ব্লগার হত্যা মামলা: হঠাৎ আলোর ঝলকানি

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 25 August 2015, 02:21 AM
Updated : 25 August 2015, 02:21 AM

নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়। তার আগে ওয়াশিকুর রহমান। তার আগে একই 'অপরাধে' বিদায় নিয়েছিলেন অভিজিৎ রায়। আর সে ঘটনার বছর দুয়েক আগে রাজীব হায়দার।

এই যুবাদল মুক্তবুদ্ধির আকাশে পাখা মেলতে চেয়েছিলেন। কলমকে তরবারির চেয়ে শক্তিশালী মনে করার মধ্যে যে ভুল আছে, তা এঁরা জেনে বা না জেনে করে ফেলেছিলেন। এর জন্য তাদের পরিবারের পাশাপাশি পুরো জাতিকেই মূল্য গুণতে হচ্ছিল। একের পর এক ব্লগার হত্যার ঘটনা নিয়ে ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ, হতাশা আর অসহায়তার মধ্যে 'হঠাৎ আলোর ঝলকানি'র মতো এ বিষয়ে কিছু 'সুসংবাদ' আমাদের অনুসন্ধিৎসু করে তুলেছে। ইতোমধ্যে একাধিক ব্লগার হত্যা রহস্য উন্মোচিত হয়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বক্তব্য দিয়েছেন। বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত ব্রিটিশ নাগরিক ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের অন্যতম নেতা তৌহিদুর রহমানের পরিকল্পনায় লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় ও অনন্ত বিজয়কে হত্যা করা হয় বলে জানান র‌্যাবের মুখপাত্র মুফতি মাহমুদ খান।

তৌহিদুর রহমান এক সময় বাংলাদেশ বিমানে চাকরি করতেন। তিনি ১৯৯০ সালের দিকে যুক্তরাজ্যে চলে যান। আইটি বিষয়ে পড়াশুনা শেষে সে দেশের নাগরিকত্ব লাভ করেন। যুক্তরাজ্যে যাওয়ার আগেই আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান জসিম উদ্দিন রহমানির সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সে দেশে যাওয়ার পর ফেসবুক ও বিভিন্ন মাধ্যমে তাদের মধ্যে যোগাযোগ হত। সেখান থেকে তিনি বিভিন্ন সময় আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে অর্থায়ন করেছেন। কাকে কাকে হত্যা করতে হবে, তা তৌহিদ নির্ধারণ করতেন। আইটি বিশেষজ্ঞ তৌহিদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ব্লগে বিভিন্ন জনের লেখা পর্যবেক্ষণ করতেন।

জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগে জসিম উদ্দিন রহমানি গ্রেফতার হওয়ার পর তৌহিদ ২০১২ সালের দিকে বাংলাদেশে আসেন। তখন তিনি আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যদের সমন্বয় করে অভিজিৎ রায় ও অনন্ত বিজয়কে টার্গেট করে হত্যার পরিকল্পনা করেন। এ দুটি হত্যাকাণ্ডে পাঁচজন অংশ নেয়। এরা হলেন, রমজান সিয়াম, নাঈম, জুলহাস বিশ্বাস, জাফরান আল হাসান ও সাদেক আলী মিঠু।

এদের মধ্যে সাদেক র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন। তিনি প্রেসে কাজ করেন। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান জসিম উদ্দিন রহমানির বইয়ের প্রকাশক ও স্বাস্থ্য উপদেষ্টা তিনিই। ২০১২ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন তিনি। রহমানির সঙ্গে তার পরিচয় হয় ২০০৭ সালে। পরে তার মতাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সংগঠনের সক্রিয় সদস্য ও আস্থাভাজন হয়ে উঠেন সাদেক। বিভিন্ন সময় কাশিমপুর কারাগারে গিয়ে রহমানির সঙ্গে দেখা করে সংগঠনের বিভিন্ন কার্যক্রমের দিকনির্দেশনাও নিয়ে আসতেন।

এই অপারেশনের পর জঙ্গিদের অর্থদাতা হিসেবে কজন তরুণ আইনজীবীকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। 'শহীদ হামজা ব্রিগেড' নামের নতুন জঙ্গি সংগঠনে অর্থ জোগান দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার এই তিন আইনজীবী হলেন, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক এবং চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান ও ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী মাহফুজ চৌধুরী ওরফে বাপন।

