গরিব দেশের আজম খান

বিদিশা
Published : 12 June 2011, 05:15 AM
Updated : 12 June 2011, 05:15 AM

আজম খানের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আমার পরিচয় ছিলো না, তাকে কাছে থেকে কখনো দেখিনি। এমনিতে তার সম্পর্কে তেমন কোন ধারণাও ছিলো না। কিন্তু কিছুদিন ধরে তাকে নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় যে লেখালেখি বা প্রচার হচ্ছে, সেসব আমার মনের মধ্যে বসিয়ে দিয়েছে আজম খানকে।

বাংলাদেশের মিডিয়া ও সাংবাদিকদের সম্পর্কে আমার মিশ্র অনুভূতি। ফেব্রিকেটেড জার্নালিজমের কারণে বেশ কয়েকবার আমাকে বিব্রত হতে হয়েছে, দু'একবার দারুণ বিপদেও পড়েছি। আবার এর বিপরীতে এই সাংবাদিকদের কারণেই জীবনের সবচেয়ে বড় ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষাও পেয়েছি। তাই সব মিলিয়ে আমার উপলব্ধি হলো, এমনিতে টুকটাক ডেভিয়েশন হয়তো আছে, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে বাংলাদেশের মিডিয়া সঠিক কাজটি করতে খুব একটা ভুল করে না।

যেমন করেনি এবার, আজম খানের ব্যাপারে। দেশের প্রতিটি পত্র-পত্রিকায়, টেলিভিশনে গত কয়েকদিন ধরে আজম খানকে নিয়ে লেখালেখি হয়েছে, অনুষ্ঠান প্রচার হয়েছে। সত্যি কথা বলতে কি, আসলে এসবের মাধ্যমেই কিছুটা ধারণা পেয়েছি আজম খান সম্পর্কে। তিনি পপ সঙ্গীতের শিল্পী ছিলেন। আর আমি বছর পাঁচেক আগে পর্যন্ত একটি পপ গানও পুরোটা শুনিনি। সেই শৈশব থেকেই আমি রবীন্দ্র সঙ্গীতের অনুরক্ত। সম্ভবত পারিবারিক কারণেই হয়েছে এটা। রবীন্দ্র সঙ্গীতের ভক্তের সংখ্যা এই দেশে অনেক, কিন্তু তারপরও আমি হয়তো কিছুটা অন্যরকম। হয়তো অনেকে বিশ্বাসই করবেন না, তারপরও সত্য যে, আমি দীর্ঘদিন রবীন্দ্র সঙ্গীত ছাড়া অন্য কোনো গানই শুনিনি। ছোটোকালে বাসায় এই গানই বাজতো। কিছুটা কম বয়সেই বিয়ে হয়ে যায় বিদেশীর সঙ্গে। বিদেশে স্বামীর বাড়িতে যাওয়ার সময় দেশ থেকে যে কয়টা গানের ক্যাসেট নিয়ে গিয়েছিলাম, তার সবই ছিলো রবীন্দ্র সঙ্গীতের। মন খারাপ লাগলে, কিংবা মন ভালো থাকলে, ওগুলোই শোনা হতো। বর আমার বিদেশী হলেও বাংলা বুঝতে, বলতে ও লিখতে পারতো। রবীন্দ্রনাথের প্রতি তারও ছিলো প্রবল অনুরাগ। তাই সে-ও ওই রবীন্দ্র সঙ্গীতের ক্যাসেট ছাড়া অন্য কোনো গান কিনে দেয়নি। তাই অন্য কিছুর প্রতি ন্যূনতম আগ্রহও জন্মায়নি। এভাবেই চলছিলো।

আমার এই একরৈখিক যাত্রায় প্রথম ব্যাঘাত ঘটালো আমার বড় ছেলে উইলিয়াম। ছোট বেলা থেকেই গান-বাজনার প্রতি ওর প্রবল আগ্রহ। বয়স কুড়ি পেরোনোর আগেই উইলিয়াম আর তার বন্ধুরা মিলে একটি ব্যান্ড গড়ে তোলে। ইলেক্ট্রিক রিভার নামের সেই দলটি ইংল্যান্ডে এখন কিছুটা নাম-ডাকও করেছে বলে শুনি। আমি ওদের কয়েকটা কনসার্টেও গিয়েছি। ছেলে আমার বেশ ভালোই গায়, অন্তত ওকে নিয়ে ভক্তদের মধ্যে যে উন্মাদনা দেখেছি, তাতে সে রকমই মনে হয়েছে। উইলিয়ামদের গানগুলোর সঙ্গে রবীন্দ্র সঙ্গীতের কোনোই মিল নেই, তারপরও ওই গান শুনতে আমার কিন্তু তেমন একটা মন্দ লাগেনি। সুর, মিউজিক–এসব কিছুটা চড়া টাইপের হলেও কিছু কিছু গানের কথা খুবই চমৎকার। পছন্দের একটি গান নিয়ে কথা বলতে যেয়ে উইলিয়াম যখন জানালো সেটির কথাগুলো তারই লেখা, আমার ভালো লাগার পরিমাণ যেনো বেড়ে গেলো আরও। ওই প্রথম মনে হলো, রবীন্দ্র সঙ্গীতের বাইরেও ভালো লাগার মতো কিছু গান রয়েছে, থাকতে পারে।

গেলো বছর উইলিয়াম দেশে এলে আমি বেশ গর্ব করেই ওকে আমাদের ঐতিহ্যবাহী লোকসঙ্গীতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চাইলাম। ও বাংলা তেমন বোঝে না। তাই ঠিক করলাম বাংলা গানের সঙ্গে হয়তো বোঝাপড়াটা ততটা সম্ভব হবে না, তবে আমাদের লোকজ বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে পরিচয়টা সহজেই হতে পারে। উইলিয়াম খুবই উপভোগ করলো, তবলা, একতারার সঙ্গে একাত্ম হয়ে বাজালো সে তার গিটার। আমাদের এরিক বিস্ট্রোতে সে রাতের সেই সঙ্গীত আয়োজনটি বেশ জমেছিলো। আমার বন্ধু, পরিচিতদের মধ্যে যারা সে সন্ধ্যায় সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তাদের অনেকেই বলেছিলেন, বাংলার সঙ্গে পাশ্চাত্যের এক অসাধরণ মিলন নাকি দেখলেন তারা। আমার কাছেও মনে হলো, সঙ্গীতের কাছে আসলেই রাষ্ট্রীয় সীমানা কোনো বাধা-ই নয়। শিল্প, সংস্কৃতি, সঙ্গীতের একটা সার্বজনীন ভাষা রয়েছে, রাষ্ট্রীয় সীমানাকে অতিক্রম করে তা সকলের মধ্যেই তৈরি করতে পারে এক মানবিক আবেদন।

সেই একই ধরনের অনুভূতি আবারও টের পেলাম এবার আজম খানের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ইলেক্ট্রানিকস মিডিয়ায় প্রচারিত অনুষ্ঠানগুলো দেখে। মনে হলো কী এক অসাধারণ দক্ষতায় পাশ্চাত্যের সঙ্গে সম্মিলন ঘটিয়েছেন তিনি বাংলার সুর ও মননের। তার কয়েকটা সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনুষ্ঠানও দেখলাম কয়েকটি চ্যানেলে। শিশুর মতো সরল এক শিল্পীর অকপট উচ্চারণ অবলোকন করলাম।

চিকিৎসা অসমাপ্ত রেখে সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত আসার পর একটি টেলিভিশন চ্যানেলে ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন আজম খান। দেখলাম অতিসাধারণ তার বাড়ি ঘর। এত বড় একজন শিল্পী, অথচ ঘরদোয়ার, আসবাবপত্র এমনকি তার পোশাক পরিচ্ছদে পর্যন্ত নেই ন্যূনতম প্রাচুর্যের ছোঁয়া। একই রকম আটপৌঢ়ে সারল্য লক্ষ্য করলাম তার আলাপচারিতাতেও। বললেন, টাকা শেষ হয়ে যাওয়াতেই চিকিৎসা শেষ না করেই ফিরে এসেছেন সিঙ্গাপুর থেকে। সাংবাদিক যখন জানতে চাইলেন, কারও কাছে অর্থ সাহায্য চাইবেন কিনা, আজম খান বললেন, না, আমি কারো কাছে কিছু চাই না। এই গরীব দেশে কারও কাছে কিছু চাওয়া ঠিক না। আমি বরং দেশকে আরও কিছু দিতে চাই। যতদিন বেঁচে থাকবো, যেনো দিয়ে যেতে পারি। তার এই কথাগুলো আমাকে খুবই স্পর্শ করলো। কী দারুন সাহসী আর মর্যাদাবোধসম্পন্ন উচ্চারণ! জীবনের এই চরম মুহূর্তেও কারও কাছে কোন প্রকার সাহায্য না চাওয়ার মানসিকতা এই দেশে খুব বেশি দেখা যায় না।

এই ইন্টারভিউটি দেখার পর আমার খুবই জানতে ইচ্ছা হলো, আজম খান কি পরে আবার সিঙ্গাপুরে যেতে পেরেছিলেন তার অসমাপ্ত চিকিৎসা শেষ করতে? আমি খবর নেয়ার চেষ্টা করলাম। যা জানলাম, তা আমাকে হতাশই করলো কেবল।

টেলিভিশনে আজম খানের অন্তিম বিদায়ের দৃশ্যগুলোও দেখলাম। শহীদ মিনারে তার কফিনকে ঘিরে অগনিত মানুষ। এদের অনেকেই বিখ্যাত এই সমাজে, প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা অর্থনৈতিক উভয় বিবেচনাতেই। বিভিন্ন চ্যানেলেই দেখলাম আজম খানকে নিয়ে লাগাতার অনুষ্ঠান। এটাই শেষ নয়, একটি মোবাইল কোম্পানীকে দেখলাম, এরই মধ্যে আজম খানকে নিয়ে একটি বিজ্ঞাপনও করে ফেলেছে।

মাথায় আমার একটি ছেলেমানুষী চিন্তা ভর করলো। আচ্ছা, যে লোকগুলো আজম খানের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে হাজির হয়েছিলেন, তারা সবাই যদি ১০টি করেও টাকা দিতেন, তাহলে কি আর টাকার অভাবে অসমাপ্ত থাকতো শিল্পীর চিকিৎসা? অথবা ধরা যাক, মোবাইল কোম্পানীর ওই বিজ্ঞাপন চিত্রটির কথা-ই। ওই বিজ্ঞাপন চিত্রটি তৈরি করতে যে অর্থ ব্যয় হয়েছে, এবং সেটা বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচার করতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হবে, সেই অর্থের ক্ষুদ্র একটি অংশই হয়তো লাগতো আজম খানের চিকিৎসা শেষ করতে।

আজম খানের ক্যান্সার হয়েছিলো। আমরা যারা সুস্থ সবল আছি বলে মনে করছি, তাদেরকেও একদিন মরতে হবে। তারপরও আমরা চেষ্টা করি, যতদিন বাঁচি যেন সুস্থভাবে শান্তিতে বাঁচতে পারি। আর ক্যান্সার হলে মৃত্যু যে কিছুটা ত্বরান্বিত হবে, এটা অভাবিত কোনো তথ্য নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আজম খানকে আমরা, এই জাতি কি তার জীবনের শেষ সময়ে সেই শান্তিটি তাকে দিতে পেরেছিলাম? অথবা নিদেন পক্ষে সেই শান্তি দেয়ার জন্য চেষ্টা করতে পেরেছিলাম?

নিবেদিতপ্রাণ শিল্পী, কবি, সাহিত্যিকদের পক্ষে আর যা-ই হোক ভালো গৃহস্থ হওয়া সম্ভব নয়। এটা আমাদের নিজের পরিবারেও দিনের পর দিন দেখেছি। আমার পিতাকে যতটা ভালো সাহিত্যিক বলা যাবে, ততটাই খারাপ বলতে হবে সংসারী হিসাবে। নিজের ভবিষ্যত নিয়ে কখনো তাকে চিন্তিত হতে দেখিনি। তার এই বৈশিষ্ট্যকে আমাদের মা কিংবা আমরা ভাইবোনরা কখনো কি মুগ্ধদৃষ্টিতে দেখেছি? আমাদের মনোভাবকে তিনি যদি পাত্তা দিতেন, তাহলে হয়তো তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনো অধ্যাপক হয়েই থাকতে হতো, আজকের সাহিত্যিক আবুবকর সিদ্দিক হয়ে উঠতে পারতেন না।

শিল্পী সাহিত্যিকরা যা কিছু করেন, তা কি তাদের ব্যক্তিগত লাভের জন্য? আজম খান যা কিছু করে গেছেন, তার উত্তরাধিকার কি কেবল তার তিন সন্তান? আমরা বাঙালিরা কি আজম খানের গান নিয়ে গর্ব করছি না, করবো না? তাহলে আজম খানের প্রতি আমাদেরও কি কিছু দায়িত্ব ছিলো না? সে দায়িত্ব কি আমরা পালন করতে পেরেছি?

এ কথা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, সকল নাগরিকের প্রতিই রাষ্ট্রের একটা দায়িত্ব রয়েছে। আমরা সাধারণ মানুষেরা নিজের প্রতি, নিজের পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করে থাকি। কিন্তু যারা আজম খানের মতো অসাধারণ, যারা নিজের পরিবারের চেয়ে বেশি চিন্তা করেন দেশ ও দেশের শিল্প সংস্কৃতি নিয়ে, তাদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব কিছুটা বেশি-ই থাকা দরকার। কিন্তু সেই দায়িত্ব কি এবার পালিত হয়েছে, আজম খানের ক্ষেত্রে?

চিকিৎসাটা শেষ হলেই যে আজম খান বেঁচে যেতেন, সেটাও হয়তো নয়। তবে সে ক্ষেত্রে যেটা হতে পারতো, তা হলো জীবনের শেষ সময়টাতে তিনি এই তৃপ্তি নিয়ে থাকতে পারতেন যে, এই গরীব দেশের মানুষেরা মনোজগতেও অতটা দরিদ্র নয়, অন্ততঃ শিল্পীকে তারা সম্মান জানাতে পারে।

বিদিশা: ফ্যাশন ডিজাইনার ও লেখক।