রাজনীতির মাঠে গোল ও একজন সাকা চৌধুরী

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 29 July 2015, 00:54 AM
Updated : 29 July 2015, 00:54 AM

যুদ্ধাপরাধের দায়ে ইতোমধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আত্মীয়রা প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করেছেন বলে গুজব রটেছিল। সাকা নামে পরিচিত এই লোক পারেন না হেন কাজ নেই বলে জনশ্রুতি রয়েছে। তার পেছনে পাকিস্তানের আইএসএস রয়েছে বলে জানা যায়। তার সঙ্গে আছেন আওয়ামী লীগের হিন্দু নেতা। তার নাকি বিএনপি-জামায়াত, এমনকি ভারতীয় কানেকশনও খুব দৃঢ়। তার আগে বলে নিই তার বিরুদ্ধে কঠিন হবার বিকল্প খুঁজে না পাবার কারণ।

আমি মৃত্যু অপছন্দ করি। ধর্ম, প্রকৃতি বা যে কোনো অর্থে মানুষের জীবনের চেয়ে পরম কোনো সম্পদ নেই। কেউ আমার শত্রূ হলেও যা আমি তাকে দিতে পারি না তা কেড়ে নিতে পারি না। তাই মৃত্যু আমাকে টানে না। আমরা বাঙালিরা এমনিতেই বড় দুঃখবিলাসী। বিবাহের মতো আনন্দ অনুষ্ঠানেও আমরা কেঁদে বুক ভাসাই। ভালোবেসে মা-বাবার অমতকে মত বানিয়ে সংগ্রাম করা মেয়েও পর্যন্ত বিয়ের দিন তা করে। গান শুনে, নাটক দেখে, কবিতা পড়েও কাঁদি আমরা। অন্যরা যে কাঁদে না তা নয়। তবে এমন আবেগ অন্য জাতিতে বিরল।

এমন আবেগপ্রবণ জাতির লোক আমি, মৃত্যুর খবরে তাই আমার আনন্দের কিছু নেই। বরং কান্নাপ্রিয় জাতির চোখ সজল হবারই কথা তাতে। কিন্তু সব মরণ নয় যে সমান। কিছু কিছু মানুষ আছে যারা তাদের জীবনকে নিজের কারণে অন্যের কাছে বিষময় করে তোলেন। তাদের অজান্তে বা ইচ্ছে করেই তারা মানুষের দুশমনে পরিণত হন। দুনিয়ায় সবাইকে খুশি করা কারও দ্বারা সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা বলছি তাদের কথা যারা তাদের কৃতকর্মে পুরো জাতি এমনকি রাষ্ট্রকেও বিষিয়ে তোলেন। তখন তাদের জন্য কান্না তো দূরের কথা ভাবার মানুষও থাকে না।

খবরে দেখলাম, এই ঘাতকের বিরুদ্ধে করা মামলার চূড়ান্ত রায়ের দিন গণজাগরণমঞ্চ কর্মসূচি চালিয়ে যাবার ঘোষণা দিয়েছে। এই মঞ্চ এক সময় আশা-ভরসার প্রতীক হয়ে উঠলেও পরে সেটা টেকেনি। কেন, সে কথার পুনরাবৃত্তির দরকার নেই। তবু তাদের এই কর্মসূচিতে আমারও সমর্থন থাকবে।

বলছিলাম মরণজয়ের কথা। সাকা চৌধুরীকে আমরা চট্টগ্রামবাসীরা যেভাবে দেখেছি বা দেখে বড় হয়েছি তাতে করুণা করারও কারণ দেখি না। সত্যি বলতে কী, আমি গোলাম আযম ও সাঈদীর শাস্তির আদেশ হবার পর কিছুটা হলেও ভেবেছি। ভেবেছি এ কারণে যে, এরা আমাদের বিরুদ্ধে হলেও বিশেষ এক আদর্শের মানুষ। এদের জীবনের কোথাও না কোথাও উত্থান আছে বা ছিল। তারা কোনোদিন মন্ত্রী ইত্যাদিও হননি। যদিও তারা আমাদের রাজনৈতিক শত্রু, তারপরও আমাদের ভেতরেই রয়েছে তাদের সমর্থকরা।

বিপরীতে সাকা হচ্ছেন খানিকটা নির্বোধ আর খানিকটা উন্মাদ ধরনের লোক। এখন দেখা যায় তার জন্য কেউ নেই। কীভাবে থাকবে? এই লোক যে রাজনীতি আশ্রয় করে বেঁচেছেন তাকেও ছাড় দেননি। খালেদা জিয়া ও তারেকেকে নিয়ে যে অশ্লীল ব্যঙ্গ করেছেন তা আওয়ামী লীগাররাও করেনি কখনও। আরেকবার এক নির্বাচনী জনসভায় বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের মার্কাকে তিনি নৌকা মনে করেন না, এটা নাকি মা কালীর জিভ। এমন কথা কোনো সভ্য দেশে বললে সেদিনই তার রাজনৈতিক জীবনের অবসান ঘটত। হিন্দুদের পক্ষ থেকে পরে প্রতিবাদ এলে তিনি নানা অজুহাতে পার পেয়ে যান। শোনা গিয়েছিল, তার অপরাধমুক্তির পেছনে আওয়ামী লীগের কিছু নেতার ভূমিকা ছিল।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এমনই। রাজনীতির জন্য সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মবিদ্বেষ কাজে লাগান; দোস্তির বেলায় হিন্দুপ্রেম।

বিএনপিতে আসার আগে তিনি এনডিপি নামে একটি দল গড়েছিলেন। এক নেতা আর কিছু সাগরেদ ও খুনির দল হয়ে উঠেছিল সেটি। সে দলের দেয়াল লিখনে প্রচ্ছন্ন দেশবিরোধিতা থাকত। আঞ্চলিকতার নামে চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে পৃথক রাখার এক জঘন্য ভাবনা নিয়ে দেয়াল লিখনগুলো হত। এমনকি চট্টগ্রামকে প্রদেশ করে ফেলা হোক বা চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসন চাই এগুলোও লেখা হত।

এ জাতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী লেখালেখির পরও এরশাদ সরকার তার বিরুদ্ধে কোনো দিন মামলা করেননি। কারণ সেটা ছিল অগণতান্ত্রিক একনায়কের শাসন। যেনতেন প্রকারে গদিতে থাকার জন্য যে কাউকে দরকার ছিল তাদের। সে সুযোগে সাকা সমান তালে দেশবিরোধী কথা বলে গেছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, আওয়ামী লীগও তার বিরুদ্ধে কথা বলেনি।

মানুষ যখন শুরুতে মিথ্যা বলে তখন অনুত্প্ত, লজ্জিত হয়। আল্লাহর দরবার মাফ চায়। কিন্তু মিথ্যা বলা যখন অভ্যাসে পরিণত হয় তখন সে ভাবে ঈশ্বরকেও ঠকানো যায়। সাকার বেলায় সেটাই দেখেছি আমরা। এবারের আগেরবারে বিএনপির ভরাডুবির ইলেকশনে সাকা কিন্তু জিতে এসেছিলেন। পেয়ারুর বিরুদ্ধে জয়ের সে নির্বাচনে নির্বাচনী ঘোষণাপত্রে তিনি স্বভাবসুলভ হামবড়াভাবে লেখাপড়ার কলামে 'শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই' বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন।

অন্যদিকে একই লোক নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যার অপরাধ থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য বলছেন যে, সে সময় তিনি পাকিস্তানে পড়তে গিয়েছিলেন। যে লোক স্বাধীন দেশের নির্বাচনে দাঁড়াতে গিয়ে 'লেখাপড়া নেই' বলে ঘোষণা দেন, তিনি একাত্তরে লাহোর বা পাঞ্জাবের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করলেন কীভাবে? জানি না এর উত্তর কেউ চেয়েছেন কিনা। না চাইলেও অবাক হব না। কারণ এ দেশে সবকিছু সম্ভব।

যে কথা বলছিলাম, সাকা চৌধুরী এখন শেষ রায়ের দোরগোড়ায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে চিরকাল ফোঁড়ন কাটা আর দালালি করে যাওয়া এই লোকের শাস্তি আমরা না চেয়ে পারি না। কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হবার পরিবর্তে মানুষকে খেলো করা, তাচ্ছিল্য করা আর পাকপ্রেমে মশগুল থাকা সাকা গোলাম আজমের চেয়ে কম বড় অপরাধী নন। একাত্তরে তার কারণে রাউজান এলাকা সন্ত্রাস আর হত্যার অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছিল। একটি দেশ, দেশের মানুষ, শহীদ আর ধার্মিকদের আস্থা নিয়ে খেলা করা অনেক বড় অপরাধ।

আজ মনে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আরও কবার ঋণী হয়ে গেলাম আমরা। দাম্ভিকতা, আস্ফালন, ধরাকে সরা জ্ঞান করা আর খুনের রাজনীতি যে চিরদিন চলে না, সাকার বিচারের ভেতর দিয়ে সেটাই যেন প্রমাণিত হতে যাচ্ছে। একদা রাজনীতির মাঠে বাজেভাবে গোল দিলেও চিরকাল সে সুযোগ মিলবে না কারও, সেটাও বোঝা হোক। তাছাড়া দেশ ও মাটির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার ফলও পেতে হয়। এদেশের সন্তান শুধু হিন্দু বা আওয়ামী লীগ করার কারণে খুন হবে আর তার বিচার হবে না! রবীন্দ্রনাথ সে কবে বলেছিলেন, 'তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছো ভালো?'

এ দেশ এ সময় এ লোককে মার্জনা করার মতো বর্বর হয়নি আজও।