দলবেঁধে পিটিয়ে ও কুপিয়ে মানুষ মারা

ফরহাদ মজহার
Published : 19 July 2011, 03:03 PM
Updated : 19 July 2011, 03:03 PM

আয়ু যখন শেষ হয়ে আসে তখন মৃত্যু সব নিঃশ্বাস খরচ করে ফেলা মানুষটির কাছ থেকে ঠিক কী নিতে আসে আমরা জানি না। কারণ ততোদিনে তার তো কিছুই দিতে পারার সামর্থ থাকবার কথা নয়। কিন্তু তবু আমরা বলি, প্রাণ নিয়ে যাবার একটা কর্তব্য বুঝি কারো থেকেই যায়। নইলে নিঃশ্বাস খরচ হতে থাকবে অপ্রয়োজনে। যম বলি কী আযরাইল বলি, যাকে এই কর্তব্য পালন করতে হয় তাকে খুবই ভয়ংকর বলেই আমরা জানি। মৃত্যু ব্যক্তির রূপ ধরে আসে কি আসে না সেই তর্ক, কূটতর্ক। সত্য হোক বা না হোক মানুষ কল্পনাপ্রবণ। যা কিছু সম্পর্কে ভয় তাকে মানুষ ভয়ংকর কোনো আদল দিয়েই উপলব্ধি করতে চেষ্টা করে।

মৃত্যু মানুষের জন্য ভীতিকর। কবি ভাবুক সাধু সন্ত নানান সময়ে মৃত্যুর একটা সুন্দর ছবি দাঁড় করিয়ে আমাদের ভয় ভাঙ্গাবার চেষ্টা করেছেন। ওতে খুব একটা কাজ হয়েছে বলে মনে হয় না। জীবনানন্দ তাঁর 'মৃত্যুর আগে' কবিতায় নানানভাবে ইশারায়-ইঙ্গিতে প্রতীকে-উপমায় চেয়েছিলেন না মরেও আমাদের মৃত্যুর কোনো অভিজ্ঞতা দান করা যায় কিনা। বাংলা কাব্যের ইতিহাসে কবিতাটি একটা মজবুত জায়গা দখল করে নিতে পেরেছে, কিন্তু মৃত্যুর সর্বজনীন কোনো উপলব্ধি দানের চেষ্টা সফল হয়েছে দাবি করা যাবে না।

কারণ মৃত্যু জনে জনে আসে। অন্যের বাড়িতে আমি বাস করে দেখতে পারি, সে ঘরে বসবাসের অভিজ্ঞতা কেমন, অন্যের মিষ্টি খেয়ে বলতে পারি তার স্বাদ কেমন, কিন্তু অন্যের মৃত্যুর স্বাদ আমার নেবার সাধ্য নাই। নিজের মৃত্যু নিজেকেই বরণ করতে হয় আমাদের। জনে জনে মৃত্যুর কোনো সর্বজনীন উপলব্ধি বা অভিজ্ঞতা নির্ণয়ের চেষ্টা মৃত্যুর ব্যক্তি-নির্দিষ্ট চরিত্রের কারণেই অসম্ভব।

ফলে বলতে হয়, মৃত্যু সম্পর্কে কী আর আমরা বুঝতে চাই? রোদ নিভে যাবার পরে গলে-যাওয়া পচে-যাওয়া বর্জ্য খেয়ে যে পাখি কালো রঙ ধারণ করেছে-– যাকে আমরা ঠিক পাখি বলেও গণ্য করি না-– সেই কাক যখন উড়ে যায় তখন তো মৃত্যু সম্পর্কে যা বোঝার আমাদের বোঝা হয়েই যায়। আর কী বুঝব?

