আলোর পথের যাত্রী

শারমিন আহমদ
Published : 4 Nov 2015, 09:30 AM
Updated : 4 Nov 2015, 09:30 AM

৩ নভেম্বরের জেল-হত্যাকাণ্ড নিয়ে যখুনি লিখতে বসেছি তখুনি পেলাম আরও এক মর্মান্তিক খবর। আমাদের সর্বজনশ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক স্যারের একমাত্র পুত্র, জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে, শাহবাগে, তারই অফিস-কক্ষের ভেতরে।

খবরটি শুনে সঙ্গে সঙ্গেই ইথিওপিয়া থেকে স্যারকে ফোন করেছিলাম। পুত্রশোকের এই নিদারুণ বেদনার মধ্যেও প্রথমেই আমার কুশল তিনি জিজ্ঞাসা করলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত তাজউদ্দীন আহমদ মেমোরিয়াল ট্রাস্ট ফান্ডের তৃতীয় বর্ষপূর্তির (২৮ অগাস্ট, ২০১৪) স্মারক বক্তব্যের (তাজউদ্দীন আহমদ ও প্রথম বাংলাদেশ সরকার) নির্মোহ উপস্থাপনায় তিনি সত্যান্বেষণের মাধ্যমে স্বাধীনতার বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস সংরক্ষণের কথা বলেছিলেন।

ঠিক যেন একই অন্তর্দৃষ্টি থেকেই তাঁর স্বভাবজাত শান্ত অথচ অন্তহীন বেদনামিশ্রিত কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন উচ্চ আদর্শ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এমনতরো নির্বিচার এবং অমানবিক হত্যাকাণ্ড রোধের কথা। তিনি বললেন 'মধ্যযুগীয় বর্বরতা এবং আধুনিক যুগের অনাচার দূর' এবং 'স্বাধীনতার অন্যতম অঙ্গীকার, আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমাজে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠার' প্রয়োজনীয়তার কথা। তিনি, 'জ্ঞান ও বিবেকবোধসম্পন্ন আলোকিত মানুষ সৃষ্টির' কথা উল্লেখ করলেন; যার মাধ্যমে এমনতরো অমানবিক ও পাশবিক হত্যাকাণ্ড প্রতিহত করা যায় এবং পুত্রশোকের আজীবন বেদনার মধ্যেও কিছুটা সান্তনা পাওয়া যেতে পারে।

এ বছরের বই মেলায় প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল বিজ্ঞানী ডক্টর অভিজিৎ রায়কে। তাঁরই বই প্রকাশ করার শাস্তি হিসেবে দীপনকে খুন করা হয়েছে বলে মনে করেন আবুল কাশেম স্যার। এই খুনিরা প্রকাশ্যে একের পর এক লেখক-ব্লগার এবং অতিসাম্প্রতিক প্রকাশককে খুন করে পালিয়ে যাচ্ছে এবং হত্যার হুমকি দিয়ে চলেছে, অথচ তাদেরকে ধরা সম্ভব হচ্ছে না, এটি অতি বিস্ময়কর, লজ্জাকর ও হতাশাজনক ব্যাপার।

এই খুনিরা কারা? তারা সেই ধর্মান্ধ এবং অন্ধকারের প্রতিনিধি অপশক্তি যারা অজ্ঞতা, হিংস্রতা ও ঘৃণাকে বানিয়েছে অনন্ত জ্ঞান ও করুণার আধার স্রষ্টার প্রতিনিধিস্বরূপ। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর, যে ষড়যন্ত্রকারী এবং হত্যাকারীরা রাতের আঁধারে কারাগার-অভ্যন্তরে প্রবেশ করে খুন করেছিল স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী চার জাতীয় নেতা, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী এবং কামরুজ্জামানকে এবং ১৫ অগাস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারকে, তারাও ছিল সম-মানসিকতাসম্পন্ন– অন্ধ অপশক্তি এবং স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের অংশ।

উন্নত সমাজের সঙ্গে অনুন্নত সমাজের মূল ফারাক হল জ্ঞান ও অজ্ঞানতার। উন্নত সমাজে কোনো মত প্রতিষ্ঠা করার জন্যে সাধারণত যুক্তি-বুদ্ধি প্রয়োগ করা হয় এবং তার বিপরীত মত প্রতিষ্ঠার জন্যেও একইভাবে যুক্তি-বুদ্ধির প্রাধান্য দেওয়া হয়। বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা তো স্রষ্টার আরাধনাস্বরূপ। মধ্যযুগের অন্ধকারাছন্ন ইউরোপে ইসলাম ধর্ম রেনেসাঁ বা নবজাগরণের পথিকৃৎ হয়ে ছিল জ্ঞানের বাতিঘর হয়ে। বহুমুখী জ্ঞানের অধিকারী ইসলামি আইনের পণ্ডিত ইবনে রুশদ (আভে রোঁশ) যুক্তিনিষ্ঠ মুক্তচিন্তার মশাল হয়ে ইউরোপের বিদ্বৎ-সমাজে আলোড়ন তুলেছিলেন। আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক-রপে অভিহিত ইবনে খালদুন বিভিন্ন দেশ ঘুরে বৈচিত্র্যময় জাতি ও সংস্কৃতির বিশ্লেষণ করেছিলেন ও রাষ্ট্রের উত্থান-পতনের কারণ নির্ণয় করেছিলেন। গণিতবিশারদ আল খোয়ারিজমি আল-জাবর ও আল মুকাবিলা পুস্তকে বীজগণিতের সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন।

এ ধরনের উন্নত চেতনাসম্পন্ন চিন্তাবিদরা বিরুদ্ধ মতবাদ ভয় করতেন না, বরং তাকে জানতে সচেষ্ট হতেন, বিশ্লেষণ এবং খণ্ডন করতেন বুদ্ধিবৃত্তিচর্চার সংস্কৃতি লালন করে। ইসলাম ধর্ম বা হযরত মোহাম্মদ (স.)এর বিরুদ্ধে কেউ কটূক্তি করলে তাকে যারা হত্যা করে, তারা বাস্তবিক দুর্বল, অজ্ঞ ও কাপুরুষ। শত কোটি মানুষের বিশ্বাসের ক্ষেত্র ধর্ম তো কোনো ঠুনকো বস্তু নয় যে, কারও কটূক্তিতে তা ধসে পড়বে। ধর্ম হল আগুনের মতো শক্তিস্বরূপ। যার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, কিন্তু অজ্ঞ লোকের হাতে তা ধ্বংসই নিয়ে আসে।

কোরআন শরীফে বর্ণিত হয়েছে:

"জ্ঞান ও উৎকৃষ্ট উপদেশ সহকারে তোমার প্রতিপালকের প্রতি আহবান কর এবং সৌন্দর্যমণ্ডিত আচরনের মাধ্যমে তাদেরকে বোঝাও।"

(১৬-২৫)

অন্যত্র বলা হয়েছে:

"পরম করুণাময়ের সত্যিকারের দাসরা পৃথিবীতে হাঁটে বিনয়-সহকারে। অজ্ঞ লোকেরা যখন তাদের আহ্বান করে, তারা বলে, 'শান্তি'।"

(২৫-৬৩)

একই সঙ্গে এটাও লক্ষ্যণীয় যে, আমাদের দেশের মূলধারার অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী ধর্মের বিষয়টি এড়িয়ে চলেন। ধর্মের মানবিক ব্যাখ্যা প্রদান হতে তারা বিরত থাকেন। এর ফলে এই শূন্য স্থানটিতে আসন গেঁড়ে বসে ধর্মের সংকীর্ণ ও অপব্যাখ্যাকারীরা। বিজ্ঞানমনস্কতা এবং মুক্তচিন্তার সঙ্গে ধর্মের মূল বাণীর যে সংঘাত নেই, এটি মূলধারার আলোচনায় তেমন উঠে আসে না।

অন্যদিকে, পাশ্চাত্যে বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে সকল ধর্মর নির্যাস আধ্যাত্মিক জ্ঞানের বিষয়টি, যা আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে অতীন্দ্রিয় জগতের সন্ধান দেয় এবং সমাজে ভারসাম্যতা আনে, তা আরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে।

আশির দশকে আমি যখন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমাই তখন বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা বিশেষত মলিকিউলার বায়োলজি এবং কোয়ান্টাম ফিজিক্সের ক্ষেত্রে বেশ কিছু আবিস্কার আলোড়ন তুলেছিল। বিজ্ঞানী ডক্টর ব্রুস লিপটন, ডক্টর ফ্রেড অ্যালান উলফ, ডক্টর জোন বরিসেনকো, চিকিৎসাবিদ ডক্টর ল্যারি ডসি প্রমুখের গবেষণালব্ধ ফলাফল সে যুগে জ্ঞানের জগতে নতুন মাত্রা প্রদান করেছিল।

বিশ শতকের শুরুতে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন, নিলস বোহর, মাক্স প্ল্যাঙ্ক, নিকোলা তেসলা প্রমুখ বস্তু, শক্তি, আলো এবং আলোর বিভিন্ন মাত্রার স্পন্দন (ভাইব্রেটিং ফ্রিকোয়েন্সি) নিয়ে যে যুগান্তকারী আবিস্কার এবং নতুন পথ দর্শন করেছেন, তা-ই প্রাযুক্তিক উন্নয়নের ফলে আরও অগ্রসর হয়ে বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতাকে একসূত্রে গেঁথেছে। আত্মিক উন্নয়নের চাবিকাঠি প্রার্থনা, সুচিন্তা, কৃতজ্ঞতাবোধ, দয়া, দান, ক্ষমাশীলতা প্রভৃতির অনুশীলন যে শরীরের প্রতিটি জীবকোষে, বংশধারায় (ডিএনএ) এবং পারিপার্শ্বিকতায় অসামান্য এবং হিতকারী পরিবর্তন আনতে সক্ষম তা উল্লিখিত এবং অনুল্লিখিত বিজ্ঞানীদের গবেষণায় প্রমাণিত হয়।

মানব-ইতিহাসের অতি-প্রাচীন আধ্যাত্মিক জ্ঞান আরও স্বচ্ছ হয়ে ওঠে ও ব্যাপ্তি লাভ করে বিজ্ঞানের শাণিত স্পর্শে। নব্বই দশক হতে এই বর্তমান সময় পর্যন্ত মানবদেহের কার্যক্রম, মন, চেতনা সম্পর্কে যে বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলি প্রকাশিত হয়েছে তা হতে একটি সত্যই ক্রমান্বয়ে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে যে, জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সমগ্র মানবজাতি ও বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের উৎস এক অনন্ত মহাশক্তি হতে। কোয়ান্টাম ফিজিক্সের মূলেও রয়েছে অদৃশ্য শক্তি, যাকে অনেক বিজ্ঞানী অভিহিত করেছেন 'আলো' রূপে। সকল বস্তুর উৎপত্তি এই এক অসীম বুদ্ধিসম্পন্ন মহা-আলো হতে যা স্থান ও সময়ের গণ্ডির বাইরে।

বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাসে এই মহাশক্তিকে সম্বোধন করা হয় ঈশ্বর, আল্লাহ, ভগবান,গড, জেহভা এবং আদি আমেরিকান ইনকা, মায়া, চেরকি,অ্যাজটেক প্রভৃতি গোত্র যাকে সম্বোধন করত 'দ্য গ্রেট স্পিরিট' রূপে।

বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড সেই অনন্ত আলোরই প্রতিফলন। কোরআন অনুসারে, "আল্লাহ আকাশসমূহ ও পৃথিবীর আলো…। আলোর উপর আলো। আল্লাহ যাকে চান তাকে স্বীয় আলোর দিকে পথ প্রদর্শন করেন।"

(আল কোরআন, ২৪- ৩৫)

মুণ্ডক উপনিষদ অনুসারে, "উচ্চতম সোনালী কোষে অধিষ্ঠিত নিখুঁত ব্রহ্ম (অদ্বিতীয় স্রষ্টা), সম্পূর্ণ, পূর্ণ, অতি-উজ্জ্বল, সকল আলোর আলো। যে নিজ সত্তাকে জানে, সে তা জানে।… সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড তারই আলোতে প্রতিফলিত।''

(মুণ্ডক উপনিষদ, ২-১০)

বাইবেলেও স্রষ্টাকে আলোর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে:

"… এবং শহরটির কোনো প্রয়োজন নেই যে, সূর্য অথবা চন্দ্র তার ওপর দীপ্তি ছড়াক; কারণ স্রষ্টার মহিমাই হল তার আলো।"

(রিভিলেশন, ২১-২৩)

ভূগর্ভের অতল অন্ধকারে হীরা যেমন লুকিয়ে থাকে তেমনি সকল মানব-হৃদয়েও লুক্কায়িত থাকে স্রষ্টার আলো। এই আলোকে তিলে তিলে খনন করে বের করতে হয় আত্মোউপলব্ধি ও আত্ম-পরিশুদ্ধির হাতিয়ার দিয়ে। যারা সেই সাধনা অব্যাহত রাখেন তারা হন সমাজের পথপ্রদর্শক। তাঁদের অঙ্কিত পদচিহ্ন অনুসরণ করে নবীনরা খুঁজে পায় আলোকিত পথের সন্ধান।

১ নভেম্বরে স্ত্রী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের সঙ্গে জেলে শেষ সাক্ষাতের সময় তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখা হবে না। আর ঐ একই সময়ে বন্দি তাজউদ্দীন আহমদ জেল-প্রাঙ্গনে শতাধিক মৌসুমি ফুলের চারাগাছ লাগানোর কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন। যাঁরা মৃত্যু আসন্ন জেনেও মাটিতে রোপণ করেন স্বপ্ন ও সৌন্দর্যর বীজ, তাঁরাই মৃত্যুঞ্জয়ী– আলোর পথের যাত্রী।

আদ্দিস আবাবা, ইথিওপিয়া

২ নভেম্বর, ২০১৫