শার্লি নই, জঙ্গিও নই

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 3 Nov 2015, 02:06 PM
Updated : 3 Nov 2015, 02:06 PM

আস্তিক ও নাস্তিকের দ্বন্দ্ব সভ্যতার মতোই পুরনো। রামায়ণে নাস্তিক চার্বাকদের (চারু+বাক) উল্লেখ রয়েছে। যুক্তি ও হাস্যরস সহকারে চার্বাকেরা ঈশ্বরের অনস্তিত্ব প্রমাণ করতেন, ধর্মের অসারতা নিয়ে কথা বলতেন, ব্রাহ্মণদের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করতেন। পাশ্চাত্যেও ঈশ্বর ও ধর্মদ্রোহিতার দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। আলফ্রেড নোবেল তাঁর 'নেমেসিস' নাটকে বেশ মুুন্সিয়ানার সঙ্গে গির্জা, ঈশ্বর ও ধর্মের সমালোচনা করেছেন (নাটকের এক জায়গায় খ্রিস্টানদের সঙ্গে তুলনা করে মুসলমানদের প্রশংসাও করেছেন)।

যুগে যুগে নিরস্ত্র নাস্তিকেরা ঈশ্বর, ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মগুরুদের সমালোচনা করেছেন বাচনে বা কলমে। এ সমালোচনা-টিটকারী কারও কারও মতে, 'সীমা' অতিক্রম করেছে। কিছুদিন আগে সাপ্তাহিক শার্লি পত্রিকায় একটি ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশিত হয়েছিল যাতে দেখানো হয়েছিল যে, 'পবিত্র আত্মা ঈশ্বরকে বলাৎকার করছে'। হামলা-পরবর্তী পাঁচ মিলিয়ন কপির সেই বিখ্যাত সংখ্যার একটি ব্যঙ্গচিত্রে দেখানো হয়েছে, যিশু ক্রুশে শুয়ে আছেন সমুদ্রসৈকতে, দুপাশে দুজন দিগম্বর নারী-পুরুষ। যিশু চিৎকার করে বলছেন, 'ওরে কে আছিস, আমাকে একটু পাশ ফিরিয়ে দে!'

ইওরোপে শার্লি এবং অন্য অনেক পত্রিকায় বিভিন্ন ধর্মের মহাপুরুষদের নিয়ে এ রকম শত শত ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশিত হয়েছে গত কয়েক দশকে।

আস্তিকদের অসহিষ্ণু একটি অংশ যুগে যুগে নাস্তিকদের সমালোচনার উত্তর দিয়েছে অস্ত্রের নিষ্ঠুর ভাষায়। ভিন্নতর বিশ্বাসের আস্তিকদেরও যে তারা ছেড়ে কথা বলে না তার প্রমাণ কদিন পরপরই কোনো না কোনো পীরের শিরোচ্ছেদ, মাজারে আক্রমণ, মূর্তি ভেঙে দেওয়া, গির্জায় অগ্নিসংযোগ, বর্ষীয়ান সিস্টারকে ধর্ষণ, ঢাকার হোসেনি দালানে হামলা, ভিন্নমতাবলম্বী লেখক হত্যা। প্রকাশক হত্যা ও হত্যাচেষ্টা এদের সাফল্যের টুপিতে যুক্ত হওয়া সর্বশেষ পালক!

রাষ্ট্রক্ষমতা আস্তিক ও নাস্তিক এই দুগোষ্ঠীর মধ্যে একটা ভারসাম্য রাখতে চেষ্টা করে। তবে তার পক্ষপাত আস্তিকদের দিকে। কারণ সংখ্যা-বাহুল্যের বদৌলতে আস্তিকেরাই 'কিং-মেকার'। পান থেকে চুন খসলে ধর্মের সমালোচনাকারীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে ৫৭ ধারায়। অথচ হুমায়ুন আজাদ থেকে শুরু করে নিলয় চট্টোপাধ্যায়, দীপন– কোনো লেখকের হত্যার তদন্তই এখনও শেষ হয়নি, বিচার তো 'দূর-অস্ত'। নাস্তিকেরা যখন সরকার গঠন করবে তখন তারাও হয়তো আস্তিকদের ঘাঁটাতে চাইবে না। কারণ তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে কোনো সরকার ক্ষমতায় থাকতে চায়, পুনর্নিবাচিত হতে চায়।

এমন হওয়াও অসম্ভব নয় যে, স্বার্থান্বেষী কোনো সরকারি-বেসরকারি মহল নিজেদের হীন স্বার্থে জঙ্গিদের ব্যবহার করে থাকে। প্যারিসের শার্লি পত্রিকা অফিসে হামলাকারীদের হত্যা করার ফলে জানা যায়নি তারা আসলে দাবার ঘুঁটি ছিল কিনা। ব্যবহৃত হয় শার্লিরাও। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি নিয়ে সরকারের যখন টালমাটাল অবস্থা তখন বাংলাদেশের শার্লিদের উদ্যোগে শুরু হয়েছিল শাহবাগের গণজাগরণ। সরকার অবশ্যই সেই আন্দোলনের ফায়দা লুটেছে। দুবছর ধরে শাহবাগ আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের 'ব্লগার' নাম দিয়ে একের পর এক খুন করা হচ্ছে। সরকার তাদের রক্ষায় এগিয়ে আসছে না। কারণ নদী পার হবার পর কেই-বা সেতুটা কাঁধে নিয়ে ঘুরতে চায়?

প্রাচীনকালের চার্বাকদের মূল উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ মানুষকে বিশ্বাসের বন্ধন থেকে মুক্তি দিয়ে ধর্মগুরুদের শোষণ থেকে মুক্ত করা। আধুনিক যুগের চার্বাকদের লক্ষ্য হয়তো একটি যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গড়ে তোলা। প্রশ্ন হতে পারে, ব্যক্তি শতভাগ যুক্তিবাদী হতে পারে, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক, এমন সমাজ কি কখনও গঠিত হয়েছে পৃথিবীর কোথাও?

আর মানুষ মাত্রেই নাস্তিক হয়ে উঠলেই কি সমাজে শোষণের অবসান হবে? সুযোগসন্ধানীরা ধর্ম ও ঈশ্বর ধারণার অপব্যবহার অবশ্যই করে। কিন্তু সমাজের বহু লোকের মনে এ দুটি ধারণা কি সৎ জীবনযাপনের অন্যতম অবলম্বন নয়? সভ্যতার ক্রমবিকাশে এ ধারণা দুটির কি কোনো অবদান নেই? ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা কি কোনো শান্তিই বয়ে আনে না অসহায় মানুষের মনে? যে শিশু পুতুল নিয়ে খেলছে, তার পুতুলটি আপনি কেড়ে নিতেই পারেন, কিন্তু তার কান্না থামাবেন কী দিয়ে?

'অন্ধবিশ্বাস' কথাটা স্ববিরোধী। কারণ চোখ-কান খোলা রেখে কেউ বিশ্বাস করতে পারে না। প্রশ্ন হতে পারে, সন্দেহ আর বিশ্বাস কি মানুষের জন্মগত দুটি প্রবণতা, নাকি সমাজে থাকতে থাকতে মানুষ এগুলো অর্জন করে? মানুষের মন একশৈলিক ভাস্কর্য নয়। কোনো মানুষ কি একই সঙ্গে বিশ্বাসপ্রবণ ও সন্দেহপ্রবণ হতে পারে না? যারা নিজেদের যুক্তিমনস্ক মনে করেন তারাও কি কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশ্বাস করতে বাধ্য হন না? বিশ্বাস যদি মানব-মস্তিষ্কে 'ইন-বিল্ড' হয়ে থাকে তবে আধুনিক চার্বাকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে কোনো না কোনো ফর্মে ঈশ্বর আর ধর্মের ধারণা বার বার ফিরে আসবে মানুষের জীবনে ও আচরণে।

সমাজে তৃতীয় একটি পক্ষ আছে যারা Ni Charlie, ni terroriste! (নি শার্লি, নি তেরোরিস্ত), অর্থাৎ শার্লি আর জঙ্গি– এই দুগোষ্ঠীর কোনোটির প্রতিই তাদের নিরঙ্কুশ সমর্থন নেই। উভয় গোষ্ঠীর কাছে বাচন, লিখন, আচরণ ও আক্রমণে তারা সংযম প্রত্যাশা করে। প্রাচীনকালে অসিযুদ্ধের যেমন কিছু নিয়ম ছিল, তেমনি আধুনিক যুগে আদর্শগত যুদ্ধেরও কিছু নিয়ম রয়েছে। ব্যক্তিকে আক্রমণ করা যাবে না, ব্যক্তির আইডিয়া বা আদর্শের সমালোচনা করা যাবে।

শার্লিদের তারা বলতে চায়, বিভিন্ন ধর্মের প্রবর্তকেরা হাজার বছর আগে তাদের মতো করে সমাজে পরিবর্তন আনতে চেয়েছেন। বর্তমানের পরিবর্তিত সময়ের আলোকে সেই মহাপুরুষদের চরিত্রে কালিমা লেপন করলে, তাদের কথা বা ধর্মগ্রন্থ ভুল প্রমাণ করলেই মানুষ রাতারাতি ধর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না। জাগতিক উন্নতি হলে ধর্ম ও ঈশ্বর ধারণার প্রভাব এমনিতেই কমে আসে, যেমনটা হয়েছে পাশ্চাত্যে।

জঙ্গিদের তারা বলতে চায়, মানুষের তৈরি বিচার ব্যবস্থায় যদি আস্থা না থাকে, তবে সত্যিকারের একজন আস্তিক বিচারের ভার নিজের হাতে তুলে নেবে না, পরকালে সৃষ্টিকর্তার রায়ের জন্যে অপেক্ষা করবে। ইহকালে কলমের উত্তর কলম দিয়ে দেওয়া যায়। ধর্ম ও ঈশ্বরের দীর্ঘ ঐতিহ্যের থামগুলো এতটা ঠুনকো নয় যে, ডিজিটাল ব্লগের ('ব্লগ' শব্দের মূল অর্থ 'কাঠের গুঁড়ি') আঘাতে ভেঙে পড়বে।

প্রবাদ আছে, কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়ে পবিত্র। কলম তরবারির চেয়ে শক্তিশালী। শার্লি আর জঙ্গি দুপক্ষই সংযমের সঙ্গে নিজ নিজ যুক্তি তুলে ধরুক; বিচারের ভার পাঠকের, সমাজের। কলম ভেঙে দিয়ে কোনো লাভ নেই। এক কলম ভেঙে দিলে নতুন কলম আসবে। ব্যক্তির মৃত্যু আছে, আদর্শের মৃত্যু নেই। তরবারি সাময়িকভাবে জয়ী হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী জয় কলমেরই হবে।

যে অস্ত্র দীর্ঘস্থায়ী বিজয় এনে দেবে– শার্লি ও জঙ্গি উভয় দলের সে অস্ত্রই ব্যবহার করা উচিত।

শিশির ভট্টাচার্য্য: অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়