ক্ষুদ্রঋণ বিভ্রান্তি: আসলে কার লাভ

জ্যাসন হিকেল
Published : 18 Sept 2015, 11:06 AM
Updated : 18 Sept 2015, 11:06 AM

আমি সব সময় অবাক হই, প্রতি বছর যে সংখ্যক ছাত্রছাত্রী আমার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিকসে আমার ক্লাসে উপস্থিত হয়, যেখানে আমি ক্ষুদ্রঋণ ও অন্যান্য bottom-of-the-pyramid উন্নয়ন পদ্ধতি পড়িয়ে থাকি। তরুণরা, উৎসাহী মিশনারির মতো, তারা খুব আবেগি ভাবে দেখতে পায়, দারিদ্র্য দূরীকরণে ক্ষুদ্রঋণের ব্যর্থতা যা তারা হয়তো ভেবেছিল পুরো পৃথিবীকে বাঁচাতে পারত।

সত্যি যদি ক্ষুদ্রঋণ দারিদ্র্য দূর করতে পারত! মাইক্রো ফাইন্যান্স বা ক্ষুদ্রঋণের সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার এই যে, ক্ষুদ্রঋণ সম্পূর্ণ ব্যর্থ এই দুর্ভাগ্যজনক প্রপঞ্চটি বাস্তব এবং সত্যি হওয়ার পরও এটি টিকে আছে। যদিও ক্ষুদ্রঋণের সফলতার অনেক সুন্দর সুন্দর গল্প বা উপাখ্যান শোনা যায়, কিন্তু বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল ঠিক তার উল্টোটাই প্রকাশ করেছে। যেমন, সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্টের ডেভিড রুডমেন উনার সাম্প্রতিক বইয়ে উল্লেখ করেছেন: "সবচেয়ে নির্ভুল বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ঋণগ্রহীতার দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্রঋণের গড় ভূমিকা শূন্য।"

অর্থাৎ ক্ষুদ্রঋণ, ঋণগ্রহীতার দারিদ্র্য বিমোচনে কোনো ভূমিকা রাখে না।

এটি কিন্তু ফেলে দেওয়ার মতো কোনো মতামত নয়। বরং ডিএফআইডির অর্থায়নে পরিচালিত একটি পূর্ণাঙ্গ তথ্য ও পরিসংখ্যান পর্যালোচনাও কিন্তু একই ধরনের ফলাফল পেয়েছে। সেই গবেষণা মতে, ক্ষুদ্রঋণকে আসলে 'বালির বসতি' বললে অত্যুক্তি হবে না। কারণ ঋণগ্রহীতার দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্রঋণ সফল ভূমিকা রেখেছে এমন কোনো সঠিক বা নির্ভুল প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বরং সত্যিকার অর্থে যেটা দেখা যায় তা হচ্ছে, ক্ষুদ্রঋণ আসলে ঋণগ্রহীতার দারিদ্র্য কমায় না, বরং আরও বাড়ায়। এর মূল কারণ আসলে খুব সহজ।

এক.

ক্ষুদ্রঋণের বেশিরভাগ অংশই ব্যয় হয় ভোগের পিছনে যা দিয়ে ঋণগ্রহীতা তার বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারেন। যেমন, গবেষণায় দেখা গেছে, সাউথ আফ্রিকায় ক্ষুদ্রঋণের প্রায় ৯৪ ভাগই ব্যয় হয় মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয়ে। কাজেই এই ঋণগ্রহীতারা ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে নতুন কোনো আয়ের উৎস তৈরি করতে পারেন না যা দিয়ে তারা ঐ ঋণ পরিশোধ করতে পারবেন। ফলশ্রুতিতে এই ঋণ পরিশোধের জন্য তাদের আরও ঋণ নিতে হয় এবং তারা এক সময় ঋণের চাপে পিষ্ট হয়ে পড়েন।

দুই.

আবার ক্ষুদ্রঋণ যদি ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহৃত হয় দেখা যায়, ওই ব্যবসা এক ধরনের চাহিদা-স্বল্পতায় ভুগে। কারণ তাদের মূল ক্রেতা কিন্তু সেই দরিদ্র জনগোষ্ঠী যারা মূলত বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনে থাকেন, যা কিনা ইতোমধ্যে বাজারে রয়েছে। যেহেতু তাদের নতুন করে আর কোনো দ্রব্যের চাহিদা থাকে না, ফলে দেখা যায়, নতুন উদ্যেগটি ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত কোনো ব্যবসার স্থান দখল করেছে। কাজেই এই ব্যবসা বা উদ্যেগ নতুন করে কোনো আয় অথবা কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে না। আর এটাই হচ্ছে এই ধরনের বিনিয়োগের সম্ভাব্য সফল পরিণতি।

তবে এর চেয়ে খারাপ পরিণতিও হতে পারে এবং হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আর সেটা হচ্ছে যে, নতুন বিনিয়োগটি সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়বে যা কিনা ঋণগ্রহীতাকে আরও ঋণের চাপে ফেলে দিবে, আরও দারিদ্র্যের দিকে নিয়ে যাবে। এই যে চাহিদার স্বল্পতা– সহজ ভাষায় বলা যায়, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর যথেষ্ট আয় নেই। আর আপাতদৃষ্টি এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, দরিদ্র মানুষের যে যথেষ্ট আয় নেই, সেটা প্রমাণ করার জন্য আমাদের অনেক ব্যয়বহুল গবেষণা প্রয়োজন!

তবে একটা ব্যাপার সত্য যে, এই ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পে কেউ যে লাভবান হয় না, তা নয়। এতে ধারাবাহিকভাবে একটা পক্ষই লাভবান হয়, আর তা হছে ঋণদাতা। কারণ অধিকাংশ সময় তারা (উদাহরণস্বরূপ, Banco Compartamos) যে সুদ আয় করেন তা বার্ষিক ২০০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। আগে এ ধরনের সুদখোরদের বলা হত, 'ঋণ-হাঙ্গর'। কিন্তু এখন তাদের আখ্যায়িত করা হয়, ক্ষুদ্রঋণদাতা হিসেবে। শুধু তাই নয়, এই ক্ষুদ্রঋণদাতারা সামজিকভাবে এত স্বীকৃত যে, মনে হয় তাদেরকে সমাজসেবার জন্য এক ধরনের মুকুট পরিয়ে রাখা হয়। এভাবেই দিনে দিনে ক্ষুদ্রঋণ হয়ে উঠেছে গরিবের কাছ থেকে ধন, সম্পদ আনার একটি সামাজিকভাবে গৃহীত পদ্ধতি।

ক্ষুদ্রঋণের ব্যর্থতা কিন্তু সর্বোচ্চ পর্যায়েও স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে; তারপরও কোনো এক কারণে এটি টিকে আছে অনেকটা সিনেমার জম্বির মতো যা কিনা মরতে অস্বীকার করে।

প্রশ্ন হচ্ছে, ক্ষুদ্রঋণের এত ব্যর্থতার পরও কেন এক একটি চমকপ্রদ ধারণা হিসেবে প্রচার করা হয়। এটা জানতে হলে বুঝতে হবে যে, ক্ষুদ্রঋণের ধারণাটি দারিদ্র্য দূরীকরণে এক ধরনের উইন-উইন অবস্থা হিসেবে দেখানো হয়, যেখানে দুপক্ষই লাভবান হয়। এটি ধনী রাষ্ট্রগুলোকে এই নিশ্চয়তা প্রদান করে যে, ধনী দেশগুলি দারিদ্র্য দূর করতে সক্ষম হবে চলমান রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক সিস্টেমটি কোনো হুমকির মাঝে না ফেলে। অন্যভাবে বললে, কোনো ধরনের শ্রেণি-সংঘাত ছাড়াই এটি এক ধরনের বিপ্লবের প্রতিশ্রুতি দেয়।

তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এই যে, এর মাধ্যমে শুধু যে দারিদ্র্য দূর হবে তা নয়, এর থেকে মুনাফা অর্জনও সম্ভব, এই প্রতিশ্রুতি দেয় ক্ষুদ্রঋণ। এই লোভ সামলানো অসম্ভব।

তার উপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের জন্যও এটি খুব কার্যকর একটি পন্থা। এ প্রসঙ্গে, ক্ষুদ্রঋণের অন্যতম প্রধান সমালোচক মিলফোর্ড বেটম্যান বলেছেন, এই ক্ষুদ্রঋণ আন্দোলন আসলে ল্যাটিন আমেরিকায় পরিচালিত মার্কিন মুল্লুকের 'কনটেইনমেন্ট স্ট্র্যাটেজি'এর উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে বা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যার মাধ্যমে জনগণকে বামধারার আন্দোলন থেকে দূরে রাখা সম্ভব এই বলে যে, দারিদ্র্য আসলে কোনো রাজনৈতিক সমস্যা নয়, এটি একটি ব্যক্তিগত সমস্যা।

ক্ষুদ্রঋণ এ ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী মাধ্যম এটা বুঝানোর জন্য যে, দরিদ্র লোকেরা নিজেরাই দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বের হয়ে আসতে পারবেন। প্রয়োজন শুধুমাত্র একটু সাহস আর ক্ষুদ্রঋণ, তবে তারা খুব সহজেই দারিদ্র্য থেকে বের হয়ে আসতে পারবেন। আর এরপরও যদি তারা ব্যর্থ হন, তবে এর দায়ভার শুধু তাদেরই।

এটি আসলে 'নিও-লিবারেল উন্নয়ন পরিকল্পনা' নামে পরিচিত। ভুলে যান, কলোনিয়ালিজম; কাঠামোগত সমন্বয়; রাষ্ট্রের ব্যয়-সংকোচন; অর্থনৈতিক সংকট; জমি-দখল, কর ফাঁকি অথবা আবহাওয়ার পরিবর্তনের কথা। শুধু মনে রাখবেন, ব্যাংকাররাই হবে আমাদের নতুন দিনের নায়ক এবং ঋণ সমস্যার সমাধানকারী। ঋণ আসলে দমিয়ে রাখার একটি দারুণ, কার্যকরী মাধ্যম।

আমরা যদি দারিদ্র্যের মূল কারণ কী এ ব্যাপারে দৃষ্টিপাত করি তবে দেখতে পাব, ক্ষুদ্রঋণ কোনোভাবেই এর সমাধান নয়। কাঠামোগত সমস্যা দূর করতে হলে দরকার কাঠামোগত সমাধান। কিন্তু সেটা কেমন হতে পারে? আমরা বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফকে গণতন্ত্রায়নের মাধ্যমে এ প্রক্রিয়া শুরু করতে পারি; মূলধন পাচার রোধ, বিভিন্ন বাণিজ্য চুক্তি সমতামূলক করা, শ্রম-অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেও সেটা সম্ভব। আমরা যদি দারিদ্র্য দূর করতে চাই, ধনী দেশ আর ধনী ব্যক্তিদের এর জন্য ত্যাগ স্বীকার করতেই হবে। এর বাইরে কোনো পথ নেই।

দুঃখজনক হলেও সত্যি এই যে, ক্ষুদ্রঋণের প্রবক্তাদের এতে খুশি হওয়ার কথা নয়।

তার মানে এই নয় যে, ক্ষুদ্রঋণ একেবারেই বিলুপ্ত করে দিতে হবে, কিন্তু যদি আমরা দারিদ্র্যের মূল কারণ চিহ্নিত করতে না পারি, ক্ষুদ্রঋণ কোনোদিনই সফলতা লাভ করতে পারবে না। আমাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে, ক্ষুদ্র বিনিয়োগ যেন সফলতার মুখ দেখে। সেটা হতে পারে ভর্তুকি দিয়ে; হতে পারে রাষ্ট্র উন্নয়নমূলক প্রদান করে; এমনকি উদ্যেক্তা যদি ব্যর্থ হয়, তখন কল্যাণমুখী সহায়তার মাধ্যমেও হতে পারে– অর্থাৎ, যদি আমরা সেই পদ্ধতিতে ফিরে যাই যা কিনা নিও-লিবারেলিজম আমাদেরকে ত্যাগ করাতে সক্ষম হয়েছে।

তবে দারিদ্র্য দূরীকরণের তাৎক্ষণিক অনেক ধরনের সমাধান রয়েছে। যেমন, আমরা দরিদ্র লোকদের বিনামূল্যে সরাসরি অর্থ-সহায়তা প্রদান করতে পারি। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, যে সব জায়গায় ক্ষুদ্রঋণ ব্যর্থ হয়েছে, সে সব জায়গায় কোনো শর্ত ছাড়া সরাসরি অর্থ-সহায়তা শুধুমাত্র সফলতাই নিয়ে আসেনি, বরং সবচেয়ে কার্যকর দারিদ্র্য দূরীকরণ পদ্ধতিতে আবির্ভূত হয়েছে। নামিবিয়া, মেক্সিকো, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া এবং অন্যান্য জায়গায় এই পদ্ধতি দারুণ কাজ করেছে।

এর মূল কারণ হচ্ছে, এ ধরনের অর্থ-সহায়তা ভোগ-ঘাটতি কমায়, স্বাস্থ্য পরিস্থিতির উন্নতি সাধন করে এবং নতুন স্থানীয় চাহিদা বৃদ্ধির মাধ্যমে নতুন ব্যবসায়িক উদ্যেগের পথ সুগম করে।

এই পদ্ধতির সবচেয়ে সুন্দর ব্যাপার হচ্ছে এই যে, এটা শুধুমাত্র দারিদ্র্য দূর করে না, এটা দরিদ্রদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন ঘটায়। এটা দরিদ্রদের করুণার পাত্র হিসেবে দেখে না, তাদের অর্থ উপার্জনের মাধ্যম বলে মনে করে না, বরং সেই মানুষ হিসেবে বিবেবচনা করে যাদের এই পৃথিবীর সম্পদের ওপর অধিকার রয়েছে।


ড. জ্যাসন হিকেল:
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের নৃতত্ত্ববিদ।

[ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় ১০ জুন, ২০১৫ প্রকাশিত ড. জেসন হিকেলের 'দ্য মাইক্রোফিন্যান্স ডিলিউশন: হু রিয়েলি উইনস' শিরোনামের আর্টিকেলটির অনুবাদ করেছেন কানাডার অ্যালবার্টা প্রদেশের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালগেরির অর্থনীতিতে পিএইচডির শিক্ষার্থী হোসেন রিজু]