জাতীয় স্বার্থ রক্ষার কর্মসূচী সফল হোক

ফরহাদ মজহার
Published : 22 June 2011, 03:48 PM
Updated : 22 June 2011, 03:48 PM

১. কে কাকে কী বলে!
বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ দারুণ জিনিস। তিনি জাতীয় সংসদে যেভাবে মুখ খারাপ করেছেন তাতে তাকে খুব সুস্থ ও প্রকৃতিস্থ মনে হয় নি। তিনি জাতীয় তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটিকে (বা সংক্ষেপে জাতীয় তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটি) বলেছেন তারা 'বিদেশিদের দালাল ও গুপ্তচর'। জবরদস্ত খবর! গুরুতর অভিযোগ!

মহাজোট সরকার চুক্তি করেছে মার্কিন তেল কোম্পানি কনকোফিলিপসের সঙ্গে। কনকোফিলিপসের বোর্ড অব ডিরেক্টরসদের একজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ডেপুটি সেক্রেটারি অব স্টেট রিচার্ড এল আরমিটেজ, যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ যে তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্হা সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স এজেন্সির পরিচালিত গোপন ও কুখ্যাত ফিনিক্স প্রোগ্রামের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সেই কারণে কনকোফিলিপসকে শুধু জ্বালানি কোম্পানি হিসাবে বিচার করলে চলছে না, আরো বড় ছকের মধ্যে ফেলে বিচার করতে হবে। বঙ্গোপসাগরের আবিষ্কৃত ও অনাবিষ্কৃত খনিজ ও দাহ্য পদার্থের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিকেও সেই বিচারের অন্তর্ভূক্ত করা দরকার। (দেখুন, 'বাংলাদেশের রাজনীতি এখন বঙ্গোপসাগরে', ফরহাদ মজহার, দৈনিক আমার দেশ, ২৩ অক্টোবর, ২০০৮)। সামরিক ও গোয়েন্দা তৎপরতাও সেই আলোচনা থেকে বাদ থাকতে পারে না। কথাটি বলছি জাতীয় তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটিকে হাছান মাহমুদ বিদেশিদের 'দালাল ও গুপ্তচর' বলার পরিপ্রেক্ষিতে। কে কাকে কী বলে!

পাকিস্তানের সাবেক সেনাপতি ও সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফ সিবিএস নিউজের সিক্সটি মিনিটস প্রোগ্রামে বলেছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেপুটি সেক্রেটারি থাকার সময় রিচার্ড আরমিটেজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথামত না চললে পাকিস্তানকে 'প্রস্তর যুগে' ফেরত পাঠিয়ে দেবার হুমকি দিয়েছিলেন। বলাবাহুল্য, সেটা বোমা মেরে। যেমন আমরা ইরাক, আফগানিস্তান দেখেছি এবং এখন লিবিয়ায় দেখে মোহিত বোধ করছি। আরমিটেজ ২০০৬ সালে সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখের ঘটনার পর পাকিস্তানের ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সের একজন জেনারেলের কাছে টেলিফোন করে এই হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, পাকিস্তান যদি 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে' মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা না করে তাহলে এটাই হবে শাস্তি।

পারভেজ মোশাররফ তার বই (In the Line of Fire: A Memoir) বইতে ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন। সেই সময়ের মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ অবশ্য দাবি করেছেন, তিনি এসব কিছু জানতেন না। ব্যাপারটা তার কানে উঠেছে ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে। আরমিটেজ বলেছেন, তার সঙ্গে একজন আইএসআই জেনারেলের কথা হয়েছে ঠিকই, তবে বোমা মেরে পাকিস্তানকে প্রস্তরযুগে ফেরত পাঠিয়ে দেবেন, এই ধরনের হুমকি নাকি দেন নি। ইরাক ও আফগানিস্তানের পরিস্থিতি দেখলে আমরা অবশ্য বুঝি যে আরমিটেজ কী বলেছেন বা বলেন নি। তেল ও গ্যাসসমৃদ্ধ দেশগুলোকে প্রস্তরযুগেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেইসব দেশের যুদ্ধের কারবারে তিনি সক্রিয়ভাবেই যুক্ত ছিলেন। সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যখন কনকোফিলিপসকে বঙ্গোপসাগরে আটটি ব্লক ইজারা দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে খবর বেরিয়েছিল, তখন বোঝা গিয়েছিল কনকোফিলিপসের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের তাগিদ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের ছকের মধ্যেই তৈরি হয়েছে। চুক্তি স্বাক্ষর সময়ের ব্যাপার মাত্র। সেনা-সমর্থিত অনির্বাচিত সরকারের আমলে চুক্তি স্বাক্ষরিত না হবার কারণ প্রধানত চুক্তির রাজনৈতিক বৈধতা নিশ্চিত করা। ক্ষমতায় নির্বাচিত সরকার থাকা দরকার। সেনা-সমর্থিত সরকারকে নিঃশর্ত সমর্থন দেবার সিঁড়ি বেয়ে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসেছে। এখন দুইটি ব্লকের চুক্তি হলো।

ভিয়েতনাম যুদ্ধের পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডিফেন্স ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে রিচার্ড কাজ শুরু করেন। আশির দশকে আর্মিটেজ রোনাল্ড রিগানের পররাষ্ট্র বিষয়ক পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেন, ১৯৮৩ সালে অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অব ডিফেন্স পদে অধিষ্ঠিত হন। ফিলিপাইনের মার্কিন প্রেসিডেন্টের তরফে আরমিটেজ ফিলিপাইনের মার্কিন সামরিক ঘাঁটি নিয়ে কথাবার্তা মীমাংসার জন্য কাজ করেন।

আরমিটেজ বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন ১৯৯৮ সালে। ইরাক আক্রমণ করে সাদ্দাম হোসেনকে হত্যা ও অপসারণের জন্য বিল ক্লিনটনকে Project for the New American Century নামে যে প্রকল্প পেশ করা হয়েছিল সেখানে প্রধান প্রধান স্বাক্ষরদাতার মধ্যে তিনি একজন। ২০০১ সালে তিনি ডেপুটি সেক্রেটারি অব স্টেট হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। চাকরি ছাড়েন ২০০৬ সালের নভেম্বর মাসে। তিনি Center for Strategic and International Studies (CSIS) -এর বোর্ড অব ট্রাস্টির সদস্য। তিনি ২০০৬ সালের ১০ মে কনকোফিলিপসের বোর্ড অব ডিরেক্টরস নির্বাচিত হন। এই কোম্পানি ছাড়াও তিনি মানটেক ইন্টারন্যাশনাল কর্পোরেশন (ManTech International) এবং ট্রানস্কু লিমিটেডের (Transcu Limited) বোর্ড অব ডিরেক্টরের সদস্য।

যেখানে কনকোফিলিপসের মতো একটি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের কাছে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেবার অভিযোগ উঠেছে সেই সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রীর মুখে জাতীয় তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটিকে বিদেশিদের দালাল ও গুপ্তচর বলায় হাছান মাহমুদের প্রতি করুণা বোধ করছি। তবে তার তোলা অভিযোগের পক্ষে মুখ ব্যবহার ছাড়া প্রতিমন্ত্রী কোন প্রমাণ হাজির করেন নি। আগে দেখেছি বাংলাদেশের বামপন্থার রাজনীতির মধ্যে কারো সঙ্গে মতাদর্শিক ও কৌশলগত প্রশ্নে পার্থক্য ঘটলে তাকে 'সাম্রাজ্যবাদের দালাল' বা বিদেশী কোন গোয়েন্দা সংস্থার 'এজেন্ট' বলে গালি দেবার রেওয়াজ ছিল। এটা এখনও কমেনি। কাকে দোষ দেব? এটা আমাদের সমাজের সাধারণ অসুখ। অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকার হীনম্মন্যতা, সাংস্কৃতিক পশ্চাদপদতা এবং চিন্তা চর্চার জন্য দরকারি মগজ ও মাংসের ঘাটতি ও অপুষ্টির লক্ষণ এইসব।

জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব আনু মুহাম্মদ সম্পর্কে হাছান মাহমুদ বলেন, "তাকে জাতীয় কমিটি করার ম্যান্ডেট কে দিয়েছে? তাদের কে দায়িত্ব দিয়েছে? কিছু টোকাই নিয়ে গঠিত কমিটি কীভাবে জাতীয় কমিটি হয়?" (দেখুন 'bdnews24.com,', Sun, Jun 19th, 2011 11:56 pm BdST)' তিনি রোববার সংসদে আরও বলেছেন, "যেখানে হাজার হাজার কোটি টাকার শিল্প কারখানা করে গ্যাসের অভাবে সেগুলো চালু করা যাচ্ছে না। সেখানে এই মনু মোহাম্মদরা বলছেন, এই গ্যাস তোলা যাবে না।" (দেখুন 'bdnews24.com,', Sun, Jun 19th, 2011 11:56 pm BdST) অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের নাম বিকৃত করে তিনি সেটা 'মনু মোহাম্মদ' বানিয়েছেন। এতে অবশ্য আনু মুহাম্মদের ছার কিছুই আসে যায় না, তবে হাছান মাহমুদ নিজেই নিজের ভব্যতা ও শিষ্টাচারের সীমা কতো নিচু ও নোংরা মাত্রায় নামিয়ে আনতে পারেন তারই একটা প্রমাণ দিলেন। নিজেরই ক্ষতি করলেন তিনি। 'টোকাই' বলায় তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটির কেউই ক্ষিপ্ত হবেন বলে মনে হয় না। তাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ পেশা ও কর্মক্ষেত্রে পরিচিত। হাছান মাহমুদের খিস্তিতে দমবার কোন কারণ নাই। বরং টোকাইদের সঙ্গে তাদের শ্রেণীগতভাবে একাকার করে দেওয়ায় গৌরব বাড়বে তাদের। তারা তো সমাজের নিচু তলার মানুষগুলোর স্বার্থ রক্ষার কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু এসবই গৌণ দিক। বরং যে-দিকটা এই ধরনের ভাষা ব্যবহারে ধরা পড়ছে সেটা হচ্ছে 'টোকাই" বা বাংলাদেশের গরিব ও সর্বহারা মানুষগুলোর প্রতি হাছান মাহমুদের ঘৃণা। 'টোকাই'-দের প্রতিমন্ত্রী কী পরিমাণ ঘৃণা করেন তার কথায় সেই শ্রেণী-ঘৃণারই উদ্গীরণ ঘটেছে। এই বমনে কলুষিত বোধ না করে পারা যায় না।

বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রীর খিস্তিখেউড় এখানেই শেষ হয় নি। তিনি বলেছেন, "আনু মুহাম্মদ হলেন অর্থনীতির শিক্ষক। তেল-গ্যাস একটা টেকনিক্যাল বিষয়। এ বিষয়ে তিনি কী জানেন? কিছু লোক আছে যারা মানুষের মাথায় প্রস্রাব করে হলেও আলোচনায় থাকতে চায়। আনু-মনু মোহাম্মদরা হচ্ছে সেই দলের লোক। এরা আলোচনায় থাকার জন্য দেশের বুকে ছুরি চালাতেও দ্বিধাবোধ করে না।" তিনি বলতে চাইছেন, তেল-গ্যাস একটি 'টেকনিক্যাল' বিষয়, এর কোন রাজনীতি নাই, অর্থনীতি নাই। অতএব বাংলাদেশের সম্পদ কী চুক্তিতে বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে সেই বিষয়ে প্রশ্ন করার অধিকার বাংলাদেশের নাগরিকদের নাই।

প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, হাছান মাহমুদ এতো ক্ষিপ্ত হলেন কেন? সেটা বোঝা যায় যখন তিনি তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটির ডাকা হরতালে ভয় না পেতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। বলেন, "তাদের হরতালে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। এই কমিটি এমন কোনো শক্তিশালী কমিটি নয় যে তাদের ডাকে হরতাল পালন হবে।" ভেতরের গোমর হচ্ছে এই যে আসলে হাছান মাহমুদ নিজেই ভয় পেয়েছেন। হয়তো হরতাল হয়েও যেতে পারে। জাতীয় তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটির সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক দুর্বলতা সত্ত্বেও। যাই হোক না কেন ক্ষমতাসীন সরকারকে এই চুক্তির জন্য চিরকাল বাংলাদেশের জনগণের কাছে দায়ী থেকে যেতে হবে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই। বাংলাদেশের জ্বালানি সম্পদ অতি সংবেদনশীল জাতীয় ইস্যু। কনকোফিলিপসের সঙ্গে চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা হয় নি বলে যে-অভিযোগ জাতীয় তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটি তুলেছে তাকে খিস্তিখেউড় দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। এই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের প্রতি গণসমর্থন কম নয়। তাছাড়া দাহ্য পদার্থ নিয়ে বিশ্বব্যাপী যে দখলদারী, যুদ্ধবিগ্রহ ও সহিংসতার আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি সেই কারণেও সাধারন মানুষের উৎকণ্ঠার কারণ রয়েছে।

এই লেখার একটি উদ্দেশ্য প্রতিমন্ত্রী হাছান মাহমুদের নিন্দা করা। এর বাড়তি সংকল্প হচ্ছে জাতীয় তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটির কর্মসূচি ঘোষণার অধিকারের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ। তেল-গ্যাস রক্ষার আন্দোলন হঠাৎ মাটি ফুঁড়ে সামনে খাড়া হয় নি। এই সংগ্রাম-আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাস আছে। এই চুক্তি বাংলাদেশের অনুকূল নয় বলে তারা মনে করেন, কিন্তু তারপরেও চুক্তি হয়েছে। তাহলে ক্ষমতাসীন সরকারকে সেটা আরো স্পষ্টভাবে জানাবার একটা জরুরী তাগিদ অবশ্যই সৃষ্টি হয়েছে। কর্মসূচী সে কারণেই।

এটা পরিষ্কার প্রতিমন্ত্রী যে-ভাষায় সংসদে কথা বলেছেন সেটা শোভন নয়। সেই উপলব্ধি তার হবে কিনা সন্দেহ আছে। কিছুদিন আগে (২২ জুন ২০১১) দেখলাম তিনি কৃষিবিদ ইন্সটিটিউটের চত্বরে ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো কোম্পানির চারা বিতরণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করছেন (দেখুন যুগান্তর ২৩ জুন ২০১০)। জলবায়ুর ঝুঁকি মোকাবিলায় এটা তার সরকারী প্রচেষ্টা। অবাক হয়েছি। পরিবেশ মন্ত্রীর তামাক কোম্পানির অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে তামাক কোম্পানি দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলা শুধু স্ববিরোধিতা নয়, রীতিমত তামাশা ছাড়া আর কী! প্রাণ ও পরিবেশের ঝুঁকি ও খাদ্য উৎপাদনের জন্য জমি কমে যাওয়ার বিপদ মোকাবেলার জন্য প্রথম কাজ হচ্ছে তামাক চাষ বন্ধ করা। তামাক চাষে বিষ ও সারের ব্যবহারে প্রাণ ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি তো আছেই, তাছাড়া রয়েছে বনের পর বন উজাড় বা ধ্বংস করে দেওয়া। তামাকের পাতা শুকানোর জন্য যে তন্দুর বা চুল্লি ব্যবহার করা হয় সেখানে শুধু একটি তন্দুরে এক মৌসুমে কাঠ লাগে কমপক্ষে বিশ হাজার টন। মৌসুমের পর মৌসুমে তামাক চাষ গাছপালা ও বনাঞ্চল কীভাবে ধ্বংস করে দিতে পারে এই ছোট্ট হিসাবেই যে কেউ আন্দাজ করতে পারে। এই যদি বাস্তবতা হয় তাহলে ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো কোম্পানির চারা বিতরণ বিকট প্রহসনের অধিক কিছু নয়। পরিবেশ ও কৃষক সংগঠনগুলো তামাক চাষের ফলে একদিকে তীব্র খাদ্য সংকট আর অন্যদিকে তামাক পাতা পোড়াবার কারণে বনের পর বন উজাড় হয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করছে। আর অন্যদিকে চারা বিতরণের ছুতা ধরে প্রতিমন্ত্রী বহুজাতিক তামাক কোম্পানির প্রচার ও প্রপাগান্ডায় ইন্ধন জোগাচ্ছেন।

তাছাড়া বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক তামাক নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত চুক্তির (Framework Convention on Tobacco Control) অধীনে 'ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫' পাশ করেছে এবং তা বাস্তবায়নের জন্য নিয়ম বা বিধিমালাও জারি করেছে। তামাকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও এই আইনে তামাক চাষীকে তামাকজাত দ্রব্য উৎপাদনে নিরুৎসাহিত করবার ও বিকল্প ফসল উৎপাদনের জন্য উৎসাহ দেবার আইনী প্রতিশ্রুতি আছে। বহুজাতিক তামাক কোম্পানির প্রপাগান্ডা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে সেই আইন কার্যত প্রতিমন্ত্রী ভঙ্গ করেছেন। বনের পর বন ধ্বংস করে দেবার পাপ ঢাকা দেবার জন্য চারা বিক্রির এই প্রপাগান্ডা-অনুষ্ঠানের মধ্যে যে-শঠতা তাকে প্রশ্রয় দেবার রাজনীতিও এখানে পরিষ্কার। বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের সম্পর্কের চরিত্র আমরা এইসব নজির থেকে অনায়াসেই বুঝতে পারি। কনকোফিলিপসের সঙ্গে সম্পর্কও এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কিছু হবে না। তবে প্রতিমন্ত্রীর মন্তব্যের প্রহসনের দিকটা বোঝাবার জন্যই আমরা এতো কাহিনী বললাম। যেন খানিক আমোদিত হতে পারি। যে বহুজাতিক কোম্পানিটি দেশের প্রাণ, পরিবেশ ও খাদ্য ব্যবস্থায় সর্বনাশ ঘটাচ্ছে সেই কোম্পানিটিরই স্বার্থ রক্ষায় যিনি তৎপর তিনি তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটিকে 'বিদেশীদের দালাল ও গুপ্তচর' বলছেন। সাব্বাস!!

২. লাভের লাভ কিছুই নাই
গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে করা পিএসসি-২০০৮-এর কাঠামোতেই বাংলাদেশ সরকার ১৬ জুন বঙ্গোপসাগরের দুটো ব্লকের (১০ ও ১১) গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য কনোকোফিলিপসের সঙ্গে চুক্তি করেছে। জাতীয় তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটি যে-কারণে সম্পাদিত চুক্তির বিরোধিতা করছে তা পরিষ্কার। এই বিষয়ে যথেষ্ট লেখালিখি হয়েছে। পুনরাবৃত্তির দরকার নাই। তাদের যুক্তি খণ্ডন করে চুক্তির পক্ষে ক্ষমতাসীন সরকারের বিশেষ কোন যুক্তি আমরা দেখি নি। তবে গত সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ড. তামিম প্রথম আলোতে (২২ জুন ২০১১) গ্যাস উৎপাদনে অংশীদারী চুক্তি কী করে করা হয় সেই বিষয়ে পাঠকদের সবক দেবার জন্য একটি 'সহজ পাঠ' পেশ করেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন "বিস্তারিত তথ্য না জেনে সাধারণত কারও পক্ষে একে (পিএসসি-২০০৮) অসম আখ্যায়িত করা ধৃষ্টতাপূর্ণ। বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ চুক্তির ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার মাপকাঠি। সেদিক থেকে এ চুক্তি মোটামুটি ভারসাম্যপূর্ণ। অর্থাৎ দুই পক্ষেরই লাভ আছে (Win-Win)"। তার কথা হচ্ছে তেল ও গ্যাস কোম্পানি যদি বিনিয়োগ করতে চায় তাহলে সেটাই হবে প্রমাণ যে চুক্তিতে ভারসাম্য আছে। যেহেতু কনকোফিলিপস বিনিময় করতে চাইছে তাতেই তাহলে প্রমাণিত হয়েছে যে চুক্তি 'অসম' হয় নি। কিন্তু আবার ভারসাম্যপূর্ণ হয়েছে এটাও তিনি পুরাপুরি দাবি করতে পারছেন না। বলছেন, 'মোটামুটি ভারসাম্যপূর্ণ'। 'মোটামুটি' বলায় তার কথার মধ্যে বিস্তর ফাঁক রয়ে গিয়েছে। সহজে বোঝাবার জন্য গ্যাস উৎপাদনের অংশীদারী চুক্তিকে তিনি জমি বর্গা দেবার সঙ্গে তুলনা করেছেন। কিন্তু সেই ক্ষেত্রেও কৃষক তার নিজের লাভক্ষতি হিসাব করে। কৃষকের স্বার্থ নয়, যে জমি বর্গা নেয় তার আগ্রহকেই বর্গা চুক্তির ভারসাম্যতা প্রতিষ্ঠার মাপকাঠি গণ্য করার মানদণ্ড তো কৃষকের স্বার্থ রক্ষার মানদণ্ড হতে পারে না। কনকোফিলিপস যদি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চায় তাহলে বুঝতে হবে এই বিনিয়োগে সে লাভের আশা করছে। সেটা কনকোফিলিপসের মানদণ্ড হতে পারে। কিন্তু কনকোফিলিপসের কাছে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের দুটো ব্লক যে চুক্তিতে বর্গা দেওয়া হলো তাতে বাংলাদেশের কী লাভ সেই আসল হিসাবের জায়গা তার আলোচনায় অনুপস্থিত।

মডেল পিএসসি টা করেছেন, ম. তামিম। কিন্তু সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যখন কনকোফিলিপসকে চুক্তির জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল তখন সেটা কীসের ভিত্তিতে হয়েছিল? সেটা প্রতিযোগিতামূলক উন্মুক্ত বিডিং-এর মারফতে নির্ধারণ করা হয়েছিল কি? নাকি আগাম বাছাই হওয়া কোম্পানি কনকোফিলিপসের সাথে পর্দার আড়ালেই রফা হয়েছিল? বিভিন্ন কোম্পানি নিজ নিজ সমীক্ষা থেকে বিনিয়োগ সম্ভাব্যতার হিসাব কষে প্রতিযোগিতামূলকভাবে যদি বাংলাদেশকে উৎপাদন বণ্টন চুক্তির প্রস্তাব দিত তাহলেই একমাত্র আমরা বুঝতে পারতাম যে ড. তামিমের যুক্তির ভিত্তি ধরেই কনকোফিলিপস বিনিয়োগে আগ্রহী হয়েছে। বাজার ব্যবস্থার দ্বারাই ঝুঁকি ও বিনিয়োগের অর্থনৈতিক দরকষাকষি নির্ধারিত হয়েছে। সেটা হয়নি বলেই এটা সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস মরিয়ার্টির চাপ ও দেনদরবারের বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। দূতাবাস থেকে বারবার তাগাদা এসেছে। বাংলাদেশ থেকে যাবার আগমুহূর্তে কনকোফিলিপসের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে নিশ্চিন্ত হয়েই তিনি বাংলাদেশ ছেড়েছেন। বাজার ব্যবস্থার আলোকে হিসাবনিকাশ বা অর্থনীতির যে যুক্তি ড. তামিম দিচ্ছেন সেটা তো নিছক লোকভোলানো চতুরতা।

বাজারের যুক্তি মেনে নিলেও আরো কথা থাকে। একটা কোম্পানি বিনিয়োগের আগে যেমন গ্যাসপ্রাপ্তির সম্ভাব্যতা যাচাই করে তারপর বিনিয়োগের আগ্রহ দেখায় বা সে অনুযায়ী উৎপাদিত গ্যাসের বণ্টন বিষয়ে নিজের দরকষাকষির প্রস্তাব করে, ঠিক তেমনই রাষ্ট্র বা সরকারকেও তো নিজের প্রাকসমীক্ষা ও গ্যাসের প্রাপ্তির সম্ভাব্যতা নিয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে বুঝতে হবে তারা কেমন চুক্তি করতে পারে। কতটুকু অনিশ্চয়তা আছে এবং কী ধরনের বণ্টন চুক্তিতে গেলে সেটা দেশের জন্য অর্থনৈতিক ও অন্যান্য স্বার্থের দিক থেকে যৌক্তিক হতে পারে। ড. ম. তামিম কি সেটা করেছিলেন? কিম্বা সেনাসমর্থিত সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা এখন ক্ষমতাসীন মহাজোটের সরকার কি তা করেছে? তিনি কীসের ভিত্তিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নিশ্চিত হলেন যে আমাদের জন্য ২০ ভাগ গ্যাসের অংশীদারী চুক্তি করা লাভজনক হবে? এমনকি ২০ ভাগ না হয়ে ধরা যাক ৫০ বা ৬০ ভাগ পাওয়া যেত না সেটা কী করে আমরা এখন বুঝবো? সেই টেকনিক্যাল স্টাডি রিপোর্ট থাকলে তারা সেটা জনগণের জন্য প্রকাশ করছেন না কেন? যদি থাকে প্রকাশ করুন।

এটা হল তথাকথিত বাজার অর্থনীতির সাধারণ জিজ্ঞাসা। কিন্তু গ্যাস বা জ্বালানী আজকের দুনিয়ায় নিছকই অর্থনীতির প্রশ্ন নয়, এটা সরাসরি জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন। এ জন্যই এটাকে আর দশটা শিল্প বা পণ্য উৎপাদনের তুলনামূলক দক্ষতার মাপকাঠিতে মাপা যায় না। তিনি জাতীয় নিরাপত্তার সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রশ্নকে উড়োজাহাজ বানাবার চেষ্টা বলে যে পরোক্ষ তামাশা করেছেন সেটাই বরং অতিশয় ধৃষ্টতাপূর্ণ এবং সরাসরি দেশবিরোধী অবস্থানের নমুনা বলে আমরা চিহ্নিত করতে পারি।

জাতীয় তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটি বলছে, যে-বিধিবিধানের ( পিএসসি-২০০৮) অধীনে বঙ্গোপসাগরে ব্লকগুলো ইজারা দেওয়া হলো তার ফলে বাংলাদেশ আসলে কিছুই পাবে না। যদিও চুক্তি অনুযায়ী যে-জ্বালানি সম্পদ পাওয়া যাবে তার ৮০ ভাগ পাবে কনকোফিলিপস এবং বাকি ২০ ভাগ পাবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে সমুদ্র থেকে ১৭৫ মাইল লম্বা গ্যাস পাইপ বসিয়ে সেটা আনতে হবে। এতে খরচ পড়ে যাবে অনেক। তার চেয়ে গ্যাস আমদানির খরচ কম পড়বে।

কনকোফিলিপসের কাছ থেকে বাংলাদেশকে গ্যাস কিনতে হবে, কিন্তু রপ্তানি মূল্য যদি বাংলাদেশে বিক্রির দামের বেশি হয় তাহলে কোম্পানি রপ্তানিই করবে, বাংলাদেশকে কম দামে দেবে কেন? জাতীয় তেল গ্যাস রক্ষা কমিটির দাবি হচ্ছে আসলে শেষমেশ চুক্তির মানে দাঁড়ায় একটাই যে কনকোফিলিপসের হাতে সমুদ্রের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ তুলে দেওয়া। এই সব বিষয়ে সরকারের কাছ থেকে কোন সদুত্তর পাওয়া যায় নি। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ছাড়া। ডক্টর তামিমও এই চুক্তির সমালোচনাকে 'ধৃষ্টতা' বলে গালি দিলেন। কোন সদুত্তর দিলেন না।

জাতীয় তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটি বলছে লাভের লাভ তো কিছুই নাই, তার ওপর রয়েছে বিপদ ও বিপর্যয়ের আশঙ্কা। কনোকোফিলিপস বিভিন্ন দেশে গ্যাস উত্তোলনের কাজ করে। তাদের দুর্ঘটনার রেকর্ড রয়েছে। সমুদ্রে গ্যাস সম্পদ তোলা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, ক্ষতির সম্ভাবনা অনেকানেক বেশি। কিন্তু চুক্তিতে ক্ষতি নিরীক্ষণ করা বা কোন ক্ষতি বা বিপর্যয় ঘটলে কীভাবে তা পরিষ্কারভাবে নির্ধারণ বা নিরূপণ করা যাবে এবং ক্ষতি হলে ক্ষতিপূরণ আদায় কীভাবে হবে এইসব অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় খুবই অস্বচ্ছ। কোন দুর্ঘটনা ঘটলে শুধুমাত্র একটি কি দুটি ব্লক নয় পুরো সমুদ্রের গ্যাস সম্পদ নষ্ট হতে পারে, তার সঙ্গে প্রাণ ও পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা তো আছেই। একদিকে লাভের খাতায় শূন্য, অন্যদিকে বিপর্যয়ের ঝুঁকি, তাহলে এই চুক্তির যৌক্তিকতা কী?

বিদেশী তেল কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করবার পক্ষে আরেকটি যুক্তি দেওয়া হয় সেটা হচ্ছে সমুদ্র থেকে তেল গ্যাস তোলা অনেক ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার ফলে বিদেশি তেল কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি আমাদের করতেই হবে। তর্কের খাতিরে এই যুক্তি মানলেও সেটা শেষ বিচারে অমীমাংসিত থাকে যদি প্রমাণ করা না যায় যে চুক্তি অনুযায়ী এতে যে-গ্যাস আমরা সমুদ্রের ব্লক বর্গা নেওয়া কোম্পানির কাছ থেকে কিনবো তার দাম, কিম্বা সমুদ্র থেকে আমাদের হিস্যা বহন করে নিয়ে আসতে বাংলাদেশে গ্যাসের যে খরচ পড়বে তা আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে কম। যদি কম না হয় তাহলে এই গ্যাস আমরা এখন তুলব কেন? থাক এখন। এই গ্যাস যদি বাইরে থেকে আমদানি করতে খরচ কম লাগে বা কাছাকাছি হয় তাহলে আমদানি করাটাই তো যুক্তিসঙ্গত। এই অবসরে আমাদের উচিত সমুদ্র থেকে গ্যাস তোলার কারিগরী জ্ঞান আয়ত্ত্ব করা, পেট্রোবাংলাকে শক্তিশালী করা এবং দেশের ভেতর থেকে পুঁজি সংগ্রহ বা বিনিয়োগের জন্য উৎসাহিত করা।

দুই একটি প্রশ্ন রেখে লেখা শেষ করা যাক। গরিব ও খেটে খাওয়া শ্রেণীর রাজনৈতিক অবস্থান থেকে যারা এই আন্দোলনে সক্রিয় তাদের কয়েকটি বিষয় ভেবে দেখতে বলি। প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে তেল-গ্যাস রক্ষার লড়াই যদি 'জাতীয় স্বার্থ' রক্ষার লড়াই হয়ে থাকে তাহলে এতো দীর্ঘদিন লড়াই-সংগ্রামের পরেও এই আন্দোলন 'জাতীয় চরিত্র" অর্জন করতে পারছে না কেন? এই আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা ও সংকীর্ণতা এই প্রশ্ন তোলার মধ্য দিয়ে বের হয়ে আসবে বলে আমার ধারণা। দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম না হলেও এটা মনে করার কোন কারণ নাই যে বাংলাদেশের ধনী ও উচ্চবিত্ত শ্রেণী বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মধ্যে তাদের শ্রেণিস্বার্থ নিহিত রয়েছে– এই সত্য বুঝতে একদমই অক্ষম। এই তেল-গ্যাস রক্ষার আন্দোলনের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী চরিত্র আছে, কিন্তু সে চরিত্র বাংলাদেশে গতিশীল অর্থনীতি গড়ে তোলার স্বার্থে। যদি আসলেই এই আন্দোলন জাতীয় স্বার্থ রক্ষার আন্দোলন হয়ে থাকে তাহলে এই শ্রেণীর কাছ থেকে সমর্থন আদায়ের কৌশল কী হবে? তৃতীয়ত, বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে তার উপকার সরাসরি শ্রমিক, কৃষক ও গরিব জনগোষ্ঠি ভোগ করবে না। বরং সরাসরি ভোগ করবে শিল্প-কলকারখানার মালিক, বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্টের মালিক, যানবাহনের মালিকসহ উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ওপরের অংশ। বলাবাহুল্য এর পরোক্ষ ফল ভোগ করবে নিম্নবিত্ত, শ্রমিক, কৃষক ও অন্যান্য খেটে খাওয়া মানুষ। এই আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং যারা মাঠে সক্রিয় তারা মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে আসা। তারা নিজেদের 'বাম" বা 'প্রগতিশীল" ভাবতে ভালবাসেন। তাহলে তাদের প্রশ্ন করতে হবে শ্রেণিস্বার্থ এবং জাতীয় স্বার্থের মধ্যে মিল এবং দ্বন্দ্বগুলো কী? প্রশ্নগুলো খোলা মনে তাদের বিচার করার দরকার আছে।

বাংলাদেশের গ্যাস, তেল ও বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিত করবার দিক থেকে যদি দেখি তাহলে এই আন্দোলনের সঙ্গে ধনী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিরোধের জায়গা রয়েছে। ধনী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিত করতে চায়। তাহলে বিকল্প কী? জাতীয় তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটির কথা যদি আমি বুঝে থাকি তাহলে তারা বলছেন বাংলাদেশ তার মালিকানায় জাতীয় প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্বেই এই কাজ শুরু করতে পারে। যেমন, পেট্রোবাংলা। ব্যাপারটা এত সহজ নয়। এটা সম্ভব যদি একটি গণমুখী ও সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সরকার ক্ষমতায় আসে। যদি দাবি করি আমরা পারি, কিন্তু বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানির কাছে ধরা দিচ্ছি নিজেদের হীনম্মন্যতার কারণে, সেটাও জটিল ও বহুস্তরীয় সমস্যার সরলীকরণ। (দেখুন, 'আমরা পারব না'—এই হীনম্মন্যতাই বড় বাধা', আনু মুহাম্মদ; প্রথম আলো ২১ জুন ২০১১)। আমরা হীনমন একথা ঠিক, কিন্তু বড় বাধা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক, এমনকি কারিগরী দক্ষতার অভাবও বটে। এই বিষয়গুলো নিয়ে তেল-গ্যাস রক্ষার আন্দোলন যতো খোলামেলা আলোচনা তর্কবিতর্ক করবে ততোই তার শক্তির বিকাশ ঘটবে।

জাতীয় স্বার্থ রক্ষার কর্মসূচী সফল হোক এই কামনাই করি।

২২ জুন ২০১১। ৮ আষাঢ় ১৪১৮। শ্যামলী।