যুদ্ধাহতের ভাষ্য: ৩৫ ‘‘অনেক মুক্তিযোদ্ধাকেই রাজাকার হতে দেখেছি’’

সালেক খোকনসালেক খোকন
Published : 3 August 2015, 08:03 PM
Updated : 3 August 2015, 08:03 PM

''বাবার ইচ্ছে ছিল তাঁর প্রথম সন্তান যদি হয় মেয়ে তবে নাম রাখবেন 'নিলু'। ছেলে হলে 'চন্দন'। দশ ভাইবোনের মধ্যে আমি তৃতীয়। কিন্তু প্রথম ছেলে সন্তান। তাই বাবার ইচ্ছেতেই নাম রাখা হয়, 'চন্দন'। পুরো নাম কাজী জাকির হাসান চন্দন।

বাবা কাজী মকবুল হোসেন ছিলেন আর্টিস্ট। তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিও কোলকাতার স্টাফ আর্টিস্ট ছিলেন। একাধারে ছিলেন গায়ক, নাট্যকার, গীতিকার, চিত্রনাট্যকার, অভিনেতাও। সহকারী পরিচালক হিসেবে প্রমথেস বড়ুয়ার সঙ্গে কাজ করেছেন 'দেবদাস' ও 'মুক্তি' ফিল্মে। তাঁর সমসাময়িক ছিলেন গীতিকার মুকুল দত্ত, সুরকার নচিকেতা ঘোষ, জগন্ময় মিত্র প্রমুখ।

বাবাকে দেখে ছোটবেলা থেকে আমারও ইচ্ছে, শিল্পী হব, নাটক লিখব ও ডিরেকশন দিব। কিন্তু আর্টিস্ট হয়েও বাবা তা চাইতেন না। কারণ তখন শিল্পীদের জীবন ছিল কষ্টের। পরিবার থেকে তাঁকে দূরে দূরে থাকতে হত। টাকাকড়ি ছিল না। তাঁদের জীবনটাই ছিল সাধনার। এখন তো দুএকটা নাটক লিখলে আর দুচারটা চরিত্রে অভিনয় করলেই সবাই আর্টিস্ট হয়ে যায়। বাড়ি, গাড়ি আরও কত কী! ব্যবসায়ী আর আটির্স্ট এখন আলাদাভাবে চেনার উপায় নেই!

শৈশব ও কৈশোরের নানা স্মৃতির কথা শুনছিলাম যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কাজী জাকির হাসান চন্দনের মুখে। তাঁর মায়ের নাম জুলেখা বেগম। গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা গ্রামে। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি খাটামারি প্রাইমারি স্কুলে। তিনি এসএসসি পাশ করেন কুড়িগ্রাম রিভারভিউ হাই স্কুল থেকে। পরে চলে যান বাবার কাছে, ঢাকার বাসাবোতে। ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন আবুজর গিফারি কলেজে। ১৯৭১ তিনি ছিলেন ওই কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র।

স্কুলজীবনের স্মরণীয় ঘটনার কথা আমাদের জানালেন মুক্তিযোদ্ধা জাকির হাসান। তাঁর ভাষায়:

''আমি তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। সে সময় অনেকেই স্কুলে যেত ঘোড়ার পিঠে, হাতির পিঠে চড়ে। শুনেছি, আমার দাদারও ঘোড়া ছিল। কিন্তু আমাদের ঘোড়াও ছিল না, হাতিও না। আমি বড় আব্বার (বড় চাচা) একটি ষাঁড় গরুকে পোষ মানালাম। ওই ষাড়ের পিঠে চড়ে স্কুলে পৌঁঁছেই ওকে ঘাস খাওয়ানোর জন্য মাঠে ছেড়ে দিতাম। আবার ওর পিঠে চড়েই বাড়ি ফিরতাম। আমি যখন চলতাম তখন রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়ে মানুষ সে দৃশ্য দেখত। কেউ কেউ মুচকি হাসত। বড় আব্বা দেখলেন, বিষয়টি খুব শোভনীয় নয়। তাই একদিন ষাঁড়টি বিক্রি করে দিলেন। ওই ষাঁড়ের জন্য সেদিন খুব কেঁদেছিলাম। সে সব দিনের কথা মনে হলে আজও আপন মনে হাসতে থাকি।

[মুক্তিযোদ্ধা কাজী জাকির হাসানের মুখে একাত্তরের বিবরণ:

১৯৬৯ দিকের কথা। গ্রামের মধ্যে একবার নাটক হয়েছিল। ফয়েজ আহমেদের 'মুক্তাহার' নাটকটি। দস্যুর চরিত্রটি আমি করি। মেকআপ দিয়ে তখন ছেলেদের নায়িকা বানানো হত। যাত্রা নাটকে নগ্নতা বলে কিছু ছিল না। অভিনয়ই ছিল প্রাণ। বুলবুল অপেরা, বাবুল অপেরা, নবরঞ্জন অপেরা ছিল নামকরা। এখন তো যাত্রা মানেই জুয়া আর অশ্লীল নৃত্য।''

দেশের অবস্থা তখন কেমন ছিল ?

জাকির হাসানের উত্তর:

''রাজনৈতিক চেতনাবোধ তখন আমাদের মধ্যে ছিল না। দেশের নানা বৈষম্যের কথা বড়দের মুখে শুনতাম, বেতার ও পত্রিকা থেকে জানতাম। ভাসানী ও শেখ মুজিব তখন আন্দোলন করছেন। সত্তরের নির্বাচনের আগে শেখ মুজিব এসেছিলেন কুড়িগ্রামে। নাগেশ্বরীতে তিনি ভাষণ দেন। পাটেশ্বরীতে গাড়িতে ওঠার সময় তাঁর হাতের স্পর্শ পেয়েছিলাম। তাঁর সম্মোহনী কণ্ঠ শুনে ও ব্যক্তিত্ব দেখে মনে হয়েছিল এই লোকই দেশের রাজা!''

৭ মার্চ, ১৯৭১ মুক্তিযোদ্ধা জাকির হাসান রেসকোর্স ময়দানে খুব কাছ থেকে শুনেন বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটি। তাঁর ভাষায়, ''পুরো ভাষণটাই যেন একটি কবিতা। একটির সঙ্গে অন্যটির ছন্দেও মিল। কোথাও এতটুকু ছন্দপতন ঘটেনি। ভাষণের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বডি ল্যাগুয়েজ। এটা যেন ঐশ্বরিক একটা ব্যাপার। আমার কাছে এটি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণ।''

২৫ মার্চ রাতে আপনারা কোথায় ছিলেন?

''দেশের অবস্থা তখন থমথমে। ২০ মার্চ অনেক কষ্টে ঢাকা থেকে পরিবারসহ আমরা চলে আসি কুড়িগ্রামে। পরে ঢাকার গণহত্যা ও বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের খবর পাই বেতারে।''

স্বাধীনতার ঘোষণা কি শুনেছিলেন?

মুচকি হেসে জাকির হাসান বলেন:

''দেখুন, ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরেই কিন্তু লড়াইয়ের জন্য মানসিকভাবে আমরা তৈরি হয়ে যাই। বুঝে যাই, সংগ্রাম করেই স্বাধীনতা আনতে হবে। ওই ভাষণটাই ছিল স্বাধীনতার ভাষণ। এরপর মুক্তিযোদ্ধাদের আর কোনো ঘোষণারই প্রয়োজন পড়ে নাই।''

ট্রেনিং নিয়েছেন কোথায়, কোন সময়?

