দ্বিজাতিতত্ত্বের মৃত্যু, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ

এ বি এম খায়রুল হক
Published : 4 August 2011, 02:57 AM
Updated : 15 August 2015, 03:49 AM

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের চার দশক পূর্ণ হল এ বছরের ১৫ অগাস্ট। নিষ্ঠুর এই হত্যাকাণ্ডের হোতারা প্রকৃতপক্ষে চেয়েছে মুক্তিযুদ্ধের আর্দশ হত্যা করতে। কিন্তু ঘাতকচক্র ও তাদের পেছনে থাকা ষড়যন্ত্রকারী মহল বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া দারুণভাবে বিঘ্নিত করতে ব্যর্থ হলেও পারেনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মুছে দিতে। স্বাধীনতার স্থপতি দেশবাসীর কাছে সমুজ্জ্বল রয়েছেন, থাকবেনও। এ প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সহকর্মীরা কীভাবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এগিয়ে নিয়ে গেছেন, তাই এ নিবন্ধের আলোচ্য।

১৯০৫ সালে ইংরেজ সরকার যে কারণেই বঙ্গভঙ্গ করে থাকুক না কেন, এর ফলে পূর্ববঙ্গের অধিবাসীরা সর্বপ্রথম রাষ্ট্রীয় জীবনে অংশগ্রহণের সামান্য সুযোগ পায়। বিশেষ করে এখানে শিক্ষার প্রসারের সুযোগ ঘটে। ৬ বছর পর বঙ্গভঙ্গ রদ হলেও বাঙালির এই নবউন্মেষ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে, বিশেষ করে শিক্ষা, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে।

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে হিন্দু ও মুসলমানদের যৌথ উদ্যোগ ব্যর্থ হলে ১৯৪০ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে এক ঐতিহাসিক পটভূমিতে লাহোর প্রস্তাব উপস্থাপনের মাধ্যমে ভারতবর্ষে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর (states) দাবি ওঠে। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর আবারও দীর্ঘ সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বঞ্চনার প্রেক্ষিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ও গণস্ফুরণ ঘটে। যে সংগ্রামের মহানায়ক ছিলেন আপাদমস্তক বাঙালি। তিনি শেখ মুজিবুর রহমান।

সি আর দাস থেকে শুরু করে সুভাষ বসু পর্যন্ত বাঙালি জাতীয়তাবোধের প্রাথমিক বিকাশ এবং সেই বোধের পরিচর্যা ও লালনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বেই বাঙালি জাতীয়তাবোধের প্রকৃত উন্মেষ। যার ধারাবাহিকতায় এল এই ভূখণ্ডের স্বাধীনতার ঘোষণা এবং নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে তা অর্জন।

এসব বিষয় নিয়ে ১৯৭০ দশকে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি; কিন্তু পরবর্তীকালে বিভিন্ন বিষয়, যেমন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের প্রকৃত তাৎপর্য, ওই ভাষণটি স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল কিনা, এ ভাষণ এবং ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে প্রদত্ত স্বাধীনতার ঘোষণা পর্যন্ত তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সাংবিধানিক অবস্থান কী ছিল, এসব প্রশ্ন মাঝে মধ্যেই উঠানো হয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতা ঘোষণার পরবর্তী এক দশকে এসব প্রশ্ন দেখা দেয়নি। কিন্তু পরবর্তীকালে অসৎ উদ্দেশ্যে অহেতুক নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হতে থাকে।

এ সব প্রশ্নের যথাযথ উত্তরের জন্য ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে পাকিস্তান সৃষ্টির অধ্যায়ের দিকে দৃষ্টি ফেরানো প্রয়োজন। ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টির প্রায় ৪০ বছর আগে থেকে ভারতের জনগণের দুটি রাজনৈতিক মুখপাত্র, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ স্বরাজ ও স্বায়ত্তশাসনের দাবি করে আসছিল। Government of India Act, 1935এর মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার কিছু স্বায়ত্তশাসন প্রদান করে এবং এই আইনের আওতায় ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এগুলো আসলে ছিল ধর্মভিত্তিক স্বতন্ত্র নির্বাচন।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শুরু থেকেই কংগ্রেস দেশজুড়ে 'ভারত ছাড় আন্দোলন'এর সূচনা করে। ওদিকে, ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের সর্বভারতীয় বার্ষিক অধিবেশনে বাংলার তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির প্রয়োজনে ভারতের অভ্যন্তরে একাধিক পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রের (states) দাবি উত্থাপন করেন। দাবিটি মুসলিম লীগের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ভারতে হিন্দু ও মুসলমান দুই পৃথক জাতির বাস তথা দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতেই করা হয়েছিল। মূলত এই দ্বিজাতিতত্ত্বই ছিল মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির দাবির একমাত্র যৌক্তিক ভিত্তি।

এই প্রস্তাব এবং পাকিস্তান পরিকল্পনায় ধারণা ছিল, পূর্বাঞ্চলে বাংলাসহ ভারতে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলো নিয়ে স্বতন্ত্র, স্বাধীন ও সার্বভৌম একাধিক রাষ্ট্র গঠিত হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন বেগবান হয় এবং সে প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকার সে দাবি বিবেচনা করতে নীতিগতভাবে বাধ্য হয়। সমস্যা ছিল একটিই– অখণ্ড ভারত স্বাধীনতা পাবে, নাকি দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে হিন্দু ও মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র সৃষ্টি করে সেগুলো স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পাবে।

১৯৪৫ সালের নভেম্বর থেকে সমগ্র ভারতবর্ষে প্রাদেশিক নির্বাচন শুরু হয় এবং মুসলিম লীগ ওই নির্বাচনটি পাকিস্তান দাবির প্রতি গণভোট হিসেবে গ্রহণ করে। অবিভক্ত ভারতে বাংলা ছিল সর্বাপেক্ষা বৃহৎ একক মুসলিম-অধ্যুষিত প্রদেশ। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাসিমের নেতৃত্বে এক বিশাল কর্মীবাহিনী বাংলার গ্রামগঞ্জে মুসলিম লীগের পাকিস্তান দাবির সপক্ষে প্রবলভাবে প্রচারণা চালাতে থাকে। বিশেষ করে মুসলিম ছাত্রলীগ ও সব স্তরের ছাত্র-জনতা এই প্রচারণায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।

তাতে বাংলার কৃষক জনগোষ্ঠীর মনে আশা জন্মে যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রে তারা হাজার বছরের বঞ্চনার হাত থেকে রেহাই পাবে, রাষ্ট্রযন্ত্র তাদের হয়ে কথা বলবে। এর ফলে মুসলিম লীগ অখণ্ড বাংলা প্রদেশে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। বাংলার মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত ১২১টি আসনের মধ্যে ১১৪টি আসন লাভ করে তারা। সমগ্র উপমহাদেশে মুসলিম লীগ আর কোথাও এমন বিপুল বিজয় পায়নি। ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশসহ পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম ফ্রন্টিয়ার প্রদেশ ও বেলুচিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করতে ব্যর্থ হয়েছিল তারা। কেবল সিন্ধু প্রদেশে তারা অতি সামান্য ভোটের ব্যবধানে কষ্টার্জিত জয় লাভ করে।

বাংলায় মুসলিম লীগের এরূপ ভূমিধস বিজয়ের ফলে জিন্নাহর পাকিস্তান সৃষ্টির দাবিটি ব্রিটিশরাজের ওপর প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, উপমহাদেশে পাকিস্তান সৃষ্টিতে বাঙালি মুসলমানদেরই মুখ্য অবদান ছিল। নির্বাচনের পর সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৬ সালের ৩ এপ্রিল বাংলার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এখানে স্মতর্ব্য যে, ১৯৪৭ পূর্ববর্তী বছরগুলোতে কলকাতায় অধ্যয়নরত শেখ মুজিব রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে সোহরাওয়ার্দীর বিশ্বস্ত অনুসারী ছিলেন এবং তাঁর নেতৃত্বে পাকিস্তান দাবির সমর্থনে ১৯৪৫-৪৬এর নির্বাচনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন।

এ সময়, ১৯৪৬ সালের ৯ এপ্রিল দিল্লিতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের ব্যবস্থাপক সভার সদস্যদের সম্মেলনে জিন্নাহর পরামর্শে সোহরাওয়ার্দী একক পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ওই সভায় বাংলার মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ ছাড়াও ভারতের অন্যান্য প্রদেশের মুসলিম লীগের সব নেতাই একক পাকিস্তানের পক্ষে মতামত প্রদান করেন। ফলে একক পাকিস্তানের প্রস্তাব গৃহীত হয়। যদিও দিল্লি সভার প্রস্তাব সর্বভারতীয় লাহোর প্রস্তাবের ওপর প্রাধান্য পাবে কিনা সে প্রশ্নও বাঙালি নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে উত্থাপন করা হয়; কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত টেকানো সম্ভব হয়নি।

১৯৪৭ সালের প্রথম দিকে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ তাদের ভুল বুঝতে পারেন এবং সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাসিম স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। জিন্নাহ কিছুটা মৌন সম্মতি দিলেও কেন্দ্রীয় কংগ্রেসের বিরোধিতার মুখে এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই Indian Independence Act, 1947এর মাধ্যমে পাকিস্তান ও ভারত স্বাধীন করার জন্য ইম্পিরিয়াল পার্লামেন্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান ১৯৪৭ সালের ১৪ অগাস্ট স্বাধীন হলেও, ১১ অগাস্ট গণপরিষদে প্রদত্ত প্রথম নীতিনির্ধারণী বক্তৃতায় জিন্নাহ পেছনের কথা ভুলে গিয়ে সবাইকে মিলেমিশে সমানভাবে কাজ করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে ধর্মীয়ভাবে নয়, বরং রাজনৈতিকভাবে রাষ্ট্র পরিচলিত হবে। (Hindus would cease to be Hindus and Muslims would cease to be Muslims.)

এতে মনে হয়, নতুন রাষ্ট্রে তিনি হয়তো দ্বিজাতিতত্ত্বের পরিবর্তে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে একটি আধুনিক রাষ্ট্র গড়ার কথা চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু পূর্ববঙ্গের গণপরিষদে অবাঙালি ও উর্দুভাষীদের সদস্য হিসেবে গ্রহণ করার মাধ্যমে এ অঞ্চলের বঞ্চনা শুরু হল। গণপরিষদে বাঙালি সদস্য সংখ্যা হ্রাস পায়। পরে, ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে জিন্নাহ ঢাকার তদানীন্তন রেসকোর্স ও কার্জন হলে অনুষ্ঠিত দুটি পৃথক সভায় 'উর্দু হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা' বলে ঘোষণা করেন।

এভাবে স্বাধীনতা লাভের সাত মাসের মাথায় বাঙালিদের মননে ধাক্কা লাগে, তাদের আশাভঙ্গের সূচনা হয়। ধীরে ধীরে পূর্ববঙ্গ শুধু পূর্ব পাকিস্তান নয়, প্রকৃতপক্ষে পাঞ্জাবের একটি কলোনিতে পরিণত হয়। শুরু হয় তেইশ বছরের বঞ্চনার ইতিহাস।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং প্রদেশগুলোতে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে প্রথমে ছয় দফা দাবি উত্থাপন করে পাকিস্তানজুড়ে প্রচারণা চালান। জনগণের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা এবং ছয় দফার গ্রহণযোগ্যতা দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় শাসকগোষ্ঠী তাদের ওপর মিথ্যা ষড়যন্ত্র মামলাসহ কারা-নির্যাতন চাপিয়ে দমন-পীড়নের নীতি গ্রহণ করে। তাতে দেশের জনগণের কাছে তিনি আরও বেশি গ্রহণযোগ্য হন। জনগণ তীব্র আন্দোলনের মাধ্যমে তাঁর সহকর্মীদেরসহ তাঁকে কারামুক্ত করে। তিনি ভূষিত হন 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে।

এর পর থেকে বঙ্গবন্ধুর সুদক্ষ নেতৃত্বে আন্দোলনের ফলে সামরিক জান্তা আইয়ুব খান, যাকে এশিয়ার লৌহমানব বলা হত, পদত্যাগে বাধ্য হলেন। পরবর্তীতে ক্ষমতাসীন আরেক সামরিক জান্তা জেনারেল ইয়াহিয়া খানও Legal Framework Order (LFO) 1970 মারফত আওয়ামী লীগ কর্তৃক দাবিকৃত সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দিতে বাধ্য হলেন।

এভাবে মানুষের অধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ ধারাবাহিক সংগ্রামের মাধ্যমে জনগণের একক আস্থাভাজন নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সংগ্রামের এক মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠেন। আওয়ামী লীগ হয়ে যায় পাকিস্তানের একক সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দল। জাঁদরেল সামরিক জান্তা জেনারেল ইয়াহিয়া খান নির্বাচনের পর তাই শেখ মুজিবুর রহমানকে 'পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী' বলে সম্বোধন করতে বাধ্য হন।

১৯৭১ সালের ১ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খানের জাতীয় সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ নানা ক্ষোভ, দ্বিধাদ্বন্দ্ব সত্ত্বেও নিজেদের 'পাকিস্তানি' মনে করত। কারণ বাঙালিরাই তাদের ভোটের জোরে পাকিস্তান এনেছিল; কিন্তু ১ মার্চ অনির্দিষ্টকালের জন্য অধিবেশন স্থগিত ঘোষণায় পাকিস্তানি শাসকদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার তাদের একগুঁয়ে মনোভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রত্যেক বাঙালির মনে তখন একটি প্রতিক্রিয়াই দেখা দেয়, 'আর নয়, আর পাকিস্তান নয়, এবার এক দফা, বাংলার স্বাধীনতা'। বাঙালির মনোজগতে এই স্বয়ংক্রিয় প্রতিক্রিয়ার স্রষ্টা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এই লক্ষ্যেই তিনি পূর্ববর্তী বছরগুলোতে ক্রমাগত আন্দোলন করে গিয়েছিলেন।

এখানে উল্লেখ্য যে, আওয়ামী লীগ ৬ দফার ভিত্তিতে সমগ্র পাকিস্তানের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। ধারণা করা যায়, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু ৬ দফার ওপর ভিত্তি করে আপাতত স্বায়ত্তশাসন অর্জনের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিত উপায়ে পথপরিক্রমায় স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছিলেন।

১ মার্চ থেকে সমগ্র দৃশ্যপট দ্রুত বদলে যেতে থাকে। সে প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এ কারণে যদিও ১ মার্চ থেকে বাঙালিদের দাবি ৬ দফার পরিবর্তে ১ দফা তথা স্বাধীনতার দাবিতে পরিণত হয়, নির্বাচিত নেতৃবৃন্দকে তাদের নির্বাচনের ম্যান্ডেট এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পরিস্থিতি মাথায় রেখে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়েছে। বিশেষ করে ওই সময় আফ্রিকার নাইজেরিয়ার একটি অংশে, বায়াস্রায় চলমান স্বাধীনতা যুদ্ধ কোনোভাবেই আন্তর্জাতিক সমর্থন পাচ্ছিল না, বরং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তৎপরতা হিসেবেই গণ্য হচ্ছিল।

মনে হয়, এসব জটিল আন্তর্জাতিক ও জাতীয় সমস্যাগুলো মাথায় রেখেই বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ বলেছিলেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম'। যা শুধু স্বাধীনতার ঘোষণা বোঝায় না, বরং একটি চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে শাসকদের কাছে স্পষ্ট বার্তা পৌঁছে দেয়। আরও ধারণা করা যায়, বঙ্গবন্ধু সম্ভবত আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এ বার্তাই দিতে চাচ্ছিলেন যে, পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ স্বায়ত্তশাসন চাচ্ছে। যা আন্তর্জাতিক আইন অনুসারেও তাদের জন্মগত অধিকার। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে আসুরিক শক্তি প্রয়োগ করে আন্তর্জাতিক আইনবহির্ভূতভাবে তাদের নিষ্পেষণ করছে।

এটাও মনে রাখা চাই যে, ৬ মার্চ পাকিস্তানে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে এই বার্তা দেন যে, এ অঞ্চলের স্বাধীনতার ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করবে না। সে প্রেক্ষাপটেই হয়তো বঙ্গবন্ধু শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলেন। চরম দুর্যোগময় সে সময়ে যখন পাকিস্তানের সামরিক শক্তি বাংলার জনগণের ওপর নগ্ন হত্যালীলা শুরু করে, তখন এর দায়ভার ওদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরই ফলশ্রুতিতে আমরা দেখেছি সারাবিশ্ব বাংলাদেশের নিপীড়িত জনগণের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছে। এই কৌশলই বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচায়ক। এ কারণে তাঁকে শেষ সময় ২৬ মার্চের প্রথম প্রহর পর্যন্ত অসীম ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে অপেক্ষা করতে হয়েছিল।

১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র কিংবা এর পশ্চিম ও র্পূবাঞ্চল অবশ্যই বিদ্যমান ছিল। জাতিসংঘ সনদের আওতায় প্রত্যেক জাতি ও মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রয়েছে। ১ মার্চ পশ্চিমাঞ্চলে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বাধীন একটি সরকার কার্যকর থাকলেও পূর্বাঞ্চল বা পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সরকারের কর্তৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে ১ মার্চের পর থেকে এ অংশে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ অকার্যকর হতে থাকে। এর জেন্য দায়ী পাকিস্তানের সামরিক জান্তাদেরই কার্যক্রম।

১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের মোট ১৬২ আসনের মধ্যে ১৬০ আসন লাভ করে। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পর ১ মার্চ অপরাহ্নে জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত বাঙালি সদস্য ও প্রাদেশিক সদস্যরা তাদের সবার পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার সব ক্ষমতা বঙ্গবন্ধুকে অর্পণ করেন। বঙ্গবন্ধুর ওপর এরূপ আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা অর্পণের মাধ্যমে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনগণের পক্ষে তাঁর বক্তব্য প্রদান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের নৈতিক ও আইনগত ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়। ছাত্র সংগঠনগুলোও বঙ্গবন্ধুর ইঙ্গিতেই তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে।

৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দানে নীতিনির্ধারণী ও বাঙালির ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে স্পষ্ট বক্তব্য রাখেন। তারঁ নির্দেশনা অনুসারে পূর্ব পাকিস্তানের সব সরকারি অফিস-আদালত, বাণিজ্যিক সংস্থা, ব্যাংক, বীমাসহ সব ধরনের অফিস পরিচালিত হতে থাকে। এমনকি কাঁচা বাজারের মালিকরা সেনাবাহিনীকে খাদ্যসহ কাঁচামাল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। দেশের সব সাধারণ কার্যক্রম তাঁর নির্দেশ অনুসারে চলতে থাকে।

ওদিকে চট্টগ্রামের ডক শ্রমিকরা জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসে বিরত থাকে। দেশরক্ষা বিভাগে চাকরিরত বেসামরিক কর্মচারীরা অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করেন। ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে কেবল ক্যান্টনমেন্টগুলোতে পাকিস্তানের পতাকা উড্ডীয়মান হলেও সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়তে থাকে। এই প্রেক্ষাপটে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ ঢাকায় আগমন করেন এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন।

এ প্রসঙ্গে সাংবিধানিক ও আন্তর্জাতিক আইনের আলোকে ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থান পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ১৯৬২ সালে পাকিস্তানের জন্য তথাকথিত গণতন্ত্র সৃষ্টি করে সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে ওই সংবিধান বাতিল করে সামরিক আইন জারি করেন। পরবর্তীকালে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট সামরিক আইন ও জেনারেল ইয়াহিয়া খানের শাসনকাল উভয়ই অবৈধ ঘোষণা করেন।

প্রত্যেক জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত। এলএফওর আইনগত অবস্থান যাই হোক না কেন, পাকিস্তানে সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে একটি নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করায় দেশ সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধিদের শুধু নৈতিক নয় বরং আইনগত অধিকারও জন্ম নিয়েছিল। যা জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত হওয়ার দাবিও রাখে বটে। এরূপ প্রেক্ষাপটেই বঙ্গবন্ধু তদানীন্তন পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের নেতা ও বাঙালি জাতির নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে জেনারেল ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেন।

এবার আন্তর্জাতিক আইনের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি পর্যালোচনা করা যেতে পারে। এটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যে, দেশের জনগণ সাধারণভাবে দেশের মালিক। বিষয়টি তাত্ত্বিকভাবেও সঠিক। তবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য প্রয়োজন 'সংশ্লিষ্ট সময়ে কোন শক্তির হাতে রাষ্ট্রটির কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ (effective control) বিদ্যমান ছিল' তা নিরূপণ করা।

১৯৭১ সালের ১ থেকে ২৫ মার্চ পযন্ত নিঃসন্দেহে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের জনগণ তাদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে দেশের দৈনন্দিন সাধারণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু তারপরও জনপ্রতিনিধিরা সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের সব ধরনের প্রশাসনিক কার্যক্রমের কার্যকরী নিয়ন্ত্রণে ছিলেন তা বলা যায় না। জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও তার সামরিক কর্তৃত্ব সত্যিকার অর্থে অবৈধ হলেও প্রকৃতপক্ষে তারাই পূর্ব পাকিস্তানের এই অঞ্চলসহ সমগ্র পাকিস্তানের কার্যকরী নিয়ন্ত্রণে ছিল। যার প্রকাশ ঘটে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্মম ও পৈশাচিক প্রকাশে। সমাপ্তি ঘটে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অপরাহ্নে ঢাকায় মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণে।

১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে যে বাঙালি জাতিসত্তার বোধন, ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে তার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা। এরপর 'জয় বাংলা' রণধ্বনি লালন করে নয় মাসে সশস্ত্র সংগ্রাম। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে বাঙালি জাতিসত্তা কার্যকারিতা লাভ করেছিল, তা সশস্ত্র সংগ্রামে বাঙালিকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। যার পূর্ণতা লাভ হয় ১৬ ডিসেম্বরে। বাঙালি জাতি বাংলাদেশের de facto ও de jure মালিক হয়।

১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। পরের দিনই তিনি Provisional Constitution Order জারি করতঃ সর্বতোভাবে চরম বিধ্বস্ত দেশকে একটি আইনি কাঠামোর মধ্যে আনেন। তারপর তাঁর নেতৃত্বে মাত্র নয় মাসের মধ্যে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর জাতিকে একটি অতি উৎকৃষ্ট সংবিধান উপহার দিতে সক্ষম হন। যার বিকল্প এখনও পরিলক্ষিত হয় না। এটি একটি বিশ্ব রেকর্ডও বটে। আমার জানামতে, সদস্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত পৃথিবীর কোনো দেশেই এত অল্প সময়ে সংবিধান প্রণয়ন করতে পারেনি।

এই সংবিধান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায় লিখিত। এর ৪টি মূলনীতির একটি হল ধর্মনিরপেক্ষতা। সংবিধানে এই মূলনীতি গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে দ্বিজাতিতত্ত্বের আনুষ্ঠানিক মৃত্যু ঘটে।

আমাদের কোনো মার্শাল প্ল্যান ছিল না। বঙ্গবন্ধু সীমিত সম্পদ দিয়েই আক্ষরিক অর্থে সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশের বিনির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু করেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই দেশটির প্রায় সর্বক্ষেত্রে উঠে দাঁড়ানোর ছাপ স্পষ্টতর হতে থাকে। তখনই এই বজ্রাঘাত, ১৫ অগাস্টের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড। যা আমাদের পিছিয়ে দিতেই করা হয়। সে সব সময় কাটিয়ে আমরা এখন পরিণত একটি জাতি। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির ইতিহাসের মহান নেতা হিসেবে গোটা বিশ্বে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। দ্বিজাতিতত্ত্বের অপমৃত্যুর পর বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশের মূর্ত রূপ বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির জনকের প্রতি তাঁর মহাপ্রয়াণ দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।