ধর্ষণ, প্রতিবাদকাণ্ডে গুলি ও আমাদের দায়

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 22 Sept 2015, 06:10 PM
Updated : 22 Sept 2015, 06:10 PM

সন্তানের সামনে মাকে ধর্ষণ, এমন অন্যায়ের প্রতিবাদ করাই কি তবে অন্যায়? এ কেমন বর্বরের সমাজ আমরা নির্মাণ করছি? কাদের সাহসে পুলিশ গুলি চালায়, হত্যা করে সাধারণ মানুষকে? যারা ধর্ষণ করবে, অত্যাচার চালাবে তাদের পক্ষেই কেন পুলিশের অবস্থান? ঈদের প্রাক্কালে কোরবানির পশু নিয়ে যাদের ব্যস্ত থাকার কথা, তারা নিজেরাই পশুর মতো 'কোরবানি' হলেন পুলিশের গুলিতে! এ কোন সমাজে আমাদের বাস?

টাঙ্গাইলের কালিহাতিতে পুলিশের গুলিতে নিহত চার জনের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় পুলিশের এভাবে নির্বিচার গুলি কিছুতেই মানতে পারছেন না স্বজনহারা এসব মানুষ। শুধু নিহতদের স্বজনরাই নন, পুরো গ্রামবাসী স্তব্ধ। দেশের বিবেকবান সকল মানুষও বিমূঢ়। এ কেমন দেশ যেখানে অন্যায়ের প্রতিকার চাইতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারাতে হয়?

এ ন্যাক্কারজনক ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হবে কিনা সেটাই এখন প্রশ্ন। মানুষ কেন সেদিন ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল তার তদন্ত হলে জানা যেত প্রতিবাদী জনতার উপর পুলিশের নির্বিচার গুলি চালানোর কারণ। পরিস্থিতি আদৌ তৈরি না হয়ে থাকলে পুলিশ নিরস্ত্র জনতার উপর গুলি চালাতে পারে না। সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে শোনা যায়নি। পুলিশের এই 'ঠাণ্ডা মাথায় খুনের' বিচার হওয়া খুব জরুরি।

আমাদের দেশে এমনিতেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের খুব একটা বিচার হয় না। আর পুলিশের অপরাধমূলক কাজের বিচার তো আরও হয় না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যেন খুনের লাইসেন্সপ্রাপ্ত বাহিনীতে পরিণত করা হয়েছে। তাদের কোনো জবাবদিহিতার বিষয় নেই। তারা যদি অন্যায়ভাবে কাউকে হয়রানি করে বলে, 'ওই লোকটা দাগি আসামি', তবে তাই মেনে নিতে হবে। যদি বলে, 'ওই লোকটা অস্ত্রধারী, খুনি', তবে তাই সত্য। পুলিশ যদি কাউকে খুন করে বলে, 'সে আসলে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী, তাকে গ্রেপ্তার করতে গেলে তার অনুগত বাহিনী পুলিশের উপর আক্রমণ করে, পুলিশ পাল্টা গুলি ছুঁড়লে শুরু হয় বন্দুকযুদ্ধ, তাতে ওই সন্ত্রাসীর মৃত্যু হয়'– এমন বয়ানও সত্য বলে না মেনে উপায় কী?

প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেপ্তার বা শায়েস্তা করার ব্যাপারে পুলিশের উদাসীনতা সুবিদিত। অপরাধীদের সঙ্গে তাদের গোপন আঁতাত ও লেনদেনের সম্পর্ক রয়েছে, পুলিশ ঘুষ খেয়ে সব সময় ক্ষমতাবান ও দুর্বৃত্তদের পক্ষাবলম্বন করে, নিরীহ মানুষকে হয়রানি করে, মানুষ দায়ে না পড়লে পুলিশের কাছে যায় না– এমনি অসংখ্য অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা হয়েছে, অনেক উদ্যোগ-আয়োজনও দেখা গেছে, কিন্তু পরিস্থিতি খুব একটা বদলায়নি। ঢালা্ওভাবে পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করাও হয়তো ঠিক নয়, কিন্তু এ বাহিনীর একটি অংশ তো অবশ্যই এসব অপবাদের দায়ভার নিতে বাধ্য থাকবেন।

সরকারে যারাই থাকেন তারাই সাধারণত পুলিশকে নিজেদের দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করেন। কাজেই তারা পুলিশকে সব রকম অপকর্মের দায়ভার থেকেও রেহাই দেয় বা দিতেও চায়। নিতান্ত দায়ে না পড়লে কোনো সরকারকে পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যায় না। এতে পুলিশের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা না কমে বরং বাড়তে থাকে।

আমাদের সমাজে সবখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। আগে সংঘটিত কোনো ঘটনায় অপরাধীরা ধরা না পড়লে বা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না করে তাদের বাঁচিয়ে দিলে এ সমস্ত অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটবে এবং তা আগেরটার চেয়ে ভয়ংকরভাবে। বিচারহীনতার এই নোংরা সংস্কৃতি দেখে ধরে নিতে বাধ্য হয়েছি যে, প্রতিদিন যে সমস্ত ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে, তার বিচার যেমন হবে না। প্রতিবাদে মানুষ বিক্ষোভ করলেও পুলিশ গুলি করে যাদের হত্যা করছে তাদের স্বজনরাও ন্যায়বিচার পাবেন না। অপরাধীদের দু-একজন যদি কাকতালীয়ভাবে গ্রেপ্তার হয়েও যায়, পরে দুর্বল আইনের ফাঁকে ছাড়া পেয়ে যাবে।

আমাদের দুর্ভাগ্য হল, পক্ষপাতমূলক আইন, বিদ্যমান বিচার ও সমাজ কাঠামো অপরাধীদের তিরস্কার করার পরিবর্তে ভুক্তভোগীকেই হেয় প্রতিপন্ন করতে ব্যস্ত। সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারা এর জ্বলন্ত উদাহরণ। এই ধারা অনুযায়ী, ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টার শিকার কোনো নারী যদি মামলা দায়ের করেন, তাহলে ধর্ষকেরা বিচারের শুরুতেই এটি দেখাতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে যে, ওই মহিলা 'দুশ্চরিত্রা' ছিল।

এভাবে শুরুতেই তার চরিত্রের উপর 'কালিমা লেপনের' মাধ্যমে শুরু হয় নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক বৈষম্যের চরম প্রকাশ। প্রভাব-প্রতিপত্তি ও টাকা দিয়ে ধর্ষকদের পুলিশকে পকেটে রাখা, অপরাধীদের রাজনৈতিক আশ্রয়দান, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ধ্যান-ধারণা আর পক্ষপাতমূলক আইন-বলে ধর্ষণের শিকার নারীকে আদালতের মাধ্যমে 'দুশ্চরিত্রা' প্রমাণ করার বিষয়গুলো সমাজে ধর্ষণে উৎসাহ দান করছে।

ধর্ষণ, খুনের মতো অপরাধগুলো ঘটলে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ হবে এটি স্বাভাবিক। কিন্তু রাষ্ট্রের 'পেটোয়া বাহিনী' হিসেবে খ্যাতি পাওয়া পুলিশ প্রতিবাদী মানুষদের দমাতে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করছে। পরোক্ষভাবে তারা কি তবে এই বার্তাই দিতে চায় যে, অপরাধ সংঘটন হলেও এর প্রতিবাদ করা যাবে না? বিচার চাওয়া যাবে না? অপরাধীদের বিচার চেয়ে আন্দোলন করলে আন্দোলনকারীদেরই দমন করতে হবে?

সময় গড়াচ্ছে, আমরা অনেক ক্ষেত্রে বদলে যাচ্ছি, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে আমরা যেন আরও পেছনে হাঁটছি। ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বরের টাঙ্গাইলের কালিহাতি আর ১৯৯৫ সালের দিনাজপুরের দশমাইল– ঘটনা ভিন্ন হলেও পরিস্থিতি কিন্তু একই। পার্থক্য হচ্ছে, ওই ধর্ষণের ঘটনাটা ছিল সরাসরি পুলিশি ধর্ষণ ও হত্যার পরে এলাকাবাসীর প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে পুলিশের গুলিবর্ষণ। বিশ বছর পরে, কালিহাতিতে ঘটে যাওয়া কাণ্ডটিতে ভিন্নতা হল, যুবক সন্তানের সামনে পরিণতবয়স্ক মাকে ধর্ষণের ফলে এলাকাবাসীর বিক্ষোভে পুলিশের গুলি চালিয়ে হত্যা।

দুটো ঘটনারই মূল সুর হচ্ছে অন্যায়ের প্রতিবাদ– বিশেষ করে ধর্ষণের মতো বীভৎসতার বিরুদ্ধে মানুষের বিবেকের জাগরণ। অথচ দিনাজপুরে পুলিশ এজন্য সাত জনকে গুলি করে মেরেছিল। বিশ বছর পরেও আমরা একটু এগুইনি। কালিহাতিতে পুলিশ প্রতিবাদকারীদের চার জনকে মেরে ফেলল। শুধু তাই নয়, এলাকার নয়শ ব্যক্তিকে আসামি করে মামলাও দিয়েছে পুলিশ।

সবচেয়ে বড় ট্র্রাজেডি হল, এত বড় ঘটনার পরও এটি নিয়ে আলোচনা ক্রমেই যেন থিতিয়ে এসেছে। কজন পুলিশকে সরিয়ে নেওয়া, দুজন ওসিকে অন্যত্র বদলি করার মধ্যেই আপাতত প্রশাসন দেশবাসীকে 'বুঝ দেওয়া'র উদ্যোগ নিয়েছে। প্রশ্ন জাগে, এই সভ্যতাবিরোধী ঘটনার বিরুদ্ধে কি সচেতন মানুষ ফুঁসে উঠবে না? কোথায় দেশের নারী ও মানবাধিকার এবং ছাত্র সংগঠনগুলো? কোথায় দেশের রাজনৈতিক শক্তি?

আমরা নিন্দা জানাই, প্রতিবাদ করি সরকার ও পুলিশের ভূমিকার। অবশ্যই সচেতন মানুষদের এগিয়ে আসতে হবে। ক্রমাগত ধর্ষণের ঘটনা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পয়লা বৈশাখের দিন নারীর ওপর যৌন-সন্ত্রাস এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যদি আমরা ক্ষুব্ধ না হই, তাহলে রুখে দাঁড়াব কবে?

আমাদের বোধ, নৈতিকতার জায়গাটি নিয়েও প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে। নিজেদের স্বার্থের ব্যাপার হলে আমরা গর্জে উঠি, কিন্তু নারীর নিরাপত্তা ও মর্যাদার বিষয়টি আমাদের কাছে এখনও তেমন গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয় না। এ প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের কথা উল্লেখ করা যায়। দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গেল সপ্তাহে টিউশন ফির উপর আরোপিত সাড়ে সাত ভাগ ভ্যাট আরোপের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে নিজেদের দাবি আদায় করে ঘরে ফিরেছে।

অথচ পয়লা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের উপর যৌন-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তেমন জোরদার আন্দোলন গড়ে উঠেনি। এই কলঙ্কজনক ঘটনার প্রতিবাদ অনেকেই করেছেন, কিন্তু তা সমন্বিত দাবানলে পরিণত হয়নি। ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন প্রত্যেক শিক্ষার্থীর স্বার্থের আন্দোলন। তা বলে নারীর মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনও কিন্তু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এমন ঘটনার পরও দেশের একটি অগ্রণী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা এ বিষয়ে নির্বিকার ভূমিকা পালন করবেন তা মোটেই কাঙ্ক্ষিত ছিল না, যদিও তাই ঘটেছে। যৌনহয়রানি ও নারীর মর্যাদার ব্যাপারে দেশের সচেতন ছাত্রসমাজ প্রতিবাদী হবেন, এটা তাদের কাছে আশা করা অন্যায় নয়। তারা সফল শিক্ষার্থী; সচরাচর সুস্থ, সচ্ছল, সুবিধাভোগী বর্গের সন্তান। উচ্চশিক্ষার পাট চুকিয়ে কর্মজীবনে কৃতী হবেন বা উচ্চতর শিক্ষার দুনিয়ায় প্রবেশ করবেন। অনেকে দেশের গণ্ডি পার হয়ে বিশ্ববাসী হবেন। কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ জানানো, তা নিয়ে চিন্তা করা এবং সে অনুসারে আন্দোলন তৈরি করা এই তরুণ-তরুণীদের নৈতিক দায়িত্ব।

পয়লা বৈশাখে টিএসসসিতে যা ঘটেছে তাতে দেশের প্রত্যেক বিবেকবান মানুষেরই মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় উদ্বেগ বোধহয় এখানে যে, এত বড় একটা ঘটনার প্রতিকার হল না, এমনকি সংঘবদ্ধ সমন্বিত প্রতিবাদও নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ-তরুণীরাও বুঝলেন না যে, ঘটনাটি তাদের প্রতিষ্ঠানের সম্মান, তাদের নিজেদের সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। তারপরও প্রতিবাদ করেনি তারা।

টাঙ্গাইলে অন্তত প্রতিবাদ হয়েছে। এই প্রতিবাদ যারা দমন করতে চেয়েছে তাদের ক্ষমা নেই। মানুষ হলে আমাদের অবশ্যই এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে হবে। যদি ক্লীব হই তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা!

চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট।