মগজ-হারানো যুবকের ক্রুসেড উপাখ্যান

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 19 Nov 2015, 10:59 AM
Updated : 19 Nov 2015, 10:59 AM

ছেলেটিকে যখন আমি প্রথম দেখি, ঝাঁ-চকচকে স্মার্ট, খুব পরিষ্কার করে দাড়ি-গোঁফ কামানো, দেখলেই কেমন প্রসন্নতা জাগে। হাল ফ্যাশনের অথচ পরিমিত পরিচ্ছন্ন পোশাক, ব্যাকব্রাশ করা চুল, কথায় কথায় হাসি।

সংস্কৃতি বিষয়ে তার দারুণ কৌতূহল। এত বছর বিদেশে, এখানেই পড়াশুনা করেছে, প্রেমও করেছে খানিকটা– তারপরও জীবনে, জীবনবোধে খিচুড়ি, ডিম ভাজা, ইলিশ মাছের মতো বাঙালিয়ানা জেঁকে বসে আছে। রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে, নজরুলের 'বিদ্রোহী' কবিতার পঠনে বা লালনের গানে কণ্ঠ তার কখনও আর্দ্র, কখনও-বা বলিষ্ঠ। একবার তো কোথা থেকে এক কবিতা লিখে এনে আবৃত্তি করে চমকে দিয়েছিল আমাদের। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের এমন চুলচেরা নির্মোহ বিশ্লেষণ ও অযথা তুলনা করার প্রবণতার ব্যঙ্গ করে লেখা কবিতাটি আগে কোথাও শুনিনি। তার ভরাট কণ্ঠে আবৃত্তি শুনে আমি তো রীতিমতো মুগ্ধ।

সপ্তায় এক দুবার ফোন দিত। কারণ খুব হালকা। কোন কবিতা আসলে কোন ভাব বহন করছে, কীভাবে পঠিত হওয়া উচিত এই সব নিয়ে ম্যালা কথাবার্তা। আমি তাকে বোঝাতে ব্যর্থ হতাম যে, সে যা ভাবছে তার সিকিভাগও আমার জানা নেই। আমি বিদেশে মঞ্চে কবিতা পড়ি বটে, তবে দেশের কোনো মঞ্চে আবৃত্তি করার যোগ্য বিবেচিত হতাম না– সে সামর্থ বা অধিকার কোনোটাই আমার নেই। তবু ছেলেটি নাছোড়বান্দা।

প্রবাসে দেশের সংস্কৃতিচর্চা যেমন সহজ তেমনি কঠিন। সহজ বলতে প্রতিযোগিতা নেই। মেধার দ্বন্দ্ব নেই। সবাই সচ্ছল। ফলে ইচ্ছেমতো বই কিনে, বড়সড় হারমোনিয়াম কিনে এনে বা পায়ে দামি নূপুর জড়িয়ে পাঠ, গান, নাচ একটা করলেই হল। কে পায় আর? কত সুজন, বন্ধু, অগ্রজদের দেখলাম, কয়েক বছরেই মাথা ঘুরে যেতে। চাটগাঁ থাকলে কবিদের পেছনে ঘুরত। ভালো করে আঞ্চলিকতার বাইরে উচ্চারণও জানে না। তারাও এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হৈ চৈ ফেলে দিচ্ছে। সেটা যত না মন্দের, এদের আচার-আচরণ দেখে তার চেয়ে বেশি হতভম্ব হয়ে যাই। চেহারা-সুরতেও হামবড়া ভাব। পকেটের ডলার-পাউন্ডই এমন বানিয়ে দেয়!

শূন্যতার ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে পতনের আগ মুহূর্ত অব্দি নিজেকে সম্রাট ভাবার সোনালী ভূমি বিদেশে দলীয় সংকৃতিচর্চা দুঃসাধ্য এক ব্যাপার। আমাদের ছোটখাটো একটি দলের নিয়মিত সদস্য এই যুবকটি ভাব দেখাত না। ঠিক সময়ে এসে বসে থাকত। মাইলের পর মাইল ড্রাইভ করে বা একবেলা চাকরি খুইয়ে আসার পরও তার মুখে উচ্চবাচ্য ছিল না।

এমন বিনয়ী কর্মঠ আর সংস্কৃতিপ্রবণ যুবকটি হঠাৎ একদিন বদলে যাবার ঘোষণা দিয়ে আমাদের ছেড়ে গেল। এর আগে তাকে হঠাৎ হঠাৎ অনুপস্থিত, ফোনহীন, যোগাযোগহীন দেখে খবর নিলে জানতাম, সে ব্যস্ত বা কোথাও কাজে আছে। আস্তে আস্তে ফোন ধরাও বন্ধ করে দিল। বেশ কিছুদিন পর স্থানীয় বাংলাদেশি এক গ্রোসারি শপে হঠাৎই দেখা হল তার সঙ্গে। সে এগিয়ে এসে সালাম বা আদাব না দিলে চিনতে পারতাম না। ধর্মীয় পোশাক; চেহারা-সুরতে অন্য রকম, তবে একটা সৌম্য ভাব। এ কথা বলি না যে, তাকে দেখতে ভালো লাগছিল না। তবে পরিবর্তনের ধরন ও কারণ না বোঝা পর্যন্ত মুখ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।

আমাকে অবাক করে দিয়ে যুবকটি জানাল, সে আর কোনোদিনও দলে আসবে না। তার নানা রকম ফিরিস্তি আর মনগড়া ফতোয়া শুনে আমি তখন ক্লান্ত। বলতে থাকল, 'আমি আপনাদের অনেক ভালোবাসি। আপনাদের সঙ্গ ও ভালোবাসা কোনোদিন ভুলব না।'

কিঞ্চিৎ বিব্রত হয়ে প্রশ্ন করলাম, 'তাহলে তোমাকে কে নিষেধ করল? কী অসুবিধে তোমার?'

মাথা নিচু করে বিড়বিড় করতে থাকা যুবকটি সোজা হয়ে আমার চোখের দিকে তাকাতেই চমকে গেলাম। এ চোখ জোড়া তো আমার চেনা নয়! কথা চলতে শুরু করলে তার কণ্ঠও অজানা অচেনা মনে হতে লাগল। ভীতি-জাগানিয়া কণ্ঠে অ্যাদ্দিনের আলাপ, বিনিময়, চর্চার জন্য ক্ষমা চাইতে শুরু করল যুবকটি। তার কণ্ঠ ও চেহারায় বোঝা যাচ্ছিল কোথাও অসততা বা মিথ্যে ছিল না। সে তার বিশ্বাস থেকেই বলছিল তার ভয় ও অপরাধবোধ কীভাবে তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এই 'আজাব' থেকে মুক্তির জন্য সে আর কোনোদিনও ফিরে আসবে না। সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, এই অতীত ঝেড়ে ফেলে তার মতে, ধর্মের পথে থাকার।

সেটা মন্দ নয়। আমরা সবাই কোনো না কোনো বিশ্বাসের ওপর ভর করে বাঁচি। কোনো না কোনো অদৃশ্য শক্তি আমাদের বাঁচার উৎস। সেও তার পথ বেছে নিতেই পারে। ঘন অন্ধকার বা অতি আলোর ঝলকানিতে বিভ্রান্ত হবার পরিবর্তে বিশ্বাসের রজ্জু ভর করে জীবন পাড়ি দেওয়ায় ক্ষতির কিছু নেই। কিন্তু আমার সে আশা ভেঙে দিয়ে যুবকটি জানাল, বিশ্বাসের হঠাৎ পরিবর্তনে তার মনে হচ্ছে, অ্যাদ্দিন সে অনেক পাপ করেছে। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এত নিয়মনিষ্ঠ, ভদ্র, শান্ত ও পরিমিত যুবকটি এসব কী বলছে!

আমাদের সাধারণ দৃষ্টিতে সে সব পাপ-পূণ্য বা লাভালাভ তার কথা বলেনি সে। এত দিনের সংস্কৃতিচর্চা, কবিতা, গান, এমনকি ধর্মবিশ্বাসের কারণে ভিন্ন সম্প্রদায়ের আমাকেও তার সঙ্গে রাখতে পারছে না। বারবার বলছিল, 'আপনাকে আমি অনেক ভালোবাসি। আপনাকে পছন্দও করি, কিন্তু আমার পক্ষে আপনাদের সঙ্গে থাকা আর সম্ভব নয়।' যে কথাটি সে মুখ ফুটে বলতে পারল না, তার ভেতরেই লুকিয়ে ছিল মমার্থ।

পরে জেনেছি, তার মনে অনেক বেদনা– ধর্মীয় পরিচয়ে স্বতন্ত্র হবার কারণে আমার মতো 'ভালোমানুষ'কে সে দোয়াও করতে পারছে না। বাকি বিষয়গুলো অব্যক্ত থাকাই শ্রেয়।

এই পরিবর্তনের জন্য যুবকটিকে দোষী বা দায়ী করতে পারলে শান্তি পেতাম, কিন্তু তা তো নয়। বছরের পর বছর মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তা ও সংস্কৃতির চর্চা করে যৌবনে পথ হারানোর দায় তার একার নয়। দেশে-বিদেশে ধর্মপ্রচারের যে দায় সাধক, তাপস ও জ্ঞানীরা নিয়েছিলেন, এখন তা নিজ দায়িত্বে কাঁধে তুলে নিয়েছে উগ্রবাদীরা। এরা ব্যক্তি হলেও সংগঠিত। এদের পেছনে আছে অর্থ, মোহ, পরকাল, উম্মাদনা ও অস্ত্রের জোগান। আজকাল দেশে দেশে বহু ধর্মে বহু মতবাদে এর আছর দেখছি আমরা।

বলাবাহুল্য, বিশ্বপরিস্থিতিও অনেক যুবক-যুবতীর মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে। চতুর শ্বেতাঙ্গ ও পশ্চিমাদের ক্রুসেডের দায়িত্ব নিয়েছে সংগঠিত, সুসজ্জিত বাহিনী। অন্যদিকে চাপাতি, তলোয়ার, আত্মঘাতী বোমায় উড়ে যাচ্ছে জেহাদের নামে বিভ্রান্ত যুবক গোষ্ঠী।

এই যুবকটির হঠাৎ পরিবর্তনে তার বিশ্বাস বা ভক্তি যতটা, তার চেয়ে অধিক কাজ করেছে এদের প্ররোচনা– দেশের চাইতে বিদেশেই আজ এর ভূমিকা প্রবল। সংবাদপত্র, টিভি বা যে কোনো মিডিয়া দেখলে বোঝা যাবে, কতটা আগ্রাসী আর প্রচারসর্বস্ব এরা। মাথা চিবিয়ে খেয়ে, মগজে উগ্রতা জুড়ে দিয়ে ধর্ম কায়েম হয় না, ধর্ম তা চায়ও না। তবু তার কুপ্রভাবে পৃথিবীর বড় বড় শহরগুলো এখন আতঙ্কে, ভয়ে জড়সড়। এই যুবক কি সে পথেই পা বাড়াবে?

প্রশ্নটির উত্তর আমার জানা নেই। তবে এটুকু জানি, এদের ভুল পথ থেকে সরিয়ে আনার উদ্যোগ নেই। এই যে একজন বুদ্ধিজীবী বললেন, তিনি ভাবতেও পারেননি মৌলবাদ এভাবে বড় হয়ে উঠবে, এতেই তো বোঝা যায় বুদ্ধিবৃত্তির কানে তালা, চোখে ঠুলি। দশ বিশ বছর আগে তাঁরা সামনের জিনিস স্পষ্ট দেখতে পেতেন। এখন এক হাত দূরেও কিছু দেখতে পান না।

ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়া ও ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে থাকা এসব প্ররোচনা ও ষড়যন্ত্র বন্ধ না হলে কে কখন কোথায় কার দ্বারা উড়ে যাবে কেউ জানে না। নষ্ট মগজ, বিকল চিন্তা আর বদলে যাওয়া যুবকের চেহারা আমাকে অনেক রাত ঘুমুতে দেয়নি। এখন সমাজকে নির্ঘুম রাখছে, অতঃপর দেশ ও বিশ্ব, এটাই কি সভ্যতার নেগেটিভ দিক?

না এর ভেতরেই কোথাও লুকিয়ে রয়েছে পরিত্রাণের কোনো উপায়?

অজয় দাশগুপ্ত: কলামিস্ট।