ছেষট্টিমুক্ত ভারত সাতান্নতে আটক বাংলাদেশ

এম এম খালেকুজ্জামানএম এম খালেকুজ্জামান
Published : 22 Oct 2015, 01:06 PM
Updated : 22 Oct 2015, 01:06 PM

কনফুসিয়াসের লিখিত রচনা রাজশক্তির পক্ষে যেত না বলে বার বার রোষানলে পড়ত। এমনকি তাঁর শত শত অনুগামীকে পুড়িয়ে পর্যন্ত মারা হত তাঁর সঙ্গে সহমত প্রকাশের দায়ে। সপ্তদশ শতকে ইংরেজ কবি মিল্টন ব্রিটিশ রাজার সঙ্গে লড়াইয়ে নামেন বিবেকের স্বাধীনতা ও চিন্তার অধীনতা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে। অ্যারিওপ্যাজিটিকা যে কারণে নমস্য, তার কারণ এখানে মিল্টন দাবি জানান:

''আমায় দাও জ্ঞানের স্বাধীনতা, আমায় দাও কথা বলার স্বাধীনতা, আমায় দাও মুক্তভাবে বিতর্ক করার স্বাধীনতা। সর্বোপরি আমাকে দাও মুক্তি।''

চার্চ ও রাষ্ট্র থেকে মিল্টন স্বাধীনতা চেয়ে এমন উচ্চারণ করেছিলেন। কারণ সে সময় ছিল চার্চই রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্র। লক্ষ্যণীয় যে, শর্তহীন বাকস্বাধীনতার অধিকার আজও আমরা অর্জন করতে পারিনি। দেশে দেশে কালে কালে পরিচালনার কোনো না কোনো পর্যায়ে গোয়েবলসের মতো উপদেষ্টাদের নষ্ট বুদ্ধিতে সত্য ও মুক্তবুদ্ধিচর্চার বিরুদ্ধে নানা নামে বিভিন্ন ধরনের কালাকানুন দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে দেখা যায়।

খুব বেশি দিন নয়, কয়েক দশক আগে পর্যন্ত বই-পুস্তকের মাধ্যমেই মূলত সৃজনশীল ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা হত। এক দশক হল ইন্টারনেট, ব্লগ ইত্যাদি মাধ্যমে চলছে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা। এর ধারাবাহিকতায় এই অঞ্চলের নাগরিকরা সাইবার পরিসরে চিন্তার চর্চা করছেন। এর গলি-ঘুপচি আর ওঁৎ পেতে থাকা বিপদ সম্পর্কেও সচেতনতা তাই খুব টেকসই নয়।

ইন্টারনেট মানুষকে মতপ্রকাশের জন্য অবারিত ক্ষেত্রে প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছে। এর বদৌলতে এই সময় জনপ্রিয় হয়ে ওঠা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদিতে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্লগ সাইট ব্যবহার করে কেউ কেউ লিখে যাচ্ছেন– যা-ইচ্ছা-তাই। কেউ কেউ ইউটিউবের মতো ভিডিও সাইটেও অবাধে সত্য-অসত্য যাচাই না করে মিথ্যা, বানোয়াট ভিডিও আপলোড করছেন। এটা যে অন্যের জন্য সর্বনাশ হতে পারে তা মনে করছেন না তারা। অন্যকে অপদস্থ করাই যেন কিছু মানুষের কাজ। এতে বিরোধ বাড়ছে; বিড়ম্বনার সৃষ্টি হচ্ছে সমাজে। রাজনৈতিক হানাহানির তো পোয়াবারো। এখানে ইন্টারনেটের তুলনা চলে আগুনের সঙ্গে। যার ব্যবহার নির্ভর করে ব্যক্তির ইচ্ছার ওপর। পুড়িয়ে রান্না করতে পারে যে জিনিস, তা আবার বাড়িঘর ছারখারও করে দিতে পারে।

এই সুযোগ নিয়ে তথ্য-প্রযুক্তিগত বা সাইবার অপরাধ ক্রমেই একটি সামাজিক ব্যাধি হিসেবে ছড়িয়ে পড়ার নানা লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে। বিশেষ করে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার উদ্দেশ্যে এর অপব্যবহার বিরাট হুমকি সৃষ্টি করেছে।

একই ঔপনিবেশিক জঠর থেকে বেড়ে ওঠা উপমহাদেশের দুই দেশ, ভারত ও বাংলাদেশের অনেক আইনই একে অন্যের দ্বারা ভালোমতো প্রভাবিত। তেমনই এক আইন, তথ্যপ্রযুক্তি আইন তাই কোনো লিগ্যাল ডেভলপমেন্ট ছাড়াই অন্য দেশ খুব গভীরভাবে অনুসরণ করে থাকে।

ভারত প্রেক্ষিত

বহুল-বিতর্কিত তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬ (এ) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি কম্পিউটার বা বৈদ্যুতিন যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্যে এমন কোনো মন্তব্য করেন যা তিনি নিজে মিথ্যা জেনেও শুধুমাত্র কাউকে অপমান, ঘৃণা প্রকাশ, অপপ্রচার, ভাবাবেগে আঘাত, জনমত তৈরির উদ্দেশ্যে করেছেন বা কাউকে আক্রমণ করার জন্য অথবা সাধারণ মানুষকে ভুল পথে চালিত করার জন্য যদি তিনি এ ধরনের কোনো মন্তব্য করে থাকেন, তবে তার জরিমানাসহ তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে৷

অভিযোগ ছিল, এই ধারার অপপ্রয়োগ করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নিচ্ছিল পুলিশ৷ যেমন, গত বছর বালসাহেব ঠাকরে যিনি শিবসেনা প্রধান বলে পরিচিত, মৃত্যুর পর অঘোষিত বনধের চেহারা নেয় গোটা মুম্বাই শহর। এর প্রতিবাদে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে সরব হয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন শাহিন বাহদা। সেই পোস্টে 'লাইক' দিয়ে সমর্থন করেছিলেন রিনু শ্রীনিবাসন। এর জেরেই ঠানে জেলার পালঘর থেকে রিনু শ্রীনিবাসনকে গ্রেফতার করা হয়, পড়তে রাষ্ট্রীয় রোষানলে। দোহাই দেওয়া হয় বিতর্কিত ৬৬ (এ) ধারার। বছর দুই আগে সংসদ ও প্রশাসনের উঁচু স্তরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মতামত ব্যক্ত করে ওয়েবসাইট ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যঙ্গচিত্র পোস্ট করেন মুম্বাইয়ের ব্যঙ্গচিত্রশিল্পী অসীম ত্রিবেদী। এরপরই তাঁকে গ্রেফতার করে মুম্বাই পুলিশ। এভাবে ৬৬ (এ) ধারার দোহাই দিয়ে নাগরিক হেনস্তার হাতিয়ার ব্যবহার হয়ে আসছিল অহরহ।

৬৬ (এ) ধারার প্রয়োগে অনেক সময় এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাজনীতি৷ দেশজুড়ে পরপর কয়েকটি গ্রেফতারির ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক থেকে রাজ্যগুলিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, কোনো পদস্থ পুলিশ কর্তার অনুমতি ছাড়া বিতর্কিত মন্তব্যকারীকে গ্রেফতার করা যাবে না৷ ৬৬ (এ) ধারায় বলা ছিল, আপত্তিকর মন্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করলে তা শাস্তিযোগ্য হিসেবে দেখা হবে৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজস্ব মত প্রকাশ করে এই ধারার জেরে গ্রেফতার হয়েছেন অনেক নাগরিক৷ যদিও এর আগে এই ধারা প্রসঙ্গে সরকারের তরফে বলা হয়েছিল, অপব্যবহারের অভিযোগে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের এ ধারা বাতিল করে দেওয়া উচিত নয়৷ ২৬ ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বিচারপতি জে চেলামেশ্বর ও বিচারপতি আর এফ নরিম্যানের একটি ডিভিশন বেঞ্চ গঠন করা হয়েছিল৷

আদালত বলেন, ফেসবুক-টুইটারে বিতর্কিত মন্তব্য পোস্ট করলে আর কোনো শাস্তি পেতে হবে না৷ গ্রেফতার করা যাবে না মন্তব্যকারীকে৷ সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে বাকস্বাধীনতার অধিকারের পক্ষেই রায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট৷ সুপ্রিম কোর্ট আইনটি নাকচ করে জানিয়েছে, আইনটি স্বচ্ছ তো নয়ই, তার ব্যাপ্তি বিপুল ও পরিণাম ভয়ঙ্কর। সুপ্রিম কোর্টের রায়টি প্রকৃত অর্থেই ঐতিহাসিক। কিন্তু ৬৬ (এ) ধারা ভারতের গণতন্ত্রের ইতিহাসে একটি অনপনেয় কালো দাগ হিসেবেই থেকে যাবে। ইন্দিরা গাঁধীর জারি করা জরুরি অবস্থার মতোই। বস্তুত, এক অর্থে এই দাগ গভীরতর।

বাংলাদেশ প্রেক্ষিত

ভারতের ২০০০ সালের তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৭ ও ৬৬ (এ) ধারার সঙ্গে আমাদের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারার মিল পাওয়া যায়। ভারতীয় আইনের ৬৭ ধারার ভাব ধার করতে গিয়ে ২০০৬ সালের খসড়া প্রস্তুতকারীরা দুরভিসন্ধির আশ্রয় নিয়েছিলেন। ৬৭ ধারা ছিল অশ্লীলতাবিরোধী, অথচ বিএনপির সাংসদেরা তথ্যপ্রযুক্তি আইনে অশ্লীলতার সঙ্গে মানহানি, নীতিভ্রষ্টতা, ব্যক্তির ভাবমূর্তি ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত অন্তর্ভুক্ত করেন।

বিএনপি প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে গিয়ে নিজেরাই এর শিকার হয়েছে, হচ্ছে। তাদের সরকারের সাবেক মন্ত্রী এম কে আনোয়ার এ আইনের প্রথম রাজনৈতিক শিকার। তার বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। এটা কিন্তু দণ্ডবিধির ২৯৫ (ক) ধারায় বিচার্য ছিল। সেখানে মাত্র দুবছর জেল; তাই ওই মামলার বাদী শাস্তি সর্বোচ্চ করতে সাহায্য নেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের।

বিএনপির চার দলীয় জোট ২০০৬ সালে গতানুগতিক অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ও নাগরিকদের স্বার্থবিরোধী বিভিন্ন কালাকানুন যুক্ত করে আইনটি করেছিল। সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে তখনকার সরকার যেমন ন্যূনতম আলোচনা করার প্রয়োজন মনে করেনি, ২০১৩ সালে এসে বর্তমান সরকারও কোনো ধরনের আলোচনা ও মতবিনিময় ছাড়াই সে পুরাতন আইন আরও কঠোর করেছে।

সংশোধিত আইনের খসড়ায় পুলিশকে সরাসরি মামলা করা ও পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, সে সঙ্গে কয়েকটি ধারা জামিন-অযোগ্য করা এবং আমলযোগ্য নয় এমন অপরাধ আমলযোগ্য হিসেবে গণ্য করায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের অপব্যবহার নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে দারুণভাবে।

সংশোধিত আইনটি কার্যকর হলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হবে এবং শুধু মতামত প্রকাশের জন্য হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কা করছেন তথ্যসেবী মানুষ, আইন বিশেষজ্ঞ এবং মানবাধিকার-কর্মীরা। তবে সরকার বলছে, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধ করার প্রবণতা বেড়েছে, অসৎ উদ্দেশ্যে এ মাধ্যম ব্যবহার করা হচ্ছে, নানা ধরনের উসকানি দেওয়া হচ্ছে এবং আঘাত দেওয়া হচ্ছে ধর্মীয় অনুভূতিতেও। এসব রোধেই আইনে সংশোধনী আনা হয়েছে।

আইনের ৫৪, ৫৬, ৫৭ ও ৬১ ধারায় উল্লিখিত অপরাধ আমলযোগ্য ও অজামিনযোগ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই চার ধারার অপরাধগুলো হল, কম্পিউটার ব্যবহার করে বিভিন্ন অপরাধ, সিস্টেমে হ্যাকিং, সংরক্ষিত সিস্টেমে প্রবেশ ও ইলেকট্রনিক ফরমে মিথ্যা, অশ্লীল বা মানহানিকর তথ্য প্রকাশ করা। এই চার ধারার অপরাধের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তির মেয়াদ ১০ বছর থেকে বাড়িয়ে ১৪ বছর করা হয়েছে। আর ন্যূনতম শাস্তি হবে ৭ বছর।

৫৪ ধারার অপরাধ

কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্কের মালিক অথবা জিম্মাদারের অনুমতি ছাড়া তার নথিতে থাকা তথ্য নষ্ট করা বা ফাইল থেকে তথ্য উদ্ধার বা সংগ্রহ করার জন্য কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম ও নেটওয়ার্কে প্রবেশ করা বা তা করতে অন্য কাউকে সহায়তা করা; কোনো উপাত্ত বা উপাত্ত-ভাণ্ডার থেকে আংশিক তথ্য নিয়ে ব্যবহার করাও অপরাধ হিসেবে ধরা হয়েছে। কম্পিউটারে ভাইরাস ছড়ানো বা ছড়ানোর চেষ্টা; ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো কম্পিউটার বা নেটওয়ার্কের উপাত্ত-ভাণ্ডারের ক্ষতিসাধন করা; অন্য কোনো প্রোগ্রামের ক্ষতি করে নেটওয়ার্কে বিঘ্ন সৃষ্টি করা বা করার চেষ্টা; কম্পিউটার নেটওয়ার্কে অবৈধ প্রবেশে সহায়তা করা; অনুমতি ছাড়া কোনো পণ্য বা সেবা বাজারজাত করা; অযাচিত ইলেকট্রনিক মেইল পাঠানো; কারসাজি করে কোনো ব্যক্তির সেবা গ্রহণ বাবদ ধার্য চার্জ অন্যের হিসাবে জমা করাও অজামিনযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করা হবে।

৫৬ ধারার অপরাধ

এই ধারায় কম্পিউটার সিস্টেমের হ্যাকিং-সংক্রান্ত অপরাধের শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে কম্পিউটারের তথ্য নষ্ট, বাতিল বা পরিবর্তন করা অজামিনযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে। মালিক বা দায়িত্বশীল ব্যক্তি না হয়ে কেউ কোনো কম্পিউটার, সার্ভার, নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক সিস্টেমে অবৈধভাবে প্রবেশ করে ক্ষতি করাও একই ধরনের অপরাধ বলে গণ্য হবে।

৫৭ ধারার অপরাধ

ইলেকট্রনিক মাধ্যমে মিথ্যা, অশ্লীল বা মানহানিকর তথ্য প্রকাশ-সংক্রান্ত অপরাধ এই ধারায় গণ্য হবে। ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে মিথ্যা ও অশ্লীল কিছু প্রকাশ করলে এবং তার কারণে মানহানি, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগলে বা কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি দেওয়া হলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে।

প্রতিনিয়ত আমরা ইন্টারনেট ব্যবহার করছি। আইনে তথ্যের সংজ্ঞায় মিথ্যা, অশ্লীল ও উসকানিমূলক বিষয়গুলো স্পষ্ট করা নেই। ইন্টারনেটে সত্য ভেবে কোনো তথ্য আদান-প্রদান করা হল, কিন্তু সেটা পুলিশ প্রাথমিকভাবে মিথ্যা বা অশ্লীল বা উসকানিমূলক বিবেচনা করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার করতে পারবে। ফলে ভয়ভীতির কারণে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সঙ্কুচিত হবে।

৬১ ধারার অপরাধ

সংরক্ষিত সিস্টেমে প্রবেশ এই ধারার অন্যতম অপরাধ। সংরক্ষিত সিস্টেম হিসেবে ঘোষণা করা সত্ত্বেও কোনো ব্যক্তির তাতে অননুমোদিতভাবে প্রবেশ করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

এ ছাড়া আইনের ৭৬ (১) ধারা সংশোধন করে বলা হয়েছে, নিয়ন্ত্রক বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা বা কোনো পুলিশ কর্মকর্তার মাধ্যমে এই আইনের অধীনে কোনো অপরাধ একই সঙ্গে তদন্ত করা যাবে না। যদি কোনো মামলার তদন্তের কোনো পর্যায়ে দেখা যায়, সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তদন্ত পরিচালনার দায়িত্ব পুলিশ কর্মকর্তার কাছ থেকে নিয়ন্ত্রক বা তাঁর ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা তাদের কাছ থেকে পুলিশ কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করা প্রয়োজন। তবে সরকার বা ক্ষেত্রমতো সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদেশের মাধ্যমে হস্তান্তর করতে পারবে।

এই ধারাগুলো অজামিনযোগ্য করে দেওয়ায় মানুষ ভীত হবে, এটা আসলেই ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। এর ফলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। একজন ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত তাকে দোষী বলা যায় না। এ ধরনের অপরাধ বিচারের আগেই অজামিনযোগ্য বলে দেওয়াও গ্রহণযোগ্য নয়। অপরাধ অজামিনযোগ্য করে দেওয়ার ফলে হিতে বিপরীত হতে পারে, আইনের অপব্যবহার হতে পারে। জামিন আদালতের সন্তুষ্টির ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত।

জাতিসংঘের স্পেশাল রেপোর্টিয়ার হাইনার বিলেনফোল্ড বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে উদ্বেগের বিষয়টি লক্ষ্য করেছেন বিভিন্ন পর্যায়ের আলোচনায়। হাইনার বিলেনফোল্ড বলেন, বিচার বিভাগের মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানেও এটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এটি নিয়ে অস্পষ্টতা থাকায় অনেকে একে 'আসন্ন দীর্ঘস্থায়ী দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির' সঙ্গে তুলনা করেছেন। এটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও তদন্ত কর্মকর্তাদের যে কাউকে যে কোনো সময় গ্রেপ্তারের মতো নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দিয়েছে। তিনি বলেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ধর্মীয় স্বাধীনতা। জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ সফরের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে এমন মন্তব্য করেছেন হাইনার বিলেনফোল্ড কদিন আগে।

তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬ (এ) ধারাটি রচিত হয়নি রাশিয়া কিংবা উত্তর কোরিয়ায়– হয়েছে সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশ ভারতে– বিস্ময়ের কারণ এটাই। আর বাংলাদেশেও সামরিক নয়, গতান্ত্রিক সরকারগুলোই এই মুক্তমত প্রকাশ-বিরোধী তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার সেবা নিয়ে দেশ চালাচ্ছে। গত ক বছরে আইনটি গণতন্ত্রের কী ক্ষতি করেছে, প্রায় বিনা বাধায়, বিনা প্রতিরোধে, তাও কম বিস্ময়ের নয়।

এম এম খালেকুজ্জামান: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।