বিএনপির ওথেলো সিনড্রোম ও অসতর্ক আওয়ামী লীগ

বিজন সরকার
Published : 30 July 2015, 07:04 AM
Updated : 30 July 2015, 07:04 AM

৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পরপরই জনমনে একটি প্রত্যাশা ছিল; তা হল, বিএনপি গত পাঁচ বছরে সরকারবিরোধী আন্দোলনে নিজেদের ব্যর্থতা নির্মোহভাবে পর্যালোচনা করবে। নিজেদের সাংগঠনিক সামর্থ্য, কোয়ালিশন ব্যবস্থাপনা, আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক রাজনীতি পর্যালোচনা এবং আত্মসংশোধনের মতো প্রস্তুতিমুলক বিষয়গুলি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ-সাপেক্ষে দ্রুত রাজপথে ফিরে আসবে।

প্রত্যাশাটি কেবল জনগণের নয়, আওয়ামীবিরোধী শিবিরের সমর্থক এবং দলীয় নেতা-কর্মীদেরও ছিল। কিন্তু তা না হয়ে ঘটেছে তার উল্টো। অবসন্নতা বিএনপিকে এমন অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে রেখেছে যে, ওরা সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারেনি আর। এর প্রাথমিক কারণ হচ্ছে, বিতর্কিত রাজনীতিবিদ তারেক রহমানের একগুঁয়েমি ও উগ্রবাদী মানসিকতা। বিএনপি তার অপরিপক্ব রাজনীতির খাঁচায় বন্দি হয়ে গেছে।

খালেদা জিয়া তাঁর স্বাস্থ্যগত সমস্যা ও বয়সের কারণে জনাব রহমানকে দলের পুরো দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে বিলম্বের পক্ষে নন। বিষয়টি স্পষ্ট হয় স্থায়ী কমিটির নেতাদেরকে 'ঠুঁটো জগন্নাথ' বানিয়ে রাখার মধ্য দিয়ে। বিএনপি বর্তমানে খোপের অন্ধকারে পথহারা পথিকের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। সমষ্টিগত বুদ্ধিদীপ্ত প্রচেষ্টা ছাড়া খোপ থেকে বাইরে এসে আলো দেখা নিশ্চিতভাবেই অসম্ভব। দলের এমন সংকটকালে ভূমিকা রাখতে না পারার কষ্ট বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা বহন করে বেড়াচ্ছেন। ফাঁস হয়ে যাওয়া তাদের মুঠো ফোনালাপ থেকে বুঝতে বাকি নেই যে, তারা বর্তমান নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল নন।

বেগম জিয়াকে স্থায়ী কমিটির নেতাদের মাঝে মাঝে ডাকতে হয়; তাদের সঙ্গে পরামর্শ করার তাগিদ থেকে নয়, বরং দল সম্পর্কে তাদের মতামত স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য। দ্বিধাগ্রস্ত বেগম জিয়া দলের পেশাদার রাজনীতিবিদদের সজ্ঞানে এড়িয়ে প্রায়শই কথিত জাতীয়তাবাদী চেতনাধারী কিছু পেশাজীবী প্রতিনিধিদের নিয়ে সকাল-বিকাল মিটিং করেন। লক্ষ্য করলে দেখবেন, বিএনপি যখনই রাজনৈতিক সঙ্কটে পড়েছে, এই পেশাজীবীদের কর্মতৎপরতা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। সঙ্কটের সময় পেশাদার রাজনীতিবিদের পরামর্শে বিএনপি পরিচালিত হয়েছে, তেমনটি অশ্রুত।

