সংখ্যালঘু সমস্যার নামে নতুন বিভক্তি কেন

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 9 Sept 2015, 03:30 AM
Updated : 9 Sept 2015, 03:30 AM

'সংখ্যালঘু' শব্দটি আমার অপ্রিয়। 'হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ' নামের সংগঠন তাই আমাকে কখনও টানেনি। তবে আজ যিনি যুদ্ধাপরাধী বিচার ট্রাইব্যুনালের আইনজীবী হিসেবে ব্যাপক পরিচিত, সেই রাণা দাশগুপ্ত রক্তের সম্পর্কের কেউ না হলেও আত্মীয়সম। যৌবনের শুরু থেকে আমাকে এই সংগঠনে টানার চেষ্টা করেছেন তিনি। তখন কবিতা লিখি। এলোমেলো চুলের ছড়াকার। বেপরোয়া যুবক। কলাম লেখার প্লাবনে ভাসা হয়নি। সে বয়সে রাণাদা আমাকে কেন যেন ভীষণ গুরুত্ব দিতেন। কত যে তাজা গরম চিকেন তিনি খাইয়েছেন আমাকে সে হিসাব রাখা মুশকিল।

চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামের আশেপাশে তখন অনেক সবুজ জায়গা। কয়েকটা মাঝারি সাইজের খাবারের দোকান। আজকের পাঁচতারা রেডিসন তখন কল্পনায়ও আসেনি। সেখানে ছিল 'দারুল কাবাব' নামে এক অসাধারণ কাবাব ঘর। এখন মনে হয়, কী কারণে এর নাম 'দারুল কাবাব' ছিল, এর নাম তো হওয়া উচিত ছিল 'দারুণ কাবাব'! সে কাবাব ঘরের চিকেন কিনে স্টেডিয়ামের ভেতরের সবুজ ঘাসের ওপর বসতাম আমরা। রাণাদা তাঁর সাধ্যমতো চেষ্টা করতেন তাদের সংগঠনের কার্যক্রম বর্ণনা করার।

মানতাম, সমস্যা আছে, নিজের দেশে পরবাসী আমরা। 'সংখ্যাগুরু' নামে পরিচিত মানুষজনেরা আমাদের নানাভাবে হেয় করেন। আমাদের জমিজমা, নারী, সম্পত্তি, এমনকি জিয়নও নিরাপদ নয়। কিন্তু তার মানে কি এই যে, আমরা এক দেশে এক সমাজে বিভক্তির আরেকটি চারাগাছ বপন করব?

তখন খুব ভালো করে রাজনীতি বুঝতাম না। সবেমাত্র কলাম লিখতে শুরু করেছি। তবু এটুকু জানতাম, আওয়ামী লীগ, বাম ধারা বা দেশপ্রেমিক শক্তির বাইরে এর কোনো সমাধান নেই। যে সংগঠনের কথা তিনি বলতেন তারা সীমাবদ্ধভাবে চেষ্টা করবে বটে, তবে এর ভেতর দিয়ে সত্যিকার সমাধান বের করে আনা অসম্ভব।

সে সময় মতিউর রহমানের তখনকার 'ভোরের কাগজ'এ শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে সমান্তরাল করে লেখা রাণাদার একটি আলোচনার বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলাম তখনকার 'আজকের কাগজ'এ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, এ জাতীয় সংগঠনের আওতায় সমস্যার সমাধান নেই। তবে রাণাদার সঙ্গে আমার সম্পর্কে কখনও চিড় ধরেনি। ধরবেও না।

আজ অনেক বছর পর রাণাদা আবার সংবাদে এসেছেন। যার পেছনে 'হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ'ও জড়িয়ে। সংগঠনটি এখনও তাদের অভিযোগ তোলা আর নালিশ জানানোর বাইরে পা ফেলতে পারেনি। সংসারে যেমন শিশুটি শুধু নালিশ জানায়, এরাও তাই। সে শিশু যখন বড় হয়ে ওঠে তখন সে নিজেই সমস্যার সমাধান করে। এমনকি পরিবারের সমস্যারও সুরাহা করতে উদ্যেগী হয়। এই ঐক্য পরিষদ কেন তা পারল না? তারা কি কখনও সেটা ভেবে দেখেছে?

বাংলাদেশের মানুষের সমস্যা-সম্ভাবনার আড়ালে সাম্প্রদায়িকতার যে রূপ সেটা নতুন কিছু নয়। যুগ যুগ ধরে চলে আসা সমস্যা আর আগুনের আঁচে বসবাস করতে করতে অভ্যস্ত হিন্দুরা জানে, সময় এলেই কয়েকটা দেবদেবীর মূর্তি ভাঙা হবে। যে দল বিরোধী দলে থাকবে তারা মানব বন্ধন করবে, বিবৃতি পাঠাবে, গরম গরম কথা বলবে। সরকারি দল কোনো একটি অজুহাতে সংখ্যালঘু নেতা নামে পরিচিত জন বা তাদের ভেতর যারা নামকরা তাদের কার্ড পাঠিবে ভবনে ডেকে এনে দেখিয়ে দেবে সম্প্রীতি কাকে বলে। মালকোচা মেরে ধুতি ও রঙিন পাঞ্জাবি গায়ে চাপিয়ে এ-ভবন ও-ভবনে যাওয়া কেউকেটা হিন্দু বৌদ্ধ বা খ্রিস্টানদের ফেইসবুক ছবি বা চেহারা দেখে মনেই হবে না যে, এদেশে আসলে কোনো সমস্যা আছে!

দালাল শব্দটি বড় জেল্লা ধারণ করে। এর দাপটও বেশি। একবার যে তার মজা পায় আর ভুলতে পারে না। পারে না বলেই কারও কাছে শেখ হাসিনা ত্রাতা।আর গয়েশ্বরের কাছে খালেদা জিয়া মানে দুর্গার আরেক রূপ। যে দেশে রাজনীতিবিদ আমলা সাংবাদিক লেখকেরই চরিত্র নেই, সে দেশে সংখ্যালঘুদের মেরুদণ্ড থাকবে কী উপায়ে?

রামুর ঘটনার কথা মনে করব। ভাঙা বৌদ্ধ বিহার, বুদ্ধের মূর্তির পাদদেশে কান্নারত সুকোমল বড়ুয়াকে মনে আছে? ইনি বিএনপির সময়ে দেশের সেরা পদক গলায় ঝুলিয়েছিলেন। পরে জীবন সায়াহ্ণে এসে জানলেন, তার বুদ্ধ কতটা অসহায়– দানবের কাছে কতটা খেলো। কেউ সময় থাকতে বোঝে না। রাণাদাও বোঝেন কিনা জানি না।

এর মধ্যে তিনি আবার ঝড় তুলেছেন। ফরিদপুরে এক হিন্দু ভদ্রলোকের বাড়িঘর বিক্রি নিয়ে যে বিতর্ক তাতে সরকারের প্রভাবশালী মানুষজন আছে জেনেও তিনি কেন এসব বলতে গেছেন কে জানে! যার বাড়ি সে বলছে, আমি বেচেছি। আর এরা বলছেন, কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যেও রাজনীতি আছে। বাংলাদেশে প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো মানুষ উদ্বাস্তু হয়। তারা কে কীভাবে কোন দেশে যায় আমরা জানিও না। তাহলে কেন এই ভদ্রলোক শিরোনাম হলেন?

যে কারণেই হোক পানি অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। এখন তার স্রোত কত দূর যায় সেটাই দেখার বিষয়। 'হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ' নামের সংগঠনটি কাউকে বাঁচাতে পারবে না, রাখতেও পারবে না। তারা কী চায়, কেন চায় সেটাও তারা পরিস্কারভাবে বলতে পারে না।

বাংলাদেশে এখন যা চলছে তাকে জগাখিচুড়িও হার মানায়। পোশাক খাবার আদব-কায়দা এমনকি কথাবার্তায়ও এখন ধর্মের ছড়াছড়ি। কে কত ধার্মিক তার প্রমাণ দেবার এমন প্রতিযোগিতা কস্মিনকালেও দেখা যায়নি। ভেতরে ফাঁকা বাইরে লেবাসের এই যুগে আসলে সব কিছু স্বার্থময়। যারা এগুলো করেন তাদের আসল ধান্দা জায়গা-জমি বা নারীর ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা।

শেখ আসিনার সরকার খানিকটা ইতিবাচক অনেক দিক দিয়ে। এ আমলে হিন্দু বা অন্য ধর্মাবলম্বীরা চাকরি পায়, প্রমোশন পায়, ভালো পদে থাকতে পারে। তাদের এই অবস্থানটুকু নষ্ট করে সরকারের বিরুদ্ধে জনমত লেলিয়ে দেওয়া সুশীলদের খপ্পরে পড়া নেহাত দুর্ভাগ্য। আমাদের দেশের সুশীলরাই সবচেয়ে ভয়ানক। গ্রামের চাষী-মজুর বা শহরের শ্রমিক কারও জায়গা কেড়ে নেয় না। তারা দাঙ্গা-ফ্যাসাদ ভুলে গেছে আজ কয়েক যুগ। এখন চলছে সুশীলদের রাজত্ব। এই সুশীল সমাজের হাতে বন্দি যত প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন, সেখানেই বিপদ আর ধ্বংসের হাতছানি। বাংলাদেশে কেউ কেউ উস্কে না দেওয়া অব্দি সাম্প্রদায়িকতার আগুন জ্বলে ওঠে না, এটা মনে রাখা জরুরি।

এই যে কিছুদিন আগে প্রবীর শিকদার বিপদে পড়লেন, যারা তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তারা কি সবাই হিন্দু? যারা তাকে গলায় মালা দিয়ে বরণ করে এনেছিল, তারা কি সবাই সংখ্যালঘু? ফলে আজ আবার সংকীর্ণতা বা সংখ্যালঘু রাজনীতির নামে ঘটনা উস্কে দেওয়ার কাজটা ভালো ঠেকছে না।

নেতাদের কখনও কিছু হয় না। তারা জেলে গেলেও নিরাপদ। তাদের জায়গা-জমি সহায়-সম্পত্তিও। বিপদে থাকেন আমজনতা। তাদের নিয়ে রাজনীতি করার কাজটা বন্ধ রাখলেই মঙ্গল। কারণ কোনো নেতা তো দূরের কথা, প্রশাসনেরও সাধ্য নেই কিছু কিছু বিষয়ে নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়ানো। তাছাড়া দেশের সাম্প্রতিক রাজনীতি, ছুরি-চাপাতি কী বলে? মুক্তমনা হলে কেউ নিরাপদ নয়।

সব মিলিয়ে বেশ নাজুক আর গোলমেলে এক পরিবেশ। এই সময় ঘোলা জলে মাছ শিকার বা মাছের আশায় পানি ঘোলা করাটা কি ঠিক? হুঙ্কার, পাল্টা-হুঙ্কারের সময় নয় এখন। বাংলাদেশের আকাশে সিঁদুরে মেঘের আনাগোনা থামেনি। হঠাৎ করে সাম্প্রদায়িকতার নামে নতুন বিদ্বেষ ছড়ানোর দায়িত্ব নেওয়াটা কি উচিত কাজ?

রাণা দাশগুপ্তকে সারা দেশে পরিচিতি দিয়েছেন শেখ হাসিনা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কঠিন কাজের দায়িত্ব পাবার পর দেশের মানুষ রাণাদাকে চিনেছে। সরকারের কাছ থেকে পেয়েছেন দায়িত্ব– সে সঙ্গে গুরুত্বও। সে কাজ সমাধা হবার আগে গোপালগঞ্জের জায়গা-জমি নিয়ে কূটবিতর্কে জড়িয়ে পড়ার কারণ ছিল না। তিনি এখন যে কাজে আছেন তার দায় অনেক বেশি।

এই ঘটনার উত্তাপে বা আঁচে রানাদা আওয়ামী লীগকে এক হাত নিতেও ছাড়েননি। আগ বাড়িয়ে বলেছেন, কিছু টাকা দিলেই নাকি আওয়ামী লীগের কর্মী ভাড়া পাওয়া যায়। কথাটা সত্য না মিথ্যা সে বিচারে যাব না। কিন্তু তিনি যখন এটা বলেন তখন মনে হয়, এ-ও আরেক স্ববিরোধিতা।

আগেই বলেছি ঐক্য পরিষদ নামের সংগঠনটি চাইলে জাতীয় স্রোতে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের অধিকার বজায় রাখার দায়িত্ব নিতে পারতেন। পারতেন জাতীয় প্রতিনিধিত্বের কথা বলে মানুষকে সজাগ করতে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু বা অন্য ধর্মাবলম্বীরা নানা কারণে ভালো থাকেন না। এ বিপদ-পর্বে থেকে তাদের উদ্ধার কোনো সংখ্যালঘু সংগঠনের কাজ নয়। এর দায় জাতির, এ দায়িত্ব জনগণের।

আমরা যারা দেশ থেকে সব ধরনের অনাচার আপদ আর সাম্প্রদায়িকতার অবসান চাই, উচিত হবে জাতীয় ঐক্যের কাছে যাওয়া। সবার জায়গা-জমি, পরিবার আর জীবন নিরাপদ রাখার দায় যাদের সেই রাজনীতিবিদদের কাছে আমাদের আবেদন থাকবে। সংস্কৃতি রাজনীতি সমাজ আর মানুষ, তারাই কাজটা করতে পারবে। তাতেই এদেশের মঙ্গল।

৫ সেপ্টেম্বর; সিডনি

অজয় দাশগুপ্ত: কলামিস্ট।