মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমরা মর্মাহত

মো. আনোয়ার হোসেনমো. আনোয়ার হোসেন
Published : 10 Oct 2015, 06:36 PM
Updated : 10 Oct 2015, 06:36 PM

ঊর্ধ্বশির যদি তুমি কুল মান ধনে;
করিও না ঘৃণা তবু নিচ-শির জনে!

১.

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বড়ই অপমানিত বোধ করছি আমরা। গণভবনে সাংবাদিক সম্মেলনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি আপনার বাক্যবাণ আমাদের শেলের মতো বিদ্ধ করছে। এই অপমান হয়তো আমাদের প্রাপ্যই ছিল। পদে যাওয়া, তা রক্ষা করা কিংবা পদায়িত কাউকে পদ থেকে নামানো-– ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের শিক্ষকদের নীতিহীন কর্মকাণ্ড, ক্ষমতাবানদের লেজুড়বৃত্তি এবং নানা অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়া-– এসবের কারণে সমাজে শিক্ষকদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ধসও নেমেছে আমাদের ভাবমূর্তিতে। বোধকরি এসবের কারণে এমন অপমানজনক কথা আমাদের শুনতে হয়েছে।

তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শুরুতেই আপনাকে বিনীতভাবে জানিয়ে রাখি, উপরে বর্ণিত কর্মকাণ্ডে লিপ্ত যে সকল শিক্ষকদের সামনে রেখে আপনি কথাগুলো বলেছেন, তারা সংখ্যায় মুষ্টিমেয়। আপনার সমালোচনায় আত্মশুদ্ধি নয়, আরও নতজানু এবং বশংবদ হবেন তারা। এমন শিক্ষককুল বাংলাদেশে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণে কোনো কাজেই আসবেন না। অপাংক্তেয় আবর্জনা হিসেবেই বিবেচিত হবেন।

কিন্তু তাদের বাইরে শিক্ষকদের বিশাল অংশ তোষামোদি ও লেজুড়বৃত্তির উর্ধ্বে থেকে বাংলাদেশে এক স্বপ্নের শিক্ষাব্যবস্থার অংশীদার হবেন মনে করেই এই পেশা বেছে নিয়েছেন, অন্য পেশায় না গিয়ে। এই কলুষিত সমাজে (কিছু মনে করবেন না, শ্রদ্ধেয় প্রধানমন্ত্রী, এর জন্য রাজনীতিবিদদের সৃষ্ট রাষ্ট্র এবং রাজনীতিবিদগণই মুখ্যত দায়ী) থেকেও তা থেকে বেরিয়ে আসার প্রচেষ্টাটি তাদের আছে। তাই নষ্ট শিক্ষকদের কারণে শিক্ষক সমাজের ভাবমূর্তিতে ধস নামার পরও ছাত্রছাত্রী-অভিভাবকদের কাছ থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষকেরা এখনও শ্রদ্ধা-ভালোবাসা পেয়ে থাকেন। জনগণের মধ্যে শিক্ষকদের প্রতি আস্থা এখনও একেবারে শেষ হয়ে যায়নি।

শিক্ষকদের এই নিবেদিত অংশ আপনার কথায় কষ্ট তো বটেই, অপমানিতও বোধ করছেন। এমন শিক্ষকদের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন শুধু গোটা শিক্ষক সমাজকেই নয়, ছাত্র-অভিভাবক-জনতা সকলকে শেলসম বিদ্ধ করে। আপনি হয়তো এখন তা উপলব্ধি করছেন না। অথবা আপনার চারপাশে থাকা বিজ্ঞজন, যারা প্রতিনিয়ত শিক্ষকদের সম্পর্কে আপনার মন বিষিয়ে তুলছেন, তারা তা করতে দিচ্ছেন না। ভয়টি এখানে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।

২.

পরাধীন দেশে সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তবুদ্ধি সৃজনে নিয়োজিত শিক্ষদের প্রতি শাসকবর্গের দৃষ্টিভঙ্গি যেমন হওয়ার কথা, পাকিস্তান রাষ্ট্রে তেমনটাই ছিল। তাই এসব শিক্ষায়তন থেকেই দ্রোহের, প্রতিবাদের জন্ম হয়েছে। তারই হাত ধরে একটি জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণা এবং মুক্তি ও স্বাধীনতার স্বপ্ন পরিব্যাপ্ত হয়েছে জনগণের মধ্যে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছে মুক্তিযুদ্ধে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে স্বায়ত্তশাসনের প্রয়োজন অনুভব করেছেন। আমরা তাই লাভ করেছিলাম স্বায়ত্তশাসনের রক্ষাকবজ, ১৯৭৩ সালের আইন।

মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর জীবনদানের পর ক্ষমতায় আসীন স্বৈর-সেনাশাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের আমলে আমরা শিক্ষকরা নিগৃহীত হয়েছি। আমার শিক্ষকতার সোনালি সময়ের পাঁচটি বছর কারাগারে কাটাতে হয়েছে। সামরিক আইনে পাঁচ বছর সাজা খাটার পরও '৭৩ আইনের কারণে আমি পুনরায় শিক্ষকতা পেশায় যোগ দিতে পেরেছি। আমি ক্ষুদ্র ব্যক্তি। কিন্তু আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, দেশের প্রথিতযশা বিজ্ঞানী অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরীকেও কারাগারে যেতে হয়েছে, সাজা খাটতে হয়েছে জিয়ার শাসনামলে।

এরপর আরেক সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ শিক্ষাঙ্গনে সামরিক নিয়ন্ত্রণ কায়েমের চেষ্টা চালান। ফলে ছাত্র-শিক্ষকগণ কঠিন নিপীড়নের শিকার হন। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর মাসে এরশাদের নয় বছরের অপশাসনের অবসান হয় ছাত্র-শিক্ষক-জনতার সম্মিলিত গণঅভ্যুত্থানের ফলে। আসে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার শাসন। শিক্ষক সম্প্রদায়কে সামরিক শাসকের দৃষ্টিতেই তিনি দেখেছেন, সম্মান করেননি। উল্লেখ করবার মতো কোনো সুযোগ-সুবিধা এ সময় শিক্ষক সমাজ পাননি। সে সরকারকেও বিদায় নিতে হয় প্রবল আন্দোলনের মুখে। শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে সে আন্দোলনে। শিক্ষক সমিতির সভায় বেগম খালেদা জিয়ার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বক্তৃতা করার কারণে ফজলুল হক হলে আমার বাসায় ছাত্রদল ক্যাডাররা গুলিবর্ষণ করে।

তারপর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতায় এল। দুই যুগের গভীর অমানিশার পর পুনরায় আলোতে এল বাংলাদেশ। শিক্ষকেরা আপনার কাছ থেকে মর্যাদাপূর্ণ ব্যবহার পেলেন, যেমনটা তাঁরা পেতেন বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে। আপনার সরকারের সুসাশনের ফল পেল বাংলার মানুষ।

২০০১ সালে বেগম খালেদা জিয়া পুনরায় ক্ষমতায় এসে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করলেন। সে সময় শামসুন্নাহার হলে গভীর রাতে ছাত্রীদের উপর চড়াও হয় ছাত্রদল ক্যাডার ও পুলিশ বাহিনী। ১৮ জন ছাত্রীকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। প্রবল প্রতিবাদ হয় তার বিরুদ্ধে। আমরা শিক্ষকেরা বিপন্ন ছাত্র-ছাত্রীদের পাশে দাঁড়াই। পুলিশের লাঠি ও বুটের আঘাতে আমার হাঁটু ভেঙে যায়। শয্যাশায়ী থাকতে হয় প্রায় তিন মাস। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা, আপনি তখন বিরোধী দলীয় নেত্রী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টাওয়ার ভবনে আমাকে দেখতে আপনি এসেছিলেন।

এরপর ২০০৭ সালে দেশে এক দীর্ঘমেয়াদী সেনা-শাসন চাপিয়ে দেওয়ার নীলনকশা বাস্তবায়ন করতে এল সেনাচালিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। 'মাইনাস টু' ফরমুলা কার্যকর করতে আপনাকে গ্রেপ্তার করল প্রথমে। আমলারা নন, কার্যকর অর্থে রাজনীতিবিদগণও নন, আমরা ক্ষুদ্রজন এই শিক্ষকেরা সেই দুঃসময়ে আপনার গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ করেছি। মনে আছে, সে সময় শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অপমানজনক কথা উচ্চারিত হয়েছিল শিক্ষা উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের মুখে। শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে তার সমুচিত জবাব ও প্রতিবাদ আমরা করেছি।

সেনাশাসকরা এসব ভুলে যাননি। সে বছরের ২০ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠের ঘটনা কেন্দ্র করে সেনাশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-অভ্যুত্থান হয়েছিল। অতীতের মতো আমরা শিক্ষকরা অভিভাবক হিসেবে ছাত্রদের ন্যায্য আন্দোলনে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শিক্ষকদের মুখপাত্র হয়ে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার, সেনাশাসনের অবসান, আপনার মুক্তি এবং দেশে সাধারণ নির্বাচনের দাবি করেছি। তার কারণে আমাদের ছাত্র-শিক্ষকদের রিমান্ড ও কারাগারে যেতে হয়েছে। কঠিন নিপীড়নেও আমরা ভীত হইনি। সত্য উচ্চারণ করতে পেরেছি।

দেশের সেই দুঃসময়ে সত্যিকার অর্থেই জাতির বিবেক হয়ে উঠেছিলাম আমরা, শিক্ষকরা।

৩.

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, অন্য কোনো রাজনীতিবিদ নন, একমাত্র আপনার সাহস, অনমনীয় দৃঢ়তা এবং আপনার পাশে ছাত্র-শিক্ষকদের সাহসী অবস্থানের কারণে পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশে এক দীর্ঘমেয়াদী সেনাশাসন পুনরায় চাপিয়ে দেওয়ার নীলনকশা ব্যর্থ হয়ে যায়। ১৯৭০ সালের মতো আর এক নির্ধারক নির্বাচনী লড়াইয়ে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো আপনি সরকার গঠন করেন। এ কথা সত্য, সেনাশাসনের বিরুদ্ধে শিক্ষক সম্প্রদায়ের গৌরবময় ভূমিকার কথা আপনি বিভিন্ন সময়ে বলেছেন। কিন্তু বিনয়ের সঙ্গে আপনার কাছে জিজ্ঞাসা, কী পেয়েছি আমরা?

বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন স্বায়ত্তশাসন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে উন্নীত করতে চেয়েছিলেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঘাতকের হাতে জীবন দিতে না হলে শিক্ষকরা স্বতন্ত্র বেতন স্কেলও পেতেন। খুব আশা ছিল, শিক্ষকদের ঋণের কথা মনে করে হলেও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তার মর্যাদার আসনটি দেবেন। শিক্ষকেরা পাবেন স্বতন্ত্র বেতন স্কেল– যেমনটা পেয়েছেন ভারত, শ্রীলংকা এবং এমনকি পাকিস্তানের শিক্ষকরা। আমরা কোনোটাই পাইনি।

অন্যদিকে, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র তাদের ক্ষমতার পরিধি বিস্তৃত করেছে ক্রমাগত। কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, যেমন সরকারি কর্ম কমিশন, সায়েন্স ল্যাবরেটরিসহ (বিসিএসআইআর) আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে পদায়িত হতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগ্য শিক্ষকরা। সে পদগুলোতে বসানো হল আমলাদের। শিক্ষা ও গবেষণা খাতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ সবচেয়ে লাভজনক; সারা পৃথিবীব্যাপী গৃহীত এই সত্যটি বাংলাদেশের নীতিপ্রণেতাগণ মুখে বললেও তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেই। পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশে এই খাতে বিনিয়োগ জিডিপির শতকরা হারে সবচেয়ে কম।

ভারত, শ্রীলংকা বা এমনকি পাকিস্তানে শিক্ষকদের গবেষণায় সরকারি অর্থ বরাদ্দের কথা ভাবলেই মনে পড়ে আমাদের 'ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব বায়োটেকনোলজির' কথা। বছরে যার বাজেট তিন কোটি টাকার সামান্য উপরে। যেখানে তা হওয়া উচিত অন্ততপক্ষে তিনশ কোটি টাকা। হাতেগোনা কয়েকজন বিজ্ঞানী আছেন। পরিচালকের হাত-পা বাঁধা। তেমন ব্যবস্থাই করে রাখা হয়েছে।

সচিব মহোদয়গণ সভা করেন। পরপর যে সচিবেরা দায়িত্ব পালন করে গেছেন এবং এখনও করছেন, তাঁরা কেউ বিজ্ঞানের কোনো শাখায় পড়াশুনা করেননি। এঁদের ভালো কিছু করবার ইচ্ছে যে নেই তা নয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, উন্নত গবেষণার এসব প্রতিষ্ঠানকে আমলাতন্ত্রের বেড়াজালে কেন আটকে থাকতে হবে? ভারতে সেই ১৯৮৬ সালে রাজীব গান্ধীর সময়ে বায়োটেকনোলজি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং গবেষণা আমলাতন্ত্রের খপ্পর থেকে মুক্ত করা হয়েছিল। দেওয়া হয়েছিল পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ও অর্থ-বরাদ্দ। ফল মিলেছে তাতে। যেমনটা মিলছে পাকিস্তানে।

আর কতদিন গেলে আমাদের নীতিপ্রণেতাদের এসব বিষয়ে বোধোদয় হবে? অর্থমন্ত্রী মহোদয় তাঁর ভাষায়, 'বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাফদের নিয়ন্ত্রণের' কথা না বলে, শিক্ষকদের ন্যায্য দাবির স্বপক্ষে আপনাকে কবে পরামর্শ দেবেন?

৪.

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনাকে হয়তো বোঝানো হয়েছে, শিক্ষকদের কাজ খুবই সামান্য। আর নিজ দায়িত্বে ফাঁকি দিয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতেই তাঁরা ব্যস্ত থাকেন। সে কারণেই হয়তো আপনি শিক্ষকদের লিস্টের কথা বলেছেন। আপনার হাতের সে লিস্টে শিক্ষকদের শতকরা কতভাগ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান, সে তথ্যও নিশ্চয়ই আপনি জানেন। সে সংখ্যা খুব বড় নয়। এ বিষয়ে নিজের কথা বলি।

বিভাগে তিনটি কোর্সের ক্লাস নিই আমি। সন্ধ্যার পর আমার নিজ সময়ে নিতান্ত সংসারযাত্রার জন্য বাধ্য হয়েই বছরে কখনও কখনও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বিষয়ে আমি পাঠদান করে থাকি। অবশ্যই আমার বিভাগ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি-বিধান মেনে। তাও করি সেই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে, যার সিলেবাস প্রণয়নে আমি কাজ করেছি এবং মানসম্পন্ন শিক্ষা সেখানে দেওয়া হয়। তা থেকে যৎসামান্য যে রোজগার হয়, তার জন্য ট্যাক্স প্রদান করি।

উল্লেখ করি, প্রাণবিজ্ঞান বিষয়ে বেশি ছাত্র পাওয়া যায় না বলে হাতেগোনা ভালো কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য কোথাও এমন বিভাগ খোলা হয়নি। সত্য হল, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে আয় বাড়াবার সুযোগ সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষকদের নেই। দয়া করে আপনার গোয়েন্দা সংস্থাকে বলুন আমলাদের সেই তালিকাও আপনার হাতে দিতে যারা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে নানা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অর্থের বিনিময়ে কাজ করেন। তাদের বাড়ি-গাড়ি ও অর্থবিত্তের কিছুটা খবর নিতে বলুন।

এখনও দেশে নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকদের সংখ্যা বিশাল। বস্তুতপক্ষে শহরের মুষ্টিমেয় কিছু শিক্ষক ছাড়া গ্রামবাংলায় প্রাইমারি, মাধ্যমিক এবং কলেজগুলোতে শিক্ষকরা অত্যন্ত দুস্থ জীবন যাপন করেও নিষ্ঠার সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাদান করে যাচ্ছেন। রাষ্ট্র-সরকার-সমাজ দেখেও তা দেখে না।

আমি সুযোগ পেলেই ছুটির দিনে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাই। ৩১ আগস্ট নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর উপর মাসব্যাপী অনুষ্ঠানের শেষ দিনে উপাচার্য কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম। তার পরদিন, লক্ষীপুর জেলার চন্দ্রগঞ্জ থানার মিরপুর হাইস্কুলে যাই। সকাল থেকেই বৃষ্টি। তার মধ্যেও প্রতিটি শ্রেণিকক্ষ ছাত্রছাত্রীতে পরিপূর্ণ। শিক্ষকেরা নিবিষ্ট চিত্তে পাঠদান করে যাচ্ছেন। ১৯২৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যায়তন থেকে বিভিন্ন সময়ে পাশ করা প্রাক্তন ছাত্ররা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নামকরা একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন, এই সংবাদ জানাবার সময় স্কুলের হেডমাস্টার সাহেবের চেহারায় পরিতৃপ্তির যে আলো দেখেছি, তা কী করে ভুলব?

জানলাম, এমপিওভুক্ত এই প্রতিষ্ঠানে সরকারি বেতনের বাইরে স্কুলের পক্ষ থেকে ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা শিক্ষকরা পেয়ে থাকেন। তারপরও এই স্কুলকে ও তার ছাত্রছাত্রীদের ভালোবেসে এই শিক্ষকরা বছরের পর বছর প্রত্যন্ত এই গ্রামে শিক্ষাদান করে যাচ্ছেন। এইসব শিক্ষকরা কী বার্তা পাবেন আপনার বক্তব্যে? এমন শিক্ষকরা কোন মুখে তাদের স্বপ্ন ছড়িয়ে দেবেন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে?

৫.

'কুসুমেও কীট থাকে'– এ কথা সত্য। ২০০৮ সালে বন্দি অবস্থায় সেনাচালিত সরকারের উদ্দেশ্যে সিএমএম কোর্টে বলেছি, "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষকরা নৈতিকভাবে অধঃপতিত হয়েছেন, দুর্নীতি করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি মলিন করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে বারবার দাবি করেছি। তারা তো সবাই স্বপদে বহাল আছেন শুধু নয়, তাদের সঙ্গেই আপনাদের দেন-দরবার।"

সে অবস্থার পরিবর্তন তো এখনও হয়নি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। দুর্নীতির জন্য কোনো শিক্ষককে সাজা পেতে হয়নি। দুষ্টের দমনে রাষ্ট্রের এমন অনীহার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শিক্ষায়তনে। তার সুযোগ নিচ্ছে আবার আমলাতন্ত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের উপর আমলাতন্ত্রের হস্তক্ষেপ বেড়েছে ক্রমাগত। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য থাকাকালে আমি তা প্রত্যক্ষ করেছি।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, কঠিন সময় পার করছি আমরা। যখন আপনার নেতৃত্বে সর্বক্ষেত্রে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধাপরাধী আলী আহসান মুজাহিদ এবং সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যু পরোয়ানা জারি হয়েছে। তখনই বাংলাদেশে দুজন বিদেশি নাগরিকের হত্যাকাণ্ড; আমাদের দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও কানাডার নাগরিকদের জন্য রেড এলার্ট জারি; অস্ট্রেলীয় ও সাউথ আফ্রিকার ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর বাতিল; আমাদের 'বাংলাদেশ সোসাইটি ফর বায়োকেমিস্ট্রি ও মলিকুলার বায়োলজি'র আয়োজনে অনুষ্ঠিতব্য ওয়ার্কশপে কয়েকজন বিদেশি বিজ্ঞানীর নিরাপত্তার অজুহাতে না আসার সিদ্ধান্ত; খ্রিস্টান চার্চের ফাদারকে গলা কেটে হত্যার চেষ্টা; বিশ্ববিদ্যালয় এবং সর্বত্র নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পদায়িত জামায়াত ও সংশ্লিষ্টদের সংঘবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা– এমন একটা সময়ে দেশের বিশাল শিক্ষক সমাজকে অপমানে দগ্ধ করার আত্মঘাতী পরামর্শ আপনাকে যারাই দিক, তারা যে ঘরের শত্রু বিভীষণ, এই নিখাদ সত্যটি আপনি গুরুত্বের সঙ্গে উপলব্ধি করুন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।

এদের কারণে বঙ্গবন্ধুকে ঘাতকের হাতে জীবন দিতে হয়েছে সপরিবারে। দেশের এই দুঃসময়ে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে আপনাকে বিচ্ছিন্ন করতে চায় এরা। আপনি তা হতে কেন দেবেন?

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, একটি স্বাধীন দেশে দক্ষ, জনবান্ধব ও স্বাধীন আমলাতন্ত্র বড়ই প্রয়োজন। তার জন্য তাদের উচ্চ বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা আরও বাড়ানো হোক, আমাদের তাতে আপত্তি নেই। সচিব কিংবা অন্য কারও সমান হবার জন্য নয়, গত পাঁচ মাস ধরে শিক্ষক হিসেবে আপন পদমর্যাদা ও স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের জন্য নীতিনিষ্ঠ শিক্ষকগণই তাদের ন্যায্য আন্দোলনটি করছেন নিতান্ত বাধ্য হয়ে। সমাজের কাছে, ছাত্র-অভিভাবকদের কাছে এই শিক্ষকদের উপহাসের পাত্র করে আলোকিত বাংলাদেশ কখনও গড়া যাবে না।

সে সঙ্গে আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে এই বোধ আসতেই হবে যে, এই দরিদ্র দেশের সাধারণ মানুষের অর্থে লেখাপড়া করেই আমরা শিক্ষক হয়েছি। দেশের মানুষের কাছে আমাদের দায় অনেক। আমরা আইনের উর্ধ্বে নই, জবাবদিহিতারও। আমাদের স্বায়ত্তশাসনের ১৯৭৩ আইনে সে আলোকে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। সংসদে এ বিষয়ে আলোচনার জন্য বিনীত অনুরোধ জানাই। আমরা তাতে সাহায্যের হাত বাড়াব।

কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের 'রসাল ও স্বর্ণলতিকা' কবিতার দুটো চরণ শুরুতে উধৃত করেছি। পুরো কবিতার মর্মবাণী গভীর। সবাই, বিশেষ করে রাজনীতিবিদগণ যদি কবিতাটি পাঠ করেন, স্মরণে রাখেন, তবেই দেশের মঙ্গল।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমরা তো আপনার উপর ভরসা করেছি, নির্ভর করেছি। দেশের কথা ভেবে, আমাদের নিজেদের কথা ভেবেই তা করেছি। তা থেকে আমরা সরে আসতে চাই না। সে ভুলও আমরা করব না। যেমনটা করে থাকেন আমাদের দেশের তথাকথিত বিপ্লবীরা। বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে বাংলাদেশ ডুবে গিয়েছিল গভীর অন্ধকারে। আপনাকে হারালে সে অবস্থাই হবে। আমরা তা চাইতে পারি না।

পাশাপাশি এ কথা রাজনীতিবিদেরও ভাবতে হবে যে, তারা বার বার ভুল করবেন– দেশকে ডোবাবেন, নিজেরা ডুববেন– আর দীনহীন আমরা তাদের উদ্ধারে বারবার এগিয়ে আসব এই জেনে যে, আমরা বঞ্চনা ও অবজ্ঞার পাত্র হতেই থাকব, তা আর কতদিন?

ড. মো. আনোয়ার হোসেন: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।