৭ নভেম্বরের ঘটনাবলী: প্রয়োজন বস্তুনিষ্ঠ ও নির্মোহ বিশ্লেষণ

নাদির জুনাইদ
Published : 16 Nov 2015, 05:50 PM
Updated : 16 Nov 2015, 05:50 PM

উনিশশ পঁচাত্তর সালের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সেনা-অভ্যুত্থান ও পাল্টা-অভ্যুত্থানের কারণে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল দেশের পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস অনুধাবনের জন্য সেই ঘটনাসমূহ সম্পর্কে তাই সঠিক ধারণা থাকা জরুরি। ইতিহাসের কোনো ঘটনা সম্পর্কে একজন গবেষক যদি যথার্থভাবে তথ্য উপস্থাপন করতে চান, সে ক্ষেত্রে তাকে অবশ্যই নির্মোহ ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সেগুলো বিশ্লেষণ করতে হবে। গবেষক কেবল নির্দিষ্ট কয়েকটি দিকে প্রাধান্য দিতে পারেন না। বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণে ঘটনাটির সব দিকই ব্যাখ্যা করতে হয়। কোনো তথ্য অপ্রিয় হলেও তা উল্লেখ না করার সুযোগ নেই।

যেহেতু পঁচাত্তরের নভেম্বরের ঘটনাসমূহের অনেক দিক সম্পর্কেই আমরা বিভিন্ন সময় পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পেয়েছি, নতুন প্রজন্মের মানুষদের ইতিহাস সম্পর্কে স্পষ্ট ও সঠিক ধারণা দেওয়ার জন্য অবশ্যই বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে ও নৈর্ব্যক্তিকভাবে সে সময়ের ঘটনাসমূহ বিশ্লেষণ করতে হবে।

কয়েক দিন আগেই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের মতামত বিশ্লেষণ পাতায় ৭ নভেম্বর নিয়ে পরপর প্রকাশিত হয়েছে দুটি লেখা। মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীরউত্তমের জ্যেষ্ঠ কন্যা সংসদ সদস্য মাহজাবিন খালেদ সেই দিনগুলির স্মৃতিচারণ করেছেন। আর লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তমের ভাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন সে সময় খালেদ মোশাররফ আর আবু তাহের কী চেয়েছিলেন সে সম্পর্কে উপস্থাপন করেছেন নিজের বিশ্লেষণ। দুজনই তাদের লেখায় বস্তুনিষ্ঠ অনুসন্ধান ও সত্যাশ্রয়িতার সঙ্গে তথ্য উপস্থাপনের গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেছেন।

ড. আনোয়ার হোসেনের দীর্ঘ লেখাটি মনোযোগ দিয়ে পাঠ করার পর কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের সেটিতে অনুপস্থিতি লক্ষ্য করেছি। অথচ সে সময়ের ইতিহাস সম্পর্কে স্পষ্ট ও পূর্ণ ধারণা প্রদানের জন্য তাঁর বিশ্লেষণে সে তথ্যসমূহ উল্লেখ করা দরকার ছিল এবং তেমনটি হলে হয়তো তাঁর রচনায় আত্মসমালোচনার সুযোগ সৃষ্টি করত। আত্মসমীক্ষণ একটি রচনার গুরুত্ব কেবল বাড়িয়েই তোলে। ড. আনোয়ার হোসেনের কোনো কোনো বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ রয়েছে বলে এ লেখায় সে দিকগুলোয় আলোকপাত করা হল।

ড. আনোয়ার হোসেন প্রশ্ন তুলেছেন মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি গণযুদ্ধে অংশগ্রহণের পরও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তৎকালীন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ঔপনিবেশিক কাঠামোর সেনাবাহিনীতে বিদ্যমান কর্তৃত্বকামী, জনবিচ্ছিন্ন মানসিকতা থেকে মুক্ত হতে পেরেছিলেন কি না তা নিয়ে। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় সেনা-অফিসারদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের প্রবণতা তিনি ঔপনিবেশিক সেনাবাহিনীর সঙ্গে মানানসই মানসিকতা ধারণ করার প্রভাব হিসেবেই দেখেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, কর্নেল তাহের সেনাবাহিনীর ঔপনিবেশিক ধাঁচের চিন্তা আর পরিচালনা পদ্ধতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনতে আগ্রহী ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে সেনাবাহিনীর ভরণপোষণে জাতীয় আয়ের বৃহৎ অংশ ব্যয়ের পরিবর্তে এমন একটি উৎপাদনমুখী সেনাবাহিনী গঠন করা হোক যেখানে সেনাসদস্যরা কৃষক শ্রমিক সাধারণ মানুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জাতীয় উন্নয়নে অংশগ্রহণ করবেন।

মুক্তিযুদ্ধের পর কুমিল্লা সেনানিবাসের ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে কর্নেল তাহের তাঁর ব্রিগেডের সদস্যদের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত করেন। সেনাসদস্যরা জমিতে কৃষকদের সঙ্গে হাল ধরেন, নিজেদের খাবার উৎপাদন করেন নিজেরাই, অফিসার-সৈনিক সবার পরিশ্রমে গড়ে তোলা হয় ফলের বাগান। তাঁরা নৈশ স্কুলে বয়স্কদের শিক্ষা দিতে থাকেন, গ্রামীণ মানুষদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয় সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরের মাধ্যমে।

[আলতাফ পারভেজ, পৃষ্ঠা-৭৬-৮০]

কর্নেল তাহেরের এমন চিন্তা আর উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়। এটিও স্পষ্ট যে, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে প্রচলিত ধাঁচের সেনাবাহিনীর পরিবর্তে জাতীয় উৎপাদনে ভূমিকা রাখতে নিয়োজিত সেনাবাহিনী গঠনে সে সময়ের গুরুত্বপূর্ণ সেনা-কর্মকর্তাদের মধ্যে কর্নেল তাহেরই সবচেয়ে আগ্রহী ছিলেন। ১৯৭২ সালে তিনি স্বেচ্ছায় সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন এবং পরবর্তীতে জাসদের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে তিনি ছিলেন জাসদের সশস্ত্র গণসংগঠন গণবাহিনীর প্রধান।

কিছু প্রশ্ন এই পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে ৭ নভেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে গণবাহিনীর গোপন শাখা সংগঠন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার মাধ্যমে খালেদ মোশাররফ-শাফায়াত জামিলের বিরুদ্ধে যে পাল্টা অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়, তার পূর্বে সেনাবাহিনীর বেশিরভাগ অফিসার আর সৈনিকদের কি সেনাবাহিনীর প্রচলিত কাঠামো প্রত্যাখ্যানের ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলা সম্ভব হয়েছিল?

কর্নেল তাহের তাঁর অনুগত সৈনিকদের নির্দেশ দিয়েছিলেন গৃহবন্দি জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করার জন্য। ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর সেটির সঙ্গে যুক্ত অফিসারদের এবং খন্দকার মোশতাকের আধিপত্যের সময় জেনারেল জিয়া সেনাপ্রধান নিযুক্ত হন। অর্থাৎ সেই মেজররা এবং মোশতাক জেনারেল জিয়ার প্রতি আস্থা রেখেছিলেন। সে ক্ষেত্রে কর্নেল তাহের কী কারণে চিন্তা করেছিলেন হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারী গোষ্ঠীর আস্থাভাজন জেনারেল জিয়া সেনাবাহিনীর ঔপনিবেশিক কাঠামো ভেঙে উৎপাদনমুখী নতুন সেনাবাহিনী গঠনের পরিকল্পনা সমর্থন করবেন?

৭ নভেম্বরের সিপাহী অভ্যুত্থানের সময় বিপ্লবী সৈনিকরা অফিসারদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখায়। 'অফিসারদের রক্ত চাই' এমন স্লোগানও সেদিন শোনা গিয়েছিল (শাফায়াত জামিল, পৃষ্ঠা-১৪৫)। কিন্তু উৎপাদনমুখী সেনাবাহিনী কি কেবল সিপাহীদের পক্ষেই সৃষ্টি করা সম্ভব? সেনা-অফিসারদের কি নতুন ধরনের সেনাবাহিনী গঠনের জন্য আগ্রহী করা সম্ভব ছিল না? কর্নেল তাহের কুমিল্লা ব্রিগেডে থাকাকালীন কি অফিসার, সৈনিকরা একসঙ্গে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেননি? তাহলে ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের সময় কেন অফিসারদের বিরুদ্ধে সৈনিকদের বিক্ষুব্ধ করে তোলা হয়েছিল এবং কেন গণবাহিনী নেতারা অফিসারদের বাদ দিয়ে কেবল সিপাহী অভ্যুত্থানই করতে চেয়েছিলেন?

আবার জেনারেল জিয়ার মতো সেনাবাহিনীর গতানুগতিক কাঠামো টিকিয়ে রাখতে আগ্রহী অফিসারকে কিন্তু ঠিকই সে রাতে অভ্যুত্থানকারীরা নিজেদের পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্ত করেছিলেন সেনাবাহিনীর অনেক সদস্যের সমর্থনপ্রাপ্তির জন্য (আলতাফ পারভেজ, পৃষ্ঠা-১২৭)। যদি কর্নেল তাহের এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার প্রতি সেনাবাহিনীতে ব্যাপক সমর্থন থাকত, তাহলে জেনারেল জিয়ার সহায়তা ছাড়াই তাহেরের অনুসারীরা বিপ্লব সফল করতে পারতেন। কিন্তু পরবর্তী ঘটনাধারায় বোঝা যায়, সে সময় সেনাবাহিনীর প্রচলিত কাঠামোতে বৃহৎ পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে বিপুল সংখ্যক সেনাসদস্যকে মানসিকভাবে প্রস্তুত না করেই জাসদের গণবাহিনী ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তাহলে সে অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য আসলে কী ছিল এবং কীভাবেই-বা গণবাহিনী নেতারা তাদের বিপ্লব সফল হবে এ আশা করেছিলেন?

প্রশ্নগুলোর ব্যাখ্যা ড. আনোয়ার হোসেনের লেখায় আসেনি। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহী অভ্যুত্থানটি ছিল রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিকে উচ্ছেদ করে দেশকে পুনরায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় নিয়ে আসা। লক্ষণীয়, যে ১২ দফা দাবির ভিত্তিতে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে অংশ নেয়, তার একটি ছিল পাকিস্তান-ফেরত সামরিক বাহিনীর লোকদের ১৮ মাসের বেতন দিতে হবে (আলতাফ পারভেজ, পৃষ্ঠা-১৩৬)। বোঝা যায়, পাকিস্তান-প্রত্যাগতদের সমর্থন লাভের জন্যই দাবিটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। পাকিস্তান-প্রত্যাগতরা বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধা সেনাসদস্যদের সঙ্গে তাদের একাত্মতা তৈরি হয়নি।

ড. হোসেন তাঁর লেখায় বিভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করেছেন মেজর নাসির উদ্দিনের একটি বই থেকে। সে বইয়ে মেজর নাসির সেনাবাহিনীতে ১৯৭৩এর পরবর্তী সময় সম্পর্কে লিখেছেন,

"প্রতিটি সেনানিবাসেই মুক্তিযোদ্ধা, অমুক্তিযোদ্ধা অর্থাৎ পাকিস্তান-প্রত্যাগতদের মধ্যে বিভেদ প্রকাশ্য হয়ে ওঠে এবং এ প্রকাশ্য বিভেদ কেন্দ্র করে এমন সব ঘটনার উৎপত্তি হতে থাকে যা কখনও কখনও এ রকম ধারণার জন্ম দেয় যে দেশে বুঝি-বা একই সঙ্গে দুটি ভিন্নতর বৈশিষ্ট্যের সেনাবাহিনী উপস্থিত রয়েছে। আদর্শ ও চিন্তা-চেতনার দিক থেকেও এই পার্থক্য নানাভাবে প্রকাশ্য হয়।"

[নাসির উদ্দিন, পৃষ্ঠা-৫৩]

নিজের লেখায় ড. হোসেন মনে করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় সুদূর পাকিস্তানে অন্তরীণ থাকা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে এদেশের জনগণের মন-মানসে যে বিপ্লবী রূপান্তর ঘটে গেছে তা পরিপূর্ণভাবে অনুধাবনের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করতে পারে। ফলে প্রশ্ন তৈরি হয়, গণবাহিনী নেতারা কীভাবে আশা করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিকে উচ্ছেদ করে দেশকে পুনরায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় নিয়ে আসার বিপ্লবে পাকিস্তান-প্রত্যাগতরা আন্তরিকভাবে অংশগ্রহণ করবেন?

সত্য এই যে, ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান মোশতাক-চক্রের বিরুদ্ধে নয়, বরং খালেদ মোশাররফ-শাফায়াত জামিলের মতো মুক্তিযোদ্ধা সেনা-কর্মকর্তাদের উৎখাতের জন্য পরিচালিত হয়। অথচ এই খালেদ মোশাররফ-শাফায়াত জামিলরাই মোশতাককে গৃহবন্দি করেছিলেন। তার মন্ত্রীদের মধ্যে চার জনকে ১৫ আগস্ট ও জেল হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে সেন্ট্রাল জেলে পাঠানো হয়েছিল। খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানে তাঁর পক্ষে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণকারী সেনা এবং বিমান বাহিনীর সব অফিসাররাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। অভ্যুত্থানে খালেদ ব্যবহার করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া তিনটি বেঙ্গল রেজিমেন্ট। তাহলে খালেদ মোশাররফ-শাফায়াত জামিলরা কী করে 'মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি' হন যাদের উচ্ছেদ করার জন্য ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান ঘটানো হয়?

বরং আমরা দেখি গণবাহিনী নেতারা ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে মোশতাককে সমর্থনকারী ডানপন্থী সৈনিকদের অন্তর্ভুক্ত করতে দ্বিধা করেননি। এ প্রসঙ্গে নিজের একটি বইয়ে ড. আনোয়ার হোসেন লিখেছিলেন:

"৬ নভেম্বর রাতের যে সভায় অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এবং বিভিন্ন অপারেশনাল পরিকল্পনা নেওয়া হয় তাতে ট্যাংক রেজিমেন্টের সুবেদার সারোয়ারের নেতৃত্বে মোশতাক-ফারুক-রশিদ অনুগত কিছু সৈনিকও উপস্থিত ছিল। ১৫ আগস্টের পর থেকেই এরা ক্যান্টনমেন্টের বাইরে অবস্থান করছিল। খালেদের বেঙ্গল রেজিমেন্টের মূল প্রতিপক্ষ ছিল এরা। ৬ নভেম্বর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কর্মীদের সঙ্গে এদের একাত্মতা কর্নেল তাহেরের নজর এড়ায়নি। তিনি জানতেন, এরা সৈনিক সংস্থার সদস্য নয় বরং মোশতাকের নেতৃত্বাধীন ডানপন্থী চক্রের প্রতিই তাদের আনুগত্য। কিন্তু একটি সাধারণ গণঅভ্যুত্থানে শামিল হওয়া থেকে তাদের নিবৃত্ত করার বাস্তবতা এবং যুক্তি কোনোটাই তখন খুব একটা ছিল না। তাছাড়া আমাদের আরেকটা ধারণা ছিল যে, ওই গোষ্ঠীটি অভ্যুত্থানে শামিল থাকলে অভ্যুত্থানের একটি বড় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সামরিকভাবে নিষ্ক্রিয় রাখা যাবে।

এছাড়া ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পর ট্যাংক রেজিমেন্টের ঘাতক চক্রের অধিকাংশ উর্ধ্বতন সেনা-কর্মকর্তাকেই খালেদ মোশাররফরা নির্বিঘ্নে দেশের বাইরে চলে যেতে দিয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া হয়েছিল, নেতৃত্বহীন এসব সৈন্য গণঅভ্যুত্থানের বিরোধী অবস্থানে যেতে পারবে না।"

[আনোয়ার হোসেন, পৃষ্ঠা-৯৯-১০০]

১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অফিসারদের দেশ থেকে চলে যেতে দিয়েছেন এবং নিজেকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিযুক্তি প্রদানের জন্য খালেদ মোশাররফ মোশতাকের সঙ্গে দেনদরবার করেছেন, এই দুটি কারণে ড. হোসেন খালেদ মোশাররফের সমালোচনা করেছেন। ফারুক-রশিদ-ডালিম-নূর চক্রের বিরুদ্ধে খালেদ-জামিলের নেতৃত্বে পরিচালিত অভ্যুত্থানটি ড. হোসেনের মতে খুনি মোশতাক-চক্রের সঙ্গে আঁতাতের মধ্য দিয়ে করুণ পরিণতি লাভ করেছে।

খালেদ-শাফায়াতের অভ্যুত্থান সম্পর্কে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে কয়েকটি দিক পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। শাফায়াত জামিল লিখেছেন, "সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ, রক্তক্ষয় ও বেসামরিক নাগরিকের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর জন্য অনিচ্ছাসত্বেও তাদের (ফারুক-রশিদসহ অন্যান্য মেজরদের) দেশত্যাগের সেইফ প্যাসেজ দিতে রাজি হলাম আমরা। সে সময় এটা আমাদের মনে ছিল যে, বিদেশে চলে গেলেও প্রয়োজনে পরে ইন্টারপোলের সাহায্যে তাদের ধরে আনা যাবে।"

[শাফায়াত জামিল, পৃষ্ঠা-১৩৬]

মনে রাখতে হবে, ৩০টি ট্যাংক আর ১৮টি কামান এই মেজরদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এদের গ্রেফতার করতে গেলে হয়তো তারা ট্যাংক আর কামানের সাহায্যে গোলাবর্ষণ করত এবং খালেদের অনুগত বাহিনীকেও যুদ্ধবিমান থেকে গোলা নিক্ষেপ করতে হত। ফলে যে বৃহৎ ধ্বংসযজ্ঞ তৈরি হত তা পরিহার করার জন্যই হয়তো খালেদ মোশাররফ আর তাঁর অনুসারীরা ফারুক-রশিদ চক্রকে জোর করে আত্মসমর্পণ করানো থেকে বিরত থাকেন। তাছাড়া এই মেজররা যতক্ষণ দেশে ছিল ততক্ষণ খালেদ ও তাঁর অনুসারীদের জেল-হত্যাকাণ্ডের কথা জানানো হয়নি।

শাফায়াত জামিল লিখেছেন,

"ক্ষমতা দখলকারীদের সঙ্গে আমাদের টেলিফোনে যখন বাকযুদ্ধ চলছিল, তখন ঘুণাক্ষরেও আমরা জানতে পারিনি জেলে চার জাতীয় নেতার হত্যাকাণ্ডের কথা। অথচ আগের রাতেই সংঘটিত হয়েছিল ঐ বর্বর হত্যাকাণ্ড। ওসমানী ও খলিলুর রহমান ঐ ঘটনার কথা তখন জানতেন বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু তারা আমাদের কিছুই জানাননি। জানালে এভাবে ১৫ আগস্টের খুনিদের নিরাপদে চলে যেতে দেওয়া হত না। আমাদের নেগোসিয়েশন টিমকেও এ বিষয়ে কেউ কিছু আভাস দেয়নি।"

[প্রাগুক্ত]

জেলহত্যার কথা না জানানোর জন্য সেনাবাহিনীর তৎকালীন চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে ৪ নভেম্বর শাফায়াত জামিল গ্রেফতারও করেন।

[প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১৩৮]

নিজেকে সেনাপ্রধান নিযুক্তির জন্য মোশতাককে বার বার অনুরোধ করা সেই সময় খালেদ মোশাররফের দরকার ছিল না। কারণ তিনি অভ্যুত্থান সূচিত করেছিলেন মোশতাক-চক্রের বিরুদ্ধেই। মেজর নাসিরের বক্তব্যটি এখানে যৌক্তিক:

"প্রধান বিচারপতিকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করার যে পরিকল্পনা ইতিমধ্যে গৃহীত হয়েছিল, সেই প্রধান বিচারপতিই তাঁকে (খালেদ মোশাররফকে) সেনাপ্রধান হিসেবে নিযুক্তি দিতে পারতেন।"

[নাসির উদ্দিন, পৃষ্ঠা-১২৮]

তবে শুধু এই কারণগুলোর জন্য খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানকে মোশতাক-চক্রের সঙ্গে আঁতাত হিসেবে বর্ণনা করা গ্রহণযোগ্য হয় না। ১৫ আগস্টের পর ফারুক-রশিদ-ডালিম-নূর চক্র হয়ে উঠেছিল অত্যন্ত ক্ষমতাশালী। কেবলমাত্র খালেদ-শাফায়াতের অভ্যুত্থানের জন্যই কিন্তু এই মেজররা শর্তহীনভাবে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিল এবং কদিনের মধ্যে মোশতাককেও গৃহবন্দি করা হয়। এমনকি বঙ্গভবনে শাফায়াত জামিলের সঙ্গে থাকা কয়েকজন অফিসার এক পর্যায়ে মোশতাককে গুলি করতেও উদ্যত হয়েছিল। জেনারেল ওসমানীর অনুনয়-বিনয়ে সে সময় মোশতাক রক্ষা পায়।

[শাফায়াত জামিল, পৃষ্ঠা-১৩৮; নাসির উদ্দিন, পৃষ্ঠা-১৩১]

অভ্যুত্থানের শুরুতেই জাতীয় নেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা অবশ্যই খালেদ-জামিলদের বড় ব্যর্থতা নির্দেশ করে। তবে মোশতাক আর ফারুক-রশিদ চক্রের সঙ্গে আঁতাত হলে নিশ্চয়ই ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে মোশতাক-ফারুক-রশিদপন্থীরা খালেদ-শাফায়াতের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করত না। কিন্তু আমরা দেখি জাসদের অভ্যুত্থানে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সঙ্গে ট্যাংক আর আর্টিলারি রেজিমেন্টের মোশতাকপন্থী সৈনিকরা সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল এবং ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান সফল হওয়ার পরপরই খালেদ মোশাররফকে হত্যা করা হয়। শাফায়াত জামিল পালিয়ে যাওয়ার সময় আহত হয়ে ধরা পড়েন।

মনে রাখতে হবে, খালেদ-জামিলদের অভ্যুত্থানের পর মোশতাকপন্থী এই সৈনিকরা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল। ১৫ আগস্ট থেকে ফারুক-রশিদ চক্রের নিয়ন্ত্রণে থাকা ট্যাংক আর কামানগুলো বঙ্গভবন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রভৃতি স্থান থেকে সেনানিবাসে ফেরত নিয়ে আসা হয়েছিল।

[শাফায়াত জামিল, পৃষ্ঠা-১৪২]

খালেদ-শাফায়াতের অভ্যুত্থানের পর ফারুক-রশিদ চক্রকে সমর্থনকারী দুটি সেনা ইউনিট বেঙ্গল ল্যান্সার আর টু ফিল্ড আর্টিলারির সব স্তরের সৈনিক ও অফিসারদের নিরস্ত্র করে তাদের অন্তরীণ করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এরপর একটি স্ক্রিনিং কমিটির মাধ্যমে বাছাই শেষে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরুর সিদ্ধান্ত হয়।

[নাসির উদ্দিন, পৃষ্ঠা-১৩৫]

ড. হোসেন লিখেছেন, ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পর রামপুরায় টেলিভিশন কর্মকর্তাদের এবং সেনানিবাসে কয়েকজন অফিসার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা জড়িত ছিল না, খুনি মোশতাকের ঘাতক-চক্র এসব ঘটায়। কিন্তু এটাও স্পষ্ট যে, অভ্যুত্থানে গণবাহিনীর নেতারা মোশতাকপন্থী সেনাসদস্যদের যুক্ত করেছিলেন বলেই কিন্তু এরা আবার সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। ফারুক-রশিদকে সমর্থনকারী যে ট্যাংকগুলো খালেদের অভ্যুত্থানের কারণে সেনানিবাসে ফেরত এসেছিল, ৭ নভেম্বর সেগুলো আবার রাজপথে বেরিয়ে আসে। এমনকি যে টু ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্ট ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার করা হয়েছিল এবং যে রেজিমেন্ট সম্পূর্ণভাবে ফারুক-রশিদ চক্রের অনুগত ছিল, ড. আনোয়ার হোসেনের বর্ণনা থেকেই জানা যায়, ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের মূল পরিকল্পনায় ছিল সেই টু ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টেই অভ্যুত্থানে বাধাদানকারী অফিসারদের গ্রেফতার করে রাখা হবে।

[আনোয়ার হোসেন, পৃষ্ঠা-৯৪]

ইউনিটটি ফারুক-রশিদের অনুগত তা জানার পরও ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের মূল পরিকল্পনায় কিন্তু একে যুক্ত করা হয়। অভ্যুত্থান পরিচালনাকারী গণবাহিনীর নেতারা মোশতাক-চক্রের সঙ্গে খালেদ মোশাররফের আঁতাতের কথা বলেন, কিন্তু তারা নিজেরাই মোশতাক ও ফারুক-রশিদপন্থীদের অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের মূল আদর্শের প্রতি এদের মনোভাব কেমন ছিল তা কি গণবাহিনী নেতাদের তখন জানা ছিল না? মোশতাককে সমর্থনকারী ডানপন্থী সেনাসদস্যদের সঙ্গে নিয়ে গণবাহিনীর নেতারা কী করে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় নিয়ে আসার কথা চিন্তা করেছিলেন?

পরবর্তীতে জেনারেল জিয়া মুক্ত হওয়ার পর টু ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টেই অবস্থান গ্রহণ করেন। জিয়ার অনুগত সেনা-অফিসাররা সেখানে উপস্থিত হন। কর্নেল তাহেরও সেখানে যেয়ে কথা বলেন জিয়ার সঙ্গে।

ড. হোসেন তাঁর লেখার আরেকটি অংশে খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান প্রসঙ্গে লিখেছেন:

"পদাতিক বাহিনী অবস্থান নেয় ট্যাংক ও আর্টিলারির বিরুদ্ধে। সেনানিবাসসমূহে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, ব্যাপক গৃহযুদ্ধ এবং দেশে বহিঃআক্রমণের সম্ভাবনা– এইসব মিলে এক অনিশ্চিত, দুঃসহ অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয় দেশে।"

এটি পড়লে মনে হতে পারে বিভিন্ন সেনা-ইউনিট মুখোমুখি অবস্থান নেওয়ার ফলে যে পরিস্থিতি তখন তৈরি হয়েছিল, তা ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী চক্রের বিরুদ্ধে কি সে সময় প্রতিরোধ গড়ে তোলা জরুরি ছিল না? ২ নভেম্বর খালেদ-জামিলের নেতৃত্বে পদাতিক বাহিনী ট্যাংক আর কামানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল বলেই সেই খুনি মেজরদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা সম্ভব হয়েছিল।

১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তৎকালীন শীর্ষস্থানীয় সেনা-কর্মকর্তাদের কেউ ফারুক-রশিদ চক্রের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। প্রতিরোধ তৈরি করেনি রক্ষীবাহিনীও। সেনা-কর্মকর্তাদের নিস্ক্রিয়তা ছিল দুঃখজনক। সে কারণে তাঁরা সব সময় সমালোচিত হবেন। তবে দেরিতে হলেও খালেদ-শাফায়াতের পদক্ষেপ গ্রহণের জন্যই মোশতাক আর ফারুক-রশিদ-ডালিম-নূর চক্র ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল। ২ নভেম্বরের অভ্যুত্থান তাই ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ সৃষ্টি হওয়ার কথা ড. হোসেন লিখেছেন, হয়তো সে সংঘর্ষ আর গৃহযুদ্ধ এড়ানোর জন্যই খুনি মেজরদের বিদেশে চলে যেতে দেওয়া হয়েছিল। পরে ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাদের আবার গ্রেফতার করে দেশে নিয়ে আসার সুযোগ তো ছিলই।

ড. হোসেন লিখেছেন, একমাত্র জেনারেল শফিউল্লাহর প্রতিই মোশতাক আস্থা রাখেননি এবং সেনাবাহিনী থেকে তাঁকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি আরও লিখেছেন, শাফায়াত জামিল ১৫ আগস্টের পর খুনি মেজরদের পক্ষে কাজ করতে থাকেন। কিন্তু মেজর নাসিরের বর্ণনা থেকে জানা যায়, ১৫ আগস্টের পর সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনতে এবং ফারুক-রশিদ চক্রের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণে আগ্রহী ছিলেন শাফায়াত। মোশতাককে রাষ্ট্রপতি হিসেবে গ্রহণ করছেন না এমন মনোভাবও তিনি খোলাখুলি প্রকাশ করেছিলেন। এই সময় শাফায়াত জামিলের ওপর নজর রাখার জন্য গোয়েন্দা তৎপরতাও বাড়ানো হয়।

[নাসির উদ্দিন, পৃষ্ঠা-১০৬, ১১৭]

নভেম্বরের আগেই মোশতাক-চক্র সেনাবাহিনীতে নিজেদের জন্য ঝুঁকি হতে পারে এমন ৩৩ জন অফিসারকে বরখাস্তের একটি তালিকা তৈরি করে। যার প্রথম নামটি ছিল খালেদ মোশাররফের।

[প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১১৬]

দেখা যাচ্ছে, খালেদ-শাফায়াত ও অনুগত অফিসারদের মোশতাক-চক্র চিহ্নিত করেছিল বিরোধী পক্ষ হিসেবে। সেপ্টেম্বরে খালেদের সঙ্গে তাহেরের আলোচনার সময় তাঁর নির্লিপ্ততার বিষয়টি ড. হোসেন মুক্তিযুদ্ধের সময় খালেদের মাথায় আঘাত লাগার ফলে সৃষ্ট সমস্যাজনিত কারণ মনে করেছেন। নিজের বইয়ে ড. হোসেন উল্লেখ করেছেন, জেনারেল জিয়া ও কর্নেল তাহেরের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল।

[আনোয়ার হোসেন, পৃষ্ঠা-৮৬]

তাই এমনও তো হতে পারে যে, জিয়ার সঙ্গে তাহেরের ঘনিষ্ঠতা আছে এই তথ্য জানা থাকার কারণেই খালেদ তাহেরের সঙ্গে আলোচনা এবং ২ নভেম্বরের অভ্যুত্থান পরিকল্পনার কথা তাকে জানাতে আগ্রহী হননি। পরবর্তীতে দেখা গিয়েছে, গৃহবন্দি জিয়া কর্নেল তাহেরকেই টেলিফোন করে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার মাধ্যমে তাকে মুক্ত করার জন্য অনুরোধ করেন। তাহের জিয়ার সে অনুরোধে সাড়া দিলে সূচিত হয় ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান। জিয়াকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করা হল, কিন্তু মুক্তি পাওয়ার পর জিয়া তাহেরের দাবি অনুযায়ী কাজ করতে কখনও আগ্রহ দেখাননি।

খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানে কাউকে হত্যা করা হয়নি। কিন্তু ৭ নভেম্বরের পাল্টা-অভ্যুত্থানের পরপরই খালেদ এবং তাঁর দুই সঙ্গী, কর্নেল নাজমুল হুদা বীরবিক্রম এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ টি এম হায়দার বীরউত্তমকে ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্টের দপ্তরে গুলি করে হত্যা করা হয়। জেনারেল জিয়া তখন মুক্ত। কর্নেল তাহেরের অনুসারী বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্য ও মোশতাক ও ফারুক-রশিদপন্থী সৈনিকরা তখন সক্রিয়। কার বা কাদের নির্দেশে এই তিনজন বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে হত্যা করা হয়েছিল তা সুষ্ঠু অনুসন্ধানের মাধ্যমে অবশ্যই বের করা প্রয়োজন।

ড. হোসেন লিখেছেন, ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে কর্নেল তাহেরের নির্দেশ ছিল কাউকে হত্যা করা যাবে না এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা তা অক্ষরে অক্ষরে পালনও করেছে। কিন্তু এই সদস্যরা কি খালেদ-হুদা-হায়দারের হত্যাকাণ্ড ঠেকানোর চেষ্টা করেছিল? তারা তা পারেনি। তাহলে কর্নেল তাহেরের সিপাহী অভ্যুত্থানের পর সেনানিবাসে প্রকৃত অর্থে কারা শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল?

গণবাহিনীর নেতারা সেনাসদস্যদের মধ্যে সময় নিয়ে যথেষ্ট সমর্থন সৃষ্টির চেষ্টা না করেই জেনারেল জিয়ার জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে অভ্যুত্থান করতে চেয়েছিলেন। খালেদ-জামিলদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভ্যুত্থানে গণবাহিনীর নেতারা এমনকি মোশতাক আর ফারুক-রশিদপন্থী সৈনিকদেরও অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়েছিলেন। কোনো পুরনো কাঠামো পরিবর্তনের বিপ্লব কখনও এমন অসংগঠিত অবস্থায় করা যায় না। আর তাই, ড. হোসেন যেমন লিখেছেন, গণবাহিনীর সে অভ্যুত্থান পরাজিত হয়।

খালেদ মোশাররফের প্রতি গণবাহিনীর তৎকালীন নেতাদের সমালোচনা যৌক্তিক না ভিত্তিহীন তা সে সময়ের বিভিন্ন ঘটনা বিশ্লেষণের মাধ্যমেই মানুষ অনুধাবন করতে সক্ষম হবে। ৭ নভেম্বর গণবাহিনীর নেতারা যে সিদ্ধান্তসমূহ নিয়েছিলেন তা কতটা সঠিক ছিল সে সম্পর্কে তাদের আত্মসমীক্ষণ এবং আত্মসমালোচনার প্রয়োজনীয়তাও নিশ্চয়ই অস্বীকার করা যায় না। কর্নেল তাহেরের ভাই আবু ইউসুফ খান বীরবিক্রম বলেছিলেন, "৭ নভেম্বরে আমরা শত্রু-মিত্র চিনতে ভুল করেছিলাম।"

[ফেরদৌস ও চৌধুরী, পৃষ্ঠা-১৪৭]

ড. আনোয়ার হোসেনও নিজের লেখায় সত্যানুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেছেন। সন্দেহ নেই, অতীতে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনা পক্ষপাতশূন্যভাবে বিশ্লেষণ করা সম্ভব হলেই নতুন সময়ের মানুষ প্রকৃত ইতিহাস এবং অতীতে কার কী ভূমিকা ছিল সে সম্পর্কে সঠিকভাবে জানতে পারবে।

তথ্যসূত্র:

১. আলতাফ পারভেজ (সম্পাদিত), 'অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধ, কর্ণেল তাহের ও জাসদ রাজনীতি'

(ঢাকা: পাঠক সমাবেশ, ১৯৯৫)

২. কর্নেল শাফায়াত জামিল (অব:), 'একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর'

(ঢাকা: সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৮)

৩. মেজর নাসির উদ্দিন, 'গণতন্ত্রের বিপন্নধারায় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী'

(ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৭)

৪. ড. মো. আনোয়ার হোসেন, 'মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ৭ই নভেম্বর অভ্যুত্থানে কর্নেল তাহের'

(ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ২০১২)

৫. রোবায়েত ফেরদৌস ও ফিরোজ জামান চৌধুরী (সম্পাদিত), 'বিশেষ জনের বিশেষ সাক্ষাৎকার'

(ঢাকা: পাঠক সমাবেশ, ২০০৫)।