উচ্চশিক্ষা, গবেষণার অবকাঠামো ও কিছু প্রস্তাব

সাইফুল মাহমুদ চৌধুরী
Published : 31 Oct 2015, 10:29 AM
Updated : 31 Oct 2015, 10:29 AM

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার অবকাঠামো নেই বললেই চলে। প্রথম সারির উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সবচেয়ে পুরনো। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে পরিচিত এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চমানের কোনো প্রকাশনা দেখা যায় না। একই দশা বাংলাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের।

দেশের সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয় মূলত পরিচালিত হচ্ছে 'টিচিং' বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে। আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির প্রধান শর্ত হচ্ছে, উচ্চমানের গবেষণা অবকাঠামো তৈরি। বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় এই ইনডেক্সে অনেক পিছিয়ে। তাই এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো তালিকার মধ্যে এরা স্থান করে নিতে পারেনি।

গবেষণার অবকাঠামো তৈরি সহজ নয়। বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোতে সে সব নিয়ে অনেক লেখা পড়ি। প্রবাসে পিএইচডিরত তরুণ গবেষকরা বাংলাদেশে কীভাবে গবেষণা কাঠামো তৈরি করা যায় তা নিয়ে স্বপ্ন দেখেন। এদের আশা দেখে সত্যিই ভালো লাগে। আমি দীর্ঘদিন গবেষণার সঙ্গে যুক্ত বলে ভাবলাম এ বিষয়ে কিছু লিখি। আবেগ নিয়ে অনেক কিছু লেখা যায়, তবে বাস্তবে কীভাবে সেটা প্রয়োগ করা যায় সেটাই এই লেখার উদ্দেশ্য।

বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে আমি এ লেখায় মূলত বিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণার উপর ফোকাস করব। গবেষণার মূল শক্তি হচ্ছে মেধাবী ছাত্রছাত্রী, সুযোগ্য গবেষক এবং আর্থিক অবকাঠামো। এ তিনের সমন্বয় না থাকলে উচ্চমানের গবেষণাগার তৈরি সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রতি বছর শত শত শিক্ষা্র্থী ভালো ফলাফল করে বের হয়। গবেষণার অবকাঠামো না থাকায় এবং বিদেশি ডিগ্রির দেশে একটা আলাদা সম্মান আছে বলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করার পর মেধাবীরা বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য স্কলারশিপ পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। যারা বৃত্তি নিয়ে বাইরে পড়ছে, তাদের কত জন থেকে যাচ্ছে আর কত জন ফেরত যাচ্ছে দেশে?

দেশে ফেরত যাচ্ছে যারা, তাদের সংখ্যা খুবই কম। ফিরে গেলেও তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে গবেষণায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছে। বিজ্ঞানের গবেষণার ক্ষেত্রে পিএইচডি যথেষ্ট নয়। কয়েক বছর পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণারও প্রয়োজন রয়েছে। উন্নত গবেষণার দক্ষতা এবং বিজ্ঞানী মহলে নিজেকে প্রকাশের মাধ্যমে পরিচিত করার প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে যদি সব মেধাবী শিক্ষার্থী বাইরে পিএইচডি করতে যায় তাহলে কোনোভাবেই দেশে গবেষণার অবকাঠামো তৈরি হবে না। কারণ নিজের দেশে বিজ্ঞানের উচ্চশিক্ষার অবকাঠামো তৈরি না করে উন্নতি লাভ করেনি বিশ্বের কোনো দেশ।

সাম্প্রতিককালে চীন ও ভারত নিজেদের দেশে কিছু সুপার-পিএইচডি প্রোগ্রাম তৈরি করেছে। ওসব দেশ থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশে পাড়ি জমায় ঠিকই, তবে তাদের দেশেও এখন অসংখ্য শিক্ষার্থী পিএইচডি করছে। আমার অনেক চীন বন্ধু আমেরিকায় পিএইচডি শেষ করে ফিরে গেছে নিজের দেশে। তাদের শিক্ষার্থীরা আজকাল পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণা করতেই উন্নত দেশে যায়। পিএইচডি প্রোগ্রাম তৈরি করার সঙ্গে গবেষণার অবকাঠামো তৈরি হয়ে যাচ্ছে। এই প্রোগ্রামগুলো থেকে অনেক উচ্চমানের পিএইচডি তৈরি হয়েছে, যা উন্নত বিশ্বের যে কোনো বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমতুল্য।

অবশ্য এমন প্রোগ্রাম তৈরির জন্য দরকার প্রথম সারির শিক্ষার্থীদের নিজ দেশে পিএইচডি করার জন্য উৎসাহিত করা, যোগ্য গবেষকদের নেটওয়ার্ক তৈরি এবং গবেষণার আর্থিক সঙ্গতি যা বাংলাদেশের মতো গরিব দেশের জন্য হয়তো অত্যন্ত কঠিন। তবু বলব, এটি কিন্তু সম্ভবও। সে বিষয়ে কিছু প্রস্তাবনা লেখার এ অংশে রাখব।

-১-

প্রথম বিষয়টি হচ্ছে মেধাবীদের দেশে পিএইচডি করতে উৎসাহিতকরণ। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মাস্টার্স ডিগ্রিধারীদের প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। পৃথিবীর কোনো দেশে পিএইচডি (কিছু প্রফেশনাল বিষয় বাদে, যেমন আর্কিটেকচার) না থাকলে কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান না। বাংলাদেশে পিএইচডিহীন মেধাবীদের আর্থিক সহায়তার জন্য 'লেকচারার' পজিশনটি রাখা যেতে পারে, তবে সেটা হতে হবে সাময়িকভাবে; যেমন তিন বছরের জন্য। এ সময়ের মধ্যে যারা উচ্চশিক্ষায় যেতে চান, তারা দেশে অথবা বিদেশে উচ্চশিক্ষা নেবেন অথবা অন্য পেশা নির্বাচন করবেন।

সব মেধাবী শিক্ষার্খী একাডেমিক রিসার্চে থাকবেন তা ঠিক নয়। দেশে শিক্ষা উৎসাহিত করার জন্য প্রাথমিকভাবে বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের বিভিন্ন শাখায় ২০ থেকে ২৫টি পিএইচডি প্রোগ্রাম এবং অথবা কিছু ইন্টার-ডিসিপ্লিনারি প্রোগ্রাম শুরু করা যেতে পারে। এগুলোতে স্কলারশিপের অংক উন্নত বিশের প্রায় সমমানের হলে মেধাবীদের এতে আকৃষ্ট করা যাবে।

আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে শুধু ভালো শিক্ষার্থী হলে হয় না, নতুন কিছু চিন্তা করার ক্ষমতা, মোটিভেশন ও অধ্যবসায়ের গুণ থাকতে হয়। আমেরিকান পদ্ধতিতে প্রথম দুবছর কোর্সওয়ার্ক ও প্রপোজাল ডিফেন্সের মাধ্যমে অত্যন্ত কড়াকড়ির মাধ্যমে দুর্বল ছাত্রদের ঝরিয়ে ফেলা হয়। পিএইচডি পাওয়ার শর্ত ও গবেষণায় সাফল্যের মাপকাঠি হয় উচ্চমানের প্রকাশনা।

গবেষণায় সাফল্যের পর এদেরকে পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণার জন্য দু-তিন বছর বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। সাফল্যের উপর নির্ভর করে তাদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় অথবা সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। এসব প্রোগ্রাম ধীরে ধীরে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার অবকাঠামো তৈরি করবে।

বাংলাদেশে এখন লিবারেল আর্টসে ভালো কিছু পিএইচডি প্রোগ্রাম রয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞান গবেষণার অবকাঠামোগত দুর্বলতার জন্য মেধাবীদের কখনও বিজ্ঞান বিষয়ে দেশে উচ্চশিক্ষার জন্য উৎসাহিত করা যায়নি। মানসম্মত উচ্চশিক্ষার কাঠামো প্রদান করলে এরা বাংলাদেশে পিএইচডি করবেন এবং পিএইচডি গবেষণার শক্তিশালী অবকাঠামো তৈরি হবে।

-২-

দ্বিতীয় প্রয়োজনীয় বিষয়টি হল, উচ্চমানের ফ্যাকাল্টি যাদের উচ্চশিক্ষা পরিচালনার যোগ্যতা রয়েছে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে যে উচ্চমানের বিজ্ঞানী নেই তা নয়। শিক্ষা ও গবেষণার যোগ্যতা পরিমাপ করার সঠিক মানদণ্ড না থাকায় যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা গবেষণায় মনোযোগ দেন না। এছাড়া ভালো শিক্ষার্থী ও গবেষণার কাঠামোর অনুপস্থিতি রয়েছে। রাজনীতির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক উচ্চ পদগুলো যেহেতু অর্জন করা যায়, অধিকাংশ শিক্ষক ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায়, কমবেশি রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে পড়েন। প্রভাষক পদটির জন্য পিএইচডি ডিগ্রি দরকার হয় না বলেও অনেক অযোগ্য গবেষক শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান।

আরেকটি সমস্যা হল, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেবল নিজেদের প্রতিষ্ঠানের 'ভালো' শিক্ষার্থীদের নিয়োগ দিয়ে থাকে। 'ভালো' শিক্ষার্থী পরিমাপ করার কোনো মাপকাঠিও কোথাও থাকে না। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হবার যোগ্যতা শুধু ভালো ফলাফল দিয়ে নয়, নতুন আইডিয়া বের করা এবং তা সফলভাবে সম্পাদন করার দক্ষতা দিয়েও বোঝা দরকার। এসবের অনুপস্থিতি রয়েছে দেশে।

ওদিকে, উচ্চশিক্ষার ভালো অবকাঠামো না থাকায় প্রভাষকদের বাইরের স্কলারশিপের উপর নির্ভর করতে হয়। শিক্ষার্থী যদি ইংরেজিতে দুর্বল হন তাহলে ইংরেজি-ভাষাভাষী দেশের কোনো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ পেতেও সমস্যা হয় তার। উন্নতমানের উচ্চশিক্ষা নেবার নানা প্রতিকূলতার কারণে এরা কোনোভাবে একটা পিএইচডি করে নেন। আর পিএইচডি করতে পারলেই তো প্রমোশন পেতে অসুবিধা হয় না। পিএইচডির সাফল্য যেহেতু এ দেশে কোনো মানদণ্ড নয়– পিএইচডি গবেষণার বিষয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম এবং উন্নতমানের প্রকাশনা প্রমোশনের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয় না– সেহেতু কোনোভাবে পিএইচডি অর্জনই এরা যথেষ্ট মনে করেন। অনেক ভালো প্রফেসর ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অবকাঠামোর অভাবে গবেষণায় এগুতে পারেন না। তারপরও অনেক প্রফেসরকে দেখেছি নিজস্ব উদ্যোগে গবেষণার চেষ্টা করতে। সন্দেহ নেই, তাদের সংখ্যা নেহায়েত হাতেগোণা।

একটি উদাহরণ দিই। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার হোমল্যান্ড সিকিউরিটি মন্ত্রী মন্ত্রিত্ব ছেড়ে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার প্রেসিডেন্ট পদটি নিয়েছিলেন। পদটি তাঁর কাছে অনেক আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। বাংলাদেশে এটা কল্পনার অতীত। মার্কিন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগের পর পাঁচ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে পদটি স্থায়ী হয়। এ সময়ে শিক্ষককে প্রমাণ করতে হয় যে, তিনি আন্তর্জাতিকমানের গবেষণা পরিচালনা ও প্রকাশনা এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে গবেষণার খরচ আনার ক্ষমতা রাখেন।

দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান কাঠামোতে উন্নতমানের গবেষণা প্রকাশ করা কঠিন। গবেষণার পিয়ার-রিভিউ প্রসেসে অনেক ফ্যাক্টর কাজ করে। কোন ধরনের প্রতিষ্ঠানে গবেষণাটি হয়েছে, গবেষকের রেপুটেশন, আগের পাবলিকেশন রেকর্ড, সব কিছু হিসাবে আনা হয়। বাংলাদেশে আইসিসিডিডিআরবিএর এ ধরনের রেপুটেশন রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির আন্তর্জাতিকমানের প্রকাশনার অনেক উদাহরণ রয়েছে। এদের প্রকাশনার অর্থ মূলত বাইরের প্রতিষ্ঠান থেকে আসে এবং প্রতিটি প্রকাশনা উচ্চমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে হয়।

প্রাথমিকভাবে গবেষক নেটওয়ার্ক তৈরি করতে হলে– আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে– একটা ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠা করা দরকার। এ জন্য বিভিন্ন বিষয় চিহ্নিত করে একেকটা গবেষণা টিম তৈরি করতে হবে। তার মধ্যে সাব-গ্রুপ করতে হবে বিভিন্ন রিসার্চের জন্য। আমি মনে করি, বাংলাদেশে ইউরোপিয়ান স্টাইলে প্রাথমিকভাবে এই গ্রুপগুলো চালানো যেতে পারে। এতে ভালো গ্রুপ-লিডার নির্বাচন করে তার সঙ্গে বেশ কিছু জুনিয়র বিজ্ঞানী, এমনকি কিছু সিনিয়র বিজ্ঞানীকেও কাজ করতে দেওয়া যেতে পারে। চীনে চাইনিজ একাডেমি অব সায়েন্সের অধীনে এ ধরনের অনেক গ্রপ রয়েছে।

আমাদের দেশে প্রাথমিকভাবে এ ধরনের গ্রুপে জুনিয়র মেম্বার থেকে শুরু করে সিনিয়র মেম্বার, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হলে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদে ছাড়াও এ পদে কাজ করবেন। প্রবাসে কর্মরত গষেকদের কেউ কেউ বাংলাদেশে কাজ করতে ইচ্ছুক হলে তাদের সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে একাডেমিতে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। বিদেশে সফল একজন গবেষককে বাংলাদেশে আনা সহজ নাও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে এদেরকে কনসালটেন্ট হিসেবে নেওয়া যাবে। উচ্চমানের গবেষণা প্রকাশের জন্য এ ধরনের নেটওয়ার্কের প্রয়োজন রয়েছে। ভারত ও চীন তাদের অনেক সুযোগ্য গবেষককে নিজের দেশে ফেরার ব্যাপারে উৎসাহিত করতে এ ধরনের অবস্থা তৈরি করে।

আরেকটি বিষয় না বললেই নয়। বাংলাদেশে শিক্ষক ও গবেষকদের বেতন খুবই হাস্যকর। শিক্ষকদের আন্দোলন চলছে বেতন বাড়ানোর জন্য। যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষকদের বেতন তাঁর প্রফেশনাল এক্সিলেন্সের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। একাডেমি গঠনের মাধ্যমে গবেষক ও শিক্ষকদের উচ্চমানের বেতন দেওয়াও সম্ভব যা আমি তৃতীয় পয়েন্টে বিস্তারিত বলছি।

পদগুলোতে নিয়োগের বিষয়ে এটা মানতে হবে যে, প্রফেশনাল বিষয়ে নিয়োগের ব্যাপারে প্রফেশনাল যোগ্যতাই হবে মাপকাঠি। আমেরিকায় একাডেমিক পদে নিয়োগের জন্য সিলেকশন কমিটি তৈরি করা হয়। এমনকি সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে প্রমোশনের জন্য ৬ থেকে ১২ জন উচ্চমানের গবেষকের মতামত চাওয়া হয়। আমাদের প্রস্তাবিত একাডেমি অব সায়েন্সে গ্রুপ-লিডার হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে এ ধরনের ফিল্টার ব্যবহার করে এদেরকেে একই সঙ্গে ইচ্ছানুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।

এখানে আমি আমার ব্যক্তিগত কিছু প্রস্তাব সংক্ষেপে পেশ করলাম। এর আলোকে অনেকভাবে কাঠামো তৈরি করা যায়।

-৩-

তৃতীয় বিষয়টি গবেষণার আর্থিক কাঠামো নিয়ে। গবেষণার প্রাণ হচ্ছে, খরচ। বিজ্ঞান এমনকি প্রকৌশলের কিছু বিষয়ে থিওরেটিকাল গবেষণা সম্ভব যার জন্য দরকার ভালো কম্পিউটার ও সফটওয়ার। কিন্তু এক্সপেরিমেন্টাল কাজের জন্য অনেক খরচ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষক ও গবেষকদের এটি প্রাথমিকভাবে প্রদান করে বিশ্ববিদ্যালয়। কয়েক বছর পর গ্রুপ-লিডার অথবা প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটরকে সম্পূর্ণভাবে তার গ্রুপকে ফান্ড করতে হয়। একেকটি গবেষণা গ্রুপ চালানো একেকটি ছোটখাট কোম্পানি চালানোর মতো বিষয়।

যুক্তরাষ্ট্রের মেডিকেল স্কুলগুলো আরও ভয়ঙ্কর। এখানে প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটরের বেতনও সম্পূর্ণ গ্রান্ট থেকে আনতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির প্রোগ্রাম এ ধরনের গ্রান্টের ওপর নির্ভরশীল। এ ধরনের প্রোগ্রাম আমেরিকায় সম্ভব। সেখানকার ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথের এক বছরের বাজেট প্রায় ২৮ বিলিয়ন ডলার। আরেকটি সরকারি প্রতিষ্ঠান, ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের এ বছরের বাজেট প্রায় ২.৮ বিলিয়ন। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে অসংখ্য প্রাইভেট ফান্ডিং রয়েছে যারা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার গবেষণার জন্য ডোনেশন দেয়। বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস এবং হাওয়ার্ড হিউজ এ ধরনের প্রতিষ্ঠান।

প্রতিষ্ঠানগুলো কিন্তু প্রদত্ত অর্থের যথাযোগ্য ব্যবহার চায়। তাই ওদের প্রতি বছর প্রগ্রেস রিপোর্ট প্রদান করতে হয়। কোনো অবহেলা ধরা পড়লে গ্রান্ট বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আমেরিকায় একাডেমিক প্রফেশনের চাহিদা এবং অ্যাকাউন্টিবিলিটি এত বেশি যে, এসব প্রফেশনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে রাত-দিন কাজ করতে হয়। ছাত্র পড়ানো, পিএইচডি ছাত্রদের দেখাশোনা করা ছাড়াও গবেষণার টাকা যোগাড়ের জন্য প্রতি বছর তাদের সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর কাছে গ্রান্ট প্রপোজাল লিখতে হয়। একেকটা গ্রান্ট প্রপোজাল একটা মধ্যম আকারের বই লেখার মতো। পিএইচডি গ্রান্ট করে এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দেখা হয় তার একাডেমিক যোগ্যতা, ভালো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ এবং গবেষণার অভিজ্ঞতা। পাশাপাশি দেখা হয় গবেষণা প্রোগ্রাম সুনির্দিষ্ট সময় টিকিয়ে রাখার মতো যোগ্যতাও।

প্রাথমিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নবীন অধ্যাপকদের যথেষ্ট টাকা প্রদান করে যাতে কিছুদিন তারা গবেষণা চালিয়ে যান। এ অর্থ বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে বিভিন্ন রকম। বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের বিভিন্ন বিষয়ে ৩০০,০০০ হাজার ডলার থেকে শুরু করে এক বা দু মিলিয়ন ডলারও পাওয়া যায়। সবচেয়ে বেশি হয় রসায়ন, বায়োলজি ও মেডিকেল-সম্পর্কিত বিষয়ে। কারণ এসব বিষয়ে গবেষণার খরচ অনেক।

প্রচুর অর্থ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার মানে এই নয় যে, ওরা এটা এমনি দিচ্ছে। একজন অধ্যাপক একটি সরকারি গবেষণার ফান্ড পেলে এর একটি অংশ গবেষণার কাজে ব্যবহৃত হয় এবং বাকি অংশ বিশ্ববিদ্যালয় পায়। বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে এ অংক বিভিন্ন। একে 'ওভারহেড' বলে। একজন অধ্যাপক যদি ১ মিলিয়ন ডলারের গ্রান্ট সরকার থেকে আনতে পারেন, সরকার এর ৫০ শতাংশ বা প্রায় ৫০০,০০০ ডলার বিশ্ববিদ্যালয়কে অতিরিক্ত প্রদান করেন। একজন সফল অধ্যাপক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য 'অ্যাসেট'। এ জন্য বিজ্ঞান, প্রকৌশল এবং মেডিকেল বিষয়ে অধ্যাপকদের বেতন তার সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রে বিজ্ঞান বিষয়ে একজন সহকারী অধ্যাপকের বেতন তার সম-পদের একজন নন-সায়েন্স বিষয়ের অধ্যাপকের চেয়ে বেশি হতে পারে। একই বিষয়ে একজন সহযোগী অধ্যাপকের বেতন অধ্যাপকের চেয়ে বেশি। অধ্যাপকদের রিটায়ারমেন্টের বয়স নেই। অধিকাংশ অধ্যাপক, ৭০ থেকে ৭৫ বছর বয়সে অবসর নেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় তাদের 'এমিরেটাস অধ্যাপক' হিসেবে সম্মাননা প্রদান করে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের মডেল হয়তো সম্ভব নয়; তবে গবেষণার জন্য প্রতিটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা সেন্টার অব এক্সিলেন্স করা যেতে পারে (কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন আছে), যা ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংএর গবেষকদের রিসার্চ ল্যাবরেটরি হিসেবে থাকবে। কেন্দ্রীয়ভাবে এটা করা হলে গবেষণার যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক অবকাঠামো কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকা সরকার প্রদান করেন ইউজিসির মাধ্যমে। আমার প্রস্তাব হচ্ছে, উচ্চশিক্ষার জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় করা যেতে পারে। এটা উচ্চশিক্ষার দেখভালের পাশাপাশি উচ্চশিক্ষার ফান্ডিং এজেন্সি হিসেবে কাজ করবে। ইউনিভার্সিটি গ্রান্ট কমিশনের বাজেট সম্পর্কে আমার জানা নেই। তবে কিছুদিন আগে আমার একজন ব্যাচমেটের (ভারপ্রাপ্ত ডিন) সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে জানতে পারলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৫ লাখ টাকা ৩৭ টি ডিপার্টমেন্টকে প্রদান করা হয়েছে এবং একেকটি ডিপার্টমেন্টের ভাগে পড়েছে ১ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। এ অংক যদি ডিপার্টমেন্টের প্রফেসরের সংখ্যা দিয়ে ভাগ দেওয়া হয়, একেক জন যা পাবেন তা দিয়ে কোনো গবেষণা আশা করা হাস্যকর।

সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, গবেষণার জন্য টাকার উৎস। আমেরিকায় গবেষণার টাকা আসে জনগণের ট্যাক্স থেকে। এছাড়া সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাংলাদেশে এটা করা অসম্ভব। আন্ডার-গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার টিউশন ফি উন্নত বিশ্বে অনেক। আমেরিকায় পিতামাতারা সন্তানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর টিউশন ফি তার জন্মের পর থেকেই জমাতে থাকেন।

বাংলাদেশে এ পর্যায়ে বেতন বাড়ানো যেহেতু অসম্ভব, তাই গবেষণার ব্যয় সরকারকে সংগ্রহ করতে হবে। প্রাথমিকভাবে ৫০ থেকে ১০০ কোটি টাকার বিনিয়োগে বেশ কিছু ভালো পিএইচডি প্রোগ্রাম শুরু করা সম্ভব। প্রোগ্রামটি ইউজিসি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ন্যাশনাল একাডেমিতে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের বেতন উচ্চ হতে পারে। এছাড়া কিছু গ্র্যান্ট প্রোগ্রাম থাকতে পারে যা থেকে শিক্ষকরা অতিরিক্ত বেতন নিতে পারেন। প্রতিটি গ্রান্ট প্রোগ্রাম বিদেশি বিশেষজ্ঞর মাধ্যমে রিভিউ করানো দরকার।

আরেকটা কাজ সম্ভব; তা হচ্ছে, ১৫ বছরের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আর্থিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার চেষ্টা। এ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো টিউশন ফি বাড়াতে পারে। কিছু ট্যাক্স-ফ্রি সেভিংস প্রোগ্রাম করা হলে জনগণ তাদের চাকরির বেতন থেকে নির্দিষ্ট একটি অংক জমা দেবে যা ভবিষ্যতে তাদের ছেলেমেয়ের টিউশন ফি পরিশোধের কাজে লাগবে। সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের পড়ার খরচ জোগাতে সাহায্য করতে শিক্ষা লোন ব্যাংক তৈরি করতে পারে। অনেক দেশে শিক্ষা ফ্রি। কিন্তু সেসব দেশে ট্যাক্স থেকে অনেক রেভেনিউ আসে যা বাংলাদেশে বর্তমানে সম্ভব নয়।

বাংলাদেশ সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে, ২০৪১ সালের মধ্যে ধনী দেশে পরিণত হওয়া। উচ্চশিক্ষার মান এবং ধনী দেশে পরিণত হওয়া সমার্থক শব্দ। পৃথিবীর কোনো দেশ উন্নতমানের গবেষণার অবকাঠামো তৈরি না করে ধনী দেশে পরিণত হয়নি। ভারত ও চীন এ পথে ধীরে ধীরে এগুচ্ছে।

অনেকে ভাবে, গবেষণা আসলে বাংলাদেশের জন্য নয়, আমাদের মতো গরিব দেশের জন্য দরকার প্রায়োগিক প্রযুক্তি। এটা সঠিক নয়। নতুন নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন শিল্প তৈরি হয়। আমেরিকায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন প্রযুক্তি তৈরির সঙ্গে প্রযুক্তি কীভাবে বাজারজাত করা যায় তার জন্য অনেক বিভাগ রয়েছে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে যে নতুন প্রযুক্তি তৈরি হবে তা নতুন নতুন শিল্প তৈরিতে সাহায্য করবে। এছাড়া গবেষণার উপকরণের উপর কোম্পানির বিশাল বাজার রয়েছে সারা বিশ্বে। গবেষণার অবকাঠামো প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান তৈরি সম্ভব।

এ লেখায় আমি কাঠামোগত তিনটি প্রধান বিষয়ে কিছু প্রস্তাব রাখলাম। উচ্চমানের গবেষণার অবকাঠামো তৈরি না করলে উচ্চমানের গবেষক দেশে রাখা সম্ভব নয়। তাই সরকারকে উচ্চশিক্ষায় বিনিয়োগের মানসিকতা রাখতে হবে।

ড. সাইফুল মাহমুদ চৌধুরী: যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট আরলিংটনের অধ্যাপক।