যুদ্ধাহতের ভাষ্য: ৪১ “সমালোচনা না করে ভালোদেরও রাজনীতিতে আসা উচিত”

সালেক খোকনসালেক খোকন
Published : 30 Oct 2015, 05:14 PM
Updated : 30 Oct 2015, 05:14 PM

যুদ্ধাহত এক মুক্তিযোদ্ধার দিন কাটছে প্রায় নিভৃতে। বুকের ভেতর তাঁর চাপা কষ্ট। সে কষ্ট কখনও ফুরিয়ে যায় না। বরং আমৃত্যু মনের অতলে তা বাসা বেঁধে থাকবে। আপনজনদের এড়িয়ে চলেন এই যোদ্ধা। প্রয়োজন না হলে ঘর থেকে তেমন বেরও হন না। সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো তাঁর মনে কষ্টের মেঘ জড়ো করে। তাই প্রায় সব অনুষ্ঠানেই তিনি থাকেন অনুপস্থিত।

একাত্তর এই মুক্তিযোদ্ধার জীবনের গতি পাল্টে দিয়েছে। যে দেশের স্বাধীনতার জন্য তিনি রক্তাক্ত হয়েছেন, হারিয়েছেন শরীরের একটি অঙ্গ, সেই স্বাধীন দেশের মানুষেরই বিদ্রুপের হাসি তাঁকে সহ্য করতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাঁর সহধর্মিনীকেও শুনতে হয় নানা কটূক্তি।

এই আখ্যান যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন বাদলের জীবনের। তাঁর সম্পর্কেেআমরা জানতে পারি আরেক মুক্তিযোদ্ধা মান্নানের কাছে। মান্নান জানান, ''একাত্তরে অনেক মুক্তিযোদ্ধা পা হারিয়েছেন, হাত খুইয়েছেন, কিংবা হয়েছেন গুলিবিদ্ধ। কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা বাদলের বংশরেখায় ইতি টেনে দিয়েছে। একাত্তরে একটি অপারেশন চলার সময় পাকিস্তানিদের ব্রাশফায়ারে বাদলের তলপেট ঝাঁজরা হয়ে যায়। তখন তাঁর নাভি ভেদ করে বের হয়ে যাওয়া গুলিতে তাঁর পুরুষাঙ্গটি দেহ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অবাক বিষয়, দেশের জন্য পুরুষাঙ্গ হারানো এই মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীনতার পর পেয়েছেন মানুষের অবজ্ঞা। মানসিকভাবে রক্তাক্ত হয়েছেন প্রতিনিয়ত। তবু এই দেশ আর তার স্বাধীনতার জন্য গর্ব বোধ করেন বাদল।''

আনোয়ার হোসেন বাদলের সঙ্গে দেখা করতে ঠিকানা জোগাড় করতে দ্বারস্থ হতে হয়েছিল আবদুল মান্নানের। সাক্ষাতকারের অনুমতিও আদায় করা গেল তাঁর মাধ্যমে। এক বিকেলে আমরা পা রাখি মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার শাকরাইল গ্রামে।

সেখানেই এখন মুক্তিযোদ্ধা বাদলের নিবাস। তাঁর বাবা সিরাজ খান চাকরি করতেন ঢাকায়, বিজি প্রেসের বাইন্ডিং সেকশনে। ছয় ভাই ও এক বোনের সংসারের পুরো দায়িত্ব ছিল মা মনোয়ারা বেগমের ওপর। লেখাপড়ায় তাঁর হাতেখড়ি গড়পাড়া হাই স্কুলে। ছোটবেলার সময়গুলো আজও তাঁকে আন্দোলিত করে।

[আহত হওয়ার বর্ণনা দিচ্ছেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন বাদল:

তাঁর ভাষায়:

''বাবা গ্রামে আসতেন মাঝে মাঝে। তাঁর আয়ে সংসার চলত না। কষ্ট করে আমগো চলতে হইছে। খাওয়া-দাওয়ায় কষ্ট ছিল। তাই লেখাপড়ার পাশাপাশি কৃষিকাজও করছি। হেল্প করার কেউ ছিল না। মা সব ম্যানেজ করতেন। আমাদেরও আঁকড়ে রাখতেন।''

স্কুলজীবনের স্মৃতি রোমন্থন করলেন বাদল:

''বন্ধুগো লগে তহন মারবেল আর ডান্ডাগুলি খেলতাম। নদীতে মাছ মারা ছিল নেশার মতো। লেখাপড়ায় কম্পিটিশন ছিল বন্ধু মিনুর সঙ্গে। আমি ফাস্ট হইলে ও মেনে নিতে পারত না। কথা বলা বন্ধ করে দিত। কিন্তু ও ফাস্ট হলে আমি ওই রকম করতাম না। একবার এ নিয়ে আমাদের মধ্যে মারামারিও হয়। মিনু আজ বেঁচে নেই। কিন্তু ওর কথা মনে হইলে এখনও খারাপ লাগে।''

ক্লাস নাইনে পড়ার সময় থেকেই নেতাদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতেন মুক্তিযোদ্ধা বাদল। নুরুল আমিন খান, সিদ্দিক খান, মহিউদ্দিন, মফিজুল ইসলাম কামাল প্রমুখ ছিলেন মানিকগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা। গ্রামে গ্রামে মিটিং-মিছিল আর ঘুরে ঘুরে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অন্যায় ও বৈষম্যের কথা বাদলরা জানিয়ে আসতেন মানুষকে।

বাদলের রাজনৈতিক সচেতনতার চিত্র পাই তাঁর কথায়:

''পূর্ব পাকিস্তানের উৎপাদিত জিনিস পশ্চিম পাকিস্তান ঘুরে আসলেই ডাবল দাম দিয়ে কিনতে হইত। বাঙালিদের আয়ের টাকায় উন্নত হইত পশ্চিম পাকিস্তান। আমাদের রাস্তাঘাট থাকত অনুন্নত। সত্তরের নির্বাচনে কুঁড়েঘর ছিল মুসলিম লীগের প্রতীক। আওয়ামী লীগের ছিল নৌকা। নির্বাচনে জয়ের পরও ক্ষমতা না দেওয়ায় আমরা বাঁশের লাঠি নিয়ে বাসস্ট্যান্ড থেকে শহরের বিভিন্ন জায়গায় মিছিল বের করতাম।''

৭ মার্চ, ১৯৭১। শেখ মুজিব গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিবেন রেসকোর্স ময়দানে। খবর পেয়ে এলাকার ৫০-৬০ জন আওয়ামী লীগ কর্মীর সঙ্গে বাদলও যান সেখানে। ওই দিনের ঐতিহাসিক ভাষণের বাকি গল্প শুনি মুক্তিযোদ্ধা বাদলের মুখে:

''আমরা ঢুকি ১১টার দিকে। লোকজন তহন আসা শুরু করছে। মানুষ তো অধিকার আদায়ে মরিয়া হয়েছিল। সবার হাতে হাতে বাঁশের লাঠি। সবাই শেখ মুজিবের আদেশ ও নির্দেশের অপেক্ষায়। কিন্তু তিনি সরাসরি কিছু বললেন না। শুধু বললেন, 'প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল… আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি… এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম'– আমাদের কাছে ওটাই ছিল স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় নির্দেশনা।''

এরপর আপনারা কী করলেন?

''মানিকগঞ্জে গ্রামে গ্রামে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয় নুরুল আমিন খান, এলাহী মাস্টার, সিদ্দিক খান প্রমুখের নেতৃত্বে। ২৬ মার্চে লোকমুখে আমরা জানি ঢাকার গণহত্যা ও বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতারের খবর। ৩০ তারিখের পর আর্মি আসে মানিকগঞ্জে। ক্যাম্প বসায় বাসস্ট্যান্ডের পাশে, পিটিআইএএ। ওদের সোর্স হিসেবে কাজ করে মুসলিম লীগার ও শান্তি কমিটির লোকেরা। তহন পিছ কমিটির চেয়ারম্যান ছিল শাহজাহান সাহেব। আমরা তহনও গ্রামেই ছিলাম।''

সে সময়কার একটি ঘটনার কথা জানালেন মুক্তিযোদ্ধা বাদল। তাঁর ভাষায়:

''পিটিআইএএর পাশেই ছিল মানিকগঞ্জ ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস। সেখানে জাহাঙ্গীর নামে এক বড় ভাই কাজ করত। মাঝে মাঝে আমি তার কাছে টুকটাক কাজ শিখতে যেতাম। এপ্রিলের প্রথম দিকের কথা। একদিন সকালে গিয়া দেখি, সেখানে মালামালের স্তূপ। পাকিস্তানি সেনারা এক হিন্দু বাড়ি থেকে এনে সেগুলো রেখেছে। মালামালের ভেতর খুঁজে পেলাম একটা টেপরেকর্ডার। তুলে এনে সুইচ অন করতেই ক্যাসেটে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বেজে উঠল। শুনে আর ঠিক থাকতে পারিনি। চিৎকার দিয়ে বলি, 'জয় বাংলা'।''

''ওই সময়ই আর্মিরা চলে আসে। চুল ধরে আমায় তুলে নিতে চায়। হুংকার দিয়ে বলে, 'বাইনচোদ, সাজা মিল জায়েগা, কই বাদ নেহি'। ওয়ার্কসপের মালিক দলি মিয়া ও হাসি মিয়ার মিনতিতে রক্ষা পাই সে যাত্রায়। কিন্তু সেদিনই বুঝে গেছিলাম, এদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেওয়া ছাড়া উপায় নাই।''

দিনে দিনে মানিকগঞ্জে পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে যেতে লাগল। প্রতিদিনই তারা নিকটবর্তী গ্রামে ঢুকে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিত। পাকবাহিনী আসছে শুনলেই তখন মানুষ বাড়িঘর ফেলে আশ্রয় নিত খেতে-খামারে। তরা ফেরিঘাটে একবার চোখের সামনে তারা গুলি করে হত্যা করে ফেরিচালক খালেককে। বাদলদের বাড়ির পাশেই ছিল রামাসাই নামে এক ধনী হিন্দুর বাড়ি। সেনারা তাকেও গুলি করে মেরে ফেলে। এসব দেখে ঠিক থাকতে পারেন না বাদল। সিদ্ধান্ত নেন যুদ্ধে যাওয়ার।

''তহন এপ্রিলের মাঝামাঝি। মায়েরে না জানাইয়া এক রাতে প্রথম চান্দর গ্রামে হালিমদের বাড়িতে গিয়া উঠি। সেখানে ১০-১৫ জন জড়ো হইলে চলে যাই আজিমনগরের পদ্মার পাড়ে। পরে আমাদের পাঠানো হয় সাটুরিয়ায়। প্রাইমারি স্কুলে ছিল আমাদের ট্রেনিং ক্যাম্প। ওখানেই চলে ১০০ জনের এক মাসের ট্রেনিং। আর্মি ও পুলিশের লোকেরা ট্রেনিং করায়। আরআই আবদুল আজিজ ও আনসার চাঁন মিয়ার কথা এখনও মনে পড়ে।''

কোথায় কোথায় অপারেশন করেছেন?

''আমাদের অস্ত্র ছিল কম। নেতারা বিভিন্নভাবে তা কালেক্ট করতেন। অস্ত্র সংগ্রহের কৌশল হিসেবে সে সময় কয়েক জনকে রাজাকারেও ভর্তি করানো হয়েছিল। আমাদের বিশ জনের দলরে কমান্ড করতেন এলাহী মাস্টার ও আফতাব উদ্দিন খান। গেরিলা ছিলাম। আক্রমণ করেই সরে পড়তাম। আতঙ্ক তৈরি করাই ছিল কাজ। একবার গুলাইডাংগা ও কালিগঙ্গা নদীতে আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনাদের নৌকা ও লঞ্চ ডুবায়ে দিছিলাম। এভাবেই অপারেশন করি ২ নং সেক্টরের সাটুরিয়া, সদর, বিরামপুর, সিঙ্গাইর প্রভৃতি এলাকায়।''

যে অপারেশনে আহত হয়েছিলেন সেটির গল্প চলে এল এবার। খানিকটা সময় নীরব থেকে স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলতে থাকেন রক্তাক্ত ওই দিনের আদ্যোপান্ত। যতই তিনি ঘটনার গভীরে যাচ্ছেন ততই তাঁর বুকে পুষে রাখা কষ্টগুলো জল হয়ে ঝরে পড়ছে দুচোখ বেয়ে:

''পাকবাহিনী তখন পিছু হটেছে। সাটুরিয়া থেকে আমরা মানিকগঞ্জ শহরে এসডিওএর অফিসে অবস্থান নিয়েছি। ১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১। ভোরবেলা। খবর আসে আরিচা পার হয়ে আড়াইশর মতো পাকিস্তানি আর্মি মানিকগঞ্জের দিকে ঢুকছে। সব গ্রুপ তখনই রেডি হয়ে নিল। ঢাকা-আরিচা রোডের মানুরা নামক স্থানে আমরা পজিশন নিই। প্রধান রাস্তার পাশেই ৭০-৮০ জনের পজিশন। কমান্ডে আরআই আবদুল আজিজ। অপজিটে আরেকটি গ্রুপ। নির্দেশ ছিল গুলি না ছোঁড়ার।''

''পাকিস্তানি আর্মি আমাদের রেঞ্জের মধ্যে আসতেই মাইকিং করে ওদের সারেন্ডার করতে বলা হল। ওরা অস্ত্র ফেলে দিয়ে সারেন্ডারের প্রস্তুতিও নিল। একজন বলল, 'তোম লোগ ইন্ডিয়ান আর্মি ভেজো। হাম লোক সারেন্ডার করনে কে লিয়ে রাজি হ্যায়।' আমাদের সঙ্গে ইন্ডিয়ান আর্মি ছিল না। এ নিয়ে ওদের সঙ্গে কথা চলছিল। কথায় কথায় কেটে যায় মিনিট দশেক।''

''আমাদের মধ্যে দুয়েকজন ছিল একটু উগ্র। দেরি দেখে ওদের সহ্য হচ্ছিল না। নির্দেশ না মেনেই ওরা ফায়ারিং শুরু করে দিল। অমনি দুপক্ষে তুমুল গোলাগুলি শুরু হল। ওরা রাস্তার ঢালে পজিশন নেয়। আমাদের মধ্যে তখন চেইন অব কমান্ড ভেঙে যায়। সবাই বেশ খানিকটা পিছনে সরে গিয়ে পজিশন নেয়। কিন্তু কোনো নির্দেশনা না পাওয়ায় এক লাইনে থাকা আমরা কয়েক জন আগের অবস্থানে থেকেই ফায়ার করি। এদিকে রাস্তার অপজিটের গ্রুপটিও সরে গিয়েছে। ফলে পুরো অ্যামবুশটি ভেস্তে যায়।''

''আমাদের দিকে পাকিস্তানি সেনারা এগোচ্ছে। একটা বড় গাছের পাশে ছিল আমাদের পজিশন। গাছ সামনে রেখে দুপাশে আমি ফায়ারিং দিচ্ছি। আনসার চাঁন মিয়া ছিল বাম পাশে। ওরে ওরা টার্গেট করে। চোখের সামনেই একটা গুলি এসে লাগে তার মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে মগজটা বেরিয়ে যায়। তা দেখে আমার হাতটাও চলছিল না। মনে তখন মৃত্যুভয়। কোনো রকমে আমি পাশের একটি উঁচু বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। বাড়ির উঠানে ২-৩ টা রাইফেল পড়ে ছিল। ক্রলিং করে তা আনতে গেলে সেনাদের তিন জন বাড়ির পেছন দিক থেকে আমাকে টার্গেট করে। বারিন্দায় শুয়ে পড়ে আমিও প্রত্যুত্তর দিই। সাইড থেকে ওরাও ফায়ার করে।''

''ওরা ক্রলিং করে বাড়ির দিকে আসছিল। ওই অবস্থায় হাঁটু গেড়ে আমি ফায়ার শুরু করি। ওরাও ব্রাশ ফায়ার করছিল। আমার একটা গুলি গিয়ে লাগে ওদের একজনের হাতে। ভয়ে বাকি দুজনও আর এগোয় না। কিন্তু তার আগেই ওদের অনেকগুলো গুলিতে আমার শরীর ঝাঁজরা হয়ে যায়। আমি তা টেরও পাই না।''

''অস্ত্রগুলো নিয়ে পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে এক গ্রামে ঢুকি। প্রচণ্ড পিপাসা ছিল। এক মহিলা পানি এনে দিলে খেতে খেতেই চোখ পড়ে নাভির নিচে। দেখি, শরীরের নিচের দিকটা লাল হয়ে আছে। ভিজে গেছে রক্তে। পানি খাওয়াতে প্রেসার পড়ছিল শরীরে। আর তখন ভক ভক করে রক্ত বেরুচ্ছিল। দেখে মাথাটা ঘুরে উঠল। ওখানেই পড়ে যাই। আর কিছু বলতে পারি না।''

''জ্ঞান ফিরতে দেখি মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালে। গুলি ঝাঁজরা করে দিয়ে ছিল আমার নিচের অংশ। এর ফলে শরীর থেকে পুরুষাঙ্গটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অপারেশন করতে হয়েছে। তবে এখন নিজেকে পুরুষ বলে দাবি করার মতো কোনো অঙ্গ নাই আমার। আমি তো শুধু অঙ্গ হারাই নাই, আমার প্রজন্ম বলতেও তো কিছু নেই। আমি আমার পর্যন্তই শেষ, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই যন্ত্রণাটাই আমাকে বয়ে বেড়াতে হবে।''

যে দেশের জন্য রক্ত দিয়েছেন, সে দেশ কি পেয়েছেন?

''না, সে দেশ পাই নাই। মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নগুলো আজও বাস্তবায়িত হয়নি। মানুষে মানুষে বৈষম্য কি কমেছে? বড়লোকরা তো শুধু বড়ই হচ্ছে। দেশটা তো অল্প সময়ে স্বাধীন হইছে। এক বাড়িতে পাঁচ জনই শহীদ হয়েছে। আবার অনেকের গুষ্টিতেও একজন শহীদ হয় নাই। স্বাধীনতা যেন খুব সস্তা দামে আমরা পাইছি। যারা আমার মতো বাইচা আছে, সে বুঝে স্বাধীনতা কী জিনিস। সবাই যদি বুঝত, তাইলে দেশ অন্য রকম হইত। এত শ্রেণিবিন্যাসও থাকত না।''

বাদল বিয়ে করেছেন ১৯৮৫ সালে। সহধর্মিনীর নাম নাজমা খানম। তাঁর প্রসঙ্গে বললেন বাদল;

''আল্লাহ একটা মানুষকে সব দিক দিয়া মারে না। বাঁচার একটা পথ করে দেয়। আমার স্ত্রী পাশে না থাকলে এতদিনে হয়তো আত্মহত্যা করতে হত। তার সেকরিফাইসই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু সমাজ তো প্রতিনিয়ত তাঁকেও মানসিকভাবে আহত করেছে। অনেকেই বলে, 'আরে. ওই শালা তো আটকুঁড়া'। মানুষের মন্তব্য আমার মন রক্তাক্ত করে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত হয়তো এভাবেই আমি আঘাতপ্রাপ্ত হব। মুক্তিযোদ্ধা বড় কথা নয়, দেশের জন্য অঙ্গ হারিয়ে আজ আমি আটকুড়া গালি পাইছি!''

যুদ্ধপরবর্তী দেশ নিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন:

''একটা বিধস্ত ভাঙাচোরা দেশ তখন। নয় মাসে দেশ স্বাধীন হইছে। কিন্তু আরও তিন-চার মাস যুদ্ধ থাকলে দেশের মানুষ না খাইয়াই মারা যাইত। বঙ্গবন্ধু তো সারা পৃথিবীকে জানিয়েছিলেন। সাহায্যও পেয়েছিলেন। কিন্তু স্বার্থবাদী কিছু লোক তারে বিপদে ফেলেছিল। তিনি তো বলেছিলেন, 'সাড়ে সাত কোটি মানুষ, কম্বল আসছে ১২ কোটি। আমার কম্বলটা কোথায় গেল? আমি তো চোরের খনি পাইছি।' তাঁর এই কথায় কিন্তু অনেক কিছু লুকায়া ছিল। উনাকে অনেকেই তখন সহযোগিতা করে নাই। বরং নানাভাবে ষড়যন্ত্র করেছিল কেউ কেউ।''

স্বাধীন দেশে রাজাকারদের গাড়িতে পতাকা উড়েছে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ওই সময়ে নিজের অনুভূতির কথা জানালেন বাদল:

''বুকের ভেতর তখন যন্ত্রণা হত। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জিয়া মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছিল। তার কারণেই গৌরবের ইতিহাস কলঙ্কিত হয়েছে। কিন্তু কষ্ট লেগেছে তখন, যখন দেখেছি আমার মতো অনেক মুক্তিযোদ্ধাই রাজাকার মন্ত্রীদের কাছে ধরনা দিচ্ছে। মনে হইত কী স্বাধীনতা পাইলাম। ওই সময়টাতেই মুক্তিযোদ্ধাদের কম দামে বেচা-কেনা করা হইছে।''

মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রসঙ্গে বাদলের অকপট ভাষ্য:

''সরকারের সদিচ্ছা থাকলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা এখনও শনাক্ত করা সম্ভব। তেতাল্লিশ বছর পরও মুক্তিযোদ্ধা কিনা ইন্টারভিউ দিতে হয়। জানি না আরও কত দিতে হইব। আমি কে, আমার এলাকায় সরেজমিনে দেখেন। কাগজ দেইখা কী হইব? যে যখন আইতাছে সেই ইন্টারভিউ করতাছে। এটা তো হাস্যকর ব্যাপার।''

স্বাধীন দেশে ভালোলাগার অনুভূতি জানতে চাই আমরা। মুক্তিযোদ্ধা বাদল সরাসরি বলেন:

''বঙ্গবন্ধুর মেয়ে স্বাধীন এই দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায়। এটা ভাবলেই ভালো লাগে। সত্যিই আত্মতৃপ্ত হই। তাঁর সাহসী নেতৃত্বে এদেশে রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। আরও ভালো লাগবে এ দেশ থেকে যেদিন জামাত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করা হবে।''

খারাপ লাগে কখন?

''যখন দেখি ধর্মের নামে কিছু লোক উগ্রতা দেখাচ্ছে। মানুষ হত্যা করে দেশকে জঙ্গির দেশ বলে দাবি করার চেষ্টা করছে। আসলে আইএস-ফাইএস কিছু না। রাজাকারদের ফাঁসি দিয়া জামায়াত নিষিদ্ধ করলেই দেখবেন সব ঠিক।''

নতুনদের রাজনীতিতে আসার আহ্বান রেখে রাজনীতি নিয়ে নিজের ভাবনার কথা জানালেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর ভাষায়:

''কে কত প্রকার পূজা দিতে পারে, কত তেল মালিশ করতে পারে, এটা তো রাজনীতিবিদদের যোগ্যতা হতে পারে না। সবাই তো রাজনীতির আড়ালে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়া ব্যস্ত। ব্যবসায়ী ও আমলাদের দিয়ে রাজনীতি এগুবে না। কিছু নেতা ভালো আছে। আবার ভালো নেতারও অভাব আছে। ভালো ও নতুনরা রাজনীতি থেকে মুখ ফিরায়ে নিলে খারাপরাই তা দখল করে নিবে। তাই শুধু সমালোচনা না করে ভালোদেরও রাজনীতিতে আসা উচিত।''

পরবর্তী প্রজন্ম সত্যিকারের দেশ গড়বে, এমনটাই আশা এই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার। চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে তাদের উদ্দেশ্যে মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন বাদল বলেন:

''তোমরা লেখাপড়া শিখে উন্নতির সঠিক পথটি বেছে নিও। দেশকে ভালোবাস। মাদক থেকে দূরে থাকবে। কেননা মাদকমুক্ত না হলে এ দেশ সত্যিকারভাবে এগোবে না।''

সংক্ষিপ্ত তথ্য

নাম: যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বাদল।

ট্রেনিং নেন: ৩০ দিনের ট্রেনিং নেন সাটুরিয়ায়র শিমুলীয়া গ্রামের দরগ্রাম নামক স্থানে।

যুদ্ধ করেছেন: ২ নং সেক্টরে। সাটুরিয়া, সদর, বিরামপুর, সিঙ্গাইর প্রভৃতি এলাকায়।

যুদ্ধাহত: ১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১। ভোরবেলা। ঢাকা-আরিচা রোডের মানুরা নামক স্থানে প্রধান রাস্তার পাশেই পাকিস্তানি সেনাদের ব্রাশফায়ারে তলপেটসহ তাঁর শরীরের নিম্নাংশ ঝাঁজরা হয়ে গেলে, পুরুষাঙ্গটি শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

ছবি ও ভিডিও: সালেক খোকন।

সালেক খোকন: লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক।