ফ্যাটি লিভার: ক্রমশ দৃশ্যমান ঘাতক

মামুন আল মাহতাব
Published : 28 July 2015, 09:40 AM
Updated : 28 July 2015, 09:40 AM

সারা বিশ্বে ২৮ জুলাই বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস হিসেবে পালিত হয়। বিশেষ এই দিনে বিশ্বব্যাপী লিভার রোগ তথা হেপাটাইটিস প্রতিরোধ বা চিকিৎসা সম্বন্ধে গণসচেতনতার মাধ্যমে হেপাটাইটিস-জনিত লিভার সিরোসিস ও ক্যান্সার প্রতিরোধে এক বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।

উন্নত বিশ্বের পাশাপাশি বাংলাদেশেও লিভার রোগ এক ক্রমবর্ধমান সমস্যা। একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, বর্তমানে বাংলাদেশে লিভার সিরোসিস, লিভার ক্যান্সার, ফ্যাটি লিভার, ভাইরাসজনিত (এ, বি, সি, ডি, ই) লিভার রোগ, পরজীবীজনিত লিভার ফোঁড়াসহ লিভারের অন্যান্য রোগে সব মিলিয়ে প্রায় ৩ কোটি মানুষ আক্রান্ত। চিত্রটি খুবই আশঙ্কাজনক। এসব রোগের মাঝে ফ্যাটি লিভারের প্রাদুর্ভাব বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। বর্তমানে দেশের বেশিরভাগ মানুষ ফ্যাটি লিভারের ঝুঁকিতে রয়েছে। অন্য একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে প্রতি ৪ জনে ১ জন ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত।

প্রাথমিক অবস্থায় যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে ফ্যাটি লিভার থেকে লিভার সিরোসিস, এমনকি লিভার ক্যান্সারও হতে পারে। সময় এসেছেে এ রোগের ব্যাপারে ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তোলার। নতুবা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ব্যাপক স্বাস্থ্য-ঝুঁকিতে পড়বে। তাই আসুন ফ্যাটি লিভার রোগটির বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য জেনে নেওয়া যাক।

ফ্যাটি লিভার: লিভারের অচেনা শত্রু

ফ্যাটি লিভার লিভারের একটি খুব সাধারণ রোগ। এর কথা প্রথম শোনা যায় ১৯৬২ সালে। তবে ১৯৮০ সালে অধ্যাপক লুডউইগ প্রথম রোগটি ভালোভাবে ব্যাখ্যা করেন। এটির ব্যাপ্তি অনেক। এ রোগের কারণে লিভারে সাধারণ চর্বি জমা থেকে শুরু করে লিভার সিরোসিস, এমনকি লিভার ক্যান্সারও হতে পারে। ইদানিংকালের গবেষণাগুলোতে দেখা যায়, লিভার সিরোসিসের যে রোগীদের বেলায় রোগের মূল কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না, তাদের অনেকেই আসলে ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত।

যেসব কারণে ফ্যাটি লিভার হয়

পাশ্চাত্যে ফ্যাটি লিভারের মূল কারণ অ্যালকোহল। তবে আমাদের মতো দেশগুলোতে মেদ-ভুড়ি, ডায়াবেটিস, ডিজলিপিডেমিয়া বা রক্তে অতিরিক্ত চর্বি, হাইপারটেনশন বা অতিরিক্ত রক্তচাপ আর হাইপো-থাইরয়েডিজম ফ্যাটি লিভারের মূল কারণ। বিশেষ করে ডায়াবেটিস রোগীদের এতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি খুব বেশি। আমেরিকার এক গবেষণায় দেখা যায়, সেখানে ৩৩ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগীর ফ্যাটি লিভার রয়েছে। অন্যদিকে ৪৯ শতাংশ ভারতীয় যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে, তারা পাশাপাশি ফ্যাটি লিভারেও আক্রান্ত।

হেপাটাইটিস ভাইরাসগুলোর মধ্যে হেপাটাইটিস সি ভাইরাস অনেক সময় ফ্যাটি লিভারের কারণ হয়ে থাকে। কর্টিকোস্টেরয়েড, টেমোক্সিফেন ইত্যাদি ঔষধ দীর্ঘদিন সেবনেও এ রোগ হতে পারে। এর আরেকটি বড় কারণ, খাদ্যাভ্যাস ও লাইফস্টাইল। সিডেন্টারি বা আয়েশি জীবনযাপন আর অতিরিক্ত ফ্যাট বা কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবার খেলে লিভারে চর্বি জমতেই পারে। আমাদের দেশে ইদানিংকার খুব জনপ্রিয় 'ফাস্ট-ফুড' কালচার এদেশে ফ্যাটি লিভারের রোগীর সংখ্যাবৃদ্ধির সম্ভবত বড় একটি কারণ।

ফ্যাটি লিভারের প্রাদুর্ভাব

রোগটি বিশ্বজনীন। তবে পশ্চিমা বিশ্বে এর প্রাদুর্ভাব খুব বেশি। শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ পূর্ণবয়স্ক আমেরিকান ও ১০ ভাগ শিশু এতে আক্রান্ত। জাপান ও ইটালিতে মোট জনসংখ্যার ৩০ থেকে ৫৮ শতাংশের এটা রয়েছে।

এতে আক্রান্ত অনেকেরই লিভারে ক্রনিক হেপাটাইটিস দেখা দিতে পারে যাকে আমরা বলি স্টিয়াটো-হেপাটাইটিস। পাশাপাশি এটিও এখন সুপ্রতিষ্ঠিত যে, ফ্যাটি লিভার লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান কারণ। আগামী কয়েক দশকে প্রায় ২ মিলিয়ন আমেরিকান এ রোগের ফলে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হবে বলে এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়। প্রতিবেশি ভারতে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত রোগীদের শতকরা ১৬ ভাগের ফ্যাটি লিভার রয়েছে।

লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের উপর সিঙ্গাপুরে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উপস্থাপিত তথ্য অনুযায়ী যে সমস্ত রোগীর স্টিয়াটো-হেপাটাইটিস রয়েছে, তাদের প্রায় ৩০ শতাংশের লিভারে সিরোসিস দেখা দিতে পারে। এদের কেউ কেউ লিভার ক্যান্সারেও আক্রান্ত হতে পারেন।

আমাদের দেশেও চিত্রটি, বিশেষ করে শহর এলাকায়, সম্ভবত খুব একটা অন্য রকম নয়। আমরা প্রায়শই ফ্যাটি লিভারের রোগীদের দেখা পাই। সম্প্রতি আমাদের পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের পর ফ্যাটি লিভারই এদেশে ক্রনিক হেপাটাইটিসের প্রধান কারণ। একইভাবে সম্প্রতি প্রকাশিত আমাদের এক গবেষণায় দেখা যায় যে, এদেশে প্রায় ৫ শতাংশ লিভার সিরোসিস রোগী ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত। এ থেকে লিভার সিরোসিস হলে, ১৫ শতাংশ রোগী সাত বছরের মধ্যে আর ২৫ শতাংশ দশ বছরের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন।

রোগের লক্ষণ ও রোগ নির্ণয়

অন্যান্য বেশিরভাগ ক্রনিক লিভার ডিজিজ রোগীদের মতো ফ্যাটি লিভারের রোগীদেরও সাধারণত কোনো লক্ষণ থাকে না। এদের কেউ কেউ পেটের ডান পাশে উপরের দিকে ব্যথা, ভার-ভার ভাব বা অস্বস্তি, দুর্বলতা কিংবা খুব অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ার কথা বলে থাকেন। শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এসব রোগীর প্রায় ৫০ শতাংশের লিভার বড় পাওয়া যায়। রক্ত পরীক্ষায় সিরাম ট্রান্স-এমাইনেজ বেশি থাকতে পারে। তবে এটি স্বাভাবিক থাকলেই যে লিভারে হেপাটাইটিস নেই এ কথা বলা যায় না।

