সিরিয়ায় রাশিয়া জোটের যত চ্যালেঞ্জ

বিজন সরকার
Published : 26 Oct 2015, 06:23 AM
Updated : 26 Oct 2015, 06:23 AM

সিরিয়ায় রাশিয়ার হামলার পর বিশ্বের বহু সমীকরণ পাল্টে গেছে। কিছু সমীকরণ স্রেফ একশ আশি ডিগ্রির মতো উল্টে গেল। সেই পাল্টে যাওয়া মূল সমীকরণটি গত কয়েক দশক ধরে কেবল মানুষের আকাঙ্ক্ষায় ছিল। পশ্চিমা পুঁজিবাদী বিশ্ব-নেতৃত্বের ভারসাম্যহীনতার কুফলের ভোগান্তি চরম পর্যায়ে চলে গিয়েছে। ভেঙে পড়েছে বিশাল এলাকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। এমনকি এই গ্রহের যে সব এলাকা ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় একেবারেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, সে সব এলাকাও পুঁজিবাদী বিশ্বের সম্প্রসারণ-বান্ধব জঙ্গি গোষ্ঠীর ভয়ে তটস্থ।

মার্কিন নেতৃত্বে কথিত পশ্চিমা গণতান্ত্রিক জোট জঙ্গি রাজনীতি, বিশেষ করে ইসলামি জঙ্গিবাদ একটি পুঁজিবাদী পণ্য হিসেবে সত্তর দশকের পর থেকে বিশ্বব্যাপী মার্কেটিং করার দায়িত্ব পালন করে এসেছে। জঙ্গিবাদ তৈরির আদর্শ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে সৌদি আরবের উগ্র ওয়াহাবিজম। এর অর্থায়নের পিছনে রয়েছে সৌদিসহ উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলি। জঙ্গি গোষ্ঠীর বহুমাত্রিক ফলদায়ক কাঠামোটি দুটি বিশেষ ক্ষেত্রে গত কয়েক দশক ধরে সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। প্রথমত, মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরশাসকদের দাপট; দ্বিতীয়ত, পুঁজিবাদ বিকাশের কৌশল হিসেবে পশ্চিমা গোষ্ঠীর কূটনৈতিক ও সামরিক হাতিয়ার।

সিরিয়ায় রুশ হামলার ফলে পশ্চিম এশিয়ার কয়েকটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে দোদুল্যমান অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তবে বাকিগুলি নব্বই দশকে আফগানিস্তানে পরিচালিত তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের যুদ্ধের প্যারামিটারে নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছে। তবে নতুন ক'টি প্যারামিটার স্পষ্টত প্রতীয়মান। চীন আঞ্চলিক ও ইরান ধর্মীয় কারণে নব্বই দশকে আফগানিস্তানে মুজাহিদিন গোষ্ঠীকে সমর্থন দিয়েছিল। আজ সে চীন ও ইরান নিজেদের অবস্থান ঠিক রাখার স্বার্থেই রাশিয়ার নেতৃত্বে সিরিয়ায় হামলায় সমর্থন দিচ্ছে। এমনকি আফগান-সোভিয়েত যুদ্ধের পর যে সকল পশ্চিম এশীয় ও আফ্রিকান রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের সম্প্রসারণ নীতির সহায়ক হয়েও নিজেদের পিঠ বাঁচাতে পারেনি, তারা আজ রাশিয়ার বলয়ে নিজেদের পররাষ্ট্রনীতির ভবিষ্যৎ খোঁজার চেষ্টা চালাবে।

দুটি বিষয় বিবেচনাযোগ্য। প্রথমত, আফগানিস্তানে পশ্চিমা বিশ্ব ও বিশ্বের সকল মুসলিম রাষ্ট্রগুলি থেকে মুজাহিদিনদের প্রদত্ত যে সমর্থন ও শক্তির মোকাবেলা তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে করতে হয়েছিল, সিরিয়ায় সে রকম অবস্থা নেই। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমা জোট যেভাবে উগ্র ওয়াহাবিজমকে সমর্থন দিয়ে ইসলামের আদর্শ সম্পর্কে গোটা বিশ্বের কাছে ভুল ধারণা দিচ্ছে, সেটি কেবল মুসলিম সম্প্রদায় নয়, পশ্চিমা বিশ্বের জনগণও ভালোভাবে নিচ্ছে না।

ওয়াহাবিজমের ব্যবহার পদ্ধতি নিয়েও পশ্চিমা রাজনৈতিক সমাজ স্পষ্টত বিভক্ত। আমেরিকার ডেমোক্রেটদের মতে, আদর্শ দিয়েই ধর্মীয় উগ্রপন্থার মোকাবেলা করতে হবে; সামরিক শক্তি প্রয়োগ প্রথম পছন্দ হতে পারে না। অন্যদিকে, রিপাবলিকানরা 'উগ্র' ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে বদ্ধপরিকর।

২০১৬ সালে অনুষ্ঠিতব্য মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা রাশিয়ার চেয়ে ইসলামকে বিশ্বশান্তির প্রধান বাধা হিসেবে নিজেদের নির্বাচনী প্রচারে ঘোষণা করছেন। সে তালিকায় রয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, জেবা বুশ, মার্কো রুমিও, ক্রিস ক্রিস্টি প্রমুখ। যদিও সত্তর দশকের পর থেকে বিশ্বব্যাপী যে ধর্মীয় জঙ্গিবাদ ছড়িয়েছে, তার সিংহভাগ দায় আসলে রিপাবলিকান দল থেকে নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্টদেরই, কিন্তু রিপাবলিকান প্রার্থীদের উগ্র ইসলামবিরোধী প্রচারণার মূল উদ্দেশ্য নির্বাচনে জয়লাভ।

ভারতের গত লোকসভার নির্বাচনেও পশ্চিম ও দক্ষিণ এশিয়ায় ধর্মীয় জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থানের কুফল কাছে লাগিয়ে বিজেপি নির্বাচনে ভালো ফল পেয়েছে। ঠিক একই পদ্ধতি খোদ আমেরিকার নির্বাচনী মাঠেও ব্যবহার করা হচ্ছে বললে ভুল হবে না। অনুমানযোগ্য, নির্বাচনের পরপরই 'উগ্র' ইসলাম নিয়ে রিপাবলিকানরা ততটা মাথা ঘামাবে না। যদি ক্ষমতায় আসে, নিজেদের স্বার্থে ওরা বরং 'উগ্র' ইসলাম রপ্তানিকারক দেশগুলির সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করবে!

নির্বাচনের পরপরই মধ্যপ্রাচ্য নীতি হোয়াইট হাউজের নতুন প্রশাসকের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। যদি ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তবে পশ্চিম এশিয়া ইস্যুতে, বিশেষ করে সিরিয়ার সংকট নিয়ে একটি বহুজাতিক আলাপ-আলোচনার দ্বার উন্মুক্ত হতে পারে। বর্তমান মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ইতোমধ্যে একটি বহুজাতিক আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন। রাশিয়া সেটি পর্যালোচনা করছে। প্রস্তাবে কেরি উল্লেখ করেন, রাশিয়া, সিরিয়া, সৌদি আরব, তুরস্ক ও জর্ডানকে সঙ্গে নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। পাশাপাশি, অনুযোগ করলেন, 'সিরিয়ায় সামরিক শক্তি সমাধান দিবে না; দরকার কূটনৈতিক পদক্ষেপ।'

এটি সহজেই অনুমেয় যে, ওবামা ক্ষমতায় থাকার বাকি সময়টিতে কূটনৈতিক সমাধানের পথ খুঁজবেন। ততদিন আমেরিকার দিক থেকে সামরিক হস্তক্ষেপ একেবারেই অসম্ভব। এ অবস্থায় বলা যায়, ডেমোক্রেটরা আবার হোয়াইট হাউজে গেলে সিরিয়া ইস্যুতে জন কেরির প্রস্তাবটি বেঞ্চ-মার্ক ধরে এগুনোর জোর সম্ভাবনা থাকবে।

তবে কেরির প্রস্তাবটি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া তেমন সহজও হবে না। প্রস্তাবিত আলোচনায় জর্ডান ও তুরস্কের নাম গ্রহণযোগ্য এবং বাস্তবতায় খাতিরেই কেরি উল্লেখ করেছেন। কারণ সিরিয়ার লাখ লাখ শরণার্থী এই দুটি দেশে আশ্রয় নিয়েছে। প্রশ্ন উঠবে সৌদি আরবের অন্তর্ভুক্তি নিয়েই। পশ্চিম এশিয়ার রাজনীতিতে সৌদি আরবকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই মার্কিন প্রশাসন কাজটি করেছে।

অন্যদিকে, রাশিয়ার জোটে রয়েছে ইরান। ইরানকে বাদ দিয়ে সিরিয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যে সম্ভব নয়, সেটি মার্কিন প্রশাসন ভালো করে ওয়াকিবহাল। ইরান রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকার না করলেও বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ যে, সিরিয়ার গ্রাউন্ডে ইরানের সেনা রয়েছে। ফলে সিরিয়া ইস্যুতে আলোচনায় ইরান শক্তিশালী ও অর্থপূর্ণ অংশীদার। কেরির প্রস্তাবনায় ইরানকে অন্তর্ভুক্ত না করে সৌদি আরবকে রাখার ফলে সেটি প্রথম পর্যায়ে সমস্যা তৈরি করবে।

এখানে আরেকটি বিতর্ক আসতে পারে। সিরিয়ায় রাশিয়ার বিমান হামলার পর আমেরিকান জোট পঞ্চাশ টনের মতো ট্যাংক-বিধ্বংসী আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলা-বারুদ আসাদবিরোধী গোষ্ঠীর কাছে সামরিক বিমান দিয়ে পৌঁছে দিয়েছে। এতে কি সিরিয়া ইস্যুতে ওবামা প্রশাসন তথা ডেমোক্রেট দলের 'প্রক্সি-ওয়ার' নীতির প্রকাশ পায় না?

উত্তরটি বেশ পরিস্কার। রাশিয়ার বিমান হামলার জবাবে ওবামা প্রশাসন এমনিতেই অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে কোনঠাসা। এর প্রভাব আগামী নির্বাচনে ভালোভাবেই পড়বে। নিদেনপক্ষে আসাদবিরোধী গোষ্ঠীগুলিকে সমর্থন দিয়ে যাওয়ার যে নৈতিক দায় ওবামা প্রশাসনের রয়েছে, তা বোঝাতেই এই সামরিক সাহায্য। মনে রাখতে হবে যে, পশ্চিম এশিয়ায দুর্বল নীতি ও সময়োপযোগী হস্তক্ষেপের অভাবের অভিযোগ থেকে মুখ রক্ষা করতে নাইজেরিয়ায় বোকো হারাম দমনে মার্কিন সেনা পাঠিয়েছেন ওবামা। একই কারণে আফগানিস্তানে নিয়োজিত মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত থেকেও সরে আসতে বাধ্য হয়েছেন।

হোয়াইট হাউজে যদি রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট আসেন, তবে কেবল পশ্চিম এশিয়া নয়, বিশ্বজুড়ে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের আরেকটি ভয়ানক উত্থান ঘটতে পারে। ওবামার দু'টার্মে বৈশ্বিক রাজনীতিতে পরাশক্তি হিসেবে আমেরিকার প্রভাব-হ্রাস, উদার অভিবাসন নীতি ও নিজেদের সমাজে উগ্র ওয়াহাবিজমের সম্ভাব্য কুফলের মতো ইস্যু পুঁজি করে আগামী নির্বাচনে হোয়াইট হাউজে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের খামখেয়ালিপূর্ণ যুদ্ধংদেহী মনোভাবই ছিল বিশ্বব্যাপী ইসলামিক জঙ্গি গোষ্ঠীর বিস্তারের মূল কারণ। বিশেষ করে ইরাকে তাদের হামলা করার বিষয়টি ছিল অসভ্যতা ও অন্যায়ের নিকৃষ্টতম উদাহরণ। তবে অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও বড় বড় জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি বুশের সামরিক শক্তিপ্রিয়তার সমঝদার; তাঁরা বেশ সমীহও করতেন তাঁকে এ জন্য। এমনকি আমেরিকার অভ্যন্তরীন রাজনীতিতেও এর প্রভাব ছিল। তবে বুশের ভুল নীতির ফলেই আবার ওবামা প্রশাসনকে উত্তরাধিকারসূত্রে বিশ্বব্যাপী জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থানের মতো জটিল বিষয় সমালাতে হচ্ছে।

এত সবের পরও মধ্যপ্রাচ্যে ওবামা প্রশাসনের কোনো শক্তিশালী হস্তক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি। গত আট বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে ওবামা দ্বিধাদ্বন্দ্বে থেকেছেন। বিশ্বের কোনো দেশের রাষ্ট্রপ্রধানই ওবামাকে তেমন সমীহ করেন না বলে তাঁকে নিজ দেশে বহু সমালোচনা শুনতে হয়।

সিরিয়ায় রাশিয়ার হামলার জবাবে মার্কিন গণমাধ্যমগুলি রিপাবলিকান দলের সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের কাছে সিরিয়ার ক্ষেত্রে তাঁরা কী নীতি গ্রহণ করবেন তা জানতে চায়। সবার মতামত প্রায় অভিন্ন। তাদের সম্ভাব্য নীতির প্রথম ধাপেই রয়েছে সুন্নি রাষ্ট্র ও গোষ্ঠীগুলিকে সিরিয়া ইস্যুতে আরও তাৎপর্যপূর্ণভাবে জড়ানো। সিরিয়া যেন রাশিয়ার জন্য নব্বই দশকের আফগানিস্তান হয়ে ওঠে সে চেষ্টা করার ইঙ্গিতও তাঁরা দিয়েছেন। এমনকি চেচেন বিদ্রোহীদের দিয়ে রাশিয়ার ভিতরে বড় ধরনের হামলা করার সম্ভাবনা নিয়েও কথা বলেছেন তাঁরা।

সিরিয়ায় রাশিয়ার হামলার ফলে বাশার আল আসাদের শাসন আগামী কয়েক বছরের জন্য টিকে গেলেও এ অঞ্চলে শিয়া-সুন্নির বিভেদ আরেক ধাপ গভীরে প্রবেশ করবে। এমনকি পশ্চিম এশিয়া নতুন এক 'অন্ধকার' যুগেও চলে যেতে পারে। সিরিয়ায় রাশিয়া জড়ানোর ফলে ইস্যুটি খুব জটিল হয়ে গেল। এতে গোটা বিশ্ব দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। এমনকি বিশ্ব-মিডিয়াও। পশ্চিমা বিশ্বের ডানপন্থী মিডিয়াগুলি রাশিয়ার হামলার আগেও ইসলামি জঙ্গিবাদ নিয়ে দিনরাত্রি সরব ছিল। হামলার পরই সুর পাল্টেছে তারা। এখন ইসলামি জঙ্গিবাদ তাদের কাছে বড় ইস্যু নয়; ইস্যু হল রাশিয়াকে সিরিয়া থেকে বিতাড়ন। এ তালিকায় মধ্যপ্রাচ্যের আল জাজিরা ও খালিজ টাইমসও রয়েছে।

ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তিটি সিরিয়ার সংকট আরও ঘনীভূত করে তুলছে। ইরান পশ্চিমা বিশ্বের কাছে পাওনা ফ্রজেন মানি প্রায় একশ পঞ্চাশ বিলিয়ন ডলার ফেরত পেতে চায়। চুক্তিটির ঘোর বিরোধিতা করেছিল সৌদি আরব, ইসরাইল ও কট্টর রিপাবলিকান সমাজ। ইরান চায়, এ মাস থেকেই চুক্তির বিভিন্ন দফা বাস্তবায়ন করতে। তবে পশ্চিমা বিশ্ব আরও কয়েক সপ্তাহ সময চাচ্ছে। সিরিয়া ইস্যুতে ইরানের জড়ানোর ফলে চুক্তি বাস্তবায়নে পশ্চিমারা দীর্ঘসূত্রতার নীতি গ্রহণ করতে পারে।

পারমাণবিক চুক্তি বাস্তবায়নের তোড়জোড় শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই আমেরিকা ইসরাইলে সামরিক সাহায্য বাড়িয়ে দিয়ে বছরে ৩.৬ বিলিয়ন ডলার থেকে ৩.৭ বিলিয়ন ডলার করে ফেলল। ওদিকে, সৌদি রাজপরিবারের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল আনোয়ার এসকির মাধ্যমে সৌদি প্রশাসন ইসরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডিরেক্টর জেনারেল দোর গোল্ডের সঙ্গে সিরিয়া ও ইরানের বিষয়ে নিজেদের বিভিন্ন কৌশল ও তথ্য আদান-প্রদান করছে। বিশেষ করে ইরানকে শায়েস্তা করতে দেশ দুটি একসঙ্গে কাজ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যায়, বায়ান্ন শতাংশ সৌদি নাগরিক ইরানকে প্রধান শত্রু মনে করে। অন্যদিকে, ইসরাইলকে প্রধান শত্রু মনে করে মাত্র আঠার শতাংশ সৌদ। যুদ্ধবাজ রিপাবলিকানেরা যদি আমেরিকার ক্ষমতায় আসে, সিরিয়া থেকে রাশিয়াকে সরানোর জন্য মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুন্নির বিভেদের মতো নির্ভরশীল অস্ত্রটি যে প্রয়োগ করবে তা প্রায় নিশ্চিত।

মার্কিন জোটের নেতৃত্বে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে ধনী সুন্নি রাষ্ট্রগুলি। রয়েছে ইউরোপের বড় দুটি ধনী দেশ– ফ্রান্স ও জার্মানি। ফলে সিরিয়ায় সামরিক খরচের অর্থায়নের জন্য তাদের তেমন চিন্তা করতে হবে না। মধ্যপ্রাচ্যের জিসিসি রাষ্ট্রগুলির নিজেদের তেমন সামরিক শক্তি নেই, তবে পেট্রো-ডলারের অভাব নেই। সিরিয়া থেকে রাশিয়াকে তাড়ানোর জন্য আফগানিস্তানের মতো আমেরিকাকে বিনিয়োগ করতে হবে না। এবারের প্রেক্ষাপট একেবারেই ভিন্ন। এখানে আছে মধ্যপ্রাচ্যের দুটি বড় ধর্মীয় গোত্রের দ্বন্দ্ব।

সৌদি আরবের জন্য অকৃত্রিম বন্ধু আমেরিকার সামরিক শক্তি সর্বদা প্রস্তুত। ইরাক যখন কুয়েত আক্রমণ করে, তখন ইরাকের দিক থেকে সম্ভাব্য হামলা ঠেকাতে বাদশাহ ফরহাদ বিন আবদুল আজিজ আমেরিকার সাহায্য চেয়েছিলেন। তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন সামরিক খরচের বিষয়ে আগেই চূড়ান্ত কথা বলতে আগ্রহী হওয়ায় আজিজ হতাশ হয়ে বলেছিলেন, 'আমেরিকা আমাদের বন্ধু। আমরা জানি কীভাবে বন্ধুত্ব রক্ষা করতে হয়।' পরে প্রতিশ্রুতির চেয়ে কয়েক বিলিয়ন ডলার বেশি দিয়েছিল তারা আমেরিকাকে।

অন্যদিকে, রাশিয়ার জোটে রয়েছে কেবল ইরান। সিরিয়ায় ইরানের বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা থাকলেও একটি দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের খরচ বহন করার মতো অঙ্গীকারে ইরান যাবে কিনা সেটি মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। আবার ইরাক নিজেই নিঃস্ব। ফলে রাশিয়ার জোটকে যদি দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে লিপ্ত থাকতে হয়, একটি বড় ধরনের অর্থ-সংকটের আশঙ্কাই বেশি। আমেরিকার নীতি-নির্ধারকদের বিবেচনাতেও বিষয়টি রয়েছে।

সিরিয়া ইস্যুতে ভারত ও চীনের অবস্থান কখনও তেমন স্পষ্ট হবে না। কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ভারতকে পাশে চেয়েও আমেরিকা পায়নি। এর ফলে নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্য হিসেবে ভারতের অন্তর্ভুক্তির যে সম্ভাবনা বাকপটু ওবামা বাজারজাত করেছিলেন, সেটি পরে থামিয়ে দেন। এখন 'বণিক' মোদীর সরকার ক্ষমতায়। তাই সিরিয়া ইস্যুতে তিনি নীরব। যদি আবার হোয়াইট হাউজ বিরক্ত হয়!

চীন রাশিয়া-জোটের সমর্থক। তবে তাদের দিয়ে তেমন কিছু হবে না। ধন-সম্পদ থাকলেই নেতা হওয়া যায় না। চীন হঠাৎ গজিয়ে ওঠা গ্রামের সম্পদশালী ব্যক্তির মতন। বিশ্ব-নেতৃত্বে তাদের দেখার বাস্তবতা নেই। নেতৃত্ব দেওয়ার মতো যে সকল প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক আচার-আচরণের চর্চা দরকার, চীনের সমাজতন্ত্রে তা নেই। তাদের কাছ থেকে কিছু আশা করাও ভুল।

আপাতত দেখা যাচ্ছে, সিরিয়ায় রাশিয়ার বিমান হামলার ফলে জঙ্গিরা পিছু হটছে। গ্রাউন্ডে সিরিয়ায় সেনারা জঙ্গিদের দখলকৃত এলাকা পুনরুদ্ধার করছে। রাশিয়া যদি বিমান হামলা বন্ধ করে দেয়, জঙ্গিরা মার্কিন জোটের সহায়তায় আবারও সংগঠিত হয়ে হামলা চালাবে। ফলে রাশিয়ার সামনেও রয়েছে বিশাল চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় রাশিয়া কী পদক্ষেপ নেয়, সেটাই দেখার বিষয়।

বিজন সরকার: ভাষা গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।