কৃষিমন্ত্রীর বেখেয়ালের সুযোগে তামাকে শুল্কহার কমলো!

ফরিদা আখতার
Published : 27 June 2011, 01:44 PM
Updated : 27 June 2011, 01:44 PM

জাতীয় বাজেটে তামাকজাত পণ্যের ওপর কর বৃদ্ধি করে ব্যবহার কমিয়ে আনার জন্যে বিগত কয়েক মাস ধরে অনেক সভা সমাবেশ হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকেও বিভিন্ন সভায় আমন্ত্রণ জানিয়ে এই প্রস্তাবগুলো নির্দিষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তার ফলে সিগারেটের ওপর কিছু কর বৃদ্ধি ঘটেছে বটে, যদিও বিড়ির ওপর কর বাড়াবার বিষয়টি বেশ কিছু সংসদ সদস্যদের সরাসরি হস্তক্ষেপের কারণে সম্ভব হয় নি। অন্যদিকে ২০১০-১১ অর্থ বছরে কাঁচা তামাক পাতা রপ্তানীর ওপর ১০% শুল্ক কর আরোপ করার কারণে সমাদৃত হয়েছিল। সেখানে এবার ২০১১-১২ সালের বাজেটে এসে হঠাৎ করে দেখলাম তা ৫% হয়ে গেছে। জেনে আবাক হলাম শুল্ক হার কমানোর ব্যাপারটি ঘটেছে নেহায়েত কৃষি মন্ত্রীর বেখেয়ালের কারণে। বিডি নিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, জুন ২৬ তারিখের খবর পড়ে তা বোঝা গেল। কিন্তু বেখেয়াল কি শুধুই কৃষি মন্ত্রীর নাকি রাজস্ব বোর্ডের দিক থেকেও ফাইলের মধ্যে এই চিঠি বা নথি পাঠিয়ে দেয়ার মধ্যে দায়িত্বের অবহেলা ছিল? তবুও কৃষি মন্ত্রীকে ধন্যবাদ, তিনি বেখেয়ালের কথা অকপটে স্বীকার করেছেন।

বিডি নিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম অনুযায়ী কৃষি মন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী ২৬ জুন জাতীয় সংসদে ৩০০ বিধিতে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেন,"কাজের ব্যস্ততায়,বেখেয়ালে তামাকের রপ্তানি শুল্কহার কমানোর প্রস্তাব করেছিলাম। সচেতনভাবে আমি তামাকের ওপর শুল্ক হ্রাসের পক্ষে মত দিতাম না। বাজেট বক্তৃতায়ও আমি তা বলেছি। এখানে আমার ক্রটি হয়েছে, অনেক ফাইলের ভিড়ে আমি ওই নথিটিও স্বাক্ষর করে ফেলি। আর তাই মন্ত্রণালয়ের জবাব হিসেবে এনবিআরের কাছে যায়। তবে,এটা ঠিক যে আমার আরো সতর্ক হওয়া উচিত ছিলো।"

কৃষি মন্ত্রী নিজে শুল্ক হার কমানোর প্রস্তাব দিয়ে অর্থ মন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন বলে যে খবর পত্রিকায় (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৫ জুন, ২০১১) বেরিয়েছে তা তিনি অস্বীকার করেন। তবে খবরটি বের হবার কারণেই হয়তো তিনি এই ব্যাখ্যাটি সংসদে দিয়েছেন যা আমাদের জানা খুব জরুরী ছিল। বাংলাদেশ প্রতিদিন ২৭ জুন তারিখে কৃষি মন্ত্রীর বক্তব্য এবং তাঁদের প্রতিবেদকের ব্যাখ্যাও প্রকাশ করেন।

যেভাবেই হোক শুল্ক হার অর্ধেক কমে যাবার পেছনে কোন কারণ অবশ্যই আছে। এ ব্যাপারে আমি নিজে তথ্য অনুসন্ধানে না গিয়ে সরাসরি কৃষি মন্ত্রীর কথা থেকে উদ্ধ্বৃত করছি। তিনি বলেছেন, 'প্রথমবারের মতো তামাকের ওপর রপ্তানি শুল্ক আরোপ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) তাদের একক সিদ্ধান্তে ২০ শতাংশের পরিবর্তে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নেয়। কাঁচা তামাকের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহার করা সমীচীন হবে কি না সে বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের মতামত চায় এনবিআর। এটি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের স্বাক্ষরের পর সর্বশেষ সচিবের স্বাক্ষর শেষে নথি আমার কাছে আসে। গত ২৮ এপ্রিল আমি নথিতে সই করি" [বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, জুন ২৬, ২০১১]। অর্থাৎ শুল্ক হার কমাবার প্রক্রিয়া খুব 'সজ্ঞানে এবং খেয়ালের' মধ্যে আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল, শেষ পর্যায়ে এসে মন্ত্রীর স্বাক্ষর নেয়া হচ্ছিল। এটাই কি নিয়ম? এতো বড় একটি সিদ্ধ্বান্ত ফাইলের ভিড়ে দিয়ে স্বাক্ষর নেয়ার এই পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা উচিত নয় কি? এনবিআর কি এই ব্যপারে কোন ব্যাখ্যা দেবেন? এনবিআর কেন নিজে শুল্ক হার কমানোর প্রস্তাব দিলেন এবং কেনই বা মন্ত্রীর সাথে কোন প্রকার আলোচনা ছাড়াই একেবারে শেষ পর্যায়ে এনে মন্ত্রীর স্বাক্ষরের জন্য ফাইলে ঢুকিয়ে দিলেন?

মতিয়া চৌধুরীর কথায় মনে হচ্ছে তিনি স্ব-ইচ্ছায় এই কাজটি করেন নি, বেখেয়ালে হয়ে গেছে! কিন্তু তাঁর দিক থেকে বেখেয়ালে হলেও প্রক্রিয়াটা বেখেয়ালের বলে মনে হচ্ছে না। দুঃখজনক হচ্ছে যে এই বেখেয়ালের সুবিধা ভোগ করবে তামাক কোম্পানীগুলো, বিশেষ করে বহুজাতিক তামাক কোম্পানি, আর ক্ষতিগ্রস্ত হবে এদেশের মানুষ। তাদের খাদ্যের ঘাটতি, পরিবেশের ক্ষতি, স্বাস্থ্যের ক্ষতি এমন কি বাচ্চাদের পড়াশোনার ক্ষতি সবই ঘটবে।

কিন্তু তারপর? এখন যখন সব খেয়ালের মধ্যে এসেছে তাহলে কি শুল্ক কর বাড়িয়ে অন্তত বিগত বছরের পর্যায়ে নিয়ে আসা যায় না? এখনও সময় আছে।

তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার নিয়ে আমরা যেমন উদ্বিগ্ন, তেমনি তামাক চাষ দেশের কৃষি জমিকে গ্রাস করছে, এবং প্রতি বছর নতুন এলাকায় ছুটছে যেখানে আউশ ধান, বোরো ধান এবং সকল প্রকার রবি ফসল উৎপাদন করা হয় সেই জমিতেই তামাক চাষ করে। ফলে খাদ্য ঘাটতি ঘটছে। গত কয়েক বছরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তামাক চাষ যেভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে তা খাদ্য উৎপাদনের জন্য একটি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তামাক চাষ এক নাগাড়ে একই জমিতে করলে জমির উর্বরতা নষ্ট হয় তাই তামাক কোম্পানি নতুন নতুন এলাকার দিকে ছোটে। রংপুর, কুষ্টিয়া হয়ে এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলায় ব্যাপক চাষ হচ্ছে। শীতকালীন ফসলের মৌসুমে খাদ্য ফসলের পরিবর্তে তামাক চাষ করায় ব্যাপক খাদ্য ঘটতি সৃষ্টি হচ্ছে। ২০০৯ সালে প্রায় ৭৪০০০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে, অথচ এই জমিতে আলু, ডাল, ধান, মরিচ, ধনিয়া, সরিষা, শীতকালীন সব্জি, পেঁয়াজ, রসুন, ছোলাসহ সকল ধরনের খাদ্য ফসল উৎপাদন করা যেতো। কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারন বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায় যে ২০০৯-১০ সালে ১,১৫,৯৭৮ হেক্টর চাষের জমির মাত্র ৪৭ ৭৬৭ হেক্টর জমিতে বোরো, সরিষা, এবং সব্জি আবাদ হয়েছে, বাকী জমি তামাক কোম্পানি তামাক চাষের জন্য আগেই নিয়ে রেখে দিয়েছে (চিন্তা, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১০)। বান্দরবানের লামা উপজেলায় উবিনীগের একটি গবেষণায় দেখা গেছে ৫৩৯৯ একর জমিতে তামাক চাষ হওয়াতে ১১ কোটি টাকার সম পরিমানের খাদ্য ফসলের ক্ষতি হয়েছে। এখন সেসব এলাকায় খাদ্য অন্য এলাকা থেকে আমদানী করতে হয়। কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে ২০,০০০ একর জমিতে তামাক চাষের কারণে খাদ্য ফসলের ক্ষতির পরিমান ১৪ কোটি ২৪ লক্ষ টাকা। এগুলো নেহায়েতই কৃষকদের হিসাব। জাতীয় পর্যায়ে হিসাব কষলে ক্ষতির পরিমান শতগুন বাড়বে সন্দেহ নাই। গত বছর (২০১০) বান্দরবান জেলার আদালতে একটি মামলা হয়েছে এবং বান্দরবান জেলা দায়রা জজ বান্দরবান জেলায় তামাক চাষ কমিয়ে আনার জন্যে আদেশ দিয়েছেন। এই আদেশের ফলে কৃষকদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে, এবং ২০১০-১১ রবি মৌসুমে খাদ্য ফসল উৎপাদন করা হয়েছে।

কৃষি মন্ত্রণালয় স্ব-উদ্যোগে ২০০৯ সালে কুষ্টিয়া এবং তৎসংলগ্ন জেলা গুলোতে তামাক চাষের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন এবং ২০১০ সালের ১৫ এপ্রিল কৃষি মন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী এই প্রতিবেদনে উল্লেখিত তামাক চাষের ক্ষতিকর দিক, বিশেষ করে ধানসহ খাদ্য উৎপাদনে ক্ষতি এবং খাদ্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সার তামাক চাষে ব্যবহার সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়, তা অনুমোদন করেন। যুগান্তরপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে (১৭ এপ্রিল, ২০১০) জানা যায় যে কুষ্টিয়া অঞ্চলে ৪৯,০০০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষের জন্য ১৮-২০ হাজার মেট্রিক টন সার ব্যবহার হচ্ছে। এই প্রেক্ষিতে প্রতিবেদনে স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী প্রস্তাব করা হয়। স্বল্প মেয়াদী প্রস্তাবের অংশ হিসেবে সারের ওপর ভর্তুকি তুলে নেয়ার প্রস্তাব করা।

এই প্রস্তাবের বাস্তবায়ন হিসেবে আমরা দেখেছি কৃষি মন্ত্রণালয় তামাক চাষে সারের ভর্তুকি না দেয়ার সিদ্ধান্ত দিয়েছিল এবং কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ তা বাস্তবায়নও করেছিল। এই সিদ্ধান্তের সাথেই বাংলাদেশ ব্যাংক তামাক চাষের জন্য ঋণ সহযোগিতা না দেয়ার ঘোষণা তামাকের মতো একটি ক্ষতিকর ফসলের চাষ বন্ধ করার ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছার প্রকাশ ঘটেছিল। একই সাথে ২০১০-১১ সালের জাতীয় বাজেটে তামাক পাতা রপ্তানীর ওপর ১০% শুল্ক ধার্য করাকেও সকলে খুব ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখেছিলেন। কিন্তু এবার ১৮০ ডিগ্রী উল্টালো কেন তা বোঝা খুব কঠিন নয়। মতিয়া চৌধুরী বেখেয়ালে সই করেছেন বটে, তবে এর মধ্যে কারা 'অতি খেয়ালে' কাজটি করেছেন তাঁদের ব্যাপারে কি একটু তদন্ত হওয়া উচিত নয়?

কৃষি মন্ত্রীর এই স্বীকারোক্তি আমাদের আশান্বিত করছে। জাতীয় সংসদে তাঁর বক্তব্যকে আমলে নিয়ে অর্থ মন্ত্রী কি বাজেটে সংশোধন আনতে পারেন না? অবশ্যই পারেন।

ফরিদা আখতার:
নারীনেত্রী ও কলামলেখক।