নারী নির্যাতন বাড়ছে: গলদটা কোথায়

ফরিদা আখতার
Published : 5 August 2011, 04:01 PM
Updated : 5 August 2011, 04:01 PM

নারী নির্যাতন বাড়ছে বা এর ধরন পরিবর্তিত হয়ে ভিন্নভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে কি না তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু নারী নির্যাতন যে উল্লেখযোগ্যভাবে ঘটছে এই বিষয় নিয়ে কোন প্রশ্ন কেউ করবে না। সম্প্রতি নারী নির্যাতনের নানা ধরনের ঘটনা ঘটছে, কিন্তু সব ধরনের নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ শোনা বা দেখা যাচ্ছে না। কিছু ঘটনার প্রতিবাদ হলেও তা এক সময় আবার থেমে যাচ্ছে। পত্র-পত্রিকার দৃষ্টিও অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত যে নির্যাতিত তার বেদনা-কষ্ট-গ্লানি সব একাই বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। আর নারী নির্যাতন যে কারণে হচ্ছে, তা উৎপাটনের কোন চেষ্টাই কেউ করছে না।

তবে একটি বিষয় আমি লক্ষ্য করেছি, তা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী দেশের উন্নয়ন এবং দারিদ্র নিরসনের অনেক দাবী করলেও এই কথা বলেন না যে নারী নির্যাতন কমেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নেই, কিংবা আইন শৃংখলা সমস্যা নেই বললেও এই কথা দাবী করেন না যে নারী নির্যাতন নেই। এই সততার জন্য ধন্যবাদ জানাই। থাঙ্ক ইউ। অবশ্য বলারও কোন উপায় নেই, কারণ তা হবে বালির মধ্যে উট পাখির মাথা গুঁজে রাখার মতোই ব্যাপার। অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না, সেটাও আমরা জানি। কাজেই দেশের যতোই 'অগ্রগতি' হোক, এক জায়গায় এসে আমরা থমকে গেছি, সেটা হচ্ছে নারী নির্যাতন বন্ধ হচ্ছে না, বরং নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে।

একই সাথে এটাও বলতে চাই, নারী আন্দোলনের কাজের ধরনও বদলে গেছে। কোন একটি ঘটনা ঘটার পর নারী সংগঠন একত্রিত দল-মত নির্বিশেষে নারী হিসেবে প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়ছে না। নির্যাতিত এবং নির্যাতনকারীর রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিচয় জেনে তবে এগিয়ে আসছে। এতে আন্দোলনের গতি দুর্বল ও পক্ষপাতদুষ্ট হচ্ছে। নারী আন্দোলন হচ্ছে বিভক্ত। কাজেই নির্যাতনের বিরুদ্ধে যারা সোচ্চার হলে সমাজে মানুষ সচেতন হয়, তাদের নিস্ক্রিয়তা নারী নির্যাতন বন্ধ হবার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। একটি স্বাধীন ও নির্দলীয় নারী আন্দোলনের বড়ই প্রয়োজন। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আছে বলে অন্তত লিমন-কাদেরদের কিছুটা হলেও রক্ষা করা যায়? শুনেছি জাতীয় নারী উন্নয়ন কমিশন গঠিত হয়েছে, কিন্তু তাদের কোন চেহারা আমরা আজও দেখি নি। জাতীয় মহিলা সংস্থা এবং মহিলা অধিদপ্তরে নারী নির্যাতন বিরোধী সেল গঠিত হয়ে আছে। তাঁদের কাজ কী?

সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনা যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুমানা মঞ্জুর, ভিকারুন্নেসা নূন স্কুলের ছাত্রী নির্যাতন, বদরগঞ্জের দোররা মারার ঘটনার কথা আমরা জেনেছি, প্রতিবাদ করেছি। অবশ্য সমাধান কিছু হয়েছে এমন দাবী করা যাবে না। এরপর একই ধরনের ঘটনা ঘটেই চলেছে।

পাঠকের জন্য আমি পত্রিকা থেকে অল্প কিছু ঘটনার উদাহরণ তুলে ধরছি। নারী নির্যাতনের খবর প্রায়ই পত্রিকার ভেতরের পাতায় থাকে। সেই কারণে ভেতরের পাতা আমাদের নিয়মিত পড়তে হয়। না ভুল বলেছি, আপনা থেকেই সেখানে চোখ চলে যায়। দাগ দিয়ে কেটে রাখতে হয়। গত ২ আগস্ট, প্রথম আলোর (৪ নং পৃষ্ঠা) বিশাল বাংলার তিন ভাগের এক ভাগ বিজ্ঞাপন, আর বাকী নয়টি খবরের মধ্যে তিনটি খবরই নারী নির্যাতনের। একটি রূপগঞ্জের ঘটনা, 'স্বামী স্ত্রীকে পিটিয়ে ও শ্বাস রোধ করে হত্যা করেছে'। অপর খবরটি হচ্ছে গজারিয়ার। 'স্বামী ব্যবসার জন্য এক লাখ টাকা এনে দিতে বলে স্ত্রী ও তিন মেয়েকে বাপের বাড়ীতে পাঠিয়ে দেন। পরে সালিশে সমঝোতা করে স্ত্রীকে আবার স্বামীর বাড়ি পাঠালে স্বামী তাকে আবার পিটিয়ে আহত করে বাপের বাড়ী পাঠায়। এবং আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যায়'। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, স্বামী টাকার জন্য নির্যাতন করছে, অথচ সালিশ করে কোন প্রকার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে সেই স্বামীর কাছে পুনরায় পাঠাতে গিয়েই কি এই নারীর মৃত্যু ঘটেনি? এখানে মেয়েদের পরিবারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তাঁরা মেয়েটিকে শ্বশুর-বাড়ী পাঠাতেই ব্যস্ত বেশি!

দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার ৪ আগস্টের (৫ নং পৃষ্ঠা) অন্যান্য খবরের পাতায় ৮টি শিরোনাম রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি খবর নারী নির্যাতনের। একটি দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে 'ধর্ষিত ১২ বছর বয়সী আদিবাসী কিশোরী ধর্ষণের অপমান সইতে না পেরে বিষপান করে আত্মহত্যার' খবর (মৃত মেয়েটির ছবিও ছাপা হয়েছে, তাতে তার কষ্টের ছাপ পরিস্কারভাবে ফুটে উঠেছে)। দ্বিতীয়টি কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে 'স্বামীর নির্যাতনে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর মৃত্যু ঘটনা। গর্ভের সন্তান নষ্ট করার জন্য স্বামীর কথায় রাজী না হওয়ায় মেয়েটির ওপর নির্যাতন করা হয়। এবং গর্ভপাতের খরচের জন্য মোবাইল ফোনটিও স্বামী বিক্রি করে দেয়। স্ত্রী মোবাইল ফোনটি ফেরত চাইলে স্বামী তাকে তল পেটে লাথি মারে এবং আশংকাজনক অবস্থায় হাসপাতালে নেয়ার পথে মৃত্যু ঘটে'। তৃতীয় খবরটি হচ্ছে কুয়াকাটার কলাপাড়ায় 'ছোট বোনের সাথে প্রেম করতে ব্যর্থ হয়ে বড় বোনের ছবি কম্প্যুটারে বিকৃত করে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিলে বড় বোন আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়'। মোবাইল ফোনের ক্ষতিকর দিক নিয়ে নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যার কথা শোনা যায়, কিন্তু মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নারী নির্যাতনের বিষয়টিও প্রকাশ পাচ্ছে। সরাসরি ঘটনা বর্ণনায় মোবাইল ফোনের ব্যবহার নারী নির্যাতনের নতুন মাত্রার প্রমাণ বটে। একদিকে সালিশে দোররার মতো একেবারে পশ্চাপদ ঘটনা অন্যদিকে নতুন প্রযুক্তি দিয়ে নির্যাতন! ইন্টারনেটে পর্ণো ছবি ও তথ্য যুব বয়সের পুরুষদের বিপথগামী করছে, যার শিকার নারীই হচ্ছে। প্রযুক্তি দিয়ে এগিয়ে যাবার পরিবর্তে  পিছিয়ে যাচ্ছি না কি?

আর একটি খবর: রাঙ্গামটি থেকে 'এক কিশোরী ভাইয়ের কাছে বেড়াতে যাওয়ার জন্য খাগড়াছড়িতে এসে শহরের জিরো-মাইল এলাকায় বাসের অপেক্ষায় থাকা অবস্থায় তিন বখাটে যুবক তাকে জোর করে পাশের জংগলে নিয়ে রাতভর পাশবিক নির্যাতন করে পালিয়ে যায়। পরে পুলিশ উদ্ধার করে ডাক্তারী পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যায়। তিন বখাটে আটক হয়েছে'। (কালের কন্ঠ, ৫ জুলাই, ২০১১)। প্রশ্ন হচ্ছে, বাস স্টান্ডে কি মেয়েটি একাই ছিল? বাসের অপেক্ষমান একটি মেয়েকে নিয়ে যাবার পর পুলিশ জানলো না কেন বা কিছু করলো না কেন?

সমকাল (২৩ জুলাই, ২০১১) পত্রিকায় একটি ছোট খবর পৃষ্ঠা ৮-এ। বরগুনার 'কিশোরী জেনী মাদ্রাসায় যাবার পথে ধর্ষণের শিকার হয়ে অকালে মৃত্যু বরণ করেছে। তার বাড়ীতে এখন মাতম চলছে। ধর্ষক জিসান হায়দার তাপু এখনো গ্রেফতার হয় নি'।

এমনি ধরনের আরো অনেক খবর প্রতিদিন পত্রিকার আসছে। নারী বিয়ের আগে ও পরে, ঘরে-বাইরে সবখানে নির্যাতিত। এতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এক নোংরা চিত্র ফুটে উঠছে। আমরা দেখছি, শুনছি এবং পড়ছি। আমার আশংকা হচ্ছে, এই সব খবর গা-সওয়া হয়ে যাচ্ছে হয়তো। আগে পত্রিকার পাতায় এই ধরনের খবর দেখলেই পাঠক আতঁকে উঠতো, এখন টেলিভিশনের পর্দায় দেখানো না হলে সে খবরের মর্যাদা থাকে না। তাই পত্রিকার ভেতরের পাতার খবর, কোন খবরই নয়। পত্রিকার ক্ষেত্রেও দেখা গেছে কোন জেলায় ঘটনাটি ঘটলো তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পত্রিকার কোন পাতায় খবরটি পরিবেশিত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে শরিয়তপুরের ফতোয়ার শিকার হেনার ঘটনা একটি দৈনিকের প্রথম পাতায় ছাপার কারণে সব নারী সংগঠন ছুটে গিয়েছিল, সরকারও তৎপর হয়েছিল। অন্যদিকে, খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুমানা এবং ভিখারুন্ননেসা নূন স্কুলের ছাত্রী নির্যাতনের খবর পরিবার গোপন রেখেছিল বলে প্রথমে কেউ জানতে পারে নি। পরে পত্রিকায় প্রথম পাতায় খবরটি প্রকাশ পাবার পর সকলে জানতে পেরেছে। তার অর্থ এই যে আমি যতোই পত্রিকার পাতা ঘেটেঁ নারী নির্যাতনের খবর একত্র করি না কেন এর কোন মূল্য নেই, কারণ এ সবই ভেতরের পাতার খবর। মধ্য রাতের টেলিভিশন চ্যানেলের কিংবা সকাল বেলা বিবিসির পত্রিকা-পর্যালোচনায় এর কোন স্থান নেই। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা ভেতরের পাতা পড়েন না।

বর্তমানে নারী নির্যাতন দমনের যে আইন আছে তা যথেষ্ট কঠোর কিন্তু নারী নির্যাতনের সব ধরণ থেকে নারীকে রক্ষা করা বা নির্যাতিত নারীকে ন্যায় বিচার পেতে খুব সাহায্য করে না। নির্যাতিত নারীকে আইনের কাঠামোতে নিজের ঘটনা সাজাতে হয়, এবং সেটা করতে গিয়ে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। আমরা এটাও বুঝি আইন দিয়ে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কিংবা দমন করা সম্ভব নয়। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় (২০ জুন, ২০১১) সুপ্র ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের বরাতে বলা হয়েছে দেশে ১৫% হারে নারী নির্যাতন বাড়ছে, প্রতিদিন গড়ে ২৫ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এই চিত্র ভয়াবহ এবং প্রচণ্ডভাবে রাষ্ট্রের ব্যর্থতার পরিচয় বহন করে। আমি জানি না, এমন পরিস্থিতে মহিলা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রী, আইন মন্ত্রী, শিক্ষা মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট নীতি নির্ধারণী কর্মকর্তারা কেমন করে নিস্ক্রিয় থাকেন! দেশের আইন শৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ে যারা উদ্বিগ্ন তাদের বোঝার জন্য নারী নির্যাতনের ক্রমবর্ধমান ঘটনাগুলো একটি বড় মাপকাঠি হতে পারে।

নারী নির্যাতনকে কেবল আইনের ভাষায় বুঝলে হবে না। এটা জনস্বাস্থের জন্যও বিরাট হুমকি। প্রথম আলো (২ জুন, ২০১১) শেখ সাবিহা আলমের একটি প্রতিবেদনে বিষয়টি ফুটে উঠেছে। এই প্রতিবেদনে লন্ডনভিত্তিক চিকিৎসা বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যান্সেট-এর একটি প্রবন্ধের বরাতে বলা হয় নির্যাতনের শিকার নারীরা হৃদরোগ, আন্ত্রিক ও যৌন রোগ, মাথা ও মেরুদন্ডে ব্যথা, গর্ভধারণে জটিলতা, গর্ভস্থ শিশুর মৃত্যু, চরম বিষন্নতাসহ ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো রোগেও ভোগেন। বাংলাদেশে নির্যাতিত নারীদের আইনী সহায়তা দেন এমন সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির মতে নারীরা মাথা, মুখ, ঘাড়, বুক এবং তলপেটে আঘাত নিয়ে তাদের কাছে আসেন। তাদের মধ্যে প্রচণ্ড ভীতি ও হতাশা দেখা যায়। অথচ জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি কিংবা স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে এর কোনই প্রতিফলন নেই।

কাজেই নারী নির্যাতন শুধু কিছু ব্যক্তি পর্যায়ের সমস্যা কিংবা তাদের শাস্তির প্রশ্ন নয়। এর সাথে পুরো সমাজটাই জড়িয়ে আছে, সমাধানও রয়েছে সেখানে। আমরা এখনও যেন ঘটনার অপেক্ষায় থাকি, ঘটলে প্রতিক্রিয়ামূলক কিছু কথা বলি, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবী করি। ব্যাস। অথচ গলদটা আসলে কোথায় তার কোন ব্যাখ্যা নেই।

আজ পর্যন্ত কোন একটি কেবিনেট বৈঠকে নারী নির্যাতন প্রতিরোধের আন্ত-মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে কি? আমি শুনি নি। দেশের আইন শৃংখলা পরিস্থিতি উন্নত করতে পারলে এবং ঘরে বাইরে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে হয়তো নারী কিছুটা হলেও নিশ্চয়তা পেতে পারে। তবে নারীকে হতে হবে নিজেই শক্তিশালী। নিজের আত্মবিশ্বাস ও শক্তিই তার জন্য সবচেয়ে বড় বন্ধু।

নারী আন্দোলনকে আরও সোচ্চার হতে হবে, হতে হবে স্বাধীন এবং নির্দলীয় চরিত্রের।