ক্রমশ একা আমরা

Published : 25 Feb 2021, 04:50 AM
Updated : 4 Sept 2015, 10:49 AM

মহামতি বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্য বলেছিলেন: উৎসবে, বিপদে, দুর্ভিক্ষে, শত্রুর সঙ্গে সংগ্রামকালে, রাজদ্বারে এবং শ্মশানে যে সহচর হয় সে-ই প্রকৃত বন্ধু। খ্রিস্টপূর্ব ৩৭০ সালে জন্ম নেওয়া এই প্রজ্ঞাবান মানুষটির কথা ২০১৫ সালের বিশ্বেও চরম সত্য। তবে সে সঙ্গে আরও কিছু ক্ষেত্র যোগ করতে হবে; যেমন, প্রকৃত বন্ধুকে টকশোতে, নির্বাচনে এবং মানববন্ধনেও সহচর হতে হবে।

সাইবার-সংস্কৃতির দৌলতে আমাদের এখন বন্ধুর অভাব নেই। ফেইসবুকে একেক জনের শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে বন্ধু। টুইটারে এখন হলিউড-বলিউডের তৃতীয় শ্রেণির নায়ক-নায়িকাদেরও যত শত সহস্র 'ফলোয়ার', আগের যুগের দেশবরেণ্য জননেতাদেরও এত অনুসারী ছিল কিনা সন্দেহ।

এত বন্ধু, এত ফলোয়ার থাকতেও রবিন উইলিয়ামসের মতো অভিনেতাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়। এত বন্ধু থাকতেও মিনার মাহমুদের মতো সাংবাদিক আত্মহত্যা করেন। নভেরা দীপিতার মতো তরুণ প্রাণকে ঝরে যেতে হয় অকালে। জিয়া খানের মতো সুন্দরী অভিনেত্রীকেও বন্ধুহীন বিশ্ব থেকে বিদায় নিতে হয়। তাহলে কি বলা যায়, এত ফেইসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থাকতেও আমরা ক্রমশ একা হয়ে যাচ্ছি?

সম্প্রতি কানাডায় একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, যে কিশোর বয়সীরা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে দুঘণ্টার বেশি সময় কাটায় তারা দ্রুত মানসিক অবসাদে আক্রান্ত হয়। তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও বেশি দেখা দেয়। ১২-১৮ বছর বয়সী প্রায় এক হাজার স্কুল-শিক্ষার্থীর উপর পরিচালিত সমীক্ষা থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে। গবেষক দল জানাচ্ছেন, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে সময় কাটানো কিশোর বয়সীরা মানসিক অবসাদে দ্রুত আক্রান্ত হচ্ছে এবং তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। অথচ এই সময়টা যদি তারা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সরাসরি আড্ডায় ব্যয় করে তাহলে মানসিক অবসাদের প্রবণতা কম হচ্ছে।

কানাডার কিশোর বয়সীদের ওপর গবেষণা চালিয়ে যে তথ্য মিলেছে, আমাদের দেশেও একই চিত্র কমবেশি মিলবে বলে ধারণা করা ভুল হবে না। সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও গবেষকরা এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসবেন সেটি আশা করছি।

আমরা এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও তো ক্রমেই বন্ধুহীন হয়ে পড়ছি। আমাদের সন্তানরা এখন পরষ্পরের বন্ধু নয় মোটেই, তারা এখন ক্লাসে আর কোচিং সেন্টারে কে কার চেয়ে বেশি নম্বর পেল সেই প্রতিযোগিতায় মত্ত। জিপিএ ফাইভ পেয়েও সন্তুষ্টি নেই, প্রয়োজন গোল্ডেন জিপিএ। সেই প্রতিযোগিতায় যে পিছিয়ে পড়ছে সে একা হয়ে পড়ছে। এমনি এক পিছিয়ে পড়া কিশোরের আত্মহত্যার খবর এবং তার অন্তিম চিঠি সংবাদমাধ্যমের দৌলতে নজরে পড়েছে অনেকেরই। কতটা নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব ও হতাশা থেকে এমন চিঠির জন্ম হতে পারে, ঝরে যেতে পারে একটি সম্ভাবনাময় জীবন তা ভেবে দেখার খুব বেশি অবকাশও হয়তো নে্ই আমাদের।

প্রতিযোগিতায় যে পিছিয়ে পড়েছে সে যেমন একা, যে আপাতদৃষ্টিতে এগিয়ে আছে সেও একা। দুঃখের ভাগীদার নেই, নেই আনন্দেরও ভাগীদার। কারণ সময় যে নেই। শুধু যে পরীক্ষার পড়া তা তো নয়, পাশাপাশি তারা দৌড়াচ্ছে নাচের, গানের, গিটারের, ছবি আঁকার, আবৃত্তির, অভিনয়ের ক্লাসে। সেখানেও আড্ডার সময় নেই, বন্ধুত্বের সময় নেই, শুধু দ্রুততম সময়ে 'স্টার' হয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা।শিল্প নয়, সাধনা নয়, শুধু 'স্টার' হওয়ার ইচ্ছা। ধ্রুবতারা নয়, উল্কার মতো হঠাৎ আলোর ঝলকানি ছড়ানোর দুর্দম চেষ্টা|

আগে শিল্পচর্চায় মানুষ বন্ধু খুঁজে পেত, খুঁজে পেত মননের পথে সঙ্গী। টিভিতে কিংবা পাড়ার সঙ্গীত অনুষ্ঠানে যারা অংশ নিতেন তারা পরষ্পরের প্রতিযোগী ছিলেন না। কিন্তু এখন 'রিয়ালিটি শো'য়ের যুগ। 'আইডল' আর 'তোমাকেই খুঁজছে'র যুগ। হয় তুমি থাকবে, নয় আমি। কেউ বন্ধু নয়, সবাই কেবল প্রতিযোগী।

আলোচনা অনুষ্ঠান নয়, এখন 'টকশো'র যুগ। নিজের এবং দলীয় 'মত' প্রতিষ্ঠার জন্য সব শিষ্টাচার ভুলে টেবিল চাপড়ানো থেকে হাতাহাতি এবং গালাগালি পর্যন্ত চলবে অবাধে। গভীর রাতে সমাজের বিবেক বলে পরিচিত বুদ্ধিজীবী মানুষরা পরষ্পরের সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করবেন, আর তা দেখে আনন্দ পাবে তারা যারা এক সময় রেসলিং দেখে আনন্দ পেতেন এবং বর্তমানে তা পানসে লাগায় এখন এদিকে ঝুঁকেছেন। স্পার্টাকাসের যুগের রোমের গ্ল্যাডিয়টরের চেয়েও এই টকশোর মল্লযোদ্ধারা যে বন্ধুহীন সেটা কি তারা নিজেরাও বুঝতে পারছেন?

তাজউদ্দীন আহমেদ আর খন্দকার মোশতাকের মধ্যে কে প্রকৃত বন্ধু তা চিনতে পারেননি বলেই বঙ্গবন্ধুকে হয়তো এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছিল। রাষ্ট্রনায়কদের প্রায়শই এমন ভুল হয়। ক্ষমতার চারপাশে মধুলোভীদের গুঞ্জনে চাপা পড়ে যায় প্রকৃত বন্ধুর কণ্ঠস্বর।

আর এখন সাইবার বন্ধুত্বের যুগে অসংখ্য বন্ধুর মধ্যে আমরা ক্রমশ একা হয়ে পড়ছি। আমরা 'সেলফিবাজ' হয়ে উঠছি। আমরা নার্সিসাস হয়ে শুধু নিজেকেই ঘুরে ফিরে দেখছি। আমরা 'আপনারে শুধু হেরিয়া হেরিয়া, ঘুরে মরি পলে পলে।'

আমার একজন অতীব সুন্দরী বান্ধবী আছেন। তিনি প্রতি ঘণ্টায় একটি করে সেলফি আপ করেন এবং প্রায় প্রতিদিন প্রোফাইল পিকচার পরিবর্তন করেন। তার স্তাবকের অভাব নেই। কিন্তু তিনি যখন ভয়াবহ দাম্পত্য সংকটে পড়েছিলেন তখন পাশে দাঁড়ানোর মতো তথাকথিত স্তাবকদের একজনকেও খুঁজে পাননি। সেই নির্যাতনকারী স্বামীর সংসারেই তাকে অপমানকর দিনযাপন করতে হচ্ছে আজও। সেই গ্লানি বুকের ভিতর ধরে রেখে তিনি তার সুসজ্জিত সহাস্য মুখের একের পর এক সেলফি আপ করছেন। কী ভয়াবহ মানসিক দৈন্যতা! কী ভয়ানক বন্ধুহীনতা!

জনপ্রিয় একজন ব্লগার। তার বন্ধুতালিকা অতি দীর্ঘ। অথচ তিনি যখন কুৎসিতভাবে সাইবার আক্রমণের শিকার হলেন তখন তার পাশে দাঁড়ানোর মতো খুব কম জনকেই পাওয়া গেল| যাদের পাওয়া গেল তারাও 'সাইবার ফ্রেন্ড' নন, সরাসরি ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত ও বন্ধু।

আমরা অসংখ্য ফ্রেন্ডস গ্রুপের সদস্য হচ্ছি অথচ পাশের বাড়িতে, পাশের ফ্ল্যাটে এমনকি পাশের ঘরের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করছি না। সহকর্মীর সঙ্গে, রুমমেটের সঙ্গে, প্রিয়জনের সঙ্গে সরাসরি কথা না বলে 'সাইবার চ্যাট' করছি। কেউ কাউকে অনুভব করছি না। নিজের স্ট্যাটাসে কতগুলো লাইক পড়ল আর কে কী কমেন্ট করল, তাই দেখে উত্তেজনা বোধ করছি, কখনও সাফল্য পাচ্ছি, কখনও হতাশ হচ্ছি।

আমরা বেড়াতে যাচ্ছি শুধু ফেইসবুকে আর ইনস্টাগ্রামে ছবি পোস্ট করার লোভে। নানা রকম পদ রান্না করছি, সেটার ছবি আপলোড করার জন্য। ভিতরের ক্ষরণ লুকিয়ে রেখে সুখী-সুখী চেহারার যুগল ছবি পোস্ট করছি। বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে মা দিবস, বাবা দিবসে ছবিসহ আবেগময় স্ট্যাটাস দিচ্ছি।

আমাদের প্রেম, পরিণয়, বাৎসল্য, শ্রদ্ধা, অভিসার, শয়ন, ভোজন কোনোটাই আর 'প্রাইভেট' নেই, সবই এখন 'পাবলিক'। আমাদের সেই 'দারুণ সুখী' চেহারা দেখে কতজন হতাশায় ভুগছেন সে খবর কি আমরা রাখছি?

ফেইসবুকে পরিচিতদের 'সুখী যুগল' ছবি দেখে একজন বিযে-বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি বিষন্নতায় আক্রান্ত হচ্ছেন এবং একজন 'বিযে-বিচ্ছিন্ন' ব্যক্তির আনন্দময় ভ্রমণের ছবি দেখে আরেক জন বিবাহিত ভাবছেন বিয়েটা ভেঙে ফেলাই বুদ্ধিমানের কাজ— এমন ঘটনা আমাদের সমাজেই ঘটেছে।

এক সময় আমাদের দেশে 'সই' আর 'মিতা' পাতানোর রেওয়াজ ছিল। 'বকুল ফুল', 'প্রাণের কথা', 'নয়ন-তারা', 'সুজন-বন্ধু' এমনি ছিল বন্ধুদের বিশেষ নাম। বন্ধুর জন্য প্রাণ দেওয়ার ঘটনাও এক সময় বিরল ছিল না। আর এখন আমাদের সারা জীবন চলে যায় বন্ধু খুঁজে পেতে। হয়তো আমরা সে চেষ্টাও আর করি না।

মহাবিশ্বে প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজছি আমরা। স্টিফেন হকিংয়ের মতো মহাবিজ্ঞানী নেতৃত্ব দিচ্ছেন মহাজাগতিক বন্ধুর সন্ধান অভিযানে। কিন্তু আফ্রিকার যে শিশুটি এক ফোঁটা জলের অভাবে মারা যাচ্ছে, সিরিয়ার যে শিশু সাগরতীরে পড়ে থাকছে কেবল একটি মৃতদেহ হয়ে, নেপালের ভূমিকম্পে ঘর-হারানো যে অসহায় মানুষটি খোলা আকাশের নিচে শীতে কাঁপছে, নিঃস্বার্থভাবে তাকে সাহায্য না করে বিশ্বমোড়লরা কষছেন রাজনৈতিক ফায়দার হিসাবনিকাশ।

মহাবিশ্বে আমরা একা কিনা জানি না, তবে যতই গ্লোবাল ভিলেজ বলে চিৎকার করি, বিশ্বের দেশগুলো পরষ্পরের বন্ধু নয় মোটেই– তারা পরস্পরের ব্যবসা ও লুটপাটের ভাগীদার, সহযোগী ও প্রতিযোগী মাত্র। আবার দেশের ভিতরে, সমাজের ভিতরে আমরা একা থেকে আরও একা হচ্ছি, নিঃসঙ্গ থেকে নিঃসঙ্গতর হচ্ছি। আমরা শিখছি 'পুরুষের সেরা বন্ধু হল কুকুর' আর 'নারীর সেরা বন্ধু হীরা'। কিন্তু বলা হচ্ছে না, 'মানুষের সেরা বন্ধু মানুষ'।

শেষের কবিতার অমিত রায়ের উক্তি:

'অমরাবতীর কেউ যদি প্রশ্ন করে ভবে এসে করলে কী? তখন কোন লজ্জায় বলব ঘড়ির কাঁটার দিকে চোখ রেখে কাজ করতে করতে জীবনের যা-কিছু সকল-সময়ের অতীত তার দিকে চোখ তোলবার সময় পাইনি?'

এই প্রশ্নটি যদি এ যুগের মানুষকে করা হয়, তাহলে আমরা কি বলব যে, স্মার্টফোন আর ল্যাপটপ নামক চৌকো দুটি পদার্থের মোহে পড়ে জীবনে শুধু নিঃসঙ্গতাই অর্জন করেছি, মানুষের সঙ্গে মানুষের ভাষায় কথা বলার অবকাশ পাইনি? সে লজ্জার হাত থেকে রেহাই পেতে এখনও কি পারি না বন্ধু হয়ে মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে?

এক সময় মানুষ ছিল গুহাবাসী। একেকটি গুহায় তিন চারশ মানুষও একসঙ্গে বসবাস করত। মানুষের সুখদুঃখ, অনাহার বা অতিভোজন সবই ছিল সকলের সঙ্গে মিলেমিশে। এখন স্টুডিও আ্যাপার্টমেন্ট আর ক্যাপসুল আ্যাপার্টমেন্টের যুগ চলছে। 'একাস্য একা' জীবন। এই একা জীবনের বলয় থেকে বেরিয়ে মানুষের পাশে গিয়ে যদি দাঁড়াই তাহলে যেমন বন্ধু খুঁজে পাব তেমনি জীবনটাও প্রীতি-মধুর হয়ে উঠবে।

মানুষের সেরা বন্ধু যে মানুষ সেটি উপলব্ধি করাই হবে জীবনের সেরা অনুভব।

শান্তা মারিয়া: সাংবাদিক।