একীভূত বাজেটের অঙ্গীকার: প্রতিবন্ধী মানুষেরা বিচ্ছিন্ন সমাজ কল্যাণে

সাবরিনা সুলতানাসাবরিনা সুলতানা
Published : 20 August 2015, 06:03 AM
Updated : 20 August 2015, 06:03 AM

চলতি বছরের (২০১৫-১৬) বাজেট বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কর্মকাণ্ড শুরু হয়ে গিয়েছে ইতোমধ্যে। বাজেট-পূর্ব নানান বিশ্লেষণ আগে হয়েছে। লেখালেখি, টকশো কিছুই বাদ নেই। বাজেট নিয়ে সাধারণত বিশ্লেষণধর্মী মতামত দেন বিশেষজ্ঞগণ। আমি আমজনতা। এ নিয়ে মাথা ঘামানো আমার কম্মো নয়। তাই কোনো আলোচনা সমালোচনা কিছুতেই থাকিনি কখনও। শুধু দেখে যাই প্রতি বছর একীভূত বাজেট প্রসঙ্গে নানান আলোচনা যদিও সেখানে প্রতিবন্ধী মানুষেরা বিচ্ছিন্ন। এহেন অদ্ভুত রকমের বঞ্চনায় পরিপূর্ণ– একেই নাকি মাননীয় অর্থমন্ত্রী ইদানিংকালে একীভূত বাজেট হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। কিন্তু নির্দিষ্ট সেই জনগোষ্ঠীর মন যে খচখচ করে তা কি সরকার মশাই অবগত?

নাহ্‌! বিশ্লেষণ করতে না জানলেও অনুভূতি বলে কিছু তো থাকে আমজনতার। সাধারণ সেই অনুভূতি উগড়ে দিলে তা অপরাধ গণ্য হবে না আশা পোষণ করি।

অর্থমন্ত্রীর এবারের বাজেট বক্তব্যে লক্ষ্য করলাম, তিনি বিশ্বাস করেন, চলতি মেয়াদ শেষেই বাংলাদেশের কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটবে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তনের ফলে দেশের রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরগুলো যানজটমুক্ত হবে। শিক্ষায় দক্ষতা এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের মাধ্যমে জাতি এগিয়ে যাবে বহুদূর। পাশাপাশি কোটি কোটি তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। তিনি আরও জানালেন, দারিদ্র উচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গে বঞ্চিত ও দুর্দশাগ্রস্ত জনগণকে সামাজিক সুরক্ষা না দিলে সর্বজনীন উন্নয়ন সম্ভব হয় না। আর ২০২১এ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসব উদযাপনের প্রাক্কালে এসব অর্জন হবে অপার আনন্দ ও গর্বের বিষয়।

তার মানে, তিনি প্রত্যাশা করছেন যে, চলতি বাজেট সত্যিই একীভূত সমাজ বাস্তবায়নের পথে হাঁটছে। একীভূত বাজেট প্রণয়নের ফলে মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো অর্থাৎ শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা সকল কিছু পেতে যাচ্ছে দেশের নাগরিকেরা। বঞ্চিত ও দুর্দশাগ্রস্ত জনগণও আছে এতে। আসলেই কি তাই?

আমাদের অর্থমন্ত্রী প্রতি বছর বাজেট ঘোষণার আগে নিয়ম করে বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে আলাদাভাবে মতবিনিময় করেন। সম্ভবত খুবই মনযোগ সহকারে প্রত্যেকের মতামত শোনেন। পাশে বসে থাকা তাঁর সহকর্মীদের দেখা যায় বিভিন্ন মতামত, অনুরোধ নোট করে নিতে। একই নিয়মেই প্রতি বছর প্রতিবন্ধী মানুষের বিভিন্ন সংগঠন ও তাদের নিয়ে কর্মরত এনজিও, সংগঠনসমূহের সঙ্গে একটি মতবিনিময় সভায় সকলের চাহিদা শোনা ও নোট নেওয়া হয়।

অঘোষিত নিয়ম অনুযায়ী অভিজ্ঞদের সঙ্গে সেই ঘণ্টাকালব্যাপী আলোচনার কোনো প্রতিফলনই দেখা যায় না বাজেট ঘোষণার পর। আমাদের দেশ তথা সমাজ যেন ধরেই নিয়েছে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর অধিকার অর্জনের কিছু নেই। তাদের কেবল কল্যাণ করে যেতে হবে। একই পদক্ষেপে হাঁটছে এবারের বাজেটও।

২০১১ সালের আদমশুমারি মতে, প্রায় দেড় কোটি এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্ব ব্যাংকের পরিসংখ্যানে আড়াই কোটি (সরকারি বা বেসরকারি পরিসংখ্যান সব নিয়েই এদেশে নানা দ্বিমত রয়েছে) বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী মানুষের এক বিশাল জনগোষ্ঠী রয়েছে আমাদের দেশে। সরকারের একীভূত বাজেটে যারা বিচ্ছিন্ন একটি মাত্র মন্ত্রণালয়ে সীমাবদ্ধ হয়ে। সমাজের কল্যাণে নিয়োজিত সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রতিবন্ধী মানুষের ভাগ্যবিধাতা যেন! শিক্ষা, ক্রীড়া, বিনোদন, স্বাস্থ্যসেবা, নারী-শিশু বিষয়ক এবং অধিকার তথা আইনসমূহ সকল কিছু উক্ত একটি মন্ত্রণালয়েরই অধীনস্থ। অন্যান্য কোনো মন্ত্রণালয় প্রতিবন্ধী মানুষের জন্যে অর্থ বরাদ্দের চাহিদা তুলে ধরে না।

কিন্তু এ কীভাবে সম্ভব? জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সনদের (সিআরপিডি) অনুসমর্থনকারী শরীক রাষ্ট্র হয়েও বাংলাদেশে দিনের পর দিন এহেন বৈষম্য ঘটে যাচ্ছে, আর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কর্মরত উর্ধ্বতন এবং বিশেষজ্ঞ সকলেই মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। কিন্তু কেন? কেন এবং আর কতদিন প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকারের বিষয়টিতে অসম্মান দেখিয়ে এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে কল্যাণের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে?

সিআরপিডিএর আলোকে গড়ে ওঠা আমাদের দেশেরই প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ বলছে ভিন্ন কথা। প্রতিবন্ধী মানুষেরা সর্বক্ষেত্রে সমান আইনি স্বীকৃতি পাবে। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয় ইত্যাদি ক্ষেত্রেও পূর্ণ ও কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করবে। তাদের শিক্ষা মূলধারায় নিশ্চিত হবে। প্রবেশগম্যতা থাকবে সর্বক্ষেত্রে। সহায়ক ব্যবস্থাও থাকবে যানবাহনে।

এদিকে স্বয়ং সরকার এবং সরকার সংশ্লিষ্ট বিশেষত অর্থমন্ত্রীসহ সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, সরকারি উর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ বিগত সময়ে বেশ কিছু মন্ত্রণালয়ের আওতায় বরাদ্দের অঙ্গীকার করেছিলেন। তাহলে কেন সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার সত্বেও বার বার একই প্রবঞ্চনার শিকার প্রতিবন্ধী মানুষেরা?

স্বাধীনতার প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর হতে চলল। আমরা ইতোমধ্যেই মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছি। সাধারণ আমজনতা না পাওয়ার হাহাকারের মাঝেও বেঁচে থাকার মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ বাস্তবায়নের মাঝে। কিন্তু যখন এই সাধারণ আমজনতার নিত্য সাথী হয় একটি সহায়ক উপকরণ। আরও সহজ করে বলি, আমি হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী ব্যক্তি হিসেবে রাস্তায় বেড়িয়ে দেখি একটি হুইল চেয়ার প্রবেশগম্য বাসও নেই আমার জন্যে। কোনো বিপণী বা বিনোদন কেন্দ্র দূরে থাক, সরকারি অতি গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলোতে পর্যন্ত আমাদের প্রবেশে যেন নিষেধাজ্ঞার নোটিশ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাহাড়সম সিঁড়ির ধাপগুলো।

ধরুন, আজ না হোক কাল, বাংলাদেশে সেই রকম এক আন্তর্জাতিক কনফারেন্সের আয়োজন করা হল, যেমনটা প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ২০১১ সালে করেছিলেন অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে। হয়তো কখনও তেমনই এক কনফারেন্সের আয়োজন হল হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী মানুষদের নিয়ে। সারা দেশের হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী মানুষ সেখানে কীভাবে একত্রিত হবেন ভাবতে না ভাবতেই আরেকটি বিষয় মাথায় এল। এই যে আমরা মিনি টি-২০ ক্রিকেট বিশ্বকাপের আয়োজন করেছিলাম, একদিন নিশ্চয়ই বিশ্বকাপেরও আয়োজন হবে।

যাহোক, মিনি বিশ্বকাপের সময় পৃথিবীর নানা দেশের নাগরিকদের আনাগোনায় মেতে উঠেছিল দেশ। তখন কোনো ভিনদেশি হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী ক্রিকেটপ্রেমী ব্যক্তি এদেশে এলে সহায়ক যাতায়াত ব্যবস্থার অভাবে সরকার বা আয়োজনকারীদের কি অবস্থাটা দাঁড়াত একবার ভেবে দেখেছেন? এমন কিন্তু নয় যে, বহিঃবিশ্বের হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী ক্রিকেটপ্রেমী ব্যক্তি ভিনদেশে ম্যাচ উপভোগ করতে যান না।

আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী মানুষের সমাজের মূলধারায় ক্রীড়া বা বিনোদন উপভোগের অধিকার অর্জিত হওয়া এখনও বহুদূরের কথা শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র প্রবেশগম্যতা-যানবাহন সব দিকেই বঞ্চিত তারা। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষেরা রাস্তায় একা চলাচল করেন প্রাণটা হাতে নিয়ে। ফুটপাত, রাস্তা অথবা স্থাপনা, ভবনসমূহ কোথাও নেই টেকটাইল ব্লক নির্দেশনা। সরকারি বেসরকারি যে প্রতিষ্ঠানেই যান না কেন তারা হাজার বার জিজ্ঞাসা করে করে তবেই নিজ গন্তব্যে পৌঁছুতে পারেন। নেই র‍্যাম্প। নেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব টয়লেট।

একটি হুইলচেয়ার প্রবেশগম্য বাস রাস্তায় নামাতেই আমাদের সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং বিআরটিসি কর্তৃপক্ষের গলদঘর্ম অবস্থা। কবে কোনকালে ১০০ বাস আমদানি প্রসঙ্গে দয়াপরবশ হয়েই সম্ভবত কেউ বলেছিলেন, তন্মধ্যে ১০টি বাস প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব করা হবে। অথচ বাজেট ঘোষণায় দেখতে পাই উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার কথা ভেবে নানান পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। আমাদের নিরাপদে চলাচলের জন্য ফুটপাত এবং প্রবেশগম্য গণপরিবহনের মতো ক্ষুদ্র সমস্যা সমাধানের পথ না মিটিয়ে সরকারের আগ্রহ দেখা যায় অলাভজনক ডেমু ট্রেন, আর্টিকুলেট বাস অথবা মেট্রোরেলের মতো বিশাল সব বিলাসী প্রকল্পের দিকেই ঝুঁকতে।

এদিকে বিভিন্ন ধরনের সেবা প্রদানকারী সরকারি ও স্থানীয় সরকারের ভবনে প্রতিবন্ধী মানুষের প্রবেশগম্যতা নিশ্চিতকরণ প্রকল্প এবং শ্রবণ-প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বাংলা ইশারা ভাষা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অবহেলিত বাজেটে। বাংলা ইশারা ভাষা দিবস সারা দেশব্যাপী পালিত হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এই ভাষার ব্যবহার দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সকল ক্ষেত্রে প্রচলনের জন্য সরকারের উদ্যোগ চোখে পড়ে না। শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য হাতেগোনা কয়েকটি বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত বাংলা ইশারা ভাষা রয়েছে। এরপর কি তাদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের অধিকার নেই?

সারা দেশের বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সকলের জন্যেই যখন বিশেষায়িত শিক্ষা ব্যবস্থার কথা ওঠে তাতে আমার নাক চুলকানির উদ্রেক ঘটে। একীভূত শিক্ষানীতি প্রণীত হয়, তবুও এই বিশেষায়িত স্কুলগুলো সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনেই রয়ে যায়। যদিও নীতিমালা প্রণয়নের সময়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছিল এই স্কুলগুলোকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনার জন্য। কিন্তু সে প্রক্রিয়া শুরু হয়েও থেমে যায়। একীভূত শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চলে, কিন্তু দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব করার বিষয়ে দূর দূর পর্যন্ত কোনো আলো দেখা না।

এবার প্রথমবারের মতো শিশু বাজেট ঘোষণা হল, কিন্তু প্রতিবন্ধী শিশুরা এখানে বঞ্চিত। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় অ-প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্য নানা প্রকল্প গৃহীত হলেও প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবাগুলোও এই খাতের অন্তর্ভুক্ত নয়। প্রাথমিক স্বাস্থ্যখাতে না হয় বরাদ্দ এল না। কিন্তু বিশেষায়িত স্বাস্থ্যখাতে অথবা জাতীয় চক্ষু ইনস্টিটিউট, পঙ্গু হাসপাতাল ও ইএনটি হাসপাতাল ইত্যাদির মতো কিছু জায়গায় আমরা প্রতিবন্ধী মানুষেরা কিছু পাই না। সত্যিকার অর্থে প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য স্বাস্থ্যখাতে উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে না।

ইদানিং আবার কিছু এনজিও, যেমন সোসাইটি ফর অ্যাসিস্ট্যান্স টু হিয়ারিং ইম্পেয়ার্ড চিলড্রেন (সাহিক), সেন্টার ফর রিহ্যাবিলিটেশন অব প্যারালাইজড (সিআরপি) খুব সামান্য অর্থ বরাদ্দ পেয়েছে। কিন্তু এমন ছোটখাট বরাদ্দের কারণে দেশব্যাপী প্রতিবন্ধী মানুষের স্বাস্থ্যসেবামূলক যে কর্মকাণ্ড হওয়া উচিত তা সম্পুর্ণ বন্ধ। সিআরপি বা সাহিক নিশ্চয়ই সারা দেশের প্রতিবন্ধী মানুষের চাহিদা পূরণে সক্ষম নয়। এ বিষয়ে সরকারের কি কোনো দায়িত্ব নেই?

আমাদের অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তব্যে দেশব্যাপী পরিচালিত প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপ বিষয়ে এ বছর পরিচয়পত্র দেওয়া হবে উল্লেখ করে দেশের প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা জানিয়েছেন ১৪ লাখ ৫৫ হাজার। জরিপের আওতাভুক্ত হয়েছেন মোটে ১৮ লাখ ৩ হাজার ৪৫৬ জন।

সংখ্যাটা সত্যিই খুব দুঃখজন! এবং অবিশ্বাস্য। অর্থমন্ত্রী কী ভেবে বলেছেন তিনিই জানেন!

তবে এ-ও সত্য যে, প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণের জন্য পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতির অভাবও রয়েছে আমাদের। শ্রবণপ্রতিবন্ধী মানুষদের শনাক্তকরণের জন্য অডিও মিটার নেই। তাছাড়া অটিস্টিক শিশু শনাক্তকরণের কাজ আরও কঠিন। আমাদের অভিজ্ঞতাও কম। অথচ এই জরিপের ক্ষেত্রে দেশজুড়ে জেলা পর্যায়ে একটি অটিজম ক্যাম্প করার উদ্যোগ পর্যন্ত নেওয়া হল না।

সামান্য পেছনে যাই, ১৯৯৫-৯৬ সালের দিকে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। যা পরবর্তীতে ব্যাপক দুর্নীতি-অনিয়মের মুখে পড়ে। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আরও প্রায় দশ বছর গড়িয়ে ২০০৭-০৮ এর দিকে জাতীয় পরিচয়পত্রে প্রকল্প সফল হয়। এখন আমরা স্মার্ট কার্ড চালুর চেষ্টা করছি। ধাপে ধাপে অর্জিত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আমরা এগুচ্ছি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার দিকে।

মানুষ এভাবেই পূর্ববর্তী ভুল থেকে সফলতা অর্জন করে। আমরা এবার যদি ১৪ লাখ প্রতিবন্ধী মানুষ শনাক্ত করতে পারি, পরবর্তীতে নিশ্চয়ই সঠিক সংখ্যার কাছাকাছি যেতে পাব। কিন্তু প্রথমেই আমাদের সংখ্যা নিরূপণের দিকে মনোনিবেশ করা দরকার। সরকারের সঠিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এবং সামাজিক ও নাগরিক বৈষম্যগুলো দূরীকরণে এই পরিসংখ্যান অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু কোটি কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দ পাওয়ার পরও সমাজসেবা অধিদফতরের তত্বাবধায়নে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগে পর্যুদস্ত এই প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপের পথেই যদি হাঁটতে চায় পরবর্তী উদ্যোগগুলোও, তাহলে অর্থের অপচয় ছাড়া কিছুই হবে না।

আমাদের জন্য নতুন দুটি আইন এলেও বিধি প্রণয়নের ঘোষণা ছাড়া ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। আইনের নামও রাখা হয়েছে বেশ বাহারি। 'প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩' এবং 'নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন, ২০১৩'। সরকার আমাদের অধিকার সুরক্ষায় মুখরোচক আইন তৈরি করেন আর সে আইন বাস্তবায়নের জন্য অর্থ বরাদ্দ তো পায় না, উল্টো জমকালো আয়োজনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিদফতর উদ্বোধন করে আসেন স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।

অন্যদিকে যে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বইতে এই অধিদফতর বাস্তবায়নের উল্লেখ থাকে সেই তিনিই প্রতিবন্ধী মানুষের সঙ্গে বৈঠককালে তাদের মুখে অধিদফতরের নাম শুনে চমকে ওঠেন। এ নিয়ে আমরা বিস্মিত হব নাকি সরকারের দ্বৈতনীতি ভাবব বুঝে উঠতে পারছি না।

২০১৩ সালের অক্টোবরে আমরা এই অধিকার ও সুরক্ষা আইন পেয়েছি। যখন আমি একে বলছি অধিকার আইন, তখন আসলে মনে খানিকটা আশা জাগে, এরপর অন্তত বাজেটে মানুষের মৌলিক যে অধিকারগুলো রয়েছে সেসব পূরণের লক্ষ্যে অর্থ বরাদ্দ আসবে। আইনে আমার প্রতিবন্ধিতার সংজ্ঞায় বলা হচ্ছে, এটি আমার অসুস্থতা নয় অবস্থা মাত্র। এ নিয়েই আমি স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারি। তখন আমার মনে আবারও আশা জাগে, সমাজের মূলধারায় আমি অন্তত শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে, কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ অন্যান্য সকল খাতে মন্ত্রণালয়ভিত্তিক বরাদ্দ পেতে যাচ্ছি।

আমি মানেই সারা দেশের প্রতিবন্ধী মানুষ। আমরা শিক্ষিত হয়ে প্রতিষ্ঠিত হব সমাজে। নিজেদের উন্নয়নে নিজেরাই নেতৃত্ব দেব। সমাজের সর্বস্তরে সম-অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে আমাদের। প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে আমাদের।

দুঃখজনক হল, এসব ভারী কথা কেবল আইনের কাগজেই বাধা থাকে। কিন্তু কেন? কেন সব কিছুতেই সমাজ কল্যাণের দ্বারস্থ হতে হবে আমাদের? যদি অ-প্রতিবন্ধী মানুষের স্বাস্থ্যের সুরক্ষায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ক্রীড়া খাতে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক শিক্ষার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে বিষয়ভিত্তিক মন্ত্রণালয় বরাদ্দ পায়, আমাদের কেন সকল কিছুর জন্যেই সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে যেতে হবে?

মৌলিক অর্থে যা প্রয়োজন, আমাদের সেই সামান্য প্রতীকী বাস্তবায়নও ছিল না বাজেট ঘোষণায়। তাহলে আমরা কীভাবে এই বাজেটকে একীভূত বলি? অর্থমন্ত্রী প্রতি বছর ইনক্লুসিভ গ্রোথ, ইনক্লুসিভ বাজেট, ফিনান্সিয়াল ইনক্লুশন এমন নতুন নতুন শব্দের অবতারণা করেন। অথচ এই নতুন শব্দগুলো আমার জীবনে কিংবা কোনো প্রতিবন্ধী মানুষের জীবনেই কী প্রভাব রাখছে? আমাদের নিয়ে তামাশা করার জন্যেই কী চমৎকার সুন্দর সুন্দর সব বক্তব্য তৈরি করা হয়!

সরকার প্রতিনিধিগণ একীভূত অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে মন-ভুলানো এইসব বক্তব্য দেন, অথচ একীভূত সমাজের কাঠমোর কানাটুকুও যখন দেখতে পাই না, তখন আমি সত্যিই একীভূত সমাজ, একীভূত বাজেট, একীভূত উন্নয়ন এসবের মানে খুঁজে পাই না। ২০০১ সালে যখন আমাদের জন্য কল্যাণ আইন ছিল, তখনকার বক্তব্যগুলো মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু এখন অধিকার আইনের নামে দেশে আসলে কী হচ্ছে? প্রতিবন্ধী মানুষদের নিয়ে রাষ্ট্রের এই প্রবঞ্চনার আদৌ কি শেষ হবে?

অন্তত ন্যায্য অধিকারের বাস্তবায়ন পেলে আমাদের এই ক্ষোভ পুঞ্জিভূত মেঘ হয়ে বাংলাদেশের আকাশে ভেসে বেড়াত না।

সাবরিনা সুলতানা: সভাপতি, বি-স্ক্যান।

সহায়ক:

১. জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সনদ (সিআরপিডি)

২. প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩

৩. নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন, ২০১৩