তিনি বলেন:

''এপ্রিলের প্রথম দিককার কথা। চাচাতো ভাই রাজু, ভাতিজা মহিম আর আমি সিদ্ধান্ত নিই যুদ্ধে যাওয়ার। মায়ের আঁচল থেকে নিই ১২ আনা, রাজু আনে ১০ টাকা আর মহিম দেড় টাকা। এ নিয়েই আমরা চলে যাই ভুরুঙ্গমারীতে। পুলিশের লোকেরা ভুরুঙ্গামারী কলেজে ট্রেনিং করাচ্ছিলেন। ৪-৫দিন ফিজিক্যাল ট্রেনিংএর পর আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় টাপুর হাট, কুচবিহারে। সেখান থেকে দার্জিলিংয়ের শিলিগুঁড়িতে, মূর্তি ক্যাম্পে। পরে ওই ক্যাম্পের নামকরণ করা হয়, 'মুজিব ক্যাম্প'। আমাদের ১৫০ জনকে ট্রেনিং দেওয়া হয় ৬ সপ্তাহ। আমার এফএফ বা বডি নং ছিল এফ/৩৩। পূর্ণ সামরিক ট্রেনিং দিয়েছিল ইন্ডিয়ান আর্মি। মেজর বারমা, মেজর রঙ্গিলা, ক্যাম্পের সিও সিআর দাসের কথা আজও মনে পড়ে।''

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা জাকির হাসান যুদ্ধ করেন ৬ নং সেক্টরের লালমনিরহাট সাব সেক্টরে। ৪৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি কোম্পানির দায়িত্বে ছিলেন তিনি। তাঁদের ক্যাম্প ছিল ভারতের গিতালদহ পুরনো রেল স্টেশনে। সীমান্ত পার হয়ে তাঁরা অপারেশন করেন লালমনিরহাটের মোগলহাট, কাকিনা, গোরপমণ্ডল, আদিতমারী, স্বর্ণামতি ব্রিজ, রতনাই ব্রিজ, বড় বাড়ি প্রভৃতি এলাকায়। সেক্টর কমান্ডার এম কে বাসারের অধীনে তাঁদের কমান্ড করতেন ভারতীয় ক্যাপ্টেন উইলিয়াম।

অপারেশনের ধরন সম্পর্কে এই বীর যোদ্ধা বলেন:

''আগে রেইকি করতাম। পরিকল্পনাটা ক্যাপ্টেন অনুমোদন করলেই রাতে অপারেশন করতাম আমরা। সকাল হলেই আত্মগোপন করে থাকতাম। আক্রমণ করে সরে পড়াই ছিল নিয়ম।''

এমনিভাবে মুক্তিযুদ্ধ করতে গিয়ে এক অপারেশনে এই মুক্তিযোদ্ধা মারাত্মকভাবে রক্তাক্ত হন। পাকিস্তানি সেনাদের পুঁতে রাখা মাইন বিষ্ফোরণে তাঁর ডান পায়ের হাঁটুর নিচের অংশ উড়ে যায়। সারা শরীরে তৈরি হয় বারুদের ক্ষত। রক্তমাখা সেই দিনের কথা মনে করিয়ে দিই আমরা। কী ঘটেছিল সেদিন? প্রশ্ন শুনে জাকির হাসানের চোখ দুটি ছলছল করে। বুকের ভেতরে জমে থাকা নিঃশ্বাস দীর্ঘ হয়। অতঃপর স্মৃতি হাতড়ে তিনি তুলে আনেন চুয়াল্লিশ বছর আগের ঘটনাটি–

''আমরা ছিলাম ক্যাম্পে। ফুলবাড়ির গোরপমণ্ডল এলাকা থেকে এক বৃদ্ধ এসে খবর দেয় সেখানে পাকিস্তানি আর্মিরা নিত্যদিন এসে নারীদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ক্যাপ্টেন উইলিয়াম নির্দেশ দিলেন সেখানে অপারেশন চালাতে। দুজন কোম্পানি কমান্ডারকে দায়িত্বও দেওয়া হল। কিন্তু রেইকি ভুল হওয়ায় তারা সফল হলেন না। ফলে সেটির দায়িত্ব এসে পড়ে আমার ওপর।

১ জুলাই, ১৯৭১। বশির ও শামসুল কিবরিয়াকে নিয়ে আগে রেইকি করতে বেরুই। আলাদাভাবে ক্যাপ্টেন উইলিয়ামও বিএসএফের কয়েক সদস্য নিয়ে রেইকি করেন। ডেমুনেশনের সময় রেইকির তথ্য উপস্থাপন করতেই তিনি মুচকি হাসেন। জানালেন, রেইকি এবার সঠিক হয়েছে। অপারেশনের জন্যে সঙ্গে দিলেন ১৭-১৮জনকে। আমি ছিলাম কমান্ডে।

ক্যাম্প থেকে দড়িবাস নামক একটি জায়গা পেরিয়ে শাখা নদী জারি ধরলা পার হয়ে যেতে হয় গোরপমণ্ডল এলাকায়। জারি ধরলার কাচারটা ছিল বেশ উঁচুতে। সেখানে ছিল বিরাট এক পাকুর গাছ। রেইকির সময় আমরা দেখেছি ৮ থেকে ১০ জন পাকিস্তানি সেনা ওই গাছের নিচে রেস্ট নিচ্ছে। আমাদের পরনে ছিল সাধারণ পোশাক। ওরা যে আমাদের মার্ক করেছে, এটি আমরা বুঝতে পারিনি।

২ জুলাই, ১৯৭১। ভেলায় করে নদী পার হয়ে আমরা এগুতে থাকি। রাত তখন ৩টা। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। আমরা পজিশন নিয়ে আছি। আমার কাছে এলএমজি। দুই সাইডে দুইজন। ওদের হাতে রাইফেল। আমরা একটু উঁচুতে। রাস্তাটা নিচে। বিভিন্ন পয়েন্টে আমরা ওঁত পেতে থাকি। ভোর হয় হয়। টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছে। দূর থেকে দেখা গেল পাকিস্তানি সেনাদের টুপি আর রাইফেল। বুঝলাম ওরা আসছে। অপেক্ষায় থাকি রেঞ্জের ভেতর আসার।

ওরা এই দিক দিয়েই গ্রামের দিকে ঢুকবে, তাই আমরা অ্যামবুশ করে বসে আছি। কিন্তু আসলে আমরা নিজেরাই ছিলাম ওদের অ্যামবুশের ভেতরে। আমাদের আসার সমস্ত পথে ওরা মাইন পুঁতে রেখেছে। যা আমরা বুঝতেও পারিনি। মিরাকেল ব্যাপার হল, পজিশন নেওয়া পর্যন্ত ওদের একটি মাইনও ফোটেনি।

ওরা রেঞ্জের মধ্যে আসতেই 'চার্জ' বলে একটি গ্রেনেড চার্জ করলাম। অন্যরাও তিন দিক থেকে চার্জ করল। ওদের দশজনই স্পট ডেথ। আমরা তো ভেবেছি বিজয় হয়ে গেছে। পাশেই ছিল সহযোদ্ধা বন্ধু আকরাম হোসেন। উঁচু একটি জায়গায় সে মাইনের সুতা দেখতে পায়। পাশ থেকে সুতাটা হাতে নিয়ে সে বলে, 'জাকির, মাইন'। আনন্দে আমার তখন হুঁশ নাই। এলএমজিটা বাম হাতে ধরা। লুঙ্গিটা নেংটির মতো পরে আমি উঠে বললাম, 'কোথায় মাইন', বলেই একটা লাফ দিয়েছি, অমনি বিস্ফোরণ!

ছিটকে পড়ে গেলাম। গরু জবাই করলে যেমন হয় তেমনিভাবে ডান পা থেকে রক্ত বের হয়ে ভেসে যাচ্ছিল। দেখলাম হাঁঁটুর নিচ থেকে পা উড়ে গেছে। গাছের শিকড়ের মতো রগগুলো বের হয়ে আছে। দেখেই চিৎকার দিয়ে উঠলাম। ভুরুঙ্গমারীর আনিসুল, আকরাম, নীলফামারীর শহিদুলসহ সহযোদ্ধারা গামছা দিয়ে আমার পাটা বেঁধে দেয়। ভেলায় করে প্রথম নিয়ে আসে ক্যাম্পে। পরে চিকিৎসার জন্য আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কুচবিহার জি এন হাসপাতালে। ওখানেই ডান পা হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলা হয়। অতঃপর ব্যারাকপুরসহ বিভিন্ন হাসপাতাল হয়ে কিরকি মেডিকেল হাসপাতাল থেকে কৃত্রিম পা লাগিয়ে দেওয়া হয়। পা ছাড়াও আমার সারা শরীরে ছিল বারুদের ক্ষত। এখনও তা যন্ত্রণা দেয়।''

স্বাধীনতার পরে মুক্তিযোদ্ধা জাকির হাসান স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে যোগ দেন বাংলাদেশ বেতারে। ১৯৭২ সালে বেতারে তাঁর প্রথম নাটক 'খেয়াঘাটের মাঝি' প্রচারিত হয়। ঢাকা বেতার নাট্যচর্চার ইতিকথা, বেতার নাটকের নিজস্ব আর্টিস্টদের জীবনী, সারাদেশের বেতার নাট্যশিল্পীদের জীবনী প্রভৃতিসহ তাঁর ১৫টির মধ্যে ৫টি গবেষণা গ্রন্থ রয়েছে। সর্বশেষ তিনি বাংলাদেশ বেতারের মূখ্য পাণ্ডুলিপিকার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা জাকির হাসান অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামত:

''তাদের উত্থান দেখে কখনও ভাবিনি বিচার হবে। ওরা তো অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী। তবুও বিচার ঠেকাতে পারেনি। স্বাধীন দেশে রাষ্ট্র তো সময় ও আইনি সুবিধা দিয়েই বিচার করছে। কিন্তু একাত্তরে তারা যখন মানুষকে হত্যা করেছে, তখন কতটা সময় দিয়েছিল? উচিত তো এদের প্রকাশ্যে গুলি করে মারা। কিন্তু রাষ্ট্রর সেটি করেনি। দ্রুত এদের রায়গুলো কার্যকর করা উচিত। তার আগ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।

মৃত্যুর আশঙ্কা তুচ্ছ করে যিনি সাহসের সঙ্গে এই বিচারপ্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে গেছের তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তাঁর প্রতি মুক্তিযোদ্ধাদের দোয়া সব সময় থাকবে।''

স্বাধীন দেশে রাজাকাররা হয়েছিল রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রী। তাদের গাড়িতে উড়েছে লাল সবুজ পতাকা। সে সময়কার কষ্টের কথা বলতে গিয়ে আবেগতাড়িন হন মুক্তিযোদ্ধা জাকির হাসান:

''একজন মুক্তিযোদ্ধার হাত ধরেই এদেশে পুনর্বাসিত হয়েছে রাজাকাররা। তারা রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রীও হয়েছে। দেশের ইতিহাস হয়েছে কলঙ্কিত। ক্ষমতার লোভ মানুষকে কতটা নিচে নামাতে পারে তার উদাহরণ হতে পারেন জিয়াউর রহমান। তার দল এখনও চায় না যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হোক। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাদের বক্তব্যও স্পষ্ট নয়। রাজাকারদের সুযোগ নেই মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার। কিন্তু স্বাধীনতার পর একাত্তরের অনেক মুক্তিযোদ্ধাকেই রাজাকার হতে দেখেছি!''

কথা প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা জাকির হাসান যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীর সাজা নিয়ে বললেন, ''এমন অপরাধীদের সর্বনিম্ন সাজা 'ফাঁসি'। আমরা এদের সর্বোচ্চ শাস্তিই প্রত্যাশা করি।''

কথা ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে। তিনি বলেন, ''সরকারের আন্তরিকতা থাকলেই সঠিক তালিকা করা সম্ভব। তবে শিকড়ে যেতে হবে। আগে দেখতে হবে, যারা কমান্ডার তারা মুক্তিযোদ্ধা কিনা, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে কারা করাপশন করছে, সে সব।''

স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালো লাগার অনুভূতি জানতে চাই আমরা। উত্তরে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন:

''দেশ তো অনেক এগিয়েছে। আমাদের প্রবৃদ্ধি অনেক বেড়েছে। আগে আমাদের অঞ্চলে মঙ্গা নামক অভাব ছিল। কই, এখন তো মঙ্গা নেই। এদেশের ছেলেমেয়েরা তাদের মেধার স্বাক্ষর রাখছে সারা পৃথিবীতে। এটা দেখলে মন ভরে যায়।''

তবু তাঁর খারাপ লাগে যখন রাজনীতির নামে জ্বালাও-পোড়াও দেখেন। স্থির হয়ে যান তখন। একাত্তরেও তো মুক্তিযোদ্ধারা কোনো রাজাকার বা পাকিস্তানি সেনাকে ধরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারেননি। এই নির্মমতার সঙ্গে যোদ্ধাদের পরিচয় নেই। জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারা কোন রাজনীতি এটা বোঝেন না তিনি। তাঁরা দেশের জন্য যুদ্ধ করতে গেছেন, জীবনের কথা মনে রাখেননি। কিন্তু এখন অনেকের মাঝেই দেশপ্রেম দেখেন না এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। সবাই ব্যস্ত নিজেদের নিয়ে। স্বার্থের কারণে দুর্নীতিও নিয়মে পরিণত হয়েছে। এ সব দেখে তাই কষ্ট পান তিনি।

কী করলে দেশ আরও এগুবে এ নিয়ে জানতে চাই তাঁর কাছে। তাঁর মতে, মানুষের জন্য অর্থনীতি ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। অন্যায় যে করবে সে যে দলের বা যত শক্তিশালী হোক না কেন, রাষ্ট্রের স্বার্থে তার শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

পরবর্তী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার কথা বলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কাজী জাকির হাসান। তিনি মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধের বিষয়গুলো প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে। তাদের উদ্দেশে তিনি বললেন:

''এখন যা দেখছি এই ধারা যদি চলে তবে আমাদের বিশ্বাসটা পুরোপুরি তোমাদের ওপর। আমি প্রচণ্ড আশাবাদী, আমাদের অসমাপ্ত কাজ তোমরা অবশ্যই শেষ করতে পারবে।''

সংক্ষিপ্ত তথ্য

নাম: যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কাজী জাকির হাসান চন্দন।

ট্রেনিং নেন: ৬ সপ্তাহের ট্রেনিং নেন দার্জিলিংয়ের শিলিগুড়ির মূর্তি ক্যাম্পে (মুজিব ক্যাম্প)।

এফএফ নং: এফ/৩৩।

যুদ্ধ করেছেন: ৬ নং সেক্টরের লালমনিরহাট সাব সেক্টরে।

যুদ্ধাহত: ২ জুলাই, ১৯৭১। ভোর বেলা। ফুলবাড়ির গোরপমণ্ডল এলাকায় অপারেশনের সময় পাকিস্তানি সেনাদের পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে তাঁর ডান পায়ের হাঁটুর নিচের অংশ উড়ে যায়। তাঁর সারা শরীরে তৈরি হয় বারুদের ক্ষত।

ছবি ও ভিডিও: সালেক খোকন।

সালেক খোকন: লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক।