জীবনের পাতায় পাতায় (৩)

বেবী মওদুদ
Published : 10 Sept 2010, 12:46 PM
Updated : 10 Sept 2010, 12:46 PM

শুরুর কিস্তি
——————————–
স্মৃতিকথা ধারাবাহিক
——————————–
কিস্তি ২-এর পর

ভারত ভাগের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাও ভাগ হলো। পাকিস্তানের প্রদেশ হলো পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিমবঙ্গ ভারতের প্রদেশ। আমার বাবা পাকিস্তানের পূর্ববঙ্গে এসে প্রথমে খুলনা জজ কোর্টের সিনিয়র মুন্সেফ হিসেবে চাকুরিতে যোগদান করেন । তখনও ভিসা পদ্ধতি না থাকায় কলকাতা ও গ্রামের বাড়িতে আমাদের যাতায়ত ভালো ছিল। বাড়িতে

……..
বেবী মওদুদ, রাওয়ালপিন্ডি, কলেজে প্রথম বর্ষে অধ্যয়নকালীন
……..
শিক্ষক এসে বড় দু'ভাইকে লেখাপড়া করাতেন। আমার বয়স তখন একবছর হবে। কোন স্মৃতি আমার মনে নেই। তবে মায়ের কাছে শুনেছি আমার খুব জ্বর হতো। রোগা পাতলা ছিলাম। খুলনার আশেপাশের বাড়ির মেয়েরা মায়ের কাছে আসতো, গল্প করতো সেলাই শিখতো। একটা ভালো আড্ডা হতো। আমার মা পশ্চিমবঙ্গ থেকে এসেছেন-এটা তাঁরা খুব সহানুভূতির সঙ্গে দেখতেন। কলকাতার কথা শুনতেন। আমার বাবাকে কোর্টের কাজে বেশি ব্যস্ত থাকতে হতো। পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা, স্বাভাবিক ভাবেই সবাই একটু অন্য চোখে দেখতো তাঁকে এবং তার কাজকর্মকে। আমাদের চাল-চলনও সবাই পর্যবেক্ষণ করতো। আমাদের পরিচয় হয়ে ওঠে রিফিউজি।

খুলনায় তখন পশ্চিমবঙ্গ থেকে অনেকে এসে বসবাস করতো। তাদের কেউ কেউ আমাদের বাসায় এলে সবাই সুখ-দুঃখের গল্প করতো। এখানকার ভালো মন্দ নিয়ে কথাও বলতো। সবার ধারণা ছিল, পাকিস্তানে যখন এসেছি তখন আর জানের ভয় নেই। দাঙ্গা হলেও মুসলমান চিহ্নিত করে কেউ মারতে আসবে না। তবে বাপ-দাদার ভিটে মাটি ছেড়ে এভাবে নতুন মাটিতে আশ্রয় নেয়ায় মনে সর্বদা আশঙ্কা ছিল। আমার মায়ের পছন্দ ছিল এখানকার মাছ-সব্জি এবং কাজের লোক। পেট ভরে ভাত খেতে পেলে অল্প বেতনে কাজ করতে রাজী হয়ে যেত। ফলে আমাদের বাড়ির কাজের লোকরা পরিবারের লোক হয়ে যেত। আমাদের কোলে পিঠে করে মানুষ করতো। বাড়িতে বয়স্কা মহিলা কাজ করতেন, যাকে আমরা বুজি বলে ডাকতাম।

খুলনায় আমরা তিন ভাই-বোন ঘরে বসেই খেলতাম। মাত্র পাঁচ-ছয় মাস থাকার পর আমার বাবাকে টাঙ্গাইল কোর্টে বদলি করা হয়। লঞ্চ চড়ে ঢাকা হয়ে রেলগাড়িতে ময়মনসিংহ হয়ে টাঙ্গাইল পৌঁছাতে খুব কষ্ট হয়েছিল আমাদের। টাঙ্গাইলে এসে আমার বড় ভাই জাহাঙ্গীর বিন্দুবাসিনী হাই স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন। সেখানে তিনি পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছিলেন। এখানে আসার পর আমার বাবা খুব খুশি হন। টাঙ্গাইলের মানুষের সাংস্কৃতিক আগ্রহ ও জীবনধারা তার পছন্দ হয়েছিল। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাকে অতিথি করে নিয়ে যেত। বাড়িতে এসেও লোকজন আড্ডা দিত, পরামর্শ নিত। এখানে পুরোন লাইব্রেরি থাকায় বাবার বই পড়ার ভালো সুযোগ হয়। আমার মা খুব স্বস্তিতে ছিলেন। আমার পরের ভাই হুমায়ুনের জন্ম হয় এখানে। তাকে আমি কোলে নিতে চাইতাম, শুনেছি। টাঙ্গাইলের দুধ ও মিষ্টি আমাদের খুব প্রিয় ছিল। টিনের দুধ তখনও এদেশে মনে হয় আসেনি। গোয়ালা এসে রোজ সকালে দুধ দিয়ে যেত। রোজ দুধভাত খেতাম আমি। আর খাঁটি ঘি পাওয়া যেত। ঘি দিয়ে গরম ভাত খাবার অভ্যাসও হয়ে ওঠে আমাদের। টাঙ্গাইলের কথা আমার মায়ের মুখে বহুবার শুনেছি।

৭ নভেম্বর ১৯৪৯ সালে টাঙ্গাইল থেকে সাব জজের পদোন্নতি নিয়ে আমার বাবা পাবনা বদলি হলেন। আবার সব গোছগাছ করে আমরা পাবনা এলাম। আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে মেজভাই হারুনও পাবনা জেলা স্কুলে ভর্তি হলো। আমি তখন অনেকটা একাকী হয়ে যাই। এখানে থাকতে মা সিনেমা দেখতে যেতেন আমাদের কোলে নিয়ে। তার এই অভ্যাসটি আমার মধ্যেও সঞ্চারিত করে দেন তিনি। ছবি দেখতে না হোক, গান শুনতে আমি খুব পছন্দ করতাম।

পাবনায় সাড়ে চারমাস থাকার পর আমার বাবা ২৪ মার্চ ১৯৫০ সালে ময়মনসিংহ কোর্টে সাবজজ পদেই বদলি হন। আবার সব গোছগাছ করে আমাদের নিয়ে তিনি ময়মনসিংহে চলে এলেন। এই বাঁধাছাদার ব্যাপারটা আমার মায়ের একবারে পছন্দ ছিল না। এখানে আমার ছোট বোন রুবির জন্ম হয়। বড় দু'ভাই জেলা স্কুলে ভর্তি হলেন। এখানে একবার ইটের গাদায় পড়ে গিয়ে আমার কপাল কেটে প্রচুর রক্ত পড়ে। হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে সেলাই করে আনা হয়। সেই দাগ আমার কপালে এখনও আছে। এখানে বাড়িটা বেশ বড় থাকায় আমাদের খেলাধুলার সীমা ছিল না। আমরা বাগান করাও শিখলাম। আমাদের লাগানো গাছে পাতা ও ফুল হলে খুশির সীমা থাকতো না। ফুলের নাম শিখি। গোলাপ, বেলি, শিউলি, জবা, বকুল। লেখাপড়া না করলেও শুনে শুনে অনেক কিছু মুখস্ত করে ফেলতাম। আমরা সবাই একসঙ্গে খেতে বসতাম মাদুর বা চৌকির ওপর দস্তরখান বিছিয়ে। সাদা কাপড়ের দস্তরখানে আমার মা সুতোর কাজ করে দিতেন। খেতে বসে ডালের বাটি না দেখলে আমার ভাইরা খুব রাগ করতো। তখন পাশের বাড়ি থেকে একবাটি ডাল আনতে হতো।

ময়মনসিংহ বেশ সংস্কৃতিসম্পন্ন শহর হওয়ায় আমার বাবার কাছে অনেকেই আসতেন। লাইব্রেরির বই এনে পড়াও ছিল বাবার সন্তুষ্টি। আমার মা এখানকার সিনেমা হলেও নিয়মিত ছবি দেখতে যেতেন। মায়ের সঙ্গি যথারীতি আমিই হতাম। মা বলতেন আমি তার কোলে অনেকসময় ঘুমিয়ে যেতাম। সেই সময় বোম্বাইয়ের হিন্দি ছবি ও কলকাতার বাংলা ছবি এখানকার সিনেমা হলে খুব চলতো। বহুৎ দিন হুয়ে, ইনসানিয়াৎ ছবিগুলির নাম তখন শুনি। ছবি বিশ্বাস, সন্ধ্যারাণী, অশোক কুমারের নামও শুনি।

এক বছর থাকার পর আমার বাবা যশোর জেলা জজ কোর্টে সাব-জজ হিসাবে বদলি হন। এখানে ১১. ৪. ১৯৫১ থেকে প্রায় তিনবছর ছিলেন। এই সময় যশোরে নির্বাহী ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন হাতেম আলী খান (হায়দার আকবর খান রনো ও হায়দার আনোয়ার জুনোর পিতা) এবং জেলা জজ ছিলেন আবদুল জব্বার (রাশেদ খান মেননের পিতা)। এখানে আমাদের বাসাও ছিল বেশ কাছাকাছি। ফলে তিন পরিবারের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। তিন বাড়িতেই বেড়ানো, খেলাধুলা ও খাওয়াদাওয়ার অন্ত ছিল না। মেনন ভাইয়ের ছোট বোনরাও ছিল আমার খেলার সাথী। রনো-জুনো ভাইদের কোন বোন না থাকায়, আমার একটা বিশেষ আদর ছিল তাদের কাছে। চাচা-চাচীও আমাকে খুব স্নেহ করতেন। একদিন বিকালে তাদের বাসায় ভাইদের সঙ্গে আমিও গিয়েছি। খাবার টেবিলে চাচী আমাদের নাস্তা খেতে দিলেন। হঠাৎ আমার হাত থেকে পড়ে দুধের কাপ ভেঙ্গে গেল। দুধও ছড়িয়ে পড়লো। আমি তো ভয়ে কেঁদে ফেললাম। রনো ভাই চীৎকার করে বললেন, "মা শীঘ্রি এসো। বেবী চায়ের কাপ ভেঙ্গে ফেলেছে।" চাচী এসে দেখে প্রথমে হেসে ফেললেন। তারপর আমার চোখের পানি মুছিয়ে আদর করে বললেন, "ভেঙ্গেছে তো কী হয়েছে"। ওকে আবার দিচ্ছি।
হাতেম আলী খান চাচা ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। তাকে দেখেই আমার বড় ভাই আদর্শ হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ার হবেন এবং হয়েছেনও। আমার বাবার সঙ্গে তাঁর খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। তার প্রধান কারণ হলো বাবার সঙ্গে তিনি সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতে পারতেন এবং বাবার আলমারি ভর্তি বই পড়ার সুযোগ ছিল।

আমাদের বাড়িটা ছিল দোতলা। সন্ধ্যাবেলায় হ্যারিকেন বাতি জ্বালানো হতো। নীচের তলায় রান্নাঘর, বসার ঘর, পড়ার ঘর ছিল। দোতলায় শোবার ঘর ছিল। একটা লম্বা বারান্দা ছিল। নীচতলায় উঠোনে আমরা প্রথম এককা-দোককা খেলা শিখি। ওপরে শোবার ঘরের পাশে ছিল জানালা। সেই জানালার বরাবর নীচে ছিল রাস্তা। সেখান দিয়ে কেউ হেঁটে গেলে, রিকশা বা গরুর গাড়ি গেলে ওপরে জানালার কাঁচ ছুঁয়ে তা খাটের ঠিক ওপরের ছাদে দেখা যেত। খাটে শুয়ে শুয়ে আমরা দেখতাম। নিজেরাও নীচে গিয়ে হাঁটতাম, মুখ ভ্যাঙ্গাতাম, ওপরে অন্যরা দেখতো।

আমাদের বাসার সামনে একটা বড় পুকুর ছিল। পুকুরের পানি খুব পরিষ্কার এবং টলটলে ছিল। আমরা গোসলও করতাম। কাপড় চোপরও ধোয়া হতো। আমাদের সাতটা হাঁস ঐ পুকুরে সারাদিন থাকতো। আর সন্ধ্যা নামার সঙ্গে প্যাঁক প্যাঁক শব্দ তুলে ঘরে এসে তাদের থাকার ঘরে থাকতো। মুরগীও পালতেন আমার মা। আমার নিজস্ব একটা হাঁস ছিল সাদা-কালো রঙের। তার নাম ছিল ময়না। সন্ধ্যাবেলা আমি তাকে কোলে করে নিয়ে আসতাম। একদিন তিনটা হাঁস যথারীতি এলো না। আমার হাঁসটাও এলো না। আমি পুকুরের চারপাশ ঘুরে কত খুঁজলাম, কাঁদলাম, কিন্তু পেলাম না। সবাই বললো, জঙ্গলের শিয়াল এসে ধরে নিয়ে গেছে। পুকুরের কোণায় গাছপালা ভর্তি একটা জঙ্গল ছিল। সেখানেও গিয়ে খোঁজা হয়েছিল। আমার বাবা বললেন, শিয়াল মশাই হাঁস কি রেখে দিয়েছে। ও খেয়ে শেষ। এরপর আমি অনেকদিন হাঁসের মাংস খাইনি।

যশোরেও আমরা দস্তরখান বিছিয়ে খাওয়া-দাওয়া করতাম। ছুটির দিনে সকালের নাস্তা হতো খিচুড়ি-ডিম-মাংস। কখনও কখনও খুদের জাউ রান্না করতেন মা। আলু ভর্তা বা ডিম ভাজা দিয়ে সেই জাউ ভাত খাবার কথা আমার আজও মনে আছে।

যশোরে আমার ছোট্ট ভাই মামুন ও রাঙ্গার জন্ম হয়। মামুন জন্মের পর কাঁদেনি, জ্ঞানহীন ছিল। ধাত্রী তাকে থাপ্পর মারছিল বাইরে এনে। হঠাৎ সে কেঁদে ওঠে একবার, তারপর কাঁদতে থাকে। বাইরে বসে সবার সঙ্গে এটা আমি দেখেছি যা আমি আজও ভুলে যাইনি। আমার ছোট ভাই রাঙ্গা একেবারে লাল টুকটুকে হয়েছিল বলে ওর নাম রাখা হলো 'রাঙ্গা'। সবাই বলতো আমার মা খুব আম খেতেন বলেই রাঙ্গা অমন টুকটুকে লাল রঙের হয়। আমি তখন একটু বড় হয়েছি। তাই কোলে নিতে পারতাম।

যশোরে থাকতে আমার পর পর দু'বার টাইফয়েড জ্বর হয়েছিল। কিছু খেতে ইচ্ছে হতো না। শরীর শুকিয়ে প্রায় পাটখড়ি আকার ধারণা করেছিল। তখন থেকেই আমি রোগা পাতলা হয়ে বড় হয়ে উঠেছি। দ্বিতীয় বার যখন টাইফয়েড হয় আমার অবস্থা একেবারে মরণাপন্ন। খুলনায়ও ওষুধ পাওয়া যায়নি। আমার বাবা কলকাতায় লোক পাঠিয়ে ওষুধ আনান। সেই ওষুধ খেয়ে আমি ভালো হয়ে উঠি। ভাগ্যিস তখনও ভিসা পদ্ধতি চালু হয়নি। আর একবার দোতলার বারান্দায় রেলিং ধরে লাফাতে গিয়ে আমি নীচে পড়ে যাচ্ছিলাম। ভাগ্যিস গ্রিল ধরে ফেলি এবং ঝুলতে থাকি। আমার বড়ভাই বারান্দায় ছিলেন। তিনি আমাকে বহুকষ্টে তুলতে সমর্থ হন। নীচে লোক জড়ো হয়ে যায় এবং চাদর ধরে থাকে, যদি আমি পড়ে যাই। খুব বকা খাই মায়ের কাছে। এরপর বারান্দায় গেলেও ভয়ে আমি আর রেলিংয়ের কাছ ঘেষতাম না।

আমার বড় দু'ভাই জেলা স্কুলে পড়তেন। তাদের বই থেকে কবিতা শোনাতেন। ঐ সময় কবিতা মুখস্ত করতে সমর্থ হই। 'আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে।' এবং 'মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই'-কবিতা দুটি আমার খুব প্রিয় ছিল। তখন আমি বাসায় বসে হাতের লেখা ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের 'বর্ণমালা' বই থেকে পড়া শিখলাম। 'বর্ণমালা' ছিল দু'খন্ডের। আমার মায়ের সঙ্গে আমরা সিনেমা দেখতে যেতাম। হিন্দী ও বাংলা ছবি দেখা হতো। হিন্দী ছবির গানগুলো মুগ্ধ হয়ে শুনতাম।

যশোর শহরের প্রান্তে এক বাসায় আমরা বেড়াতে যেতাম। সেখানে একটা বড় খাল পার হতে হতো। পার হবার জন্য ছিল দুই বাঁশের একটা সাঁকো। আমার বড় দু'ভাই বেশ তর তর করে পার হয়ে গেলেও আমি ও আমার ছোঠ ভাই হুমায়ূন খুব ভয় পেতাম। আমাদের সঙ্গে যে চাপরাশি যেত সে আমার ছোট ভাইকে ঘাড়ে বসিয়ে আমার হাত ধরে ধরে পার করতো। প্রথম দিকে ভয়ে আমি কেঁদে ফেলতাম। পরে বড় ভাইদের দেখে আমি একাই বাঁশ ধরে ধরে পার হয়ে যেতাম। খালটা পার হয়ে যাবার পর আমরা একটা বাসায় যেতাম তারা আমাদের এতো আদর যত্ন করতো! আমার আজও মনে আছে। বড় বড় রসগোল্লা আর দুটো করে ঘিয়ে ভাজা ডিম পোঁচ খেতে দিতো। বেশ গ্রামীণ পরিবেশ ছিল । আমরা ঘুরে ঘুরে সব দেখতাম। সেখানে আমরা অনেকরকম পাখি দেখলাম।

এখানেও আমরা বাগান করেছিলাম। বড় বড় তালগাছ ছিল। রাতের বেলা পাকা তাল পড়তো ধুপ ধুপ শব্দ করে। আমার মা তালের ফুলুরী পিঠা তৈরি করতেন। তালের গন্ধ সারা বাড়ি ভরে থাকতো। সেই পিঠে খাওয়ার স্বাদ এখনও ভুলতে পারিনি।

যশোরে থাকতেই একবার মায়ের সঙ্গে আমরা তার নানাবাড়ি বোলপুরের বামুন্ডি গ্রামে গিয়েছিলাম। বোলপুর স্টেশনে মাত্র এক মিনিট ট্রেন থামে। মা আমাদের ঠেলে ঠুলে ট্রেনের দরজায় লাগানো পালকিতে উঠিয়ে নিজে উঠলেন। মনে আছে আমরা অনেক রাতে পালকির ভেতরে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বাড়ি পৌঁছালাম। সেবার আমার ও আমার ছোট্ট ভাই হুমায়ুনের হাতে খড়ি মা খুব ধুমধামের সঙ্গে তার নানার কাছে করেছিলেন। তিনি খুব শখ করে এ কাজটি করেছিলেন। আমার বাবা যেতে পারেন নি। আমার মায়ের মামী আমাদের নতুন জামা কাপড় কিনে দেন। ঘরে নানারকম খাবার তৈরি হয়েছিল। আমরা দু'ভাই-বোন বড় আব্বার কাছে প্রথমে আরবী, তারপর বাংলা বর্ণ পড়লাম। আসাদ মামা আমাদের ইংরেজি বর্ণমালা পড়ান। তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তেন। আমার মা ঘরোয়াভাবে হলেও এই উৎসবমুখর অনুষ্ঠানটি করতে পেরে খুব উৎফুল্ল হয়েছিলেন। সেবার আমার নানা বাড়ি বেড়–গ্রামেও গিয়েছিলাম। মোষের গাড়ি চড়ে যেতে হবে বলে হুমায়ুন প্রথমে চড়তে চায়নি। খুব কেঁদেছিল।

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতনের পর ভিসা পদ্ধতি চালু হবার আগে আমার বাবা আমাদের সবাইকে নিয়ে কলকাতা বেড়িয়ে আনেন। সেটাই ছিল তাঁর শেষ যাত্রা। কলকাতায় আমরা মায়ের মামুজানের বাসায় থাকতাম। তিনি পরে আর কখনও যান নি। সরকারি চাকুরির কারণে তিনি পাসপোর্টও করেন নি। কলকাতায় তাঁর সঙ্গে আমার বড় দু'ভাই ও আমিও বেড়াতে যেতাম। তিনি দোকানে বসিয়ে রসগোল্লা ও সন্দেশ খাইয়েছিলেন। তবে আমার মায়ের সঙ্গে আমরা কয়েকবার কলকাতা, বামুন্ডি ও বেড়ু–গ্রামে নানাবাড়ি বেড়াতে যেতাম। আমার মায়ের পাসপোর্টে আমাদের নাম দেয়া হয়েছিল।

২০ এপ্রিল ১৯৫৪ সালে আমার বাবা বগুড়ায় সাবজজ হিসাবে বদলী হয়ে যান। অনেক স্মৃতিবিজড়িত যশোর শহর ছেড়ে যাই আমরা।

baby.maudud@gmail.com
আর্টস প্রোফাইল: বেবী মওদুদ


ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts