দুই যুদ্ধাপরাধীর চূড়ান্ত রায় কার্যকরের সময়ও আরও অগণিত বাঙালির মতো অপেক্ষায় প্রহর গুনেছি। আর প্রতিটি ক্ষেত্রেই একটি আত্মজিজ্ঞাসা আমাকে তাড়িত করেছে-– আমি কি তাহলে মৃত্যুদণ্ডের কার্যকরিতায় বিশ্বাস করতে শুরু করেছি?

যদি এখনও দাবি করি যে, মৃত্যুদণ্ড, সর্বোপরি বিচার কোনো গ্রহণযোগ্য শাস্তি নয়, তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তিতে আমার সমর্থনমূলক অনুভূতির কী ব্যাখ্যা হতে পারে? আমার এই অনুভূতি কি মানবতাবোধের ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক? কেন দুটি প্রাণের অবসান হতে যাচ্ছে জেনেও কোনো প্রকার মানবিক সংবেদনশীলতা আমাকে নাড়া দিচ্ছে না? এমন কিছু আত্মজিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজতেই আজকের এই লেখার অবতারণা।

অনেকেই প্রশ্ন করেন, ধর্মান্ধ নাশকতাবাদী অথবা কোনো ফ্যাসিস্ট আদর্শে উদ্বুদ্ধ সক্রিয়তাবদীরা নির্বিচারে মানুষ হত্যা করার পর কোন প্রক্রিয়ায় বিবেকের তাড়না থেকে মুক্তি পায়? কীভাবে এই সন্ত্রাসীরা ঠাণ্ডা মাথায় জঘন্য নৃশংসতার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের পরও ন্যূনতম অনুশোচনায় পীড়িত না হয়ে পরবর্তী মুহূর্ত থেকেই আরেকটি জঘন্যতর হত্যাযজ্ঞের পরিকল্পনায় নিয়োজিত হয়?

হঠাৎ এই প্রশ্নগুলোর অবতারণা অপ্রাসঙ্গিক লাগলেও আমার ধারণা, এর উত্তরের মাঝে আমার আত্নজিজ্ঞাসার মনস্তাত্ত্বিক উত্তর অনেকটাই সন্নিবেশিত রয়েছে।

একাত্তরের সাকা-মুজাহিদের মতো পাকিস্তানি ধ্যান-ধারণার নৃশংস উপাসকদের সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন সময়ের প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ গোষ্ঠী তথা অন্যান্য ফ্যাসিবাদীদের চেতনাগত মৌলিক পার্থক্য নেই। এরা কখনও তাদের সক্রিয় বা পরোক্ষ বিরোধীতাকারীদের মনুষ্যতুল্য বিবেচনা করে না। তাদের দৃষ্টিতে, তাদের প্রতিপক্ষ চূড়ান্তভাবেই বিপথগামী এবং এমন কোনো ভয়ানক সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত যা প্রতিপক্ষের মনুষ্য পরিচয় মুছে দেয় যা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে মহাবিপর্যয় অবশ্যাম্ভাবী। গবাদি পশুপাখির মাঝে কোনো ক্ষতিকর সংক্রামক ব্যাধির প্রকোপ ঘটলে যেভাবে আক্রান্ত প্রাণিদের পৃথক করে নির্বিচারে নিধন করা হয়-– প্রতিপক্ষের ন্যূনতম সমর্থকদের বিষয়েও সাকা-মুজাহিদরা একই প্রকার দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে।

তাই স্বাধীনতার ঊষালগ্নে নিহত যে বুদ্ধিজীবীদের আমরা জাতির সূর্য্যসন্তান বলে বিবেচনা করে আহাজারি করি, মুজাহিদদের কাছে তাঁরা নিতান্তই ছিলেন পাকিস্তানবিরোধী (এবং প্রকারান্তরে ইসলামবিরোধী) ভয়ঙ্কর কোন সংক্রামক জীবানুর বাহক। আর তাই নির্মমভাবে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করতে মুজাহিদদের হাত সেদিনও এক বিন্দু কাঁপেনি। সে কারণেই আজও স্বাধীন বাংলাদেশে সাকা-মুজাহিদের অনুসারীরা দম্ভের সঙ্গে দাবি করতে পারে, বাংলাদেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই।

একাত্তর থেকে আজ অবধি সাকা-মুজাহিদদের দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হয়নি। যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করতে তাদের সমর্থকরা স্বাধীনতার চার দশক পর আবারও রক্তলোলুপ হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল। গত চার দশক জুড়ে জামায়াত-শিবিরের অব্যাহত নৃশংস রাজনৈতিক চর্চ্চার কথা তো বলাই বাহুল্য। আমাদের একটু অসাবধানতার সুযোগে তাদের অনুসারীরা আবারও একই নৃশংসতায় লিপ্ত হতে যে ন্যূনতম সঙ্কোচ করবে না সেটি নির্দ্বিধায় বলা যায়।

ফ্যাসিস্ট গোষ্ঠীগুলো তাদের প্রতিপক্ষকে যেভাবেই বিবেচনা করুক না কেন সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে, এরাই প্রকৃত অর্থে সম্পূর্ণভাবে মনুষ্যত্ববিবর্জিত। এরা এমন মনস্তাত্ত্বিক ব্যাধিতে আক্রান্ত যা তাদের মনন থেকে মানবিকতা সম্পূর্ণভাবে হরণ করে। ফলশ্রুতিতে এই ব্যধিগ্রস্তদের হাতে বারে বারে বিপন্ন হয়েছে মানবতা। সাকা-মুজাহিদদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবার মুহূর্তে যারা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দুটি মনু্ষ্যপ্রাণের অবসানের কথা ভেবে বিষাদগ্রস্ত হয়েছেন তারা হয়তো মানবতাবোধের প্রকৃত ধারণার সঙ্গে সুবিচার করেননি।

এবার আসা যাক বিচারব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে যে কোনো শাস্তি প্রদানের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যের বিষয়ে। বিচারিক শাস্তি প্রদানের মূলত একাধিক উদ্দেশ্য থাকে। প্রথমত, অপরাধের শিকার মানুষদের জন্য প্রতিকার বিধান করা; দ্বিতীয়ত, দৃষ্টান্ত স্থাপন করে অপরাপর অপরাধপ্রবণদের নতুন অপরাধ সংঘটন থেকে নিবৃত করার প্রচেষ্টা; তৃতীয়ত, সম্ভব হলে অপরাধীকে অনুতপ্ত হবার সুযোগ দিয়ে একটি সংশোধন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাবার ব্যবস্থা করা।

মৃত্যুদণ্ডের বিরূদ্ধে সবচাইতে বড় সমালোচনা এই যে, এ ধরনের চূড়ান্ত শাস্তি অপরাধীর অনুতপ্ত হয়ে সংশোধিত হবার সুযোগ তিরোহিত করে। পাশাপাশি বিচারপ্রক্রিয়ায় ত্রুটি-বিচ্যুতির দরুণ কোনো অন্যায় সংঘটিত হলেও পরবর্তীতে ভুল সংশোধনের মাধ্যমে অভিযুক্ত ব্যক্তির ন্যায়বিচার প্রাপ্তির পথও প্রাণদণ্ডের মাধ্যমে চিরতরে রোহিত হয়। তাহলে এবার শাস্তিপ্রদানের উদ্দেশ্যের নিরিখে সাকা-মুজাহিদদের মৃত্যুদণ্ডের যথার্থতার বিষয়ে আলোকপাত করা যাক।

মৃত্যুদণ্ড বাংলাদেশের বাস্তবতা। বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ একে কার্যকরী বলে বিবেচনা করে। উদাহরণস্বরূপ, মাত্র দুদিন আগেই একজন শিশুহত্যার অভিযোগে পাঁচ অভিযুক্তের মৃত্যুদণ্ডের রায় এসেছে। এ জাতীয় রায়ের বিরূদ্ধে উল্লেখযোগ্য কোনো প্রতিক্রিয়া কখনও আমরা বাংলাদেশে দেখি না।

সে ক্ষেত্রে, সাকা-মুজাহিদদের মতো ইতিহাসের জঘন্যতম ঘাতকদের অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হবার সাপেক্ষে অন্য কোনো শাস্তি প্রদান করা হলে তা বাংলাদেশের বিচারিক মানদণ্ডে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হত না। শহীদ পরিবারের সদস্য তথা বিচার-সমর্থক কোনো মানুষই সেই শাস্তি যথার্থ প্রতিকার বলে বিবেচনা করতেন না, বরং প্রত্যাখান করতেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কাদের মোল্লার রায়ের প্রেক্ষিতে উদ্ভূত পরিস্থিতি আমাদের তেমনটাই স্মরণ করিয়ে দেয়। সুতরাং মৃত্যুদণ্ড ব্যতীত অন্য কোনো রায়ে উপরে উল্লিখিত শাস্তিপ্রদানের প্রথম ও দ্বিতীয় উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ব্যাহত হত।

এবার আসা যাক শাস্তিপ্রদানের তৃতীয় উদ্দেশ্যের প্রসঙ্গে। সাকা-মুজাহিদদের সংশোধন কি আদৌ সম্ভব হত? মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত যে মানুষগুলো কখনও তাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়নি, বরং যারা বরাবর দম্ভের সঙ্গে বলেছে দেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই– অথবা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধীর গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়ানোর শখের কথা বলে অট্টহাসি হেসেছে-– 'অনুশোচনা' শব্দটি কি সেই অপরাধীদের অভিধানের অংশ কখনও হতে পারত?

পারত না। সংশোধনের পথে প্রথম ধাপ হচ্ছে দায় স্বীকার; দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে অনুশোচনা। যে অপরাধীরা তাদের ঘৃণ্য কৃতকর্ম অপরাধ হিসেবেই বিবেচনা করে না– দায় স্বীকার বা অনুশোচনার প্রশ্ন তো তাদের জন্য একেবারেই অবান্তর। সুতরাং সংশোধনের যু্ক্তিও এদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

এবার দৃষ্টি নিবদ্ধ করা যাক সাধারণভাবে মৃত্যুদণ্ডের বিরোধীতাকারীদের বিচারপ্রক্রিয়ার ভুল সংশোধনের পথ খোলা রাখার যুক্তির প্রতি। অভিযুক্তরা বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় স্বীকৃত সকল আইনি সুবিধাই ব্যবহারে সক্ষম হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল তথা দেশের সর্বোচ্চ আদালতে এদের বিরূদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

বিচারপ্রক্রিয়ায় পদ্ধতিগত ত্রুটি-বিচ্যুতির বিষয়টি বিবেচনা করতে গেলে অভিযুক্তের দ্বারা সংঘটিত অপরাধের মাত্রাও বিবেচনায় নিতে হবে। কোনো ব্যক্তির বিরূদ্ধে যখন গণহত্যার মতো নিকৃষ্টতম মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ উত্থাপিত হয় তখন তার বিচারপ্রক্রিয়ার পদ্ধতিগত ছোটখাট ত্রুটি-বিচ্যুতি বড় করে দেখার সুযোগ খুবই সীমিত। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সবচাইতে বড় সমালোচকরা এই পদ্ধতিগত বিষয়গুলোই বার বার বড় করে উপস্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে গেছে এবং আজও যাচ্ছে।

একই সঙ্গে, উদ্দেশ্য যাই হোক, বিচারপ্রক্রিয়ার সমালোচকরা বরাবরই অভিযুক্তদের অপরাধের মাত্রা বিবেচনায় নিতে এবং অপরাধের বলি মানুষের প্রতি মানবিক সংবেদনশীলতা দেখাতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। ফলশ্রুতিতে সেসব সমালোচনা ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের সমব্যথী ব্যতীত অন্য কারও কাছেই গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।

যখন লিখতে বসেছিলাম তখন সাকা-মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। আর শেষ যখন করছি তখন দণ্ড কার্যকর হয়েছে। বহুপ্রতীক্ষিত ও প্রত্যাশিত এই রায় কার্যকরের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকেরই নিজস্ব অনুভূতি থাকতে পারে। এই বিচারপ্রক্রিয়াকে কখনও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করি না-– বরং আমাদের কলঙ্কিত ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতা হিসেবে দেখি। বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে আমি আমাদের সার্বিক প্রগতির পথে অন্যতম প্রধান অন্তরায় বলে মনে করি। এই সংস্কৃতির নির্মমতম দৃষ্টান্ত ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে চার দশক ধরে পাকিস্তানপন্থীদের হাতে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের অসহনীয় অনুপস্থিতি। শুধু তাই নয়, এই নরঘাতকরা বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার পর্যন্ত হয়েছিল।

দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, জীবিত থাকলে রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অনিবার্যভাবেই এদের গাড়িতে আবারও জাতীয় পতাকা উড়বে। এটাই বাংলাদেশের নিদারুণ বাস্তবতা। রিভিউ পিটিশন খারিজ হয়ে যাবার প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির মুখপাত্রের নির্লজ্জ বয়ান এই বাস্তবতা আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।

আর তাই বাংলাদেশের সামগ্রিক বিচারিক প্রেক্ষাপট, বিচারপ্রার্থী শহীদ পরিবারগুলোর অপেক্ষা, অভিযুক্তদের অপরাধের উদ্দেশ্য ও মাত্রা, পরবর্তী জীবনে অনুশোচনার সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি তথা সংশোধনের অপারগতা এবং সর্বোপরি ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের অনুকম্পায় তাদের মুক্তিসহ পুনরায় ক্ষমতার অংশীদার হবার আশঙ্কার প্রেক্ষিতে, দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতেই হবে যে, সমকালীন যে কোনো প্রচলিত অপরাধের বিচারে মৃত্যুদণ্ড একবিংশ শতাব্দীর মানদণ্ডে মানবতাবোধের পরিপন্থী হলেও, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের জন্য অন্য কোনো শাস্তিই গ্রহণযোগ্য হত না।

পাশাপাশি প্রতিটি দণ্ড কার্যকর হবার প্রাক্কালে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ তথা নৃশংসতার শিকার পরিবারের জীবিত সদস্যদের আনন্দাশ্রু দেখে যখন আমার চোখ বার বার আর্দ্র হয়। সেই অনুভূতি কখনও মানবতাবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে না। প্রত্যেক যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সংবাদে উল্লসিত না হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছি এই ভেবে যে, অনেক বিলম্বে হলেও আমরা ইতিহাসের প্রতি কিছুটা দায়বদ্ধতা দেখাতে সমর্থ হয়েছি। একেকটি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া ইতিহাসের একেকটি কলঙ্কিত অধ্যায়ের বহুপ্রতীক্ষিত পরিসমাপ্তি।

এটা অনস্বীকার্য যে, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারপ্রক্রিয়ার প্রারম্ভ থেকে শুরু করে আজকের পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছানোর পথটি ছিল ভয়ানক কণ্টকাকীর্ণ। দেশি-বিদেশি নানা চাপ তথা ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেই এটি এগিয়ে চলেছে। আমরা এই বিচার সম্পাদনে সাফল্যের মুখ দেখলেও সাকা-মুজাহিদসহ তাদের প্রতিপালকদের নেতৃত্বে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে যে উল্টো যাত্রা শুরু হয়েছিল সেটি বন্ধ করতে আজও সক্ষম হইনি।

তাই কেবল সাকা-মুজাহিদদের দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকার সুযোগ নেই। ইতিহাসের দুই জঘন্যতম অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলেও তাদের আদর্শ থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করে পুরোপুরি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে ফিরিয়ে আনার যাত্রা অনতিবিলম্বে শুরু করা না গেলে চলমান বিচারগুলোর প্রতীকীমান ছাড়া অন্য কোনো দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব আমাদের রাষ্ট্র বা সমাজে পড়বে বলে আশ্বস্ত হতে পারছি না।

আজকের সময়গুলো তাই হোক প্রতিক্রিয়াশীল অন্ধকার শক্তির বিরূদ্ধে আমাদের চলমান সংগ্রামে দীর্ঘমেয়াদে বিজয়ী হবার প্রত্যয়ে নতুন করে দৃপ্ত হবার রাত। প্রগতির পথে আমাদের যে আরও অনেকদূর যেতে হবে।

সৈয়দ জাহিদ হোসেন: বৈজ্ঞানিক গবেষক।