কানাডার নির্বাচন: ট্রুডোর প্রতিশ্রুতি ও বিশ্বরাজনীতিতে পরিবর্তন

শওগাত আলী সাগর
Published : 23 Oct 2015, 06:51 PM
Updated : 23 Oct 2015, 06:51 PM

'কানাডার গতকালের নির্বাচনে ট্রুডোর লিবারেল পার্টি সহজেই জয়লাভ করেছে। ট্রুডো এখন দ্রুতই দেশের অভ্যন্তরীন ও বৈদেশিক নীতিমালার প্রশ্নে তাঁর যে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল, সেগুলো বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে পারেন।'

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ বিশ্বের পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রেসিডেন্টের কাছে প্রতিদিন যে ব্রিফিং পাঠায়, তাতে এই বার্তাটাই দিনের গুরুত্বপূর্ণ খবর হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

কেউ যেন আবার ভেবে না বসেন যে, এই তো সেদিন, মানে ১৯ অক্টোবর অনুষ্ঠিত কানাডার ফেডারেল নির্বাচনে জাস্টিন ট্রুডোর বিজয়ের পর সিআইএ ওই বার্তা মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কাছে পাঠিয়েছে। বার্তাটি এই সময়ের প্রেক্ষিতের সঙ্গে মিলে গেলেও এটি আসলে ৪৭ বছর আগেকার, ১৯৬৮ সালের কথা। তখন উত্তরের নিকট প্রতিবেশি কানাডাকে নিয়ে মার্কিন প্রশাসনের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা ছিল না। প্রশাসনের দৈনন্দিন আলোচনায় কালেভদ্রেও কানাডার নাম উঠে আসত না। বিশ্বের প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ দেশটিকে কোনো বিবেচনায় রাখেনি। অথচ সে দেশই কিনা সব হিসাব এলোমেলো করে দিয়ে সিআইএ ও মার্কিন প্রশাসনকে চোখ কচলে কানাডার দিকে তাকাতে বাধ্য করল!

পরিস্থিতিটা তৈরি করেছিলেন আসলে কানাডার সেই সময়কার প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো। তাঁর বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গেই সিআইএ অস্থির হয়ে পড়ে। এর কারণও ছিল। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে তিনি ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন, বিজয়ী হলে নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি আর্গানাইজেশন থেকে নিজেদের সেনাবাহিনী ফিরিয়ে নেবেন। আমেরিকার জন্য সেটা ছিল বড় ধরনের দুঃসংবাদ। আর কানাডা যাতে আক্ষরিক অর্থেই ট্রিটি থেকে সেনা প্রত্যাহার করে না নেয়, সে ব্যাপারে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে সক্রিয় করতে মরিয়া হয়ে ওঠে সিআইএ।

গুণে গুণে প্রায় অর্ধশতক পর ঠিক একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে আটলান্টিক পাড়ের রাজনীতি ও কূটনীতিতে। এবারের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে কানাডার প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন ট্রুডো– সেই পিয়েরে ট্রুডোরই ছেলে, জাস্টিন ট্রুডো। এবারও মার্কিন প্রশাসনের সামনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন ইসলামিক স্টেট-বিরোধী অভিযান থেকে কানাডীয় সেনা সদস্য প্রত্যাহার ঠেকানো। জাস্টিন ট্রুডোর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল এটাই যে, তিনি সিরিয়া ও ইরাক থেকে কানাডার ফাইটার জেট প্রত্যাহার করে নিবেন। নির্বাচনে বিজয়ের পর শুভেচ্ছা জানাতে তাই বারাক ওবামা যখন তাঁকে ফোন করেন, সে আলাপেই ট্রুডো পরিষ্কার করে দিয়েছেন, তিনি কানাডার সেনাবাহিনীকে বোম্বিং মিশনে ব্যবহার করতে চান না, ট্রেনিং মিশনে দেখতে চান।

ট্রুডোর সঙ্গে আলোচনায় ওবামা 'তোমার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি এটি, সেটা আমরা বুঝতে পারি' বলে আপাত নিরীহ অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটালেও, মার্কিন প্রশাসনের অস্থিরতা কোনাভাবেই ঢেকে রাখতে পারেননি। এই দফায় সিআইএ মার্কিন প্রেসিডেন্টকে কী ধরনের বার্তা দিয়েছে সেটি জানা না গেলেও, হোয়াইট হাউজের নিয়মিত ব্রিফিংএ 'কানাডা ইসলামিক স্টেট-বিরোধী কোয়ালিশন থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবে' বলে আশা প্রকাশ করা হয়েছে। অটোয়ায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্রকাশ্যেই এ নিয়ে তৎপরতা শুরু করেছেন।

ইসলামিক স্টেট-বিরোধী মিশন থেকে পশ্চিমের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার কানাডার পিছুটান বিশ্বরাজনীতিতে মার্কিন নেতৃত্ব কিছুটা হলেও প্রশ্নের মুখে ফেলে দেবে। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি তথা মধ্যপ্রাচ্যে নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নেও সংশয় তৈরি হবে। সিরিয়ার আসাদ সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাশিয়া বোমা মেরে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের আস্তানা প্রায় গুঁড়িয়ে দিয়ে এমনিতেই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মার্কিন ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ করে দিয়েছে। ঠিক এ সময় মার্কিন নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন থেকে কানাডা তার যুদ্ধজাহাজ প্রত্যাহার করে নিলে রাশিয়ার পদক্ষেপই অধিকতর গ্রহণযোগ্যতা পাবে।

কানাডার ক্ষমতায় লিবারেলের প্রত্যাবর্তনে মার্কিন প্রশাসনে অস্থিরতা তৈরি হলেও ক্রেমলিন খানিকটা স্বস্তিতে রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। লিবারেলের বিজয় বা জাস্টিন ট্রুডোর প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়া নিয়ে রাশিয়া এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেনি। কনজারভেটিভ শাসনামলে রাশিয়ার সঙ্গে কানাডার সম্পর্ক প্রায় মুখ-দেখাদেখি বন্ধের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানের বিরুদ্ধে মার্কিনিদের চেয়েও বেশি সরব হয়ে উঠেছিলেন কনজারভেটিভ প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পত্রিকা 'স্পুটনিক' যেন সে জন্যই বিস্ময়বোধক চিহ্ন ব্যবহার করে খবরের শিরোনাম করেছে, 'ট্রুডো জিতেছে!' তারা আরও লিখেছে, 'গাঁজাখোর সাবেক মেয়র কানাডার কনজারভেটিভদের বাঁচাতে পারেননি।'

লিবারেল পার্টির নেতৃত্বে কানাডা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাশিয়া-বলয়ে ঢুকে পড়বে, এমন ভাবনা কারও মধ্যে নেই। কিন্তু স্টিফেন হারপারের নেতৃত্বে কানাডা ও রাশিয়ার মধ্যে যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক ছিল, তা কিছুটা হলেও শিথিল হবে। আগামী মাসেই (মধ্য নভেম্বরে) ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে কানাডার নতুন প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর দেখা হচ্ছে। জি-২০এর বৈঠকে ট্রুডো যোগ দেবেন, এটা ইতোমধ্যে নিশ্চিত করা হয়েছে। তখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তাঁর দ্বিপাক্ষিক কোনো বৈঠক হবে কি না সে ব্যাপারে পরিষ্কার কোনো তথ্য না থাকলেও কানাডার সরকারি সূত্রগুলো বলছে, নতুন প্রধানমন্ত্রী নিজেকে সেখানে তুলে ধরার সুযোগ পাবেন। সেই 'তুলে ধরার' মাধ্যমে বিশ্বরাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ না হোক, টানাপড়েনের ভারসাম্য তৈরি হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।

ওদিকে, কানাডায় কনজারভেটিভ সরকারের পতনে ইসরাইলিদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা প্রকাশ্যেই দেখা যাচ্ছে। কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক ফোরামে ইসরাইলের পক্ষে কানাডার প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার এতটাই সোচ্চার ছিলেন যে, তিনি আসলে কোন দেশের সরকারপ্রধান তা নিয়েও সংশয় তৈরি হত! ইসরাইলিদের হয়ে প্যালেস্টাইন ও সে দেশের নেতাদের 'সন্ত্রাসী' আখ্যায়িত করতেও দ্বিধা করেননি কনজারভেটিভ প্রধানমন্ত্রী। লিবারেলদের বিজয়ের মাধ্যমে ইসরাইল আন্তর্জাতিক ফোরামে তাদের 'পরীক্ষিত স্পোকস পারসন' হারিয়েছে বলে নানা বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে।

ইসরাইলি মিডিয়া, কানাডায় বসবাসরত ইসরাইলিদের পত্রিকাগুলোও এ নিয়ে নানা ধরনের বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে। সব বিশ্লেষণেই হতাশা স্পষ্ট। ইসরাইলিরা হতাশ হলেও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভারসাম্য ও ন্যয্যতা জরুরি। কানাডার কনজারভেটিভ সরকারের ইসরাইল সমর্থনে এ দুটোর কোনোটাই ছিল না।

বৈদেশিক নীতিমালার ক্ষেত্রে কনজারভেটিভদের অনেক সিদ্ধান্তের সমালোচনা করলেও একটি জায়গায় লিবারেল ট্রুডো আশ্চর্যজনকভাবে নীরব রয়েছেন। স্টিফেন হারপার সৌদি আরবের সঙ্গে ১৫ বিলিয়ন ডলারের হালকা অস্ত্র রপ্তানির চুক্তি করেছিলেন। কানাডার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এ অস্ত্র রপ্তানি চুক্তি নিয়ে মিডিয়া প্রশ্ন তুললেও রাজনীতিকদের কেউ এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করেননি। এমনকি তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দলের কোনোটি নির্বাচনী ঘোষণায় এ নিয়ে বক্তব্য দেয়নি।

সৌদি আরবের শাসকদের নির্যাতনের প্রবণতা এবং দেশটির জনগণের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে সেখানে অস্ত্র-রপ্তানির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল কানাডার মিডিয়াগুলো। মধ্যপ্রাচ্যে বোম্বিং মিশনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে জাস্টিন ট্রুডোর আপত্তি থাকলেও সৌদি আরবের শাসকদের কাছে প্রশ্নহীন ও নিঃশর্তভাবে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র বিক্রির ব্যাপারে তাঁর আপত্তি নেই।

কানাডার বিশ্লেষকদের মতে, এবারের নির্বাচন নিয়ে বহির্বিশ্বের সরকার ও মিডিয়ার চোখে পড়ার মতো আগ্রহ ছিল। সে আগ্রহের কারণ কী, তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা কেউ দেননি। তবে স্টিফেন হারপার কানাডাকে আন্তর্জাতিক ফোরামে একটা আলাদা জায়গায় দাঁড় করিয়েছিলেন, এ ব্যাপারে কারও দ্বিমত নেই। তবে তা যে নেতৃত্বের নয় সে বিষয়েও অধিকাংশ একমত। দেশটি আসলে আন্তর্জাতিক ফোরামে 'ঝগড়াটে খেলোয়াড়' হিসেবেই পরিচিতি পেয়ে গিয়েছিল। এ পরিচিতির জন্য মূলত দায়ী, স্টিফেন হারপার নির্বাচনে কেমন করেন তা নিয়ে বিভিন্ন দেশে কৌতূহল ছিল।

নির্বাচন শেষ না হতেই তাই পশ্চিমের প্রভাবশালী দেশগুলোর সরকারপ্রধানরা টেলিফোন করে জাস্টিন ট্রুডোকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এ জন্য কানাডার বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দেশটির পরিবর্তন আন্তর্জাতিক ফোরামেও কাঙ্ক্ষিত ছিল।

তবে আন্তর্জাতিক ফোরামে প্রভাব সৃষ্টির আগে ট্রুডোকে তাঁর দক্ষিণের প্রতিবেশির সঙ্গে টানাপড়েনের অবসান ঘটাতে হবে। কিন্তু সেটি কতটা সম্ভব তা এই মুহূর্তে আন্দাজ করা কঠিন। অনেকেই ঠাট্টা করে বলছেন, মার্কিন প্রশাসন হঠাৎ করেই যেন পঞ্চাশ বছর আগেকার সংকটে পড়ে গেছে। পিয়েরে ট্রুডোর অভ্যন্তরীন নীতি ও বিদেশ নীতি আমেরিকাকে বেশ চেপে ফেলে দিয়েছিল। পঞ্চাশ বছর পর জাস্টিন ট্রুডো তাদের নতুন করে দুঃশ্চিন্তায় ফেলেছেন।

আমেরিকার 'দুঃশ্চিন্তা' উপেক্ষা করে জাস্টিন ট্রুডো বিশ্বসভায় তাঁর দেশকে প্রকৃত অর্থে 'লিবারেটেড' দেশ হিসেবে কত দ্রুত এবং কতটুকু দাঁড় করাতে পারেন তা দেখার অপেক্ষা করছে গোটা বিশ্ব।

শওগাত আলী সাগর: টরন্টোর বাংলা পত্রিকা 'নতুন দেশ'এর প্রধান সম্পাদক।