ফ্যাটি লিভার নির্ণয়ে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পরীক্ষাটি হচ্ছে আলট্রাসনোগ্রাম, যদিও সিটি স্ক্যান বা এমআরআই এ ক্ষেত্রে বেশি নির্ভরযোগ্য। পাশাপাশি ফ্যাটি লিভারের অধিকাংশ রোগীর রক্তে সুগার, কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইড বেশি থাকে। সম্প্রতি ফ্যাটি লিভার নির্ণয়ে যে চমৎকার পরীক্ষাটি খুবই কার্যকর হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে তার নাম ফাইব্রোস্ক্যান। সরকারি, বেসরকারি অনেক হাসপাতালেই পরীক্ষাটি এখন সহজলভ্য। আলট্রাসনোগ্রামের কাছাকাছি এই পরীক্ষা করাও খুব সহজ।

তবে নিশ্চিত করে ফ্যাটি লিভার নির্ণয়ের পরীক্ষা হচ্ছে লিভার বায়োপসি। এতে একদিকে যেমন নির্ভুলভাবে রোগ ডায়াগনোসিস করা যায়, তেমনি পাশাপাশি লিভারে স্টিয়াটো-হেপাটাইটিস, ফাইব্রোসিস এবং সিরোসিসের উপস্থিতি সম্বন্ধেও শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যায়।

ফ্যাটি লিভারের চিকিৎসা

ফ্যাটি লিভার চিকিৎসার মূল লক্ষ্যই হচ্ছে লিভারে সিরোসিস ও ক্যান্সারের ঝুঁকি প্রতিরোধ করা। অতিরিক্ত মেদ কমানো এ চিকিৎসার অন্যতম দিক। তবে খুব দ্রুত, অপরিকল্পিতভাবে ওজন কমালে হিতে বিপরীত হতে পারে। কারণ এর ফলে লিভার সিরোসিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়। ওজন কমানোর জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পরিকল্পিত ডায়েট কন্ট্রোল, এক্সারসাইজ, ঔষধ সেবন কিংবা প্রয়োজনে অপারেশন করা যেতে পারে। পাশাপাশি রোগের কারণ নির্ণয় ও তার যথাযথ চিকিৎসাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ফ্যাটি লিভারের কারণে লিভারে যে ক্ষয়ক্ষতি হয় তা থেকে লিভার রক্ষা ও পাশাপাশি লিভারে হেপাটাইটিস কমিয়ে আনার জন্য সারা পৃথিবীতেই ব্যাপক গবেষণা চলছে। এদেশে আমরা এ বিষয়ে সীমিত পরিসরে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। এ কথা ঠিক যে, এখনও এ জন্য শতভাগ কার্যকর ঔষধ আবিষ্কৃত হয়নি। তবে বাজারে এমন বেশ কিছু ঔষধ আছে যা এ রোগের চিকিৎসায় উপকারী বলে প্রমাণিত। এর বেশিরভাগই বাংলাদেশেও পাওয়া যায়। এসব ঔষধের মধ্যে ইনসুলিন সেন্সেটাইজারস, আরসোডিঅক্সিকলিক এসিড, প্রোবায়োটিক, ভিটামিন-ই, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, ভিউসিড অন্যতম।

শেষ কথা

এক সময় ধারণা করা হত, হার্ট বা ব্রেনে চর্বি জমে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের মতো মারাত্মক রোগের সৃষ্টি করলেও লিভারের ক্ষেত্রে বিষয়টি তেমন নয়। গত দশকে সেই ধারণায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এটি আজ প্রমাণিত যে, ফ্যাটি লিভার লিভারের অন্যতম প্রধান রোগ। ২০০২ সালেও যেখানে লিভার রোগের প্রধান বইগুলোতে রোগটির উপর আলাদা চ্যাপ্টার ছিল না, সেখানে আজ লিভার রোগের যে কোনো আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে বা নামকরা জার্নালগুলোর অনেকখানি জুড়ে থাকছে ফ্যাটি লিভার।

সঠিক সময়ে এ রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য চিকিৎসক ও রোগী সবারই ব্যাপক সচেতনতার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। কারণ শুরুতে ব্যবস্থা নিলে এটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিরাময়যোগ্য।

ডা. মামুন-আল-মাহতাব: সহযোগী অধ্যাপক, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।