ইরান-চুক্তি দ্বারা কার কতটা লাভ

আবদুল গাফফার চৌধুরী
Published : 25 July 2015, 04:28 PM
Updated : 25 July 2015, 04:28 PM

ইরানের পরমাণু শক্তির গবেষণা নিয়ে পশ্চিমা শক্তি, বিশেষ করে আমেরিকার সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে দেশটির যে বিরোধিতা, তার অবসান হয়েছে। উভয় পক্ষের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছে। এই চুক্তির ফলে ইরান পরমাণু শক্তির গবেষণা চালালেও বোমা বানানোর পথে এগুবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এমনকি এ ব্যাপারে পশ্চিমা পর্যবেক্ষণের দাবিও মেনে নিয়েছে। অন্যদিকে, পশ্চিমা শক্তিও ইরানের উপর অর্থনৈতিক অবরোধ, ইরানের তেল বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে রাজি হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলোতে ইরানের যে বিরাট অঙ্কের টাকা 'ফ্রোজেন অ্যাসেট' হিসেবে আটকে রয়েছে, তাও তাদের ফেরত দেওয়া হবে। পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়েও ইরানের উপর আর বাধা-নিষেধ থাকবে না।

এই চুক্তির বিস্তারিত বিবরণ ইতোমধ্যেই দেশ-বিদেশের মিডিয়ার বিরাটভাবে প্রচারিত হয়েছে। সুতরাং তার পুনরুল্লেখ নিস্প্রয়োজন। এখন দেখতে হবে এই চুক্তি দ্বারা কোন পক্ষের লাভ কতটা এবং এই চুক্তি দ্বারা বিশ্ববাসীর কতটা কল্যাণ হবে। এটা স্পষ্ট যে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ওবামা এই চুক্তি করার জন্য আন্তরিকভাবে আগ্রহী ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, হোয়াইট হাউস থেকে বিদায় নেবার আগে শান্তিবাদী হিসেবে নিজের একটি উজ্জ্বল ভাবমূর্তি যেন রেখে যেতে পারেন এবং আমেরিকারও কল্যাণ সাধন করতে পারেন।

অনেক বাধার মুখে সেটা তিনি পেরেছেন। আমি এবার বার দিন ধরে আমেরিকা ঘুরে এসে বুঝতে পেরেছি, দেশটির সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশই মনে করেন, ওবামা তাঁর অনেক সীমাবদ্ধতা, দুর্বলতা ও ভুল-ভ্রান্তি সত্ত্বেও আমেরিকাকে মহাধ্বংসের আশঙ্কা থেকে রক্ষা করেছেন। জুনিয়র বুশের নেতৃত্ব নিউকন্-অ্যাডমিনিস্ট্রেশন আমেরিকাকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দেউলিয়াপনার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছিল। সেই ধ্বংস থেকে বাঁচার জন্য ওবামা কালো মানুষ এবং অর্ধেক খ্রিস্টান হওয়া সত্ত্বেও হোয়াইট এস্টাবলিসমেন্ট তাঁকে হোয়াইট হাউসে ঢুকতে দিয়েছিল।

ওবামা এই এস্টাবলিসমেন্টের সঙ্গে কখনও আপোস করে, কখনও অনেকটা পিছিয়ে গিয়ে আবার এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাঁর প্রচেষ্টায় আমেরিকার অর্থনৈতিক পতন রোধ হয়েছে, রাজনৈতিক বিপর্যয়ও দেশটি ঠেকাতে সক্ষম হয়েছে। আজ না হোক কাল, আমেরিকার ইতিহাসে ওবামার এই অবদান স্বীকৃতি পাবে।

বিশ্বশান্তির ক্ষেত্রে ওবামা তাঁর প্রেসিডেন্টগিরির শেষ পাদে এসে দুটি অবদান রেখেছেন। একটি কিউবার সঙ্গে বিরোধের অবসান। অন্যদিকে, 'এনেমি নাম্বার ওয়ান' বা ইরানের সঙ্গে দীর্ঘকালের শত্রুতা মিটিয়ে পরমাণু গবেষণা প্রশ্নে চুক্তি সম্পাদন। তাতে ইরান এবং আমেরিকা দুটি দেশের কার কতটা লাভ-লোকসান হয়েছে তা খতিয়ে দেখার চাইতেও বড় বিবেচ্য বিষয় হল, আমেরিকার এই দুটি পদক্ষেপের ফলে বর্তমানের অস্থির বিশ্ব শান্তি ও স্থিতিশীলতার পথে কিছুটা হলেও এগিয়ে গেল।

এই চুক্তির তীব্র বিরোধিতা করেছে আমেরিকার রিপাবলিকান পার্টির কট্টর রক্ষণশীল 'নিওকন' অংশ। অন্যদিকে বিরোধিতা করেছে ইসরায়েল এবং সউদি আরব। ইসরায়েল এবং সউদি আরব যুক্তভাবে চেয়েছিল, পরমাণু শক্তির গবেষণার ব্যাপারে কোনো চুক্তিতে না গিয়ে ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করুক আমেরিকা। ইসরায়েলের নিজস্ব পরমাণু অস্ত্রের মওজুদ রয়েছে। তথাপি তার দাবি, ইরান যাতে পরমাণু শক্তির অধিকারী হতে না পারে সে জন্যে আগেভাগেই তাকে শায়েস্তা করা হোক। তাহলে আরব ভূখণ্ডে অবৈধ দখল বজায় রাখা এবং প্যালেস্টাইনিদের উপর অবাধে হামলা চালাতে থাকা তার পক্ষে সম্ভব হবে। মধ্যপ্রাচ্যে ইরান সমশক্তিশালী দেশ হয়ে উঠলে ইসরায়েলকে তার আগ্রাসী ভূমিকা থেকে সরে আসতে হবে।

সউদি আরবের ভয়, শিয়া-রাষ্ট্র ইরান মধ্যপ্রাচ্যে শক্তিশালী হয়ে উঠলে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তির অবসান হবে। এমনিতেই সউদি আরবে যে শিক্ষিত ও আধুনিকমনা মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠছে, তারা মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্রের অবসান চায়। এই রাজতন্ত্র বর্তমানে আমেরিকার প্রোটেকশন, অঢেল পেট্রোডলার এবং কট্টর ওয়াহাবি তত্ত্বের জোরে টিকে আছে। ওয়াহাবি মতবাদ থেকে উদ্ভূত টেরোরিজম, আজ যা মধ্যপ্রাচ্যে এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ ধর্মীয় সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে, আমেরিকা তার নিজের স্বার্থে এই সন্ত্রাসে প্রথমে সাহায্য জোগালেও (যেমন তালেবান ও আইসিস আমেরিকা ও সউদি আরবের মদদে প্রথম তৈরি হয়) এখন এই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের সঙ্গে নিজেই যুদ্ধরত। প্রেসিডেন্ট ওবামা এই যুদ্ধরত অবস্থা থেকে আমেরিকার অর্থনীতি ও রাজনীতিকে বাঁচাতে চান। তাই তাঁর মধ্যপ্রাচ্য-নীতি নতুন এক বাঁক নিয়েছে।

ফলে ইসলায়েল ও সউদি আরব এখন ক্রুদ্ধ এবং শঙ্কিত। এতদিন ধরে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার সবচাইতে বড় মিত্র এই দুটি দেশ। দুই মিত্রের সাহায্যে মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসবাদবিরোধী গণজাগরণ ঠেকানো, তেলস্বার্থ রক্ষা, স্বাধীনচেতা জাতীয়তাবাদী আরব রাষ্ট্রনায়কদের দমন, ইসরায়েলের অস্তিত্বরক্ষা ইত্যাদি ছিল ওয়াশিংটনের নীতি-নির্ধারণের ভিত্তি। এখন মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি যতই ঘোরালো হয়ে উঠছে, ততই আমেরিকাকে নীতি বদলাতে হচ্ছে।

মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার, বিশেষ করে গ্লোবাল ক্যাপিটলিজমের স্বার্থ ও আধিপত্য রক্ষা করতে হলে ইসরায়েল ও সউদি আরবের দ্বারা তা আর সম্ভব নয়। দুটি দেশই তাদের শক্তিশালী আঞ্চলিক অবস্থান হারাচ্ছে। সেখানে পশ্চিমা শক্তির অর্থনৈতিক অবরোধ, সামরিক হামলার হুমকি সব কিছু উপেক্ষা করে ইরান আঞ্চলিক সুপার পাওয়ার হয়ে উঠতে যাচ্ছে। সব বাধা কাটিয়ে দেশটি হয়তো আণবিক অস্ত্রেরও অধিকারী হবে। ওবামা তাই সময় থাকতে সব বাধা ও আপত্তির মুখে তার মধ্যপ্রাচ্য-নীতি বদলাতে চাচ্ছেন।

ওবামার এই নীতির সঙ্গে সত্তরের দশকের গোড়ায় আমেরিকার রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট নিকসনের চীন সম্পর্কিত নীতির তুলনা টানা চলে। কুড়ি বছরের বেশি নয়াচীনকে জাতিসংঘে ঢুকতে না দিয়ে, দেশ থেকে বহিস্কৃত চিয়াং সরকারকে চীনের প্রতিনিধি হিসেবে খাড়া করে রেখে, নয়াচীনের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ও সামরিক অবরোধ চালিয়েও যখন দেখা গেল অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি নিসেবে নয়াচীনের অভ্যুত্থান রোধ করা যাচ্ছে না, তখন হঠাৎ ওয়াশিংটন নয়াচীনের দিকে মৈত্রীর হাত বাড়ায়। চিয়াং সরকারকে জাতিসংঘ থেকে তাড়ায়। নয়াচীনকে 'ফেভারিট ট্রেড পার্টনার' হিসেবে বুকে টেনে নেয় এবং চীনের সঙ্গে এই মৈত্রীকে সোভিয়েট ইউনিয়নের পতনের কাজে লাগায়।

এক সময় রাশিয়া ও চীনের তাত্ত্বিক ঝগড়া দ্বন্দ্বে পরিণত করে আমেরিকা যেমন সেভিয়েট ইউনিয়নের পতন ঘটিয়েছিল, তেমনি পরবর্তীকালে শিয়া-সুন্নি বিরোধ উস্কে দিয়ে ইরানের বিরুদ্ধে ইরাককে আট বছর যুদ্ধে ব্যাপৃত রেখেছে। এই যুদ্ধে শিয়া ইরানকে শায়েস্তা করার জন্য সউদি আরব, কুয়েত, কাতারসহ কয়েকটি সুন্নি রাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মদদ জুগিয়েছিল।

বর্তমানে মূলত সুন্নি সম্প্রদায়ভুক্ত সন্ত্রাসীদের দ্বারা গঠিত আইসিস যখন খেলাফত প্রতিষ্ঠার নামে মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, তখন শিয়া-রাষ্ট্র ইরানকে পাশে টেনে আমেরিকা এই শত্রু দমন করতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। ওবামার বর্তমান শান্তিবাদী ভূমিকার পেছনে এই লক্ষ্যও অনেকটা কাজ করেছে।

যে লক্ষ্যেই ইরান ও আমেরিকার মধ্যে পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে থাক, তাতে দুদেশের জন্য লোকসানের চাইতে লাভের পাল্লাটাই বেশি। এই চুক্তি সন্ধানের দ্বারা আমেরিকা প্রমাণ করেছে, সে তার আধিপত্যবাদী স্বার্থ রক্ষার জন্য যে কোনো সময় যে কোনো মিত্রকে কোল থেকে নামিয়ে দিতে পারে। এক সময় চীনের কুওমিংটাং সরকার এই শিক্ষাটি পেয়েছে। এখন পেয়েছে সউদি আরব ও ইসরায়েল।

তবে তাদের ত্যাগ করেনি ওয়াশিংটন। মধ্যপ্রাচ্যে তার গেমপ্লানে এখনও রিয়াদ ও তেল আভিভকে দরকার। সুতরাং তাদের একেবারে পরিত্যক্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই। তবে তারা এই ভেবে ভীত যে, আমেরিকার শত্রুতামুক্ত হলে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে যে আঞ্চলিক সুপার পাওয়ারের অবস্থানে সহজেই উঠে আসবে, তাতে সউদি রাজতন্ত্র এবং ইসরায়েলের দস্যুবৃত্তির দিন শেষ হয়ে যেতে পারে।

এবার ইরান ও পশ্চিমা শক্তিবলয় তথা আমেরিকার লাভের কথা বলি। মধ্যপ্রাচ্যে সউদি আরব ও ইসরায়েলের কাঁধে ভর করে এবং শিয়া-সুন্নি-বিরোধ উস্কে দিয়ে আধিপত্য ও তৈলস্বার্থ বজায় রাখার দিন যে শেষ হয়েছে এটা ওয়াশিংটন বুঝতে পেরেছে। সাদ্দামকে ধ্বংস করতে গিয়ে বুশ প্রশাসন প্রকারান্তরে ইরানকেই আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে মাথা তোলার সুযোগ করে দিয়েছে। ওবামা তাই শান্তিবাদী মনোভাব গ্রহণের সঙ্গে বুশের মধ্যপ্রাচ্য-নীতিতেও পরিবর্তন আনতে চেয়েছেন। বুশ-নীতির লক্ষ্য ছিল, সিরিয়ার আসাদকেও ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করার পর ইরানের দিকে এগিয়ে যাওয়া। ইরানে 'রেজিম চেঞ্জ' দ্বারা গোটা মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আধিপত্য ও ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। রাশিয়া, চীন, ইরান এবং আরও কয়েকটি দেশের সম্মিলিত বিরোধিতায় তা সম্ভব হয়নি।

ওবামা তাঁর শান্তিবাদী নীতি অনুসরণের সুযোগ পেয়েছেন এবং ইরানের দিকে আপোসের হাত বাড়িয়েছেন। রিপাবলিকানদের কট্টর অংশ এবং শক্তিশালী ইহুদি লবির বিরোধিতা উপেক্ষা করে তিনি চুক্তিটি সম্পাদনে সক্ষম হয়েছেন। অবশ্য তার ভবিষ্যৎ নির্ভর করে মার্কিন কংগ্রেসের উপর। ওবামা আপাতত যুদ্ধক্লিষ্ট মার্কিন অর্থনীতি চাঙ্গা করার জন্য বুশের যুদ্ধ-সম্প্রসারণ নীতি থেকে সরে আসতে চাইছেন। ইরাক থেকে মার্কিন সৈন্য সরিয়ে আনার নীতি, ইরান ও কিউবার সঙ্গে শত্রুতার অবসান তারই প্রমাণ।

এ জন্যে আমেরিকার শ্বেতাঙ্গদের বর্ণবাদী একটা অংশ এখন ওবামার উপর ভয়ানক কুপিত হতে পারে। কিন্তু একদিন তিনি ইতিহাসে আমেরিকার ত্রাণকর্তা হিসেবে বিবেচিত হবেন এমন ধারণা অনেকেই পোষণ করেন।

ইরান-চুক্তি দ্বারা আমেরিকা লাভবান হবে। যুদ্ধ-অর্থনীতির উপর নির্ভরতা আমেরিকাকে প্রায় অন্তিম অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছিল। ওবামা সেই ধস অন্তত থামিয়েছেন। নইলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জয়ী হয়েও প্রায় দেউলিয়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের যে দশা হয়েছিল, সেই অবস্থা হত মধ্যপ্রাচ্যে 'ওয়ার অ্যাগেইনস্ট টেরোরিজমে' জয়ী হয়েও আমেরিকার। ওবামা অন্তত ধ্বংসের সেই গুহামুখ থেকে দেশটিকে টেনে উপরে তুলছেন। এটিই তার অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের বড় সাফল্য। কিউবা ও ইরানের সঙ্গে শত্রুতা অবসানের লাভালাভের খতিয়ান আর না তোলাই ভালো।

ইরান এই চুক্তির ফলে দ্রুত পরমাণু শক্তির অধিকারী হতে পারবে না বটে, কিন্তু চুক্তিটির শর্ত অনুযায়ী পাঁচ থেকে দশ বছর ধৈর্য ধরলে পরমাণু শক্তির অধিকারী হওয়ার পথে তার কোনো বাধা থাকবে বলে মনে হয় না। এই বাধা ও অসুবিধা ভারতের পরমাণু বোমা তৈরির সময়েও আমেরিকা তৈরি করেছিল। পরে তারাই সানন্দে ভারতকে বিশ্ব নিউক্লিয়ার ক্লাবের সদস্য করে নিয়েছে। ইরানের ব্যাপারেও ভবিষ্যতে তা ঘটবে না তা বলা যায় না।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিকসন বৈরী চীনকে মিত্র বানিয়ে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু চীনকে হাতের মুঠোয় রাখতে পারেননি। সোভিয়েট ইউনিয়ন এখন নেই। কিন্তু বিশ্বে সুপার পাওয়ারের অবস্থানে আমেরিকার একক অধিকারের প্রতিপক্ষ আজ চীন। পশ্চিমের অর্থনৈতিক অবরোধ এবং সামরিক হুমকি থেকে মুক্ত হলে মধ্যপ্রাচ্যে একক আঞ্চলিক সুপার পাওয়ার হওয়ার পথে ইরান এগিয়ে গেলে বিস্ময়ের কিছু নেই। তাতে মধ্যপ্রাচ্যে মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্রগুলোর পতন ত্বরান্বিত হতে পারে এবং আরব ভূমিতে ইসরায়েলের অবৈধ দখলদারিত্বেরও অবসান ঘটতে পারে। প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রটি সত্যিকার স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে।

সদ্য-সম্পাদিত চুক্তিটি ইরানের জন্য কিছুটা বাধ্যবাধকতার (যেমন পরমাণু গবেষণা সম্পর্কে পশ্চিমাদের পর্যবেক্ষণের অধিকার) সৃষ্টি করলেও দেশটিকে এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ারে পৌছে দেবে। পশ্চিমাদের আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে এবং বহির্বিশ্বে ইরানের তেল বিক্রির উপর বাধা-নিষেধ প্রত্যাহার হলে ইরানের অর্থনীতি প্রবলভাবে চাঙ্গা হয়ে উঠবে। পশ্চিমা দেশগুলোতে ইরানের যে বিরাট অর্থভাণ্ডার 'ফ্রোজেন অ্যাসেটস' হিসেবে পড়ে আছে, তা ফেরত গেলে দেশটির অর্থনৈতিক ও সামাজিক পুনর্গঠনের কাজ তুঙ্গে উঠবে। ইরানের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে বিরাট সংখ্যক বিদেশি শ্রমিকও দরকার হবে। এই শ্রমশক্তি জোগানোর কাজে বাংলাদেশও বিরাটভাবে অংশ নিতে পারবে।

সবচাইতে বড় কথা, ইরান থেকে পাকিস্তান হয়ে ভারত পর্যন্ত তেলের যে পাইপলাইন স্থাপনের প্রস্তাব রয়েছে, তা যদি সকল রাজনৈতিক বিতর্ক ও বিবাদ পাশ কাটিয়ে বাস্তবায়িত হয়, তাহলে তার দ্বারা সর্বাগ্রে উপকৃত হবে উপমহাদেশের ছোট বড় দেশগুলো। এই দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশও একটি। ইরানের সঙ্গে বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বহু শতাব্দীর। এই সম্পর্কে আরও ঘনিষ্ঠ ও উন্নত করা গেলে ইরান-চুক্তি দ্বারা বাংলাদেশও বহুলভাবে উপকৃত ও লাভবান হবে।

বাংলাদেশকে ধর্মীয় মৌলবাদের সন্ত্রাসী আগ্রাসন থেকে মুক্ত হতে পারসিক উদার ইসলামও সাহায্য জোগাতে পারে।