খাণ্ডব-দাহনে আয়লান ও ঘুমভাঙা মানবতা

Published : 8 Sept 2015, 01:06 PM
Updated : 8 Sept 2015, 01:06 PM

ম্যাক্সিম গোর্কির গল্পের নায়ক ডানকো নিজের হৃদপিণ্ড দিয়ে মশাল জ্বালিয়ে অন্ধকার অরণ্যে পথ দেখিয়েছিলেন শরণার্থী মানুষদের। জীবন দিয়ে তিনি বাঁচিয়েছিলেন অনেক মানুষের জীবন। আর সিরিয়ার তিন বছরের শিশু আয়লান কুর্দি জীবন দিয়ে নতুন দুয়ার খুলে দিল সিরিয়ার শত সহস্র আয়লানের জন্য। সমুদ্রতীরে উপুর হয়ে পড়ে থাকা শিশু আয়লানের শবদেহই জাগিয়ে দিল বিশ্ব বিবেক, ঘুমন্ত মানবতা।

সিরিয়ার শরণার্থীদের জন্য অস্ট্রিয়া ও জার্মানির সীমান্ত খুলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে মানবতা জয়ী হয়েছে। টিভির পর্দায় মিউনিখের ট্রেন স্টেশনের দৃশ্য দেখে অতি কঠোর হৃদয়ের মানুষও আবেগপ্রবণ হয়েছেন। শিশুদের চকলেট বিতরণের মাধ্যমে শরণার্থীদের বরণ করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণিত হল, মানুষের বিবেক এখনও মরে যায়নি, আজও মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় অসহায় মানুষের প্রতি।

যুদ্ধ ও শরণার্থী সমস্যা নতুন নয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে সাধারণ মানুষ পালাতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। বনে আগুন লাগলে পশুপাখিও পালাতে চায়। মহাভারতে খাণ্ডবদাহনের বিবরণ রয়েছে। খাণ্ডব বনে যখন আগুন লাগানো হল, তখন সেখানকার পশুপাখিরা তা প্রতিরোধ করতে চেয়েছিল সর্বশক্তিতে। কিন্তু একটি প্রাণিও যেন সে বনের বাইরে না আসতে পারে এবং অগ্নির শিকারে পরিণত হতে বাধ্য হয়, সে জন্য খাণ্ডব বনের চারপাশে কৃষ্ণাজুর্নের কড়া পাহারা ছিল।

যুদ্ধের আগুনে যে দেশ পুড়ছে সেখান থেকে অধিবাসীরা যদি পালাতে চায় তখন তাদের কি 'অবৈধ অভিবাসী' আখ্যা দিযে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া উচিত? একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সৈন্যদের আক্রমণের সময় আমরা বাংলাদেশ থেকে দলে দলে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছি। তখন যদি আমাদের সীমান্তে আটকে রেখে মৃত্যুর মুখে ফিরে যেতে বাধ্য করা হত? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও একইভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছে হাজার হাজার মানুষ। ইহুদি কিশোরী আনা ফ্রাংক ও তার পরিবারকেও পালাতে হয়েছিল জার্মানি ছেড়ে। নেদারল্যান্ডেসে পালিয়ে থাকা আনা ফ্রাংকের বাড়িতে স্থাপিত জাদুঘর বিশ্বের মানুষকে মনে করিয়ে দেয় যুদ্ধের আগুনে পুড়ে যাওয়া অসংখ্য শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যুর কথা।

হাঙ্গেরির মধ্য দিয়ে ইউরোপে প্রবেশ করছে নতুন জীবনপ্রত্যাশী মানুষের মিছিল। ইউরোপ তার দ্বার খুলে দিয়েছে এটি যেমন সাধুবাদ জানানোর মতো পদক্ষেপ, তেমনি একটু পিছন ফিরেও তাকানো প্রয়োজন। আয়লান তো একজন নয়, এমন শত সহস্র আয়লান মৃত্যুর মুখে রয়েছে অথবা মৃত্যুর কবলে পড়ছে। কিন্তু এই মৃত্যুর দায় কার? আয়লানের মৃত্যু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় মানবতার বড় বড় বুলির মধ্যে ফাঁকটা কোথায়। সিরিয়ায় যে যুদ্ধটি চলছে সেখানে আইএসএর হাতে অস্ত্র যাচ্ছে কোন উৎস থেকে? বিশ্বের যেখানেই যুদ্ধ লাগুক তাতে মূল লাভ কাদের?

অস্ত্র-উৎপাদক ও অস্ত্র-ব্যবসায়ী দেশগুলো নিত্যনতুন মারণাস্ত্র তুলে দিচ্ছে যুদ্ধরত দুই পক্ষের হাতেই। যত বেশি অস্ত্র বিক্রি হবে ততই তাদের লাভ। গোপনে এসব অস্ত্র যাচ্ছে গণহত্যারীদের হাতে এবং ব্যবহৃত হচ্ছে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন করার কাজে। অথচ এই অস্ত্র-উৎপাদক ও বিক্রেতা দেশগুলোই মানবতার ধ্বজাধারী হয়ে বসে আছে। এ যেন 'সর্প হইয়া দংশন কর ওঝা হইয়া ঝাড়'।

ধনী আরব দেশগুলোর ভূমিকাও এদিক থেকে ন্যাক্কারজনক। সিরিয়ার যুদ্ধ চলমান রাখা আর আইএসকে মদদ দেওয়ার বেলায় তারা কেউ কারও চেয়ে কম যায় না। আর মুসলিম ব্রাদারহুড জিগিরে মুখে ফেনা তুলে ফেলা এই ধনী দেশগুলো সিরিয়ার যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষদের আশ্রয়দানে কেন এত বিমুখ?

শিয়া-সুন্নি, কুর্দি-আরব, মুসলমান-খ্রিস্টান এসব হাজারো বিভেদের আওয়াজ শুধু বিপন্ন মানবতার ছবি ঢেকে রাখার আয়োজন আর ক্ষমতালিপ্সুদের কালো থাবা শক্তিশালী করার পুরনো কৌশল। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যতদিন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হবে ততদিন তাদের সংকটের কার্যকরী সমাধান হবে না। আবার যতদিন ক্ষমতালোভীরা সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হাতের মুঠোয় পুরে রাখতে চাইবে ততদিন তারা মানুষের ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয় বড় করে বিজ্ঞাপিত করার মাধ্যমে বিদ্বেষের আগুন উসকে দিতে থাকবে। ধর্মীয় বিদ্বেষের আগুনেই তো সেঁকা হবে তাদের লাভের রুটি।

মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয় সে মানুষ। এই পরিচয় ছাপিয়ে যায় ধর্ম ও জাতিগত সব ক্ষুদ্র পরিচয়। নিহত শিশু, নারী, বৃদ্ধ, বেসামরিক মানুষের কোনো ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয় নেই। তাদের সবচেয়ে বড় পরিচয়, তারা বিপন্ন মানুষ। তাদের মৃত্যু, মানবতারই মৃত্যু।

মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের আগুন নিভছেই না। এই পরিস্থিতিতে শুধু ঘরপোড়াদের নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিলে হবে না, তাদের ঘরের আগুন নেভাতেও আন্তরিকভাবে উদ্যোগী হতে হবে। যে গ্লোবাল ভিলেজে আমরা বাস করি তার একটি বা একাধিক বাড়িতে যদি আগুন লাগে তাহলে সে আগুন নেভাতে হাত লাগাতেই হবে। নইলে বড় মানুষদের বাড়িও খুব বেশি দিন নিরাপদ থাকবে না।

মধ্যপ্রাচ্যের সংকট তাদের একার নয়, সারা বিশ্বের। মূর্খ ও বর্বর আই এস যখন পালমিরার মন্দির ধ্বংস করে তখন শুধু সিরিয়ার প্রত্নসম্পদ ধ্বংস হয় না, একই সঙ্গে ধ্বংস হয় বিশ্ব ইতিহাসের অমূল্য রত্ন, ক্ষতিগ্রস্ত হয় মানবসভ্যতার উত্তরাধিকার। সমুদ্র সৈকতে যখন পড়ে থাকে আয়লানের মৃতদেহ, তখন শুধু সিরিয়ার একটি শিশু নয়, মুখ থুবড়ে পড়ে মানবতা।

শরণার্থীদের জন্য দরজা খুলে দিয়ে ইউরোপ মানবতার জয় ঘোষণা করেছে। তবে মানবতার এই পতাকা তখনই সমুন্নত রাখা সম্ভব হবে যখন শান্তিকামী মানুষের হাত শক্তিশালী করার মাধ্যমে যুদ্ধের দানবকে পরাজিত করা সম্ভব হবে। শিশু আয়লানের যে নিথর দেহের ছবি মানবতার ঘুম ভাঙিয়েছে তা যেন আবার কালঘুমে আচ্ছন্ন না হয়।

শান্তা মারিয়া: সাংবাদিক।