আলোচনায় যখন ‘ভারতীয় গরু’

হাসান মামুনহাসান মামুন
Published : 22 Sept 2015, 05:37 AM
Updated : 22 Sept 2015, 05:37 AM

রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরের হাট থেকে গরু 'আমদানি'র যেসব খবর মিলছে, তাতে মনে হয় না এর বড় রকম সঙ্কট হবে। 'আমদানি' শব্দটি কোট করে দেখালাম বলতে যে, দেশের ভেতর গ্রামাঞ্চল থেকে শহরাঞ্চলে গরু আনা হলেও, এমনকি মিডিয়ার কোনো কোনো রিপোর্টে একে আমরা 'আমদানি' বলে ফেলি। শব্দপ্রয়োগে আমাদের অসতর্কতা রয়েছে। পরিষ্কার করে বলা দরকার, ভারত থেকেও আমরা গরু আমদানি করি না। চোরাইপথে গরু আসে; ওরা পাঠায়, আমরাও আনি। এখানে এনে এসব চোরাই গরুকে বৈধতা দেওয়া হয় 'রাজস্ব' আদায় করে সংশ্লিষ্টদের হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে। আমাদের বহু প্রতিবেদন আর নিবন্ধে দেখি, এটি বিভ্রান্তিকরভাবে আসে। আমরা বোধহয় বিভ্রান্তি ভালোবাসি!

যাহোক, পার্শ্ববর্তী অন্যান্য অমুসলিম দেশ যেমন নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার থেকেও (যতদূর জানি) গরু 'আমদানি' হচ্ছে না। সরবরাহ সঙ্কটের সুযোগে অল্প কিছু গরু সীমান্তপথে পাচার হয়ে আসছে। এ সময়ে এখানে চাহিদা যেমন লাফিয়ে বাড়ে, তাতে ভারত বাদে অন্যান্য দেশ থেকে আসা গরু দিয়ে তেমন পোষাবে না। তবে ক্রেতাদের জন্য ভালো খবর হল, ঈদের বাজার ধরতে পুরনো ও নতুন রুট দিয়ে ভারত থেকেও গরু আসছে। তার সচিত্র প্রতিবেদন আমরা পড়তে ও দেখতে পারছি। এতে দেশীয় গরুর উৎপাদক ও বিক্রেতারা আবার হয়ে পড়ছে হতাশ। তারা ভেবেছিল, ভারত থেকে গরু আসা বন্ধ থাকলে বিপুল চাহিদার এ বাজারে তারা ভালো দাম পাবে।

কোরবানির সময়টায় চরম ভারতবিদ্বেষী ক্রেতাও চায়, ওই দেশটি থেকে গরু আসুক। এসে বাজার ভরে যাক ও দাম কমুক। এ নিবন্ধ লেখার সময়, সোমবার পর্যন্ত রাজধানীতে লোকজন সেভাবে গরু কিনতে শুরু করেনি। হাতে সময় থাকলে তারা হাটে যাচ্ছে গরু দেখতে আর দাম কমছে কিনা, সেটা দেখতে। এদের আশা, শেষ পর্যন্ত ভারত সীমান্ত শিথিল করে দেবে এবং ওপাড়ে জড়ো করা গরুগুলো দ্রুত এসে পৌঁছুবে। এভাবে গরু আনায় যারা নিয়োজিত, তারা প্রতিবেদকদের কাছে তেমন আশাবাদের কথা জানাচ্ছেও। পুরো বিষয়টা ইন্টারেস্টিং।

ভারত থেকে গরু আসা এক রকম বন্ধই হয়ে গিয়েছিল এবং সেটা ওই সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপে। এসব সবার কমবেশি জানা বলে এখানে আর বলছি না। দেশটি থেকে গরু আসা কমে যাওয়া এবং মাঝে বিএনপির নেতৃত্বে টানা নৈরাজ্যকর আন্দোলন হওয়ায় গোমাংসের দাম কেজিতে একশ টাকা বেড়ে গেছে। দেশে গরু জবাই এবং এর মাংস বিক্রি আর পরিভোগও নাকি কমে গিয়েছিল। ওই সময়ে আরেকটি ক্ষতির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল একটি বাংলা বিজনেস ডেইলি। সেটি হল, সঙ্কটের কারণে দেশি গাভী ও বাছুরের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ কসাইখানায় চলে যাওয়া। এটি ঘটে থাকলে গোসম্পদের পরবর্তী বৃদ্ধি, এমনকি দুধ উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে।

ভালো দাম পেয়ে ছোট-বড় খামারিরা কোরবানির জন্য তৈরি হতে থাকা গরু ও মাংস ব্যবসায়ীদের কাছে এর মধ্যে কতটা বেচে দিয়েছে, সে তথ্য কিন্তু পাচ্ছি না। বড় বড় শহরে আজকাল উন্নতমানের গরু জবাই করে এক দামে মাংস বিক্রির প্রবণতা বেড়েছে। মানুষের সচ্ছলতা বৃদ্ধি ও রুচিবদলের কারণেই ঘটছে এটা। তারপরও এটি সত্য, দেশে কোরবানির জন্য আলাদা করে গরু তৈরির প্রবণতা বেড়েছে। ছোট বিনিয়োগ ও শ্রমে তো বটেই, রীতিমতো আয়োজন করে গরুর খামার পরিচালনা করছে অনেকে। এমন বেশ কিছু গ্রামের খবর মিলছে, যেখানে প্রতিটি ঘরেই গড়ে উঠেছে এ ধরনের কর্মকাণ্ড। কর্মসংস্থান ও আত্মনির্ভরতার দিক থেকে এটা এক বড় সুসংবাদ।

চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিক থেকে এ প্রবণতা নাকি আরও বেড়ে উঠেছে– খবর পেয়ে যে, ভারত আর আগের মতো গরু পাঠাবে না। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্টদের মনে হয়েছে, তাহলে সামনের ঈদের বাজারটাই তো ধরা যায়! আমাদের অর্থনীতি তথা জনসাধারণের মধ্যে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে লেগে পড়ার এ প্রবণতা রয়েছে। জানা গেল, অতিরিক্ত বৃষ্টিবাদলে মাঠঘাট ডুবে যেতে দেখেও মাঝারি সাইজের একটা-দুটা গরু কিনে মোটাতাজাকরণ শুরু করেছে অনেক স্বল্পবিত্ত পরিবার। নারীরা এ ক্ষেত্রে পালন করছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

স্নেহভাজন এক সাংবাদিক তার পত্রিকায় লিখেছেন, ভারত থেকে গরু না এনে দেখিই না কী হয়! এমন মনোভাব থেকে আরও অনেকে লিখেছেন। এরা আসলে অবস্থান নিয়েছেন দেশের গরু উৎপাদক ও বিক্রেতার পক্ষে। একটু গভীরে গিয়ে বলতে হয়, গোসম্পদে স্বনির্ভরতার পক্ষে। এ খাত বা উপখাতে নির্ভরযোগ্য তথ্য-পরিসংখ্যানের অভাব রয়েছে, এটা ধরে নিয়েই বলি, গোসম্পদের চাহিদা ও সরবরাহে নাকি বড় গ্যাপ নেই। এমনকি কোরবানির ঈদের সময়টায় চাহিদা যখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে, তখনও এর গ্যাপ থাকে ১০-১৫, বড়জোর ২০ শতাংশ। বছরের অন্য সময়ে তাহলে গরুর চাহিদা ও সরবরাহে গ্যাপ থাকে কত? বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে আমরা কি এটা পূরণ করতে পারি না?

এর ফলে দুধেও দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। এ ক্ষেত্রেও কিন্তু বড় অগ্রগতি সাধিত হয়েছে সাম্প্রতিক বছরগুলোয়। তরল দুধের ব্যবহার বেড়েছে দেশে, গুঁড়ো দুধও ভালোই উৎপাদিত হচ্ছে। মানের দিকে দৃষ্টি রাখা গেলে তাহলে তো আমরা দুধ আমদানিও কমাতে পারব। অন্যান্য শিশুখাদ্য আমদানিও কমানো দরকার। ভারতসহ পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে যেসব গরু এনে পরিভোগ করছি, সে জন্যও তো দাম দিতে হচ্ছে। ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন হচ্ছে না; তার মানে 'হুন্ডি' হচ্ছে। হুন্ডি তো বেআইনি; আর এভাবে গরু আনতে গিয়ে সীমান্তে মারাও পড়ছে অনেকে। ওপাড়ে গণপিটুনির শিকারও হচ্ছে আমাদের রাখালরা। এর সবই আত্মমর্যাদাহানিকর।

কী আশ্চর্য, যুগের পর যুগ এটা আমরা চালিয়ে যাচ্ছি আর ভাবছি, এভাবেই চলবে! চালাচ্ছে অবশ্য ভারতীয় গরু ব্যবসায়ীরাও। তাদের তো এখানে গরু পাঠানো দরকার। সাম্প্রতিককালে দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে গরু জবাইয়ের ওপর বাড়তি নিষেধাজ্ঞা জারি করছে বিজেপি সরকার। এটা তাদের ব্যাপার আর এখানে ভিন্ন ফোকাসে আলোচনা হচ্ছে বলে মন্তব্য করব না। তবে এ তো ঠিক, ওই কারণেও এখানে গরু পাঠানোর প্রয়োজনীয়তা তাদের বেড়েছে। গরু জবাই হতে না দিয়ে একে বাঁচিয়ে রাখতে হলে তো খরচও বহন করতে হয়। ভারতীয় অর্থনীতির জন্য সেটি নাকি একটা বড় দায়।

ভারত থেকে এ মুহূর্তে কী পরিমাণ গরু আসছে, তা বলা সম্ভব নয়। চিত্র ক্ষণে ক্ষণে পাল্টাচ্ছে। এতে গুজবনির্ভর হয়ে পড়ছে বাজার। ওখান থেকে মহিষও নাকি এবার আসছে বেশ। আমরা গরু-গরু করছি; মহিষ আর ছাগল ও ভেড়ার কথা কিন্তু তেমন বলছি না। উট কমই কোরবানি দেওয়া হয়। উটের মাংস এখানে জনপ্রিয় হবে বলে মনে হয় না। সারা দুনিয়াতেই গরুর মাংস জনপ্রিয়। গরুতে স্বনির্ভর হতে পারলে আমরা তো এর মাংস রপ্তানিও করতে পারব। ভারত এ ক্ষেত্রে নাকি আছে এক নম্বরে। তারা প্রচুর পরিমাণ মহিষের মাংসও রপ্তানি করে। আমরাও কিন্তু মানসম্মত মহিষের উৎপাদন বাড়াতে পারি। এর দুধের ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগও নেওয়া দরকার। ছাগলের দুধেও অসুবিধার কিছু নেই।

আমাদের দেশ ছোট, মানুষ বেশি আর গোচারণভূমি কম। এটা হয়তো গোসম্পদ আরও বাড়িয়ে তোলার ক্ষেত্রে একটা বড় বাধা। সীমাবদ্ধ খামারে গরু, মহিষ, ছাগল বা ভেড়া পালনে খরচ বেড়ে যাবে; কর্মীও বেশি লাগবে হয়তো। এর চেয়ে ভারত থেকে 'প্রস্তুতকৃত' গরু নিয়ে আসা হয়তো সুবিধাজনক। আনলাম আর জবাই করে খেলাম। চামড়ার চাহিদাও এভাবে পরিপূরণ করা গেল। চামড়া প্রসেস, রফতানি, দেশে চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনে সেটা ব্যবহার করা গেল। কিন্তু ভারত তো একটি হিন্দুপ্রধান দেশ। সেখানে গরুর ভিন্ন মর্যাদা আছে আর সেটা সংবিধান ও আইন দ্বারা স্বীকৃত। কংগ্রেস সরকার ফিরে এলেও ওখান থেকে গরু এনে খাওয়াটা কমবেশি ঝামেলাপূর্ণ হয়ে থাকবে।

এটা বুঝতে আমরা এত সময় নিয়ে ফেললাম কেন, তা বোধগম্য নয়। এ বছরের এপ্রিল-মে'র দিকে ওদের কঠোর ভূমিকায় গরু আসা প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরই যেন আমাদের কানে একটু পানি গেল! তখন থেকেই আলোচনা চলছে, আসছে ঈদে গরুর সঙ্কট হবে না তো? মজার বিষয়, সরকার তথা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় পরিষ্কার করে কিছু বলছিল না। অথচ ওই সময়েই জোরগলায় বলা দরকার ছিল, আমরা ভারত থেকে গরু আর প্রত্যাশা করি না। ঘাটতি পূরণে নিজেরাই যা করার করব। এতদিনের 'সহায়তা'র জন্য বন্ধুরাষ্ট্র ভারতকে ধন্যবাদ দিয়েও এমন অবস্থান নেওয়া যেত।

এটা একটা জাতীয়তাবাদী অবস্থানও কি হত না? দুই দেশে শান্তির সীমান্ত প্রতিষ্ঠায়ও এটি অবদান রাখবে। উভয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীই বলছে, ওখানে গুলিবর্ষণসহ সিংহভাগ অপঘটনাই ঘটছে গরু চোরাচালান ঘিরে। অস্ত্র ও মাদকের মতো ক্ষতিকর জিনিসের চোরাচালান যে হচ্ছে না, তা নয়। তবে সেগুলো নাকি হচ্ছে নির্বিঘ্নে। গরু চোলাচালান বন্ধ হয়ে ওগুলোর 'ব্যবসা' চালু থাকাটা অবশ্য কোনো কাজের কথা নয়। তবে গরু আনা বন্ধ হওয়া দরকার। এ ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থানটি ব্যবহার করা চাই জাতীয় স্বার্থে।

বাংলাদেশ নাকি ভাবছে, চাহিদা ও সরবরাহের ঘাটতি মেটাতে চারটি সীমান্ত হাটে ভারতীয় গরু কেনাবেচার ব্যবস্থা করার একটা প্রস্তাব দেবে। ভারত ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিবেচনায় জবাইয়ের জন্য গরু 'রফতানি' করবে না, এটা আমাদের বুঝতে হবে। জীবন্ত গোসম্পদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এক বিরাট কাণ্ডও বটে। এর মধ্যে আমাদের না যাওয়াই ভালো। এক হতে পারে, ভারত থেকে গোমাংস আমদানি। এতে পরিবহন ব্যয় কম পড়লেও দামে পোষাবে না। তার চেয়ে দেশে গোসম্পদ উৎপাদন বাড়ানো ভালো। এতে গ্রামেগঞ্জে কাজের সুযোগ বাড়বে। বেড়ে যাবে আয় বর্ধনে নারীর অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়ন।

সীমান্তে গরু চোরাচালানে নিয়োজিতদেরও তো কর্মসংস্থান দরকার। সহজ শর্তে ঋণ জুগিয়ে তাদের লাগিয়ে দেওয়া যেতে পারে গরু-মহিষ ও ছাগল-ভেড়া পালনে। ট্রেনিংও দেওয়া যেতে পারে তাদের। ধানের পর মাছ ও মুরগি উৎপাদনে আমরা প্রায় বিপ্লবাত্মক ঘটনা ঘটিয়েছি। এবার গোসম্পদে ঘটানোর পালা। ভারতকে আমরা বলতে চাই, অনেক ধন্যবাদ। আপনাদের বিপুল গোসম্পদ নিয়ে আপনারা বুঝুন। আমরা যেহেতু গরু খাই, সেহেতু নিজেরাই তৈরি করে খাব। পারলে কিছু মাংস রপ্তানি করব। 'হালাল' গোমাংসের বেশ চাহিদা রয়েছে পশ্চিমেও। এর দামও বেশি। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা গেলে সেটা বেশি বিশ্বাসযোগ্য হবে।

হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলামিস্ট।