এই প্রেক্ষাপটে দলের স্থায়ী কমিটির সমন্বিত সিদ্ধান্তের চেয়ে তারেক রহমানের একক সিদ্ধান্ত বেগম জিয়ার কাছে দৈববাণী তুল্য। তারেক রহমান ব্রিটিশ সরকারের হোম অফিস থেকে সৌদি আরব ভ্রমণের ট্রাভেল পাস না পাওয়ায় বেগম জিয়া সৌদি রাজপরিবারের অতিথি হওয়ার দাওয়াত সত্ত্বেও ওমরাহ পালন পরিকল্পনা স্থগিত করলেন। এটি মূলত ওমরাহ পালনের নামে মা-ছেলের রাজনৈতিক শলাপরামর্শ করার মিলনমেলা। যদি মা-ছেলের দেখা হত, দেশের রাজনীতি হয়তো আবারও কয়েক সপ্তাহের জন্য পেট্রোল বোমার ভিতরে ঢুকে পড়ত। কারণ এই কিছু দিন আগে লন্ডনে তারেক বলেছিলেন, 'আন্দোলন হল সাগরের ঢেউের মতো। ছোট হয়, বড় হয়। আন্দোলন মাঝে মাঝে থামবে, আবার চলবে।'

আগে চক্রান্তকারীদের কাছে সিঙ্গাপুর ও দুবাই পছন্দের তালিকার শীর্ষে থাকলেও গত কয়েক বছর ধরে সৌদি আরব অগ্রাধিকারে চলে এসেছে। ধর্মীয় ভ্রমণের নামে বিভিন্ন দেশের মাদক ব্যবসায়ী, জঙ্গিবাদের অর্থদাতা এবং রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রকারীদের কাছে দেশটি খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

খালেদা জিয়া নিজেও জানেন, বন্দুকের জোরে জন্ম নেওয়া বিএনপির পক্ষে মাঠের রাজনীতির শিক্ষক আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটানো সম্ভব নয়। সরকারের বিরুদ্ধে যে পদক্ষেপই তারা গ্রহণ করুন, তা হিতে বিপরীত হতে বাধ্য। দলের ভিতরকার বহু-আদর্শিক গোষ্ঠীগুলির মধ্যে যে 'ওথেলো সিনড্রোম' দেখা দিয়েছে, সরকারের বিপক্ষে জোরে নাড়া দিতে গেলে নিজেরাই তখন কাঁচের মতো ভেঙে খণ্ড খণ্ড হয়ে যাবে। এত সব বাস্তবতার পরও খালেদা জিয়া বিতর্কিত তারেককে দেশের নির্বাহী প্রধান বানানোর স্বপ্ন দেখেন। সেটাই স্বাভাবিক। তারেককে দলের চেয়ারপারসন করতে বাধা নেই। তিনি প্রবাসে থাকেন এবং দলের সিনিয়র নেতৃত্বের সম্মতি তাতে নাও থাকতে পারে, তবু তাতে কিছু যায় আসে না।

অনুমান করা যায় বিএনপি যখনই অফিসিয়ালি তারেকের হাতে চলে যাবে, তখনই কোষ-বিভাজন প্রক্রিয়ার মতো ভেঙে জাতীয় পার্টির অনুসরণে ছোট ছোট দলে পরিণত হবে। তাতে বিলম্ব হলেও ২০১৯ সালের সম্ভাব্য জাতীয় নির্বাচনের আগেই যে জনগোষ্ঠীকে বিএনপি প্রতিনিধিত্ব করে, তাদের কাছে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। এমনকি দেশের বাইরে দলটির যে সকল বন্ধু রয়েছে, তাদের কাছেও ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাওয়ার বিষয়টি ত্বরান্বিত হবে।

ওদিকে আওয়ামী লীগ তাদের সমর্থক জনগোষ্ঠী ছাড়াও আরেকটি বড় জনগোষ্ঠীর ঋণাত্মক সমর্থন পেয়ে যাচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনে এরাই ক্ষমতা-নির্ধারণী ভোটার। অধিকন্তু বিএনপির নেতাদের একটি মাঝারি অংশের নিরব সমর্থনও তাদের প্রতি রয়েছে। উল্লিখিত শ্রেণির প্রতিনিধিরা মূলত ২০০১-২০০৬ পর্যন্ত বিএনপির কলঙ্কিত অতীত, দলের ভিতর বেগম জিয়ার স্বেচ্ছাচারিতা, অপরিপক্ব তারেকের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ এবং তার হাতে সম্ভাব্য বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই আওয়ামী লীগের বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন না। একই সঙ্গে কর্মতৎপর শেখ হাসিনার গত এবং বর্তমান শাসনামলে দেশের অর্থনৈতিক চেহারার পরিবর্তনটি মানুষকে শান্ত করে রেখেছে।

তারেকের অতীত ও বর্তমানের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড সরকারের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে কাজ করছে। সরকারি দলের প্রতিপক্ষ হিসেবে কোনো ভারসাম্যপূর্ণ শক্তি মাঠে বা সংসদে নেই। বিএনপির মতো আত্মহননমনস্ক না হয়ে উঠলে আগামী এক দশকের মধ্যে কোনো দলের শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে উঠে আসার সম্ভাবনা নেই। এটাই আওয়ামী লীগের জন্য সম্ভাব্য ঝুঁকি। শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকার ফলে তাদের ভেতর অসাবধানতার নানা উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। তার পরিব্যাপ্তি কতটুকু, সেটাও অনুমেয়।

দুটি স্বতন্ত্র ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের অসাবধানতা দৃশ্যমান। সরকারে ও দলে। যুক্তি হয়তো দেওয়া যাবে এভাবে যে, আওয়ামী লীগ আগেও ক্ষমতায় ছিল; সেই সময়েও টুকটাক ভুল করেছিল। সরকারে থাকলে দলের নেতৃত্ব কিছুটা অসাবধান হয়ে থাকে। তাতে তেমন অবাক হওয়ার কিছু নেই, ইত্যাদি ইত্যাদি।

মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগ ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে। দেশের ভিতরে ষড়যন্ত্র আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় আরও গভীর; খেলোয়াড়ের সংখ্যা বেড়ে গেছে; আরও সুসংহত হয়েছে খেলা। বিবেচনায় নিতে হবে, ৫ মে হেফাজতে ইসলামের শক্তির মহড়া দেশের স্বাভাবিক রাজনীতির মেরুদণ্ডে বড় ধরনের ঝাঁকুনি দিয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী উগ্র-ডানপন্থী মহারথীদের বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে।

এ সময় আওয়ামী লীগ পরিচালিত প্রশাসনে এবং খোদ দলেও ডানপন্থীদের অনুপ্রবেশ ঘটছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এ হান্নানের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আইয়ুব খানকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়ার কারণ কি প্রশাসনে ষড়যন্ত্রকারীদের অনুপ্রবেশ? ভারতের সংসদ ভবনে হামলার পরিকল্পনার জন্য আটক বাংলাদেশি নাগরিক দুলাল মিয়া দীর্ঘদিন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সম্প্রতি মোগল-হাটের আওয়ামী লীগের সভাপতি মাদক ব্যবসায়ী গোলাম ফারুকের হাত ধরে তার দলে যোগ দিলেন। পাশাপাশি চলছে সুকৌশলে বাঙালি সংস্কৃতি হটিয়ে আরবীয় সংস্কৃতি আমদানি করার সচেতন প্রচেষ্টা। স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী এসব প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে, দেশ থেকে উদার রাজনীতি ঝেঁটিয়ে বিদায় করা।

বিএনপির অবসন্নতাকে তাই যদি আওয়ামী লীগ নিজের জন্য সুরক্ষা মনে করে, সেটি হবে নির্ভুল আত্নঘাতী সান্ত্বনা। ক্রমশ বিপন্ন বিএনপির জায়গায় প্রতিস্থাপিত হবে কট্টর ডানপন্থী দল ও সংগঠনগুলি। যারা আদর্শিক কারণেই ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর এবং ২১ আগস্টের হত্যার রাজনীতিতে বিশ্বাসী।

বিএনপিপন্থী উদারমনা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক আলাপচারিতায় বলছিলেন, রাস্তায় আন্দোলন করার মেধা, ধৈর্য ও ইচ্ছাও বিএনপির নেতাদের নেই। তাই এককভাবে আন্দোলন করে সফলতা অর্জনের রেকর্ড তারা করতে পারেননি। আরেকটি ২১ আগস্টের প্রয়োজনীয়তা বিএনপির সর্বোচ্চ পর্যায়ের একটি অংশ ভীষণভাবে অনুধাবন করছে। তার মানে, শেখ হাসিনাকে না সরালে তারা টিকবে না ভাবছে। তবে তেমনটি ঘটলেও ওরা টিকবে কি না সে বিষয়ে সন্দিহান তিনি।

এক কথায়, ষড়যন্ত্র বোনা হচ্ছে। এ দহনকালে প্রতিটি প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগকে সিদ্ধান্ত নিতে সতর্ক হতে হবে। দলের উপর থেকে নিচে প্রত্যেক নেতা-কর্মীর সতর্কতা জরুরি। কিন্তু মাঠে বিরোধী দল না থাকায় ওরা নিজেরাই নিজেদের টার্গেট করছে। অভ্যন্তরীন কোন্দল বাড়ছে, ঘটছে হতাহতের ঘটনা। মাঠ পর্যায়ের দলীয় বিভিন্ন কমিটিতে উপঢৌকনের বিনিময়ে ও স্বজনপ্রীতির কারণে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের অনুপ্রবেশ ঘটছে। ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন নয়, সূক্ষ্ম পরিকল্পনার অংশ মাত্র। একে দলের ভিতর থেকেই আওয়ামী লীগকে বিতর্কিত করে মানুষের কাছে অগ্রহণযোগ্য করে তোলার ষড়যন্ত্র বললেও ভুল হবে না।

যে সকল জনগোষ্ঠী তারেকের নেতৃত্বে বাংলাদেশকে দেখতে চায় না বলে আওয়ামী লীগকে মেনে নিয়েছেন, আজকাল তারাও বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে এ সব বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের যৌক্তিক প্রশ্ন তুলছেন। আওয়ামী লীগকে মনে রাখতে হবে, সারা দেশে তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ তারাই ঘটিয়েছে। কোনো তথ্যই এখন আর গোপন থাকে না।

সম্প্রতি দুটি ঘটনা নিয়ে দেশ আলোড়িত হয়েছে। এমনিতেই আদর্শিক দ্বন্দ্ব ভুলে গিয়ে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর ইফতারি মোলাকাত, সুশীলদের কৌশলী শীতনিদ্রা এবং মাঝে মাঝে অধৈর্য হয়ে হুঙ্কার ছাড়া, সৌদি আরবে মা-ছেলের স্থগিত সাক্ষাতটিসহ বহু জানা-অজানা বজ্রঝড়ের মধ্য দিয়ে সরকারকে যেতে হচ্ছে। তেমন প্রেক্ষিতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের গম নিয়ে সরকার বিব্রত হচ্ছেন। ভবিষ্যতে যদি জনগণের শত শত কোটি টাকার শ্রাদ্ধ এভাবে হয়, আরও বড় আকারের প্রতিবাদ আসবে। মানুষকে হয়তো বিএনপির অতীত দুঃশাসন, তারেক রহমানের ভবিষ্যতের অন্ধকার বাংলাদেশ এবং রাস্তার গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা যাবে না।

দেশের বিচার বিভাগ একটি সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা যে রুই-কাতলাদের আইনের বাইরে রাখতে আর ইচ্ছুক নয়, তার একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে মাত্র। জ্ঞাত আয়-বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপন করার দায়ে ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াকে দেওয়া তের বছরের সাজা থেকে হাইকোর্ট খালাস করে রায় দিলেও সুপ্রিমকোর্ট তা বাতিল করে দেয়। ফলে মায়ার বিরুদ্ধে মামলা চলতে আইনি বাধা নেই। সরকারের জন্য এটি একটি বড় সিগন্যাল।

তাই আওয়ামী লীগ যদি কেবল বিএনপির অবসন্নতার উপর নির্ভর করে নিজেদের ভবিষ্যৎ রাস্তা নির্ধারণ করতে চায়, সেটি হবে তারেক রহমানকে সামনে নিয়ে বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখার মতো আত্মবিধ্বংসী চিন্তা।