বাংলাদেশে আইএস নিয়ে সাফ জবাব মিলবে কি

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 5 Oct 2015, 03:42 AM
Updated : 5 Oct 2015, 03:42 AM

বাংলাদেশের রংপুরে এক জাপানি নাগরিকের অপমৃত্যুর দায়িত্ব নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে 'আইএস'। কুনিও হোশি নামের এই জাপানি নাগরিকের হত্যার আগে ঢাকার গুলশানের কূটনীতিক পাড়ায় ইতালীয় নাগরিক চেজারে তাভেল্লার হত্যাকাণ্ড– সেখানেও সেই 'আইএস'এর দায় স্বীকার। এই হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটল এমন এক সময় যখন শীর্ষনেতাদের কেউ দেশে ছিলেন না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন আমাদের গৌরাবান্বিত করে পুরষ্কার নিচ্ছেন, তখন দেশের ভেতর ষড়যন্ত্রকারীরা আবার আঘাত হেনেছে।

এবারের আঘাতগুলো কেমন যেন কানেকটিভ। মাত্র কদিন আগেই অস্ট্রেলিয়া থেকে বলা হল, ক্যাঙ্গারুর দল বাংলাদেশে ক্রিকেট খেলতে যাবে না। মানে, অজিরা আপদের ভয় পাচ্ছে। এই ভয় অমূলক কিছু যে ছিল না, সেটা প্রমাণ করার জন্যই যেন ওদের সফর বাতিলের পরপরই তাভেল্লা ও কুনিও খুন হলেন। এমন সব ঘটনার পরও, প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরলে তাঁকে বিরাট সংবর্ধনার আয়োজন করা হল। তার মানে কি এই যে, আমাদের আসলে জবাবদিহিতার দরকার নেই?

বাইরের বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি এখন অনেকটাই ক্রিকেটনির্ভর। সিডনি বা এদেশের শহরগুলোতে কম দামের পোশাক আর ক্রিকেট আমাদের পরিচয় ক্রমাগত ঔজ্জ্বল্য দিয়ে যাচ্ছে। সে জায়গাটা এখন প্রশ্নবিদ্ধ।

ধরে নিলাম যে, আমরা জানি কারা এর পেছনে রয়েছে। এও জানি কীভাবে তা করা হচ্ছে। কিন্তু বিদেশিরা কী দেখছেন? দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আতঙ্কের যে সংগঠন, তারা এর দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিচ্ছে। ফলে আমরা যদি বলি যে, আমাদের দেশে আসলে এদের অস্তি্ত্ব নেই, তাহলে সেটা কী কারণে গ্রহণযোগ্য হবে?

আওয়ামী লীগের রাজনীতি বিরোধী দলে যতটা তীব্র আর ফলপ্রসূ, শাসনে ততটা নয়। একটি বিষয়ে খেয়াল করি, চটজলদি ধামাচাপা দেওয়ার অস্থির প্রবণতা। যদি আমাদের দেশে জঙ্গি থাকে সেটা বলতে দ্বিধা কোথায়? আর যদি না থাকে তবে একের পর এক মেধাবীদের লাশ, রাজপথে মগজের রহস্য কী? এগুলো এখন পরিষ্কার করে বলার সময় এসেছে। যেখান কান পাতি, সবার মনে সন্দেহ আর সংশয়। ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা সুখবর নয় অবশ্যই। বাঘা বাঘা দেশগুলো তা করে আমাদের জানান দিয়েছে যে, সাবধান হতে হবে। সেটা নিয়ে ভাবনা বাদ দিয়ে আত্মতুষ্টি আর কথায় চিড়ে ভাজলে হবে না।

ক্রিকেট, ফুটবল বা কোনো কিছুই এখন আর রাজনীতির বাইরে নেই। পাকিস্তানিরাও কিন্তু বলে যে, তাদের দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার হচ্ছে, সেখানে জঙ্গিদের তীব্র উপস্থিতি সত্ত্বেও। কেউ হত্যার শিকার হবার ঝুঁকি নিয়ে দল পাঠায় না। ফলে আমাদের দায়িত্ব হবে আমাদের ভাবমূর্তির পুনরুদ্ধার।

আরেকটা বিষয় মাথায় ঢোকে না। সব বিষয়ে একজন দুজনকে কথা বলতে হবে কেন? জনগণের টাকায় চলা দূতাবাসগুলো কোথায়? প্রধানমন্ত্রী আমেরিকায় গেলেন। বিমানবন্দরে প্রতিবাদের নামে তাঁর প্রতি জাতীয় চরিত্রের বিদেশি আস্ফালনের খবর কি জানত না দূতাবাস? কোথায় প্রবাসী আওয়ামী লীগাররা? সাধারণত দুদল মুখোমুখি হবার সম্ভাবনা থাকলেই এ ধরনের প্রতিবাদের অনুমতি দেওয়া হয় না। সুবিধাভোগীরা নিশ্চয়ই তখন অভ্যন্তরে কে কতটা প্রিয় বা কে কত নৈকট্য লাভ করতে পারেন সে ধান্দায় ব্যস্ত ছিলেন। আর অন্যদিকে মুখ থুবড়ে পড়ল দেশ ও জাতির সম্মান। সে জায়গা ঠিক না করে দেশে ফিরলে জাতীয় নেতাকে সংবর্ধনার নামে জনগণের ভোগান্তির কোনো কারণ দেখি না।

এবারের আলোচনা কিন্তু দেশীয় দল বা তাদের অভিযোগ নিয়ে নয়। এমন সব দেশ বলছে যাদের কথা ও কাজ আমাদের প্রভাবিত করে। নিয়ন্ত্রণও করে বৈকি। এমন দুঃসময়ে আমাদের সমাজের পচন আর বিকৃতি স্বীকার করে নেওয়াই ভালো। মানুষ তো জঙ্গি নয়। তার জীবনে এসবের কোনো প্রভাবও নেই। তাকে ধর্মের নামে ভয় দেখিয়ে জিম্মি করে রাখা হচ্ছে। সরকার যদি খোলাসা না করে, যদি প্রমাণ করতে না পারে যে, দেশে জঙ্গিবাদ আছে কী নেই, এর সমাধান মিলবে না।

কথা বা অন্য অ্যাকশনে কাজ হবে না। যারা বলছে তাদের কাছে একশ একটা প্রমাণ বা অজুহাত রয়েছে। আমাদের হাতে আছে একটি মাত্র তাস। স্বচ্ছতা আর সত্য বলার ভেতর দিয়ে জানিয়ে দিতে হবে। কাজে কথায় প্রমাণ করতে হবে। বলতে হবে সাফ কথা। মাঝামাঝি কোনো কিছুর জায়গা নেই আর। আমরা জাতীয় সঙ্গীতে গাই, 'মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি'। সেই কান্নার আগেই প্রতিকার চাই। পাব কি?

আজকাল কোনো বিষয়ে কিছু বলা মানে বাড়তি ঝামেলা কাঁধে নেওয়া। প্রায় দেখি এই আইন সে আইন আর নানা ধারা উপধারার নামে হয়রানি। কেউ যদি সা্হস করে কিছু বলে তো তার ঘাড়ে চাপাতির কোপ প্রায় নিশ্চিত। কেউ মরে, কেউ বাঁচে। এ পরিস্থিতি আমাদের কাছে স্বাভাবিক মনে হলেও বিদেশিদের কাছে নাও হতে পারে। তারা চাইবে সার্বিক নিরাপত্তা। আমাদের এ দেশে মানুষের জীবন সবচেয়ে সহজলভ্য হলেও আধুনিক উন্নত দেশে মানুষের জীবনই সবচেয়ে মূল্যবান। এত মহার্ঘ আর দ্বিতীয় কিছু নেই। সে সব মানুষ যদি জাতীয় প্রতীক বা সেলিব্রিট্রি হন তাহলে তো কথাই নেই।

আবার এটাও সত্য যে, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কেউ হারাতে চাইবে না। আমরা আমাদের ক্রিকেট টিমকে পাকিস্তানে যেতে দিতে চাই না। নানা প্রলোভন বা আমাদের মতো দেশ ও সরকারের ওপর চাপ থাকলেও আমরা তা করিনি। ফলে আমরা কোনো দেশের এখানে আসা বা না-আসার বিষয়ে মন্তব্য করতে পারি বটে, রায় দিতে পারি না। এটা তাদের অভ্যন্তরীন বিষয়।

খটকাটা সেখানে নয়। গোল বেঁধেছে পৃথিবীর একটি উন্নত ও আধুনিক দেশের চোখে আমাদের ইমেজের বিপর্যয় বা ভয়-ধরানো চেহারা দেখে। এটা যদি একশভাগ সত্য হত, বলার কিছু ছিল না। কিন্তু তা তো নয়। এই সরকার শুরু থেকে মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়ছে। আমাদের যিনি প্রধানমন্ত্রী তিনি নিজেই মৌলবাদের টার্গেট। তাঁকে হত্যা করারও পরিকল্পনা হয়েছে অনেকবার। রাজধানীর রাজপথে গ্রেনেড হামলার শিকার হয়েছিলেন তিনি। প্রাণ হারিয়েছিলেন এদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির স্ত্রী আইভি রহমান। তবে চক্রান্ত তো থেমে নেই। দেশের রাজনীতিতে জামায়াত-বিএনপির একাংশ সন্ত্রাস আর জঙ্গিবাদের আশ্রয়দাতা। তারা যে কোনো ভাবে শান্তি নষ্ট করে দাবানলের বিভীষিকা ছড়িয়ে সিংহাসনে ফেরার জন্য মরিয়া।

বলাবাহুল্য সে জায়গাটাতেই ভয় পাচ্ছে বিদেশি শক্তিগুলো। কিন্তু এটা কি এমন যে, একটি আর্ন্তজাতিক মানের খেলা বন্ধ করে দিতে হবে? পাকিস্তান বা তেমন দেশের মতো বাস্তবতা এখনও তৈরি হয়নি এদেশে। আমাদের সমাজ ও জাতিসত্তার প্রধান পরিচয় সংস্কৃতি। যার সঙ্গে জঙ্গিবাদের মূল সুরের যোগ নেই। বরং এখানে প্রবহমান সংস্কৃতির মূল শক্তি সুফিবাদ। আছে গান-বাজনা নাটক-কবিতার অমিয়ধারা। এই দেশের আদ্যপান্ত না জেনে এর গায়ে জঙ্গিবাদের তকমা লাগিয়ে দেওয়া অন্যায়।

নিন্দুকেরা বলছেন, এখানে নাকি জয় পরাজয়েরও একটা হিসাব রয়েছে। সাদা চোখে সেটিকে অবশ্য একটি কারণ বলে মনে হবে না। তবে বহুকাল আগে শ্রী অরবিন্দ ঋষি বাণী দিয়েছিলেন, ক্রিকেট হয়ে উঠবে জুয়ার খেলা। সেটা এখন প্রকাশ্য। ভারত পাকিস্তান সাউথ আফ্রিকা বাংলাদেশ অষ্ট্রেলিয়া, কেউ এর বাইরে নয়। এই আসা-যাওয়ার কারণ বা পেছনে কোন জুয়া আর কীভাবে এর নিস্পত্তি হবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে আমরা সিডনিতে বসেই টের পাচ্ছি বাংলাদেশের ক্রিকেট টিম ভয়ের কারণ হয়ে উঠছে অনেক দেশের জন্যই। তাকে আলিঙ্গন বা স্বাগত জানাতে রাজি নয় কেউ কেউ। কিন্তু যখন তার সঙ্গে দেশ, জাতি আর ইমেজ জড়িত হয়ে যায়, তখন আমাদেরও একটু কঠিন হতে হবে বৈকি। সে মেরুদণ্ডটাই যেন কথা বলে সামনে এসে দাঁড়ায়।

দুঃখের কথা, সরকারি দলের আচরণে তার প্রমাণ নেই। প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরে কোন পরিস্থিতি সামাল দেবেন সেটা ঠিক করার আগে সংবর্ধনার এই জাঁকজমক আমাদের মতো অনেককে হতাশ করেছে। এটা নিশ্চিত যে, প্রধানমন্ত্রী এর চেয়ে কম কিছু প্রাপ্তির দাবি রাখেন না। কিন্তু সব কিছুর সময় থাকে। মানুষের মনে বেদনা আর অনিশ্চয়তা যখন তুঙ্গে তখন এই বিষয়গুলো আরও পরে করা যেত।

আমরা সেদিন আমেরিকান প্রেসিডেন্টকে দেখলাম স্কুলে শ্যুটিংএর কারণে কতটা বিরক্ত তিনি। দায় স্বীকারে অকুণ্ঠ ওবামা বললেন তাঁর বেদনার কথা। সিডনির ঘটনায় এদেশের নতুন প্রধানমন্ত্রী ম্যালকাম টার্নবুলকে দেখলাম সত্যভাষণে পিছপা নন তিনি। একমাত্র আমরাই ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার কাজে উস্তাদ একটি জাতি। যেন কিছু ঘটলে তার সব লজ্জা সরকারের। যে যখন পাওয়ারে মিথ্যা বলে বিভ্রান্ত করার কাজে এগিয়ে থাকে। দায় নিতে চায় না। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা যখন বলেন 'নিহত ব্যক্তি বাংলাদেশি আলু ব্যবসায়ী', তখন আমরা কী ভাবব? আমরা কি ধরে নেব, এরা মানসিকভাবে সুস্থ?

দেশে জঙ্গিবাদ আছে কী নেই এ কথা খুলে বলার পরিবর্তে টালবাহানা করার মানে কী? আমরা নেই বললেই কি তাদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে? যেসব দেশের তরুণরা আইএসে যাচ্ছে তাদের ভেতর আমাদের দেশের তরুণরা শুধু নয় তরুণীরাও রয়েছে। দেশের গ্রামে-গঞ্জে জঙ্গি বানানোর উন্মাদনার অভাব নেই। রামুর আহত বুদ্ধ আর মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়া দেব-দেবী, প্রগতিশীল সংখ্যাগুরুর লাশ কী বলে? কী মনে করিয়ে দেয়? এসব কি দুয়েকজন পাগল মানুষের কাণ্ড না সংগঠিত চক্রের আক্রমণ?

জঙ্গিবাদ এখন আন্তর্জাতিক ভয়ের উঁৎস। থাকাটা অপরাধ নয়, অপরাধ থাকলে তাকে ধামাচাপা দেওয়া। আওয়ামী লীগ তার সব কমিটমেন্ট ভুলে সেটাই করছে। এখন সময় এসেছে ভেতরে বাইরে থাকা সব জঙ্গিবাদের কথা তুলে ধরা। কেন তারা তা করছে না? ভেতরের চাপে? না নিজেরা কনফিউসড?

যে কারণে যেভাবেই হোক আজ সময় এসেছে সত্য বলার। যাদের কাছে ভাবমূর্তি তুলে ধরার প্রয়োজন, যারা না জানলে আমরা অন্ধকারে ডুবে যাব, সেই জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার মানে নেই। বিদেশিরা দেখবে তাদের চোখে। সেটা হয়তো জরুরি, কিন্তু তার চেয়েও জরুরি দেশের মানুষকে সত্য জানানো। তারা যদি না জানে এবং না জাগে, তাহলে এইসব অপরাধপ্রবণতা সামলানো যাবে না। আর সেটা না হলে আইএসের মতো সংগঠন যদি দেশে থেকে থাকে, তারা কিন্তু কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না।

সরকারের হতাশ করা আচরণ সেদিকে মনযোগী নয়। দেশে-বিদেশে জঙ্গিবাদের নামে ভয়াবহ আকার নিচ্ছে বাংলাদেশ। হয়তো এসব অভিযোগের কিছু সত্য, হয়তো কিছুই নয়। কেবল দুঃখ জাগছে এই ভেবে যে, শ্যামল সুন্দর সর্বজনীন অসাম্প্রদায়িক আদলে প্রিয় দেশটাকে ফিরিয়ে নেবে কে? তেমন দিন কি আসলেই আসবে?

অজয় দাশগুপ্ত: কলামিস্ট।