একটি কার্যকরী সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রত্যাশায়

ড. আবুল বাসার
Published : 27 July 2015, 02:07 AM
Updated : 27 July 2015, 02:07 AM

সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ চলছে। বেশ জোরেশোরেই। এ জন্য প্রায় তিরিশটির মতো গবেষণার কাজ ইতোমধ্যে শেষ করা হয়েছে। এতে বেশ অর্থও ব্যয় হয়েছে। এ অর্থব্যয় তখনই স্বার্থক হবে যদি এসব গবেষণালব্ধ জ্ঞানের ভিত্তিতে একটি সঠিক ও যুগোপযোগী পরিকল্পনা প্রণয়ন করা যায়। অবশ্য বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে একটি দেশের এ রকম দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার উপযোগিতা কতটুকু সে বিষয়েও অনেক প্রশ্ন রয়েছে। সেটি ভিন্ন আলোচনা।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল ও নিম্ন মধ্য-আয়ের দেশসমূহ বিশ্বঅর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে কার্যকরী ভূমিকা রাখার মতো সক্ষম নয়। কিন্ত তারা আবার বিশ্বঅর্থনীতির যে কোনো সংকটের প্রতিরোধহীন শিকার হয়। আমেরিকা আর ইউরোপের অর্থনীতির দোলাচলে বাংলাদেশের মতো দেশের অর্থনীতি নিত্য দোলে। বহির্বিশ্বের নানান ঘটনায় কখনও বাংলাদেশের রপ্তানি কমে যায়; কখনও রেমিটেন্স-প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়; কখনও-বা আমদানি-ব্যয় বেড়ে যায়। এ সবের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রয়েছে সরকারের রাজস্ব আয় এবং বিদেশি অনুদানের অর্থাৎ সরকারের হাতে উন্নয়নকাজে ব্যয়যোগ্য অর্থের।

এ রকম পরিস্থিতিতে উন্নয়নের পরিকল্পনা প্রণয়ন সম্ভব হলেও তার বাস্তবায়ন দুরূহ হয়ে পড়ে। তারপরও বাংলাদেশ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে। সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে বেশ শ্রম ব্যয় করছে, যদিও মূল কাজটি করছে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।

বিভিন্ন বিষয়ে প্রাজ্ঞ মতামত নেওয়ার জন্য এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ওয়ার্কশপেরও আয়োজন করা হয়েছে। এসব ওয়ার্কশপের স্থায়িত্ব ঘণ্টা দেড় বা দুয়েক হলেও আমন্ত্রিