জাসদের ভ্রান্তিবিলাস ও খুলে যাওয়া প্যান্ডোরার বাক্স

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 27 August 2015, 01:26 AM
Updated : 27 August 2015, 01:26 AM

বেশ কিছুদিন আগে পারিবারিক আমন্ত্রণ ও এক আড্ডায় হঠাৎ তেতে ওঠা এক ভদ্রলোকের কথা মনে পড়ে গেল। বয়সী ভদ্রলোক স্থানীয় পূজা সমিতির নেতা গোছের কেউ একজন। বিদেশে বা প্রবাসে আমাদের মতো অসহায় মানুষের সংখ্যা নগণ্য। আমরা কারও পাতে পড়ার মতো কেউ নই। এক কোণে বসে কেউকেটাদের গল্প শুনি। কার কটা বাড়ি, কোন মডেলের গাড়ি, কার কত দামের শাড়ি বা পাঞ্জাবি শুনে দেখে চোখ ঝলসে যায়। ভাবি আমার মতো যারা তারা কি আসলে মানুষ?

তবে সেদিনের আড্ডাটি ছিল ভিন্ন ধরনের। সেদিন একদল মধ্যবয়সী বাঙালি তাদের অতীত ও ইতিহাস নিয়ে মেতে উঠেছিলেন। বিষয়ের কারণে আমিও একটু আধটু যোগ দিচ্ছিলাম। একজন তার অভিজ্ঞতা থেকে তৎকালীন জাসদের কথা বলতে গিয়েই বিপদ ডেকে আনলেন। তেতে ওঠা মানুষটি কিছুতেই মানবেন না। চেঁচিয়ে চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলে পরে বলতে লাগলেন তার শরীর খারাপ লাগছে। এই বয়সে প্রেসার, সুগার আর মনস্তাত্তিক চাপের কথা ভুলে এমন উগ্রতার আরেক নাম যে 'জাসদ', সেটা প্রায় ভুলতে বসেছিলাম।

দেশের রাজনীতিতে হঠাৎ চাগিয়ে ওঠা জাসদ প্রসঙ্গে আবার তা মনে পড়ে গেল। আজ যে বা যারা জাসদের ভূমিকার কথা তুলেছেন আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই। কী কারণে বা কেন তারা তা তুলছেন জানি না। তবে 'অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে' সবাই যদি সমান হয়, এরাও অন্যায়কারীদের লালন-পালনের দায় এড়াতে পারেন না।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাসদ-তোষণের দরকার দেখেছি পঁচাত্তরের পূর্বে আর এবারের ক্রান্তিকালে। সে সময় অর্থাৎ স্বাধীনতার পর বিএনপি নামে কোনো ভূত বা দেবতার অস্তিত্ব ছিল না। সেটা ছিল সিক্রেট এজেন্ডা। মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী, ভাসানী ন্যাপ, চৈনিক কমিউনিস্টদের সময় তখন প্রতিকূলে। তারা ঘাপটি মেরে পেছন থেকে কাজ হাসিলের জন্য সদ্য-জোয়ান ও স্বাধীনতার পর দলছুট তারুণ্যের অপর নাম জাসদকে বেছে নিয়েছিলেন।

তাই দেখা যেত, জাসদের মিছিল মিটিং মানে হাজার হাজার মানুষের ভীড়। রব, জলিল, সিরাজুল আলম খানরা সেখানে এসে দাঁড়ালে মনে হত মার্কস-এঙ্গেলস এসে দাঁড়িয়েছেন সামনে। খোদ লেনিন, মাও সেতুং যা শোনেননি– জ্যোতি বসু, মনি সিংহ, ভাসানীরা যা জানতেন না– এইসব তরুণরা তাও বলে দিতেন। তাদের চোখে, সমাজতন্ত্র খালি সমাজতন্ত্র হলে হয় না, তাকে 'বৈজ্ঞানিক'ও হতে হয়!

আমরা তখন ছাত্র। ছাত্রদের ভেতর এদের দাপট এমনই যে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনে প্রচারে আসা ছাত্রলীগ নেতা ও এখনকার মন্ত্রী জনাব ওবায়দুল কাদের আর তখনকার তুখোড় নেতা বাহালুল মজনুন চুন্নুকে আলাওল হলে তালাবন্দি করে রেখেছিল তারা। মধ্যরাত অব্দি স্লোগান দিয়েছিল, 'আলাওলের ভিতরে, কাদের চুন্নু কাঁদেরে'।

শুধু ছাত্র ফ্রন্টে কেন, জাতীয় পর্যায়েও ওদের জেল্লা দেখেছি আমরা। শ্রুত যে, স্বয়ং বঙ্গবন্ধুও নাকি সূত্রাপূর কোতোয়ালীতে তাঁর বিরুদ্ধে ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ মেজর জলিলের প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু বাঘের বল বার বছর। আর যদি কেউ অন্যের পায়ে ভর দিয়ে চলে এক সময় তো মুখ থুবড়ে পড়তেই হবে।

পড়া-ওঠা সময়ের হিসাব। কোনো দেশ বা জাতিতে কোনো দল বা রাজনীতি চিরকাল এক জায়গায় থাকে না। কিন্তু পতনের ঘণ্টাধ্বনি বা চিত্রটাই তো কেমন কেমন। বঙ্গবন্ধু ও চার নেতা যখন নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার– দেশ যখন পাকিস্তানের ছায়া প্রায়– দেশপ্রেমী জাসদ নেতাদের আর দেখা নেই। জলিল সাহেব তো পাকিস্তানের বিছানা, লিবিয়ার আশ্রয়, জেলখানা কিছুই বাদ রাখেননি। খেয়াল করুন, তার আগে আর কোনো মুক্তিযোদ্ধার এমন বিপথগামিতা বা কলঙ্কিত হবার কাহিনি নেই।

মুশকিল হল, তারা যে বিপ্লবের ধারণা দিয়েছিলেন তাতে সামিল হওয়া সৎ ও প্রতিভাবান মেধাবীদের নিয়ে এরা আওয়ামী রাজনীতির ওপর নানা কারণে বীতশ্রদ্ধ হয়ে মুক্তির পথ খুঁজছিলেন। কিন্তু তারা কি জানতেন যে, লুট করা ব্যাংকের টাকায় বিপ্লবের স্বপ্ন দেখানো নেতারা আসলে এজেন্ট? আজ অব্দি সে সব টাকার হিসাব মেলেনি। আজ পর্যন্ত কোনো দায়ও স্বীকার করেননি জাসদের নেতারা।

'কাপালিক' নামে পরিচিত রহস্যময় নেতা সিরাজুল আলম খানের কধা আমরা সবাই জানি। তাঁর মেধা, প্রজ্ঞা, নেতৃত্বের কথাও শুনেছি আমরা। তিনি কেন সরে গেলেন? কেউ কি জানেন কোথায় কেন কী কারণে তাঁর এই আত্মবিস্মৃত অবস্থান? আ স ম রব এখন কী বলেন আর কী করেন তাতে জাতির কিছু আসে যায় না। কিন্তু এই তিনি বঙ্গবন্ধুর চামড়ায় জুতো বানাবার মতো অশ্‌লীল কথা বলার পরও জোটের মন্ত্রী হয়েছিলেন!

ফলে এ কথা বলা যাবে না যে, জাসদের নেতারা শুধু এবারই মন্ত্রী হয়েছেন। ওই যে বলছিলাম, জাতির কপালে বিএনপি-জামাত জোটের ডেকে আনা অগণতান্ত্রিক আপদ ও ভোট বর্জনের কালে আওয়ামী লীগের দরকারেই ইনুদের ডাক পড়ে্ছিল। কিন্তু তার মানে কি এই যে, তাঁর পঁচাত্তরের ভূমিকা সাফ হয়ে গেছে? জাসদের নেতারা মোশতাকের চাইতে কোনো অংশে কম ভূমিকা রাখেননি। কথা ও গালাগালিতে তারা সাকা চৌধুরীর চেয়ে কম যাননি। আর জোট বাঁধা বা সঙ্গে থাকা তো বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছেলেখেলা। যখন ইচ্ছে পাওয়ার গেইমে বড় দলের একটার সঙ্গে থাকলেই হল!

এসব কিছুর চাইতে এখন যে প্রসঙ্গ উঠে এসেছে সেটাই ইতিহাস ও জাতির জন্য জরুরি। বর্তমান সরকারের একটি মহল মনে করে বিএনপির নাম-নিশানা মুছে দেওয়াই রাজনীতি। সন্দেহ নেই, তারেক জিয়া ও খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে ধ্বংসাত্মক কিছু বিষয় রয়েছে। একুশে আগস্টের মতো আক্রমণের পেছনেও দলটির নেতৃত্বের একাংশের হাত রয়েছে। এসব নিয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনাসহ সংশ্লিষ্ট জনদের উদ্বেগ ও ক্ষোভ থাকতেই পারে। কিন্তু এ সুযোগে জিয়াউর রহমানের কারণে কর্নেল তাহেরকে বড় করে তোলা ও তাঁর ভূমিকা গৌরবময় করার কাজটি আত্মঘাতী।

কর্নেল তাহেরের পুত্র যীশু আমার প্রিয়জন। আমাদের বাড়িতেও এসেছিল সে। তার মা ও পরিবারের জন্য আমার মতো অনেকের ভালোবাসা আর শুভেচ্ছা চিরকালীন। তাহেরের ফাঁসি একজন পা-হারানো মুক্তিযোদ্ধার প্রতি সামরিক শাসকের বড় অন্যায়; আমরা কোনো দিন তা মেনে নিইনি। কিন্তু এই পরিণতির দায়ভার কি তাঁকেও নিতে হবে না?

সে সময়, অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর উত্তাল সময়ে আমরা গণবাহিনীকে ভয়ের চোখে দেখেছি। দেশের কর্তৃত্ব নেবার জন্য তারা উগ্র ভারত-বিরোধী সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক প্রচারপত্র বিলি করেছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ কেন দাফন করা হয়েছিল, কেন তা ভাসিয়ে দেওয়া হয়নি এ নিয়েও ছিল তির্যক মন্তব্য। এগুলো অস্বীকার করে ভাড়াটিয়া লেখক দিয়ে বই লিখিয়ে কাউকে হিরো বা জাতির ত্রাতা বানানো যায় না।

কর্নেল তাহের কবে কখন জনতার সামনে জনতার জন্য রাজনীতি করতেন? আর কী সেই আদর্শ? জাসদের এমন কোনো নেতা কি ছিলেন যিনি মনে করতেন তাহেরই সব? আজ এত বছর পর তারা যদি আয়নায় চেহারা দেখেন, নিজেরাই লজ্জা পাবেন।

আগস্টে রক্তের দাগ শুকোবার আগে আগা খান গোল্ডকাপের যে খেলায় পেনাং আর ব্রাদার্স ইউনিয়ন লড়ছিল, সে সন্ধ্যায় হাজার হাজার লিফলেটে মোশতাকের চোখের ঘুম কেড়ে নেওয়া জাসদ কি জানত তাদের কথিত বিপ্লবের পেছনে ঘাপটি মেরে ছিলেন জিয়াউর রহমান? 'সিপাহী জনতা ভাই ভাই' বলে সামরিক বাহিনীকে মাঠে নামানোর সে চেষ্টা সফল হলে কী হত কে জানে! তবে এটা জানি যে, জাসদের হাতে কিছুই থাকত না।

আজ যারা জাসদ নেতা হয়ে আগের মশালটি আবার জ্বালানোর চেষ্টা করেন, তাদের উচিত অতীতের ভুলের জন্য মার্জনা চাওয়া। তারা শুধু নিজেদের নয়, এদেশের লাখ লাখ স্বপ্নবাজ তরুণ-তরুণীর মনেও আঘাত দিয়েছিলেন। এই দেশ ও জাতির সামনে এমন উজ্জ্বল কিছু রাখেননি যাতে আমরা বলতে পারি যে, তাদের ভূমিকা ছিল গৌরবের। কর্নেল তাহের তাঁর অবদানের জন্য স্বীকৃত হবেন। জাসদের যেটুকু ভালো, যেটুকু পজেটিভ, আমরা তাকে সম্মান জানাব।

কিন্তু মন্ত্রিত্ব বা পাওয়ার গেইমে অতীতের ভ্রান্তিবিলাস ঢাকা পড়বে না। খালেদা জিয়া বা তাদের দলের বিরুদ্ধে রুটিন করে 'জেহাদ' ঘোষণা করলেই কি পঁচাত্তরের ভূমিকায় ছেদ পড়বে? আজ দেশ যখন অতীতের জঞ্জাল আর পাপ ধুয়ে সাফ হতে চাইছে, তখন সবার উচিত নিজ নিজ কৃতকর্মের জন্য মাফ চেয়ে অবস্থান পরিষ্কার করে নেওয়া। আজ আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন সে সব কথা, একদিন কিন্তু মানুষও বলবে।

জাসদ যখন গঠিত হয় তখন আমরা ভেবেছিলাম তারুণ্য ও স্বপ্নের যুগলবন্দি আধুনিক রাজনীতি দেখা যাবে। সে আশায় গুড়েবালি। গণবাহিনী, উদ্দেশ্যহীন বিরোধিতা, নেতাদের সুবিধামতো জায়গা-বদল, মৌলবাদে বিশ্বাস আর হঠকারিতায় পুরো ব্যাপারটাই রহস্যময় আর ধোঁয়াসা হয়ে উঠল। তারপরও তাদের টিকে থাকার যে কারণ, সেখান থেকে শক্তি নিয়ে নিজেদের ভুল-ভ্রান্তি মোচনে এগিয়ে না এলে এক সময় এ নামের অস্তিত্ব থাকবে না।

জাসদের ভ্রান্তি আমাদের রাজনীতির মায়জাল, কূ্হক। তার সত্য উন্মোচন আসলেই জরুরি। রাজনীতিতে চিরকালীন শত্রূ-মিত্র নেই, এমন কথা ও নীতিতে বিশ্বাসী জাসদের এসিড টেস্টটাও হোক তবে। দেখা যাক কী আছে প্যান্ডোরার বাক্সে!

অজয় দাশগুপ্ত: কলামিস্ট।