সংবর্ধনার সংস্কৃতির পরিবর্তন দরকার

জায়েদুল আহসান পিন্টু
Published : 4 Oct 2015, 07:00 AM
Updated : 4 Oct 2015, 07:00 AM

জাতিসংঘের পরিবেশ-বিষয়ক সর্বোচ্চ সম্মাননা 'চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ' পুরস্কার এবং আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের দেওয়া 'আইসিটি অ্যাওয়ার্ড' পাওয়ায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকে অভিনন্দন। ওই পুরস্কারপ্রাপ্তিতে আপনাকে হাজার হাজার মানুষ রাজপথ বন্ধ করে স্বাগত জানিয়েছে। তবে আরও বলব, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, লাখ লাখ মানুষ আপনাকে অভিনন্দন জানাবে যদি রাজপথে অভ্যর্থনা জানানোর সংস্কৃতিটা বন্ধ করতে পারেন এবং এটা একমাত্র আপনার পক্ষেই সম্ভব।

রাষ্ট্রপরিচালনায় বিভিন্ন আর্জনে নানা সম্মাননা পাওয়ায় দলের নেতা-কর্মী, ভক্ত, শুভানুধ্যায়ী ও সাধারণ মানুষ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা ও ভালোবাসায় সিক্ত করতে চাইবেন, এটাই স্বাভাবিক। কয়েক বছরে ধরে দেখে আসছি, শুধু পুরস্কারের মতো বড় প্রাপ্তিই নয়, কূটনৈতিক সাফল্যের জন্যও আপনাকে ভক্তরা সংবর্ধনা দিচ্ছে। তিন দফায় প্রধানমন্ত্রী হয়ে এ পর্যন্ত ২৭টি পুরস্কার ও পদক পেয়েছেন আপনি। ভবিষ্যতে আরও পুরস্কার পাবেন এটাই প্রত্যাশা দেশবাসীর। দেশবাসী চায়, ভবিষ্যতে দেড় কোটি মানুষের এ শহরে রাস্তায় সংবর্ধনার আয়োজন বন্ধের ব্যবস্থা করবেন আপনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, প্রতিবার দেখি আপনার এই অর্জন স্মরণীয় করে রাখতে বিমানবন্দর সড়কের আপনাকে অভ্যর্থনা জানান হাজারো নেতা-কর্মী। পতাকা উড়িয়ে, ফুল ছিটিয়ে, হাত নেড়ে তাদের প্রিয় নেত্রীকে স্বাগত জানান তারা। মাঝে মধ্যে বিদেশ সফর শেষে আপনি দেশে ফিরলেও আমরা একই চিত্র দেখি। গত বছর জুনে চীন সফর শেষে দেশে ফেরার পর চীন-জাপানে 'সফল কূটনীতি'র জন্য দলীয় নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে সংবর্ধনা পান আপনি। এর আগে ২০১০ সালের জানুয়ারিতে ভারত সফর শেষে দেশে ফিরে বিমানবন্দরে সংবর্ধনা দিতে সরকারি দলের মিছিলে স্থবির হয়ে পড়েছিল ঢাকার রাজপথ।

এবার বিমানবন্দর থেকে গণভবন পর্যন্ত মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়েছিলেন নেতা-কর্মীরা। ব্যান্ড পার্টি, ভুভুজেলা বাজিয়ে আপনাকে স্বাগত জানায় তারা। ছোট ছোট পতাকা ওড়ানো হয়। কখনও ছিটিয়ে দেওয়া হয় ফুল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনিও বিমানবন্দর থেকে গণভবন পর্যন্ত হাত নেড়ে হাজার হাজার ভক্তকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।

ওই সময় শহরের চিত্রটা কেমন ছিল সেটা আপনি দেখেননি। রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের চাপ গিয়ে পড়েছে গাজীপুর পর্যন্ত। আর এমনিতেই ঢাকা শহর যানজটে নাকাল থাকে। একটা বড় সড়কজুড়ে যদি যান চলাচল বন্ধ থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, জনগণের ভোগান্তির কথা একটু ভাবুন। যে ছেলেটি সাতঘাট পার হয়ে একটু চাকরির ইন্টারভিউ কার্ড পেয়েছিল সে সময়মতো হাজির হতে পারল না, তার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। যার পরীক্ষা ছিল, সারা বছর অনেক পড়াশোনা করেও পরীক্ষার দিন সময়মতো পৌঁছাতে না পেরে পিছিয়ে গেল সে। যে মুমুর্ষ রোগীকে বহন করে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিল তার সন্তানেরা, তাদের আর্তনাদ আমরা শুনতে পাই না। আর বিদেশগামী কত যাত্রী ফ্লাইট মিস করল সে হিসাব কি আমরা রেখেছি?

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি নিশ্চয়ই জানেন, এমনিতেই ঢাকা শহর যানজটের জন্য নগরবাসীর দুঃখের অন্ত নেই। যানজটের কারণে প্রতিদিন গড়ে নষ্ট হচ্ছে ৮০ লাখেরও বেশি কর্মঘণ্টা। প্রতিদিন ক্ষতি হয় ৫০ কোটিরও বেশি টাকা। আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে, গত রোজায় আপনার সরকারি বাসভবন গণভবনে রাজনীতিবিদদের সম্মানে ইফতারের আয়োজন করেছিলেন। বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ ওই অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য নিজের বাসা থেকে রওনা দিয়ে শেষ পর্যন্ত যানজট ঠেলে গণভবনে পৌঁছাতে পারেননি। ঠিক তেমনি হাজার হাজার মানুষ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের কারণে সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেন না।

যদি আগে থেকে বলা হত রাস্তা বন্ধ থাকবে তখন না হয় বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভাবার সুযোগ পেত শহরবাসী। ১৪ দলের পক্ষে জানানো হয়েছিল, সংবর্ধনার কারণে জনগণের কোনো ভোগান্তি হবে না। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নামবে, সড়কে বাড়তি চাপ পড়বে, আর তাতে জনদুর্ভোগ হবে না, তা তো নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পারেন, দাবি আদায়ের লক্ষে রাস্তা বন্ধ করা বা নেত্রীকে অভ্যর্থনা জানাতে রাস্তা বন্ধ করা যেভাবেই হোক, মানুষের ভোগান্তির ধরনটা একই রকম।

আপনার সাফল্যে যারা আনন্দিত তাদের আনন্দ প্রকাশের জন্য লাখ লাখ মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলার হাত থেকে রক্ষা করা যায় শুধু আপনার একটি নির্দেশে। আপনার ভক্তদের আনন্দ প্রকাশের অধিকার অবশ্যই আছে। একটি দিন ঠিক করে কোনো উন্মুক্ত জায়গায়– কোনো ময়দানে সেই সংবর্ধনার আয়োজন করা যেতেই পারে। তখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ এসে তাদের প্রিয় নেত্রীকে শুভেচ্ছা জানানোরও সুযোগ পাবেন।

একজন জননেত্রী হিসেবে রাস্তা বন্ধ করে অভ্যর্থনা বা সংবর্ধনা জানানোর এই সংস্কৃতি থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দেয়ার কথা ভাবুন। আপনারা জনগণের জন্য রাজনীতি করেন। আপনার এবারের পুরস্কারও জনগণকেই উৎসর্গ করেছেন। আপনি দেখলেন, হাজার হাজার মানুষ আপনাকে স্বাগত জানাতে সমবেত হয়েছে। আপনি দেখলেন না, লাখ লাখ মানুষ যানজটে আটকে পড়ে গেল আর তাদের মূল্যবান সময়ের অপচয় হল।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি ঘোষণা করুন, এখন থেকে রাজপথ দখল করে কোনো অভ্যর্থনা বা সংবর্ধনা হবে না। শুধু আপনি নন, এদেশের আরও যারা নেতা-নেত্রী আছেন, তাদেরকেও আপনার সিদ্ধান্ত অনুসরণ করতে বলুন।

আপনি একাই নন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকেও দেখেছি এমন সংবর্ধনা নিতে। কোনো আন্তর্জাতিক পুরস্কার নয়, ২০১১ সালে চীন থেকে ফিরে বিমানবন্দর সড়ক বন্ধ করে দিয়ে সংবর্ধনা নিয়েছিলেন তখনকার বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া। তিনিও জনগণের কথা ভাবেননি। এবার ফিরবেন যুক্তরাজ্য থেকে। অতীত ঐতিহ্য অনুযায়ী খালেদা জিয়াকেও হয়তো অভ্যর্থনা জানানো হবে একই কায়দায়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যদি উদাহরণ তৈরি করে দেন তাহলে হয়তো এদেশ থেকে জনদুর্ভোগের ওই সংস্কৃতি চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে।

জনপ্রতিনিধিদের সংবর্ধনা দিতে শিক্ষার্থীদের আর রাস্তায় দাঁড় করানো যাবে না বলে একটি পরিপত্র সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। স্বাগত জানানোর নামে শিক্ষার্থীদের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এ পরিপত্র জারি
করা হয়।

জায়েদুল আহসান পিণ্টু: প্রধান বার্তা সম্পাদক, দেশ টিভি।