হত্যাকারীদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর, বিশেষ করে র‌্যাবের ভূমিকা অবশ্যই প্রশংসনীয়। তারা প্রতিটি হত্যার ঘটনা উন্মোচন করুক, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করুক– দেশবাসী তাই প্রত্যাশা করে। পাশাপাশি জঙ্গি অর্থায়ন খুঁজে বের করার যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে সেটাও তাৎপর্যপূর্ণ। এ দাবি শুরু থেকেই উচ্চারিত হয়ে আসছিল। দেরিতে হলেও যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, তা ইতিবাচক। জঙ্গিবাদ নির্মূলকরণে উদ্যোগটি প্রসারিত করতে হবে।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার এবং জঙ্গি অর্থায়ন বন্ধ করতে হলে গণজাগরণ মঞ্চ সৃষ্টি এবং এর বিরোধিতার যে রাজনীতি তা বিশেষভাবে বিবেচনায় নিতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, আমাদের দেশের রাজনীতিতে এক নব-অধ্যায়ের সূচনা করেছে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনে যখন দেশের মুক্তমনা তরুণরা অগ্নিশপথে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, এই তরুণ বুদ্ধিজীবীদের অনুসরণ করে হাজার-লাখ-কোটি জনতা নতুন চেতনার মশাল জ্বালিয়ে আঁধার তাড়ানোর মন্ত্রে হাতে হাত রেখে রাজপথে শান্তিপূর্ণ মিছিলে অংশ নিয়েছিল, তখনই অন্ধকারের অপশক্তি তাদের সব শক্তি দিয়ে শেষ ছোবল হানে। ধর্মকে ব্যবহার করা হয় আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে।

এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত তরুণ-তরুণীরা ধর্ম মানে না, তারা নাস্তিক, তাদের আন্দোলন আসলে ইসলামের বিরুদ্ধে– এমন একটা মিথ্যা প্রচারণা সামনে নিয়ে আসা হয়। নবপর্যায়ের গণজাগরণ ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন নস্যাৎ করতে বিএনপি-জামায়াতের সবগুলো মুখপাত্র, বাঁশের কেল্লা, আমার দেশ, নয়া দিগন্ত, দিনকাল, ইনকিলাব, সংগ্রামসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত তরুণ-তরুণীদের চরিত্র হনন করে।

এভাবে বানোয়াট আর মিথ্যা সংবাদের ভিত্তিতে দেশের হাজার হাজার লাখ লাখ অল্পশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ধর্মভীরু মানুষকে গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ করে তোলা হয়। পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবনে সরকারও ব্যর্থ হয়। ফলে গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোক্তাদের ভাবমূর্তি যতটা কালিমালিপ্ত করার, ততটুকু অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে শেষ করেন 'আমার দেশ' পত্রিকার প্রধান কারিগর মাহমুদুর রহমান। বাকিটুকু চালিয়ে নেয় বাঁশের কেল্লা, নয়া দিগন্ত, ইনকিলাব-সংগ্রাম। গণজাগরণ মঞ্চ ধ্বংস করতে রাতারাতি দাঁড় করায় হেফাজতে ইসলাম নামে এক ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে।

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া রাজনৈতিক লাভের জন্য রাজাকার গোষ্ঠী ও মাহমুদুর রহমানদের কুটিলতার কৌশলটি লাগসই মনে করে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের বিরুদ্ধে 'খারাপ', 'নষ্ট ছেলে', 'নাস্তিক' ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেন এবং শাহবাগ বন্ধ করে দেওয়ার আহবান জানান। এতে ইসলামরক্ষার তথাকথিত সিপাহসালাররা আরও জোর পেয়ে যায়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ গণজাগরণ মঞ্চের তথাকথিত নাস্তিক কর্মীদের হত্যা করা 'ঈমানি দায়িত্ব' মনে করে। সেই অনুযায়ী একের পর এক টার্গেট করে ব্লগার হত্যার মিশন শুরু হয়।

উল্লিখিত প্রেক্ষাপটে মাহমুদুর রহমান, সিরাজুর রহমান, শফিক রেহমান, খালেদা জিয়া, ফরহাদ মজহার গংদের কেন দায়ী করা হবে না?

গণজগরণ মঞ্চের নিরীহ কর্মীদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতি ব্যবহার করা, ধর্মভীরু সবাইকে খেপিয়ে দেওয়া, ব্লগারদের গায়ে নাস্তিকতার তকমা এঁটে ব্লগারদের খুনের জন্য জঙ্গিদের লেলিয়ে দেওয়ার জন্য যারা সেই সময় লাগাতার ভূমিকা পালন করেছেন, যারা সেদিন জেনেশুনে আগুন নিয়ে খেলেছেন, তারা কি রেহাই পেয়ে যাবেন?

গণজাগরণ শঞ্চের কর্মীদের নাস্তিক বানানোর পক্ষে যারা মুখে মিথ্যার খই ফুটিয়েছেন– সেই মাহফুজউল্লাহ, শওকত মাহমুদ, রুহুল আমিন গাজী, মাহবুব আনাম, পিয়াস করিম, আমেনা মহসিন, সদরুল আমিন, আজমেরী বেগম, আসিফ নজরুল, ড. এমাজ উদ্দিন আহমেদ, ড. শাহাদুজ্জামান– প্রত্যেকের ভূমিকার কি চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে না? হওয়া উচিত নয়?

এখন পর্যন্ত যেব্লগার ও গণজাগরণ মঞ্চকর্মী খুন হয়েছেন, যারা খুনের আশঙ্কায় দিনাতিপাত করছেন, তাদের জীবন বিপন্ন করার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাদের ভূমিকা দায়ী। কারা এই ব্লগারদের নাস্তিক খেতাব দিয়েছিল, কারা তাদের 'ইসলামের দুশমন' হিসেবে প্রতিনিয়ত উস্কানি দিত? যারা মঞ্চের ছেলেমেয়েদের রাতারাতি ভিলেন বানিয়েছিল, তাদের চরিত্র হনন করে গল্প-উপন্যাস লিখেছিল; তা ছেপেছিলও কেউ কেউ– জানতে হবে কোন মতলবে, কেন তারা এ সব করেছে। আজকে যারা ব্লগারদের খুনের জন্য মরিয়া, তারা কাদের কাছে কতটুকু পাথেয় বা উস্কানি পেয়েছে সেটাও জানা দরকার।

এগুলো মূল্যায়ন করে দেখা উচিত। প্রশ্ন হল, নিরপরাধ কেউ যেন সমাজে শাস্তি ভোগ না করে তা যেমন নিশ্চিত করতে হবে; পাশাপাশি অপরাধী তা সে যে যতটুকুই করুক, তার জন্য অবশ্যই শাস্তির ব্যবস্থা জরুরি। তা না হলে সমাজ শুদ্ধ হবে না। অনেকে বলতে পারেন, এভাবে বিচার করলে তো ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হবে। যদি হয় হোক। অন্তত একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন হোক।

বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে আমরা যেন কোনো দিন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারি, সে জন্য একাত্তরে স্বাধীনতা অর্জনের প্রাক্কালে ১৪ ডিসেম্বর যেমন রাজাকার-আলবদরা দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে হত্যা করেছিল, ঠিক তেমনি তাদের প্রেতাত্মারা গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত কিংবা সেই চেতনার পক্ষে যারা অবস্থান নিয়েছেন, তেমন তরুণদের বেছে বেছে হত্যার মিশন শুরু করেছে। বিষয়টিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে।

একজন কাদের মোল্লার ফাঁসি হলে পরিশুদ্ধ হয় ইতিহাস। কিন্তু একজন ব্লগার যখন খুন হন একজন ধর্মান্ধ যুবকের দ্বারা, তখন কিন্তু ধর্ম রক্ষা হয় না। বরং ধর্মকে কলুষিত করার জন্য যারা মন্ত্রণা দিয়েছে, তাদের শাস্তির দাবিটি সামনে চলে আসে।

এই খুনি-ধর্মান্ধরা গণজাগরণ মঞ্চ বোঝে না, বোঝে না ব্লগ। তাদের যখন বোঝানো হয়, গণজাগরণ মঞ্চ হচ্ছে নাস্তিক, নবী-রাসুলের বিরোধীদের একটা আখড়া, এর সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের হত্যা বা কতল করা তখন তারা 'ঈমানি কর্তব্য' বলে মনে করে। প্রশ্ন হল, যে রাজনৈতিক নেতারা প্রতিনিয়ত 'নাস্তিক' 'নাস্তিক' রব তুলে ধর্মবিশ্বাসী যুবককে খুনি হওয়ার স্তরে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেন, তারাও বা কেন পার পেয়ে যাবেন? তাদের রাজনীতি নিয়েও এখন সরকারের কিছু করার প্রয়োজনীয়তা রয়ে গেছে।


চিররঞ্জন সরকার:
কলামিস্ট।