বিএনপি আর ফিনিক্স পাখি নয়

বিজন সরকার
Published : 15 Nov 2015, 05:22 AM
Updated : 15 Nov 2015, 05:22 AM

জনগণের প্রতি আস্থাহীন এবং বিদেশি গোষ্ঠীনির্ভর বিএনপির বিপথগামী রাজনীতির কৌশল নির্ধারণকারীদের মধ্যে প্রভাবশালী ছিলেন সদ্য-পদত্যাগকারী দলটির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী। সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার-উত্তর বিএনপির বিদেশ বিষয়ক সকল কিছুর দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন একসময়কার বিএনপিপন্থী এই আমলা। দলের প্রতি তাঁর আনুগত্য ছিল শর্তহীন।

২০১৪ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলনের নামে মানুষ পুড়িয়ে মারার যে যজ্ঞটি দীর্ঘ তিন মাস স্থায়ী ছিল, এটির সমন্বয়কারীদের মধ্যে শমসের মবিন একজন। তিনি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে একে 'কোলেটারেল ক্ষতি' বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।

জামায়াতে ইসলামীর প্রেতাত্মার যে সহজাত উপস্থিতি বিএনপির জিনম কোডে রয়েছে, সেটি শতভাগ প্রস্ফুটিত হয় ২০০১ থেকে ২০০৬ সময়কালে। চারদলীয় জোট সরকারের সময় বাংলাদেশের বিদেশনীতিতেও জামায়াতের প্রভাবের আকার ও প্রতিফলন স্পষ্ট ছিল। তখন পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্বে ছিলেন শসসের মবিন চৌধুরী স্বয়ং। তাঁর সময় দেশের বিদেশনীতিকে কথিত 'পূর্বমুখী' করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়ে দেশের ভিতরকার ডানপন্থাকে সমাজের গভীরে নিয়ে যাওয়া।

এর ফলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক তলানিতে চলে যায়। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হতাহতের ঘটনাগুলির সমাধান দূরের কথা, জনগণের মনে কীভাবে ভারত-বিরোধিতার চাষাবাদ করা যায় সে কাজেই তাঁর অফিস ব্যস্ত থাকত।

চারদলীয় জোট সরকারের সময় বাংলাদেশে পশ্চিমা গোষ্ঠীর পুঁজিবাদ-সম্প্রসারণবান্ধব জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থান ঘটলেও আমাদের জিএসপি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হয়নি। মার্কিন প্রশাসনকে শান্ত রাখার জন্য চীনের বিরুদ্ধে গিয়ে বাংলাদেশে তাইওয়ানের কূটনৈতিক অফিস খুলতে দিতে হয়েছিল। এ সব কিছুই হয়েছিল শমেসের মবিন পররাষ্ট্র সচিব থাকার সময়।

দলের বিভিন্ন সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী এই নেতার দলে রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা অন্য অনেক সিনিয়র নেতার তুলনায় বেশি ছিল। বিশেষত দলের সম্ভাব্য কাণ্ডারী তারেক রহমানের কাছে। বিএনপির সুবিধাবাদী রাজনীতির সঙ্গে আদর্শগতভাবেই তাঁর ভুমিকাগুলো ছিল সামঞ্জস্যপূর্ণ।

একটু পেছন ফেরা যাক। সত্তরের দশকে বঙ্গবন্ধু অসুস্থ শমসের মবিন চৌধুরীকে চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে পাঠিয়েছিলেন। পরে এই ভদ্রলোকই বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিদেশে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন। বলা যায়, তিনি এমন এক ব্যক্তিত্ব, যিনি বিএনপির কেন্দ্রের চারপাশে থাকা সকল দেশি-বিদেশি বিভিন্ন স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর পছন্দের শীর্ষে ছিলেন। যদি ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি দেশের শাসন ক্ষমতায় যেত, হলফ করেই বলা যায় যে, তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে উঠতেন।

বিএনপির মতো দলের প্রভাবশালী নেতৃত্ব থেকে যখন ক্যারিয়ার-সচেতন মানুষটি পদত্যাগ করেন, তখন একে নির্মোহভাবে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ অপরিহার্য। পদত্যাগের পর বিএনপির তরফ থেকে দুজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার মন্তব্য পাওয়া গেল। স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলামের বক্তব্য ছিল এ রকম যে, শমসের মবিন মাঠের রাজনীতিবিদ নন বলে মাঠ পর্যায়ে তাঁর এই সিদ্ধান্তে কোনো প্রভাব পড়বে না। কথাটি কি আদৌ সত্য?

বিএনপির উচ্চ পর্যায়ে মাঠের রাজনীতিতে সিদ্ধহস্ত, এমন নেতার সংখ্যা নগণ্য। পর্যবেক্ষণযোগ্য যে, দলটির নেতৃত্বের প্রতিনিধিত্বশীল কাঠামোর বিভিন্ন টার্মিনালে রয়েছে শমসের মবিনের মতো নেতাদের অবস্থান। ফলে দলটি ক্ষমতায় থাকুক চাই বাইরে– রাজনীতির ফোকাস থাকে টেবিলে, মাঠে নয়।

আবার দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য ছিল অনেকটা দার্শনিক স্টাইলে। 'ব্যক্তি যাবে, আসবে, এতে দলের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না' বলে তিনি ইতিবাচক একটি মন্তব্য করেছিলেন– 'বিএনপি কখনও ভাঙেনি। গত পঁয়ত্রিশ বছরে বিএনপি অনেক প্রতিকূল অবস্থা মোকাবেলা করেছে এবং ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠেছে।'

২০০১পরবর্তী বিএনপির মধ্যে তিনটি দৃশ্যমান প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তিনটি ধারাই সমান্তরাল– যে কোনো মূল্যে তারেক রহমানকে দলের দায়িত্ব দেওয়া; দেশে সম্ভাব্য ধর্মীয় উগ্রবাদ বিবেচনায় নিয়ে দেশবিরোধী জামায়াতে ইসলামীকে বিএনপির সহচর হিসেবে রাখা; যারা এ দুটি প্রবণতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে অক্ষম, তাদেরকে দল থেকে বের করে দেওয়ার জন্য একটি বহির্গমনের পথ উন্মুক্ত রাখা।

বলা যায়, এই তিন প্রবণতা নিয়ে বিএনপি এখন একটি 'ওয়ান-ওয়ে' বা একমুখী পথে রয়েছে। ড্রাইভিং সিটে রয়েছেন দলটির সম্ভাব্য কাণ্ডারী, তারেক রহমান। সেই পথ থেকে বিএনপির ফিরে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ফলে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যে 'ফিনিক্স পাখির মতো বিএনপির আবারও জেগে ওঠার সম্ভাবনার কথা' বললেন, সেটি কেবল রেটরিক। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্তই বিএনপির জন্য ভালো সময় গেছে। বাকি সময়, বিশেষ করে ২০০১ সালের পরবর্তীতে বিএনপি নেশাগ্রস্ত ফিনিক্স পাখির মতো কাতরাতে কাতরাতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

দলটির ভেতর অস্থিরতা জেঁকে বসেছে বললে ভুল হবে না। দলের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীরাও দীর্ঘদিন ধরে হ্যালুসিনেশনে ভুগছিলেন। তবে সেই হ্যালুসিনেশন ক্রমশ কেটে যাচ্ছে। নেতা-কর্মীরা ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকলেও, বর্তমান বাস্তবতায় দল টিকবে কি না সে সংশয় দেখা দিয়েছে। শমসের মোবিনের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে তাদের দলের যে রাজনৈতিক দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে, তা ঢাকতেই আলমগীর দলের তুলনা করেছেন ফিনিক্স পাখির সঙ্গে।

দল দীর্ঘ কয়েক বছর যাবত ক্ষমতার বাইরে। প্রশ্ন হল, সরকারবিরোধী আন্দোলনের জন্য কি কোনো ইস্যু ওরা পাননি? এর উত্তর, স্রেফ হ্যাঁ, বহু ইস্যু মাঠে ছিল। বিএনপি একটি ইস্যুও কাজে লাগায়নি। প্রসঙ্গত, আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকলে এ ধরনের একটি ইস্যু নিয়েই সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করত।

বাস্তবতা হল, কোনো ইস্যুতেই বিএনপি জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারেনি। বিএনপিকে মানুষ বিশ্বাস করেনি। মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন নির্মাণ করার রাজনৈতিক ইচ্ছা তাদের ছিল কি না, অনেকে আবার সে সংশয়ও প্রকাশ করেন। এ্ই সংশয়বাদীরা বলেন, সরকারবিরোধী আন্দোলন তীব্র করার চেয়ে খালেদা জিয়া নিজ পরিবারের নামে যে সব শাস্তিযোগ্য মামলা রয়েছে, সে সব মামলার ক্ষেত্রে সরকারের নমনীয়তা আশা করেছিলেন। এমনকি জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব তারানকো যখন নির্বাচনের আগে দুই রাজনৈতিক শিবিরের মধ্যে মধ্যস্থতার জন্য বাংলাদেশে এসেছিলেন, দুপক্ষের আলোচনায় জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে মামলাগুলির প্রসঙ্গও এসেছিল বলে গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়।

এটা লক্ষ্যণীয় যে, আন্দোলনের নামে সিংহভাগ মধ্যযুগীয় তাণ্ডবলীলা চলেছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও রায় কেন্দ্র করে। ২০১৫ সালের প্রথমদিকে তিনমাসব্যাপী যে অরাজকতা চলছিল, সেটি ছিল তারেকের ওপর জামায়াতের চাপের ফল। সরকার পরিবর্তন নিয়ে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডার বাহিনী এবং দলটির নিয়োগকৃত লবিস্টরা যতটা বেপরোয়া ছিল, তার সিকিভাগও বিএনপির কোনো স্তরে দেখা যায়নি। আর এখানেই রয়েছে বাংলাদেশের জন্য সম্ভাব্য অন্ধকার দিকটি। সাংগঠনিকভাবে বিএনপির দীর্ঘস্থায়ী দুর্বলতা মানেই ফ্যাসিস্ট জামায়াতের সাংগঠনিক সফলতা।

খালেদা জিয়া মহাজোট সরকারের কর্মকাণ্ড ২০০৮ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করেন। সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করবে এটি তাঁর চিন্তার বাইরে ছিল। একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের বিচার শুরু হওয়ার বিষয়টি বেগম জিয়াকে প্রথম রাজনৈতিকভাবে আতঙ্কিত করে তুলে। পরবর্তীতে দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা এবং ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলা তাঁর রাজনৈতিক সমীকরণ পাল্টে দেয়। সর্বশেষ জিয়া অরফ্যানেজ ট্রাস্টের মামলা– সব মিলে তারেক রহমান এবং বেগম জিয়াকে বেশ আ্ইনি ঝক্কি পোহাতে হচ্ছে।

এক সময় রাজনৈতিক কারণে এই বিষয়গুলি পাত্তা না দিলেও এখন ভিতরে ভিতরে সম্ভাব্য ফলাফলের চিন্তা মাথার রেখে প্রস্তুতি নেওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে দলটি। লন্ডন থেকে খালেদা জিয়ার ফিরতে বেশ বিলম্ব হওয়া অথবা ফিরে কিছু দিনের মধ্যেই আবারও লন্ডনে অথবা অন্য কোনো দেশে চলে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তাতে অবাক হওয়ারও কিছু থাকবে না। উল্লিখিত মামলাগুলি যত বেগবান হবে, খালেদা জিয়ার বিদেশ গমনের 'ফ্রিকোয়েন্সি' তত বাড়তে থাকবে।

বেশ কয়েকটি মৌলিক সমস্যায় আক্রান্ত এখন বিএনপি। সমস্যার উৎস, জনমনে এই মৌলিক সমস্যাগুলির প্রভাব এবং প্রভাবের আকৃতিসহ প্রাসঙ্গিক বৈশিষ্ট্যগুলি কারও অজানা নয়। এমনকি বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের সচেতন কর্মীরাও সমস্যা সম্পর্কে ভালো করেই ওয়াকিবহাল। তবে কেউ প্রকাশ্যে এ নিয়ে কথা বলতে চান না।

প্রথম সমস্যা হল, দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান লন্ডন-প্রবাসী তারেক রহমানকে নিয়ে। জনাব রহমানকে দলটির সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি বললেও অযৌক্তিক হবে না। অথচ তার ব্যক্তিগত ইমেজ ভয়ানকভাবে ঋণাত্মক। দেশে ও বিদেশে। দেশের সচেতন নাগরিক সমাজ, দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম এবং বিএনপিপন্থী বিদেশি রাষ্ট্রগুলিও তার নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল নয়।

সন্ত্রাস, দুনীতি, জঙ্গি রাজনীতির প্রতি কৌশলগত মনোভাব, ব্যক্তিগত আচার-আচরণ– সব মিলেই তারেক রহমান এমন এক ব্যক্তিত্বের অধিকারী, যা দিয়ে আওয়ামী লীগবিরোধী চল্লিশ শতাংশ ভোটের প্রতিনিধিত্বশীল কাঠামোতে নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগের মতো একটি কর্মতৎপর সংগঠনের মোকাবেলা করার জন্য যে বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতির চর্চা বিএনপির বিভিন্ন স্তরে আবশ্যক সেটি নিশ্চিত করার মতো যোগ্যতা তার নেই।

তাই পরিবারতন্ত্রের কাঠামো থেকেই তারেক রহমানের বিকল্প নেতা নির্বাচন করা দলটির জন্য সব দিক থেকে ভালো। দেশের ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতার জন্যও এটি খুবই আবশ্যক। অন্যথায় যে রাজনৈতিক শূন্যতায় আমরা রয়েছি, তাতে জামায়াতে ইসলামী সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে এবং আমরা একটি অজানা অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছি।

দ্বিতীয় সমস্যাটি হল, বিএনপির উপর জামায়াতের সাংগঠনিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আদর্শের ক্রমবর্ধিষ্ণু প্রভাব। বিএনপির জিনম কোডে যে জামায়াতের প্রেতাত্মার উপস্থিতি রয়েছে, ২০০১ সালের পর থেকে তারা কৌশলে বিএনপির অভ্যন্তরীন কাঠামোতে কোষ-বিভাজন পদ্ধতিতে সেটির চাষাবাদ করে চলছে। তারেকের সহজাত উগ্র চিন্তাধারা পুঁজি করে তারা চতুরতার সঙ্গে তাকে বিতর্কিত করে তুলেছে।

বহু-আদর্শিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বশীল বিএনপি নামক প্ল্যাটফর্মে একটি বড় অংশ রয়েছে যা আদর্শিকভাবেই বিএনপিতে জামায়াতের প্রতিনিধি। কয়েক বছর আগেও তাদের যে সকল নেতা-কর্মী উদার চিন্তা করতেন, আজকাল তাদের কর্মকাণ্ড ও চিন্তাধারা দেখে বুঝা বেশ দুরূহ যে, তারা জামায়াতের রাজনীতি করেন নাকি বিএনপির। নির্মোহ বাস্তবতা হল এই, যে ফর্মেই দেশে ধর্মীয় উগ্রবাদের প্রসার হোক না কেন, দিন শেষে এটি উগ্র ওয়াহাবিজমের কোষাগারে জমা হবে।

বিএনপিকে গবেষণা করে দেখতে হবে, জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতা নির্ধারণকারী ভোটারের কত শতাংশ জামায়াতের কারণে বিএনপিমুখী হচ্ছে না। পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে 'তবে', 'যদি', 'আন্তর্জাতিক মান' জাতীয় কৌশলী সব শব্দের ব্যবহার পরিহার করাই শ্রেয়।তরুণ প্রজন্মের মনোজগত হৃদয়াঙ্গম করতে হবে। বিএনপির নীতি-নির্ধারণকারীদের বুঝতে হবে যে, ওয়াহাবিজমের তীর্থভূমি সৌদি আরব নিজেই সংশোধিত না হলে সিরিয়ার ভাগ্য বরণ করতে দেশটিকে যুগের পর যুগ অপেক্ষা করতে হবে না।

তৃতীয়ত, বিএনপি যে দশকের পর দশক মিথ্যাচার করে আসছে, তা থেকে পুরোপুরি বের হয়ে আসতে হবে। গুজব আর ষড়যন্ত্র-নির্ভর রাজনীতি পরিহার করা দরকার। হেফাজতের সমাবেশের হতাহতের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি, অমিত শাহের সঙ্গে মিথ্যা ফোনালাপের দাবি, কংগ্রেসম্যানদের স্বাক্ষর জাল করে সরকারবিরোধী বিবৃতিদান, ১৫ আগস্ট দলীয় প্রধানের 'তথাকথিত' জন্মদিন পালনের মতো বালখিল্যতা থেকে দলটিকে নিবৃত রাখার মানসিকতাও গঠন করতে হবে। পরিবর্তনগুলি বিএনপিকে বুঝতে হবে। বুঝতে হবে যে, দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় আর সামরিক শাসন সম্ভব নয়। একমাত্র পরাশক্তির প্রভাবও আগের মতো ক্রিয়াশীল নয়।

চতুর্থত, দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুসহ সকল নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর প্রতি বিরাগভাজনপূর্ণ মানসিকতাও তাদের জিনম কোডের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের আদর্শিক এই অবস্থান সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগের একমাত্র কারণ না হলেও অন্যতম। উগ্রবাদ ও উদারবাদের মাঝামাঝি ধূসর এলাকায় নিজের অবস্থান না রেখে বিকল্প প্রগেসিভ হিসেবে বিএনপিকে সামনে নিয়ে আসতে হবে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তাদের কখনও বিশ্বাস করতে পারেনি।

প্রসঙ্গত, আওয়ামী লীগও সংখ্যালঘুদের কাছে বিশ্বাস ক্রমশ হারাচ্ছে। আজ পর্যন্ত, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপরে হামলার একটি বিচারও বঙ্গবন্ধুর দলটি করতে পারেনি। মনে রাখতে হবে, সংখ্যালঘুরা একটি দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অন্যতম উপাদান। তাদের তাড়িয়ে দিলে দেশের রাজনৈতিক-সমাজ ব্যবস্থা কেমন হয় তা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির বর্তমান অবস্থায় প্রতিফলিত।

সর্বশেষ, বিএনপি জনগণের চেয়ে বিদেশি শক্তিগুলিকে দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হওয়ার অন্যতম হাতিয়ার মনে করে। তারা ১৯৭৮ সালের হ্যালুসিনেশনে ভুগছে। দলটিকে বুঝতে হবে, পশ্চিমা গণতান্ত্রিক জোট বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রকে মোকাবেলায় সে সময় একটি প্রকল্পের আওতায় এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে রাজতন্ত্রকে সমর্থন ও সামরিক শাসক তৈরি করেছিল। জিয়াউর রহমান ও হোসেইন মুহাম্মদ এরশাদ তারই ফসল।

পশ্চিমারা এখন রাজতন্ত্র এবং সামরিক শাসকের চেয়ে আরও বেশি পুঁজিবাদ-প্রসবিত ধর্মীয় জঙ্গিবাদ নিয়ে ব্যস্ত। অধিকন্তু, বিএনপিকে বুঝতে হবে যে সস্তা ভারত-বিরোধিতা এক সময় ফলদায়ক হলেও এখন দলটির জন্য তা হিতে বিপরীত হয়ে উঠছে। নতুন বিশ্বের নতুন মেরুকরণে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও চীন হল নতুন মোড়ল।

বিএনপিকে ফিনিক্স পাখি বলে জনাব আলমগীর শমসের মবিনের পদত্যাগের মৌলিক কারণগুলির উপর একটি প্রলেপ দিতে চাচ্ছেন। এতে নিস্ক্রিয় বিএনপি সক্রিয় হয়ে উঠবে না। দলটির মৌলিক পরিবর্তন জরুরি। তা না হলে ওদের বরং গ্রীক মিথে বর্ণিত হতাশাগ্রস্ত স্টিক্স পাখির মতো রাতভর গাছের ডালে বসে কৃতকর্মের জন্য কাঁদতে হবে।