সিরিয়া সংকট ও আসাদের টিকে যাওয়া

বিজন সরকার
Published : 10 Oct 2015, 05:41 AM
Updated : 10 Oct 2015, 05:41 AM

সিরিয়ার বৈধ শাসক এবং আধুনিক সিরিয়ার দ্বিতীয় রূপকার বাশার আল-আসাদ ক্ষমতায় থাকবেন কী থাকবেন না, চলমান বিশ্ব-রাজনীতিতে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিল। ৩০ সেপ্টেম্বর সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদের আমন্ত্রণে সে দেশে রাশিয়ার বিমান হামলা শুরুর মধ্যে দিয়ে প্রশ্নটির উত্তর অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে গেল।

আসাদের ক্ষমতার আয়ুষ্কালের সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলতে গেলে সিরিয়াসহ পশ্চিম এশিয়ার আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিক বহু গোষ্ঠীর স্বার্থ এবং আরব বিশ্বের স্বৈরশাসকদের খামখেয়ালিপূর্ণ আচরণের বিশ্লেষণ আবশ্যক। তবে তার আগে চলুন দেখে নিই কেন সিরিয়া বিশ্ব-রাজনীতির গিনিপিগে পরিণত হয়েছে।

সিরিয়ার সংকট তিনটি বড় প্রেক্ষাপটে মূল্যায়ন করা যায়: গৃহযুদ্ধ, ভূরাজনৈতিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও ধর্মীয় যুদ্ধ।

সে দেশের গৃহযুদ্ধে দুটি গ্রুপ রয়েছে; আসাদ গ্রুপ ও বিদ্রোহী গ্রুপ। সুন্নী সংখ্যাগরিষ্ঠ সিরিয়ায় বিদ্রোহী গ্রুপে ন'টি বড় সুন্নী জঙ্গি সংগঠনসহ রয়েছে কথিত সরকারবিরোধী 'ফ্রি সিরিয়ান আর্মি' গ্রুপ। দেশটির অধিকাংশ এলাকা বিদ্রোহী গ্রুপের দখলে। এদের সবার উদ্দেশ্য এক নয়, ভিন্ন ভিন্ন। কারও উদ্দেশ্য আসাদকে হঠানো, কারও রয়েছে ইসলামি খেলাফত গঠন, আবার কারও উদ্দেশ্য দখলদার দেশের স্বার্থ সংরক্ষণ।

সিরিয়া ইস্যুতে ভূরাজনৈতিক স্বার্থে বিশ্বের বড় দেশগুলি দুটি ভাগে বিভক্ত। মার্কিনিদের নেতৃত্বে ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালি সিরিয়া সংকটের প্রথম থেকেই জড়িত ছিল। দেশগুলি আসাদের বিপক্ষে বিদ্রোহী গ্রুপকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এই দেশগুলির সিদ্ধান্তেই কথিত 'সিরিয়ান ন্যাশালান কোয়ালিশন' গঠন করা হয়। অন্যদিকে রাশিয়া ও চীন আসাদ সরকারের পক্ষে। তারা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে আসাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এখানে রাশিয়ার বড় ধরনের অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থও রয়েছে। সিরিয়া সরকার রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র কিনে থাকে। তাছাড়া ভূমধ্যসাগরে প্রবেশের জন্য রাশিয়া সিরিয়ার তারতুস বন্দর ব্যবহার করে।

ওদিকে উপসাগরীয় দেশগুলি (গালফ নেশনস) শিয়া রাষ্ট্র ইরানের সম্ভাব্য প্রভাব ছেঁটে ফেলার জন্য ইরানের সহযোগী দেশ সিরিয়াকে শায়েস্তা করতে বদ্ধপরিকর। দেশগুলি তুরস্ক ও জর্ডানের সহযোগিতায় বিদ্রোহী গ্রুপগুলিকে অস্ত্রের যোগান দিয়ে যাচ্ছে। ওদিকে ইরান সিরিয়াকে অস্ত্র, অর্থ ও সামরিক পরামর্শ দেয়। অ-আরব (নন-এরাব) মুসলিম দেশগুলির মধ্যে তুরস্কও সিরিয়া ইস্যুতে খেলছে। তারা জঙ্গি সংগঠন আইএসকে সুযোগ দিচ্ছে ইরাক ও সিরিয়া থেকে তেল উত্তোলন করে তাদের সীমান্তে বিক্রি করতে। আবার শিয়া জঙ্গি সংগঠন হিজবুল্লাহ সমর্থন দেয় আসাদ সরকারকে। ফলে সিরিয়ার চলমান সংকট একক প্রেক্ষাপটে মূল্যায়ন সম্ভব নয়।

সিরিয়ায় রাশিয়ার সামরিক হামলার আগেই রাশিয়ার সংসদ পুতিন সরকারকে বিদেশে সামরিক শক্তি প্রয়োগের বিষয়ে অনুমোদন দেয়। রুশ সরকার বহু আগে থেকেই সিরিয়া ইস্যুতে ভূমিকা রাখার সুযোগ খুঁজছিল। বেশ ক'মাস ধরেই তারা সামরিক হামলা পরিচালনা করার জন্য হোমওয়ার্ক করেছে। শোনা যায়, পুতিন নিউইয়র্কে সাধারণ পরিষদে যোগ দেওয়ার আগে ইরান, ইরাক ও সিরিয়ার সরকারের উচ্চ পর্যায়ে নেতৃত্বের সঙ্গে মস্কোতে দীর্ঘ বৈঠকে মিলিত হন। ধারণা করা যায়, চারটি দেশ মিলে জোট গঠন ও সিরিয়ার উপর হামলার বিষয়ে এ বৈঠকেই চূড়ান্ত হয়। ইরাকের অবস্থান যে কৌশলগত হবে, তাও এই বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হয়।

বিশ্ব-নেতৃত্বে রাশিয়াকে এমন পর্যায়ে নেওয়ার জন্য ভ্লাদিমির পুতিনের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার বিষয়টি বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। ২৭ সেপ্টেম্বর সিবিএস টিভির চার্লস রোজকে পুতিন একটি সাক্ষাৎকার দেন। বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে এবং সাক্ষাৎকার-পরবর্তী চার্লস রোজের মূল্যায়নেও পুতিনের সে আকাঙ্ক্ষা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। ইউক্রেনে হামলার পর রাশিয়া কিছুটা বেকায়দায় পড়ে গেছিল। ফলে সিরিয়ার বিষয়ে তারা তেমন গ্রহণযোগ্য সমর্থন পাচ্ছিল না। পুতিন সরকার একটি মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় ছিল।

নানা কারণেই এখনই সে মাহেন্দ্রক্ষণ। রাশিয়া এমন একটি সময়ে সিরিয়ায় হামলা করল, যখন খোদ আমেরিকাও এ ইস্যুতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। মূলত আমেরিকা এতে জোরালো নীতি গ্রহণে প্রথম থেকেই ব্যর্থ হয়েছিল। তারপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশন, সিরিয়ার শরণার্থীর সমস্যা, পশ্চিমের সামাজিক জীবনে 'ওয়াহাবিজম ভীতি', ইয়েমেনে সৌদি আরবের বালখিল্য আক্রমণ এবং সর্বশেষ পরমাণু নিয়ে ইরানের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের চুক্তি রাশিয়াকে আবারও ভূরাজনীতির মূল স্নায়ুতে নাড়া দেবার সুযোগ করে দেয়।

২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নির্বাচন। এতে পশ্চিম এশিয়া নিয়ে বারাক ওবামার নীতির ফলে রিপাবলিকানরা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে। মেয়াদকালের শেষ সময়ে এসে সিরিয়াতে আমেরিকা বড় ধরনের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ুক, মার্কিন প্রেসিডেন্ট তা চাচ্ছেন না। যুদ্ধে অনীহার কারণে রিপাবলিকানরা যেমন তাঁর কট্টর সমালোচক, তিনিও তেমনি রিপাবলিকানের 'যুদ্ধবাজ' বলতে দ্বিধা করছেন না। সিরিয়ায় রাশিয়ার হামলার পর রিপাবলিকানদের সমালোচনায় ওবামা বলেছেন, তাদের কথা শুনলে তাঁর দুই আমলে আরও কয়েকটি যুদ্ধ তাঁকে করতে হত।

সিরিয়ার কথিত সরকারবিরোধী 'ফ্রি সিরিয়ান আর্মি' নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। আইএসের সদস্যরা এ বাহিনীর সদস্য সেজে সিআইএএর কাছ থেকে ট্রেনিং ও অস্ত্র নিচ্ছে বলে খোদ মার্কিন গোয়েন্দাদের সন্দেহ। রিপাবলিকান পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়াতে ইচ্ছুক ডোনাল্ড ট্রাম্পও রাষ্ট্রের টাকা খরচ করে এ ধরনের হঠকারিতার জন্য ওবামার সমালোচনা করছেন। রাশিয়াকে আইএসের বিরুদ্ধে একা লড়তে দেওয়ার পক্ষে ট্রাম্প। আবার মার্কিন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থায় প্রাক্তন প্রধান মাইকেন ফ্লেনের মতে, আসাদ নয় বরং উগ্র ইসলামিক আদর্শই মার্কিন স্বার্থের জন্য এখন বড় হুমকি। তাঁর এই মতের সঙ্গে রিপাবলিকান দলের মনোনয়ন-প্রত্যাশী সকল প্রার্থী একমত। আসাদ ক্ষমতা থেকে চলে গেলে যে সিরিয়ার ক্ষমতা আইএসের হাতে চলে যাবে, তা নিয়েও আসাদবিরোধী কট্টর মার্কিন সমাজ চিন্তিত।

রাশিয়ার নীতিনির্ধারকরা সিরিয়া নিয়ে মার্কিন প্রশাসন ও সমাজের দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থানটি সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে। সিরিয়ার শরণার্থী সমস্যা ও পশ্চিমা বিশ্বে ওয়াহাবিজমের ভীতিও এখানে ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি শরণার্থী নিয়ে ইইউএর ভূমিকায় সন্তুষ্ট নয়। অভিবাসনবিরোধী মার্কিনিরাও শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার রয়েছে।

শরণার্থী যে কেবল সিরিয়ার ছিল, তা নয়– লিবিয়া, ইরাক ও আফগানিস্তান থেকেও অনেকে আশ্রয় নিতে ভিড় করছে। এ সব দেশে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে শাসক পরিবর্তনের পদ্ধতিটি যে অন্যায় ও অকার্যকর হয়েছে, তাও সাধারণ ইউরোপিয়ানরা বুঝে ফেলেছে। ফলে লিবিয়া ও ইরাকের মতো সিরিয়ার আসাদকে সরিয়ে দিলে সমস্যা যে আরও প্রকট হবে, সে ধারণা ভালোভাবেই ইউরোপীয় ও মার্কিন সমাজে প্রতিষ্ঠিত।

আরেকটি সমস্যা হল, শরণার্থী সেজে ইতোমধ্যেই বহু আইএস জঙ্গি ইউরোপ ও আমেরিকায় প্রবেশ করেছে বলে গোয়েন্দাদের ধারণা। তাই আসাদকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেয়ে ওয়াহাবিজমের মোকাবেলা যে বেশি জরুরি, সে উপলব্ধি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমা সমাজেও খুব গভীর হচ্ছে।

বাশার আল-আসাদ ক্ষমতা ছাড়ুন, এটি চায় সৌদি আরব। আমেরিকার নেতৃত্বে সিরীয় সরকারবিরোধী পশ্চিমা জোটের অন্যতম শরিক জার্মানি ও ফ্রান্স আসাদ প্রশ্নে কিছুটা নমনীয় হলেও সৌদি আরবের চাপে আমেরিকা ততটা নমনীয় হতে পারেনি। রাশিয়ার হামলার পর সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল জুবায়ের সিবিএস টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করেই বলেন, ''আইএসের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে অবশ্যই আসাদকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে না এবং সিরিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য আসাদকে সরে যেতে হবে। আমরা আর বিকল্প ভাবছি না।''

মূলত আসাদকে সরানোর আশ্বাসেই সৌদি আরব আমেরিকার সঙ্গে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র-চুক্তি করেছে। সঙ্গে রয়েছে কাতার ও ইইউই। সৌদি বাদশা সালমান অতি সম্প্রতি ওয়াশিংটন সফরে আরেকটি নতুন অস্ত্র চুক্তি করেন। ধারণা করা হয়, সৌদি আরব, কাতার ও ইউএই মিলে ইরান ও সিরিয়া ইস্যুতে ওবামা প্রশাসনকে চাপে রাখার জন্য রাশিয়ার কাছ থেকেও বিশ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ক্রয় করে। অনেকটা এক ঢিলে দুই পাখি মারার ইচ্ছে ছিল এই তিন উপসাগরীয় দেশের। তাদের ধারণা ছিল যে, এ অস্ত্র-চুক্তির ফলে আমেরিকা যেমন চাপে থাকবে, তেমনি পুতিনও ততটা নাক গলাবেন না সিরিয়াতে।

বাস্তবতা এই যে, আইএস, আল-নুসরাতের মতো জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমর্থন দিয়েও আসাদকে সরানো গেল না। আল-কায়েদা সিরিয়াতে আল-নুসরাত নামে পরিচিত। অন্যদিকে সৌদি-সমর্থিত ইয়েমেনের শাসক আবেদ বাব্বু আল মুনসর হাদিকে পালিয়ে সৌদিতে আশ্রয় নিতে হয়, সৌদি শাসক গোষ্ঠী তাকে রক্ষা করতে পারেনি। এ সব নানা কারণে মুসলিম বিশ্বে নিজেদের অবস্থান নিয়ে সৌদি শাসক গোষ্ঠী বড় বেশি চিন্তিত।

বাদশাহ সালমান শাসন ক্ষমতায় আসার পর নিজের ছেলে মোহাম্মদ বিন সালমানকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন। বিন সালমানের বয়স ত্রিশের কোঠায়। অনভিজ্ঞ এ মন্ত্রীর একক সিদ্ধান্ত ও একগুঁয়েমির কারণেই দেশটি ইয়েমেনে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। পাকিস্তানসহ মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাহায্য চেয়েও সৌদি আরব তাই পায়নি। ইয়েমেন থেকে সরে আসার কোনো কৌশলও দেশটির কাছে নেই। ইয়েমেনে যুদ্ধ, বাশার আল-আসাদকে সরানোর মিশন, বিশ্ব-বাজারে তেলের দাম অর্ধেক হয়ে যাওয়া, হজ্জ্ব-অব্যবস্থাপনা এবং বিশ্বব্যাপী উগ্র ওয়াহাবিজমের প্রসারের কারণে সৌদি শাসক গোষ্ঠী নানাবিধ সমস্যায় আক্রান্ত এখন।

সম্প্রতি ইরানের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের সাক্ষরিত পারমাণবিক চুক্তিটি সৌদি আরবসহ আরব বিশ্বের সুন্নী রাষ্ট্রগুলিকে আতঙ্কিত করেছে। চুক্তিটি পশ্চিম এশিয়ার সকল মেরুকরণ পাল্টে দিয়েছে। দীর্ঘ দু'বছর আলাপ-আলোচনার পর গত আগস্টে মার্কিন প্রশাসনের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ইরানের চুক্তি হয়। সে মোতাবেক ইরান কোনো ধরনের পারমাণবিক বোমা বানাবে না। এর ফলে ইরানের উপর দীর্ঘ দিন ধরে আরোপিত অর্থনৈতিক অবরোধ ও তেল বিক্রির নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। চুক্তির আওতায় পশ্চিমা বিশ্বের কাছে আগের প্রায় ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলার বকেয়াও ফেরত পাচ্ছে তারা।

অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমদানি রফতানি করতে ইরানের আর বাধা রইল না। এর মধ্য দিয়ে জ্বালানি নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বকেও জিসিসির দেশগুলির কথামতো মধ্যপ্রাচ্যের নীতি গ্রহণ করার বাধ্যবাধকতার দিন শেষ হল। বিভিন্ন ধরনের অবরোধ থেকে মুক্ত নতুন ইরানের ভূমিকা পশ্চিম এশিয়ায় কী হবে, রাশিয়ার নেতৃত্বে সিরিয়ায় জঙ্গিবিরোধী হামলায় অংশগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে তা পরিষ্কার হয়ে গেছে। যদিও ইরান দীর্ঘ দিন ধরে সিরিয়ার বিষয়ে রাশিয়ার পক্ষে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু পারমাণবিক ইস্যু নিয়ে চাপে থাকার কারণে তারা স্পষ্ট ভূমিকা পালন করতে পারেনি।

গত দু'বছরে মার্কিন জোট সিরিয়ায় আইএসের উপর সাত হাজারের বেশি বিমান হামলা চালিয়েছে। তবু তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। কেন তা সম্ভব হয়নি এ নিযেও বিভিন্ন সন্দেহ রয়েছে। অপরপক্ষে রাশিয়া মাত্র এক সপ্তাহে হেডকোয়ার্টার, অস্ত্রাগার, ট্রেনিং সেন্টারসহ আইএসের বহু স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিয়েছে। ফলে মার্কিন জোট যে আইএসকে মাঠে রেখে আসাদের বিষয়ে বিশ্ব-জনমত নিজেদের কোষাগারে জমা করার কৌশল নিয়েছিল, তা পরিষ্কার হয়ে যায়।

ওদিকে পুতিন সরকার বিষয়টি আরও নির্দিষ্ট করতে পেরেছে যে, যদি হামলায় সফলতা পাওয়া যায় তবে বিশ্ব-জনমত ঘুরে যেতে পারে। হামলার পরে হয়েছেও তাই। রাশিয়া সিরিয়ায় হামলা করার পর কেবল বিশ্ব-জনমত নয়, সিরিয়ার গ্রাউন্ডেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। রাশিয়ার বিমান হামলার পর সিরিয়ার সরকারি বাহিনী আইএসের দখলকৃত অনেক শহর উদ্ধার করেছে। এখানেই মার্কিন জোটের সঙ্গে রাশিয়ার জোটের পার্থক্য। গ্রাউন্ডে মার্কিন জোট সেনা পাঠায়নি। সে বাস্তবতাও নেই তাদের। অদূর ভবিষ্যতেও সেটি তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের আগে এমনকি পরেও সিরিয়ার বিষয়ে আমেরিকার তেমন আগ্রহ ও প্রয়োজন, কোনোটিই থাকবে বলে মনে হয় না। যে জ্বালানির জন্য জিসিসির দেশগুলিকে নমঃ নমঃ করতে হত, তারও আর দরকার নেই। যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, মুসলিম বিশ্বের সুন্নি-শিয়ার রাজনৈতিক প্রভাবের দ্বন্দ্ব নিয়ে ব্যস্ত থাকার চেয়ে বরং উগ্র ওয়াহাবিজমের প্রভাব থেকে নিজের সমাজকে কীভাবে রক্ষা করা যায় সেটি নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হবে।

সব মিলিয়ে বাশার আল-আসাদ সিরিয়ার শাসন ক্ষমতায় নিদেনপক্ষে পাঁচ থেকে সাত বছর থেকে যাবেন, এটি নিশ্চিত করে বলা যায়। সেখানে গৃহযুদ্ধের অবসান করতে সকল অংশীদারীর মধ্যে আলোচনা দরকার। আর সে আলোচনার প্রক্রিয়াটি আসাদের উপস্থিতি ছাড়া যে সম্ভব নয়, সেটি রাশিয়ার হামলার মধ্যেই এখনস্পষ্ট।