কিন্তু বোঝা তবুও বাকি থেকে যায়। তাছাড়া মৃত্যু নানা প্রকার। যেমন, অসুস্থ হয়ে ধুঁকে ধুঁকে যে মৃত্যু তাকে স্বাভাবিক মৃত্যু থেকে আমরা আলাদা করি। কারণ অসুখের কাছে অসহায় মানুষের কষ্ট আমরা ধরতে পারি। ডাক্তারি শাস্ত্র অসুখ সম্পর্কে আমাদের তথ্য দিতে পারে। যার অসুখ তার কাছ থেকে কষ্টের বর্ণনা শোনার সুযোগ থাকে। অনেকের অভিজ্ঞতা থেকে একটা সর্বজনীন অভিজ্ঞতা দাঁড় করানো সম্ভব। কিন্তু সেটা অসুখের অভিজ্ঞতা যা মৃত্যু-যন্ত্রণার সমতুল্য, কিন্তু নিঃসন্দেহে তা মৃত্যুর অভিজ্ঞতা থেকে ভিন্ন।

ঠিক তেমনি টর্চার সেলে রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়ে মৃত্যুও মৃত্যু। যারা সে মৃত্যুখানা থেকে পালিয়ে আসতে পেরেছেন বা ছাড়া পেয়েছেন তাদের কাছ থেকে আমরা নির্যাতনের ভয়াবহ সব কাহিনি শুনে নির্যাতন সম্পর্কে ধারণা করতে পারি। এর ভিত্তিতেই সকল প্রকার নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে উঠেছে। নির্যাতন আন্তর্জাতিকভাবে নিন্দিত এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মানুষকে নির্যাতন করা, অমানবিক আচরণ করা, মানুষের মর্যাদা পায়ে দলিয়ে দেওয়া ইত্যাদি সব কিছুর বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ চলছে বিশ্বজুড়ে। কাউকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে তার কাছ থেকে তথ্য বের করে আনা মানবিক দিক থেকে যেমন নিন্দিত, তেমনি আইনের কাছেও গ্রহণযোগ্য হয় না। এই ব্যাপারগুলো আমরা জানি। নির্যাতন ও নির্যাতনে মৃত্যু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আমাদের বিদ্রোহী করে তোলে।

দুর্ঘটনায় মৃত্যু আবার ভিন্ন রকম। দুর্ঘটনার মৃত্যুকে আমরা তাই বলি অকালে মৃত্যু। মৃত্যুর কোনো কাল বা অকাল আছে কিনা কে জানে! যার যখন মৃত্যু তখনই তার মরবার সময়। তাই কী? তাহলে দুর্ঘটনায় যাদের আয়ু অকালে শেষ হয় তাদের জন্য আমাদের বিশেষ মায়া তৈরি হবার কারণ কী?

কিছুদিন আগে মীরসরাইয়ে খোলা ট্রাকে স্কুল ছাত্ররা ফুটবল খেলা দেখে ফিরছিল। তাদের গাড়ি দুর্ঘটনায় রাস্তা থেকে ছিটকে গিয়ে পাশে পড়ে উল্টে যায়। পানি জমে থাকা নিচু জায়গায় উল্টে থাকা ট্রাকের বডির নিচে চাপা পড়ে ৪৪ জন শিশু-কিশোরের মৃত্যু ঘটে। মর্মান্তিক!

যখন খবরটি পড়ছিলাম তখন ভাবছিলাম বাচ্চারা বেঁচে থাকার জন্য নিশ্চয়ই কী আপ্রাণ চেষ্টাই না করেছিল! আন্দাজ করতে পারি দুর্ঘটনার পরপরই সকলের নিঃশ্বাস শেষ হয়ে যায়নি। নিচে পানি ও কাদা, ওর মধ্যে ট্রাক চাপা দিয়ে থাকায় বেরুবার রাস্তা বন্ধ। আলো নিভে আসছে, নিশ্বাসের জোর কমে আসছে। শরীরের তেজ নিঃশেষ হচ্ছে। এই ভয়াবহতার কষ্ট কেমন সেটা আমরা আন্দাজ করতে পারি, কিন্তু উপলব্ধি করতে পারি না।

দুর্ঘটনায় এই ধরনের মৃত্যু ঘটছে বেশুমার। কিন্তু এই শিশু-কিশোরদের প্রতি আমাদের সংবেদনার মাত্রা দুর্ঘটনায় অন্যদের মৃত্যুর চেয়েও বেশি তীব্র মনে হয়। একসঙ্গে এতোগুলো মৃত্যু মেনে নিতে কষ্ট হয়। তাদের বয়স এমন কিছু বেদনা উস্কে দেয় যা ব্যাখ্যা করা মুশকিল।

তাছাড়া তারা ছাত্র বলে আমরা আমাদের অবচেতনে সমাজে নিচের তলার গণনার অনুপযোগীর আর দশটা জীবের চেয়ে তাদের খানিক পরিমাণ অধিক দামি গণ্য করি। কারণ তারা স্কুলে পড়াশুনা করছিল এবং আমাদের সমাজে-– মধ্যবিত্তের গণ্ডিতে প্রবেশ করবার টিকিট জোগাড় করবার চেষ্টায় রত ছিল। নইলে গরিব হাভাতেরা তো সারাক্ষণই 'কাল নাই অকাল নাই' মরে। কে তার খবর রাখে?

২. মৃত্যুর চেহারা কত রকম?

অতএব বেশ কয়েক দিন ধরে মৃত্যুর চেহারা কত রকম হতে পারে ভাবছিলাম। তার মধ্যেই অন্য এক ধরনের মৃত্যুর খবর। ছয়জন ছাত্রকে ডাকাত গণ্য করে আমিনবাজারের ট্রাক টার্মিনালের পেছনের একটি জায়গায় এলাকার লোকজন পিটিয়ে ও কুপিয়ে মেরে ফেলেছে শবে বরাতের রাতে। এ-ও মৃত্যুর আরেক চেহারা। তবে মানুষ পিটিয়ে মারার ঘটনা বাংলাদেশে মোটেও নতুন কিছু নয়। মানবাধিকার সংগঠন 'অধিকার' হিসাব দিচ্ছে, এই বছরেরই জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৭৫ জনকে পিটিয়ে মারা হয়েছে। জানুয়ারিতে ৮ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৮, মার্চে ১২, এপ্রিলে ১৮, মে মাসে ১১ এবং জুন মাসে ৮ জন। গত বছর ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পিটিয়ে মানুষ মারার ঘটনা ঘটেছে ১২৬টি।

বহু বছর আগে বাংলাদেশে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন গঠন করে যখন আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু হল তখন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লিখতে গিয়ে পিটিয়ে মানুষ মারার হিংস্রতার দিকেও দৃষ্টি ফেরাবার কথা বলেছিলাম। দুটোই একসূত্রে গাঁথা, দুটোই আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। রাষ্ট্র আইন ভেঙ্গে আইনের বাইরে নাগরিকদের হত্যাকে ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টার বলে সাফাই গায় আর মানুষ আইনের ওপর ভরসা ছেড়ে দিয়ে 'ধর ধর মার মার' বলে কাউকে চোর ডাকাত, পকেটমার, ছেলেধরা ইত্যাদি গণ্য করে পিটিয়ে মারে। দুপক্ষের কেউ আইন মানছে না। আইনি প্রক্রিয়ায় অপরাধীর বিচার ও শাস্তি সম্ভব দুই পক্ষের কেউই সেটা মানে না। আর ঠিক এখানেই বাংলাদেশের জন্য ঘোর বিপদের জায়গা।

বিপদ শুধু রাষ্ট্র, আইন ও আইন-শৃংখলা বাহিনীর দিক থেকে নয় সকল দিক থেকেই বিপদ। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সমাজ, সামাজিক সম্পর্ক, সংবেদনা ও সচেতনতার ভাঙ্গন কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তার লক্ষণ আমরা ধরতে পারি।

শবে বরাতের দুপুর রাতে কীভাবে ছয় তরুণ ছাত্রকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে মারা হয়েছে সেই হিংস্র দৃশ্য কল্পনা করা কঠিন। এই বীভৎস মৃত্যুর অভিজ্ঞতা আন্দাজ করাও কঠিন। এত রাতে গণমাধ্যমের কারও সেখানে থাকার কথা নয়। যারা পরদিন অকুস্থলে গিয়েছেন তারা ভাঙা বাঁশের টুকরো, গাছের ডাল, ইটের টুকরা, একটি জিনসের প্যান্ট, একটি লাল-হলুদ পাঞ্জাবি, স্যান্ডো গেঞ্জি, কয়েকটি স্যান্ডেল পড়ে আছে দেখেছেন। একটি গণমাধ্যমে ছবি ছাপা হয়েছে, বালুর ওপর একটি জিন্স প্যান্ট আর গেঞ্জি পড়ে আছে, পাশে একটি মোটা বাঁশের লাঠি। কিঞ্চিত দূরে আরেকটি লাঠি। যার পরিধানের কাপড় সে নিশ্চয়ই এখন লাশ হয়ে মর্গে। তার কবরে যাওয়াও এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ তার আত্মীয়-স্বজনকে আইনের মেলা জাল ভেদ করে লাশ হাতে পেতে হবে।

বালুতে রক্তের দাগ নাই। এলাকাবাসীর ব্যখ্যা হচ্ছে, বৃষ্টির কারণে রক্তের দাগ মুছে গেছে। তাই কী? হত্যার চিহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টার সহযোগী হয়েই তাহলে শবে বরাতে রাতের বৃষ্টি পড়েছিল।

প্রত্যেকটি পত্রিকাই নিশ্চিত করেছে যে, ষোল থেকে একুশ বছর বয়েসী যাদের নৃশংসভাবে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে তারা প্রত্যেকেই ছাত্র। তিনজন মিরপুর বাংলা কলেজের, একজন তেজগাঁও কলেজের, একজন ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ম্যাপল লিফের ও বাকি জন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের। পড়াশুনায় যারা এতদূর এগিয়ে আছে তারা, বলাবাহুল্য, মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান।

ছাত্রদের মধ্যে বেঁচে গিয়েছে আল আমিন। সে এখন হাসপাতালে। তার বক্তব্য হচ্ছে, শবে বরাতের রাতে নামাজ পড়ার পরে রাত একটার দিকে আমিনবাজার বাস টার্মিনালের মতো অপরাধপ্রবণ এলাকায় গাঁজা খাবার জন্য গিয়েছিল। গাঁজা কোথায় পাওয়া যায় খুঁজতে খুঁজতে তাদের রাত দেড়টা বেজে যায়। আর হঠাৎ কেবলার চরে তাদের সাতজনকে ডাকাত ভেবে লোকজন ঘিরে ফেলে। তারপর শুরু হয় গণপিটুনি ও কোপানি। পুলিশ পিটুনির ও কোপানির সময় উপস্থিত ছিল।

একটি পত্রিকার খবর অনুযায়ী, ছয় ছাত্রকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করেছে স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশ সদস্যরা। আল আমিন জানিয়েছে, মুরুব্বিদের পা ধরে তারা ডাকাত নয় বলে প্রাণভিক্ষা চেয়েছে। কিন্তু তারা তাকে পেটানো বন্ধ করেনি। এই রকম দুজন মুরুব্বির পা ধরে আকুতি-মিনতি করার পরেও কোনো ফল হয়নি। তারপর সে এক দারোগার পা জড়িয়ে ধরে। তখন আল আমিন দারোগাকে বলতে শোনে যে, "আপনারা সবাইকে মেরে ফেললে তো সমস্যা হবে। একজনকে অন্তত বাঁচিয়ে রাখেন।"

তখন মারা বন্ধ হয়। তথ্য হিসাবে আমাদের জন্য যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল, পিটিয়ে মারার সময় পুলিশ উপস্থিত ছিল। পুলিশের উপস্থিতিতেই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে (প্রথম আলো, ১৮ জুলাই ২০১১)। মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নিচ্ছে এই দাবি সর্বাংশে সত্য নয়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা আড়াল করলে চলবে না।

পুলিশের উপস্থিতির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিশেষত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমএর খবরের দিকে যদি আমরা নজর রাখি। সাভার মডেল থানার উপ-পরিদর্শক আমিনুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, "রাত আনুমানিক পৌনে ২টার দিকে ওই এলাকায় সাত সদস্যের এক দল ডাকাত ধারালো অস্ত্র-সস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ডাকাতির প্রস্তুতি নিচ্ছিল। স্থানীয়রা বিষয়টি আঁচ করতে পেরে একত্রিত হয়ে তাদের ওপর হামলা চালায়। এতে ঘটনাস্থলেই ছয় জনের মৃত্যু হয়।অন্য জনকে আহত অবস্থায় গ্রেপ্তার করে সাভার থানা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়।"

এই বক্তব্যে ছাত্ররা আদৌ ডাকাত কিনা সেই বিষয়ে সংশয় বা সন্দেহ প্রকাশিত হচ্ছে না, কিম্বা বলা হচ্ছে না এলাকার মানুষ তাদের ডাকাত বলে সন্দেহ করেছে। থানার উপ-পরিদর্শক তাদের ডাকাত বলেই ধরে নিয়েছেন। সাভার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেছেন, ডাকাত সন্দেহে গ্রামবাসী যে ছয় জনকে পিটিয়ে হত্যা করেছে, তারা ডাকাত না নিরীহ ছাত্র—- এটা এখনই বলা যাবে না। তদন্তের পর বলা যাবে।

তবে ঘটনার পর নিহত ছয় জন ও আহত এক জনের বিরুদ্ধে স্থানীয় এক বালু ব্যবসায়ী ডাকাতির মামলা করেছেন। পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যার সঙ্গে পুলিশ জড়িত ছিল বলেই কি ছাত্রদের পুলিশ ডাকাত প্রমাণ করতে চাইছে? এমনকি ঘটনাস্থল থেকে দুটি রাম দা, দুটি চাপাতি ও দুটি ছোরা উদ্ধার করা হয়েছে বলেও পুলিশ কর্মকর্তা আমিনুর বলেছেন। যদিও আলামিন এই সব অস্ত্রশস্ত্র তাদের নয় বলে পত্রিকার সাংবাদিকদের জানিয়েছে। কিন্তু এদের যে পুলিশ ডাকাত বলে প্রমাণ করবার চেষ্টা করবে তার আভাস আমরা এখনই পাচ্ছি।

এদিকে ছাত্ররা যে এলাকার সেখানে এলাকাবাসীরা বিক্ষুব্ধ। এলাকাবাসী ও মীরপুর বাংলা কলেজের ছাত্ররা ১৭ জুলাই তারিখে দারুস সালাম রোড বন্ধ করে রাখে এবং বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।

পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করার সময় পুলিশের উপস্থিতি এবং সাভার থানার উপ-পরিদর্শকের মন্তব্য নাগরিক হিসেবে আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, যাদের হত্যা করা হয়েছে তারা ছাত্র হোক বা ডাকাত হোক, উপস্থিত পুলিশ তাদেরকে নিজের হেফাজতে নেয়নি, এটাই আমরা বুঝতে পারছি। কেন নিল না? না নিয়ে পিটিয়ে ও কুপিয়ে মারতে দিয়েছে, এই সিদ্ধান্তেই আমাদের আসতে হচ্ছে, এই আশংকাই তৈরি হয়েছে। যদি তারা ডাকাত হয়ে থাকে তাহলে গ্রেফতার করে থানায় চালান করে দেওয়া ও যথাবিহিত থানার কাছে প্রমাণ থাকলে অভিযোগ দাঁড় না করিয়ে ছয়টি তরুণ ছাত্রকে মরতে দিল পুলিশ।

৩. কেবলার চর এবং অন্যান্য চর

যেখানে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে মারা হয়েছে তার নামের সঙ্গে 'চর' থাকলেও এটা প্রাকৃতিক চর নয়। বালু ফেলে নিচু এলাকা ভরাট করা হয়েছে। লোকজন নামটি দিয়েছে। ট্রাক টার্মিনালের পাশে সরু গলির গ্রাম 'বরদেশী'। অনেক পত্রিকায় 'বড়দেশী' লেখা হয়েছে। নদী-দখল, বালুর ব্যবসাসহ বিভিন্ন ব্যবসার গদি এখানে। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, এখানে চুরি-ডাকাতি নতুন ঘটনা নয়। এলাকাবাসী চুরি-ডাকাতির হাত থেকে বাঁচতে নিজেরাই পাহারা দেয়। যেহেতু তাদের ব্যবসা পরিচ্ছন্ন নয়, ফলে থানা-পুলিশ করে ঝামেলায় পড়তে চায় না। এখানে বড় রাস্তা নেই। পাশেই তুরাগ নদ। এটা নেশাদ্রব্যের ব্যবসার জায়গাও বটে। ছাত্ররাও গাঁজার খোঁজেই সেখানে এত রাতে গিয়েছে বলে প্রাণে বেঁচে থাকা আল আমিন বলছে।

'চর' কথাটা শুনে আমার নোয়াখালির চরাঞ্চলের দিকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে ২০০৩ সালে কমপক্ষে ৪০ জন মানুষ হত্যার কথা মনে পড়ছে। এদেরকেও একইভাবে ডাকাত বলে মেরে ফেলা হয়েছিল। সে ক্ষেত্রে প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগের ভূমিকাও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। চর-দখল নিয়ে এলাকার প্রভাবশালী গোষ্ঠী ও ভূমিহীনদের মধ্যেও প্রকট দ্বন্দ্ব আছে, যা প্রায়ই রক্তক্ষয়ী রূপ নেয়। চর ক্লার্কে প্রায় তিনশ পুলিশের এক অভিযানে এলাকার প্রায় দুই হাজার লোক যোগ দেয় ডাকাত ধরার জন্য। পুলিশ আর জনগণের এই যৌথশক্তির পরিণতি দাঁড়ায় পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যার মধ্যে। পিটিয়ে ডাকাতদের মারার অভিযানে বিডিআর, পুলিশ ও কোস্টগার্ডও অংশ নেয় সে সময়।

কুপিয়ে ও পিটিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনা বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। কিন্তু যাদের হত্যা করা হয়েছে তাদের পরিচয় সব সময় ডাকাত বা ভয়ংকর অপরাধী হিসেবে হাজির করা হয়েছে। ফলে খবরগুলো আমাদের মগজে কোনো আওয়াজ তুলতে পারেনি। এমনকি দুয়েকটি পত্রিকা আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার বিপদ সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করে দেওয়া সত্ত্বেও। এবারের ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যার বিষয়টি মধ্যবিত্তদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেও পারে। কারণ সম্ভবত এই প্রথম তারা নিজ শ্রেণির সন্তানদের এভাবে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে দেখতে পারছে। নোয়াখালীর চরের মতো অতি-দূরবর্তী কোনো জায়গায় ঘটনাটি ঘটেনি। ঘটেছে ঢাকাতেই। আমিনবাজারে।

মধ্যবিত্ত শ্রেণি নিজেরাই নিজ শ্রেণির সদস্যদের এভাবে হত্যা করবে এটা আগে তারা ভাবতে পারেনি। নতুন পরিস্থিতি। এখন ছাত্রদের ডাকাত বলে চিহ্নিত করবার যে পুলিশি চেষ্টা চলছে তার বিরুদ্ধে মধ্যবিত্ত কী অবস্থান নেয় সেটা নিশ্চয়ই দেখার বিষয় হবে। মধ্যবিত্ত শ্রেণি এখনও কেউ নির্দোষ না হলে তার মানবাধিকারের পক্ষে দাঁড়ানো নীতিগতভাবে ঠিক মনে করে না। এতদিন সন্ত্রাসী, ডাকাত ও জঙ্গিদের আইনবহির্ভূতভাবে হত্যা তারা দেখে এসেছে। এদের নাগরিক ও মানবিক অধিকারের পক্ষে দাঁড়াবার প্রয়োজন শ্রেণিগতভাবে মধ্যবিত্ত বোধ করেনি। র‍্যাবের আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নভাবে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সোচ্চার থাকা সত্ত্বেও।

তবে কিছুকাল আগে লিমনের পায়ে গুলি করে র‍্যাবের পঙ্গু করে দেওয়া এবং তাকে সন্ত্রাসী প্রমাণ করবার পুলিশি চেষ্টার বিরুদ্ধে মধ্যবিত্তকে আমরা বেশ সোচ্চার হতে দেখেছি। কারণ লিমন নির্দোষ। নির্দোষের পক্ষে দাঁড়ানো সহজ। লিমনের পক্ষে দাঁড়ানো অবশ্যই সঠিক, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু মানবাধিকারের প্রশ্নে একটি জনগোষ্ঠীর সচেতনতার মাত্রা নির্দোষের পক্ষে দাঁড়ানোর মধ্যে ধরা পড়ে না। বরং ধরা পড়ে নির্দোষ বা অভিযুক্ত সকলেরই নাগরিক ও মানবাধিকারের পক্ষে দাঁড়ানোর মধ্যে। প্রত্যেক নাগরিকেরই আইনের আশ্রয় লাভ, আইন অনুযায়ী ব্যবহার লাভ, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ ও বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এই অধিকার রাষ্ট্র ও নাগরিক উভয় পক্ষ থেকেই ক্রমাগত লঙ্ঘন করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী অপরাধীকে পুলিশের হাতে সোপর্দ না করে পেটানো, কোপানো, আঘাত করা ও মেরে ফেলা গুরুতর অপরাধের মধ্যেই পড়ে। মুশকিল হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যদি দলবেঁধে পেটানো ও কুপিয়ে হত্যা করার মতো অপরাধের সহযোগী হয়, তাহলে তা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ভয়ানক বিপদ ডেকে আনবে।

মৃত্যুর চেহারা কত রকম হতে পারে তা নিয়ে কথা শুরু করেছিলাম। ছেলেগুলোকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে মেরে ফেলার মধ্যে মৃত্যুর যে হিংস্র চেহারা টের পেয়েছি তাতে বিষণ্ণ বোধ করেছি। দলবেঁধে যখন মারমুখো জনতা কাউকে হত্যা করতে উদ্যত হয়, তখন নীতি-নৈতিকতা, আইন, মানবাধিকার কিছুই সেই হিংস্রতার সামনে দাঁড়াতে পারে না। মৃত্যুর এই সুরত শুধু আক্রান্তের আয়ু ধরে টান দেয় না। মৃত্যুর হিমঠাণ্ডা হাত পুরা সমাজ ও রাষ্ট্রের টুঁটি চেপে ধরতে উদ্যত হয়।

এখনই যদি আমরা সচেতন না হই, তাহলে বরফের আঙ্গুল আমাদের গলায় ক্রমে আরও চেপে বসবে।

১৮ জুলাই ২০১১; ৩ শ্রাবণ ১৪১৮; শ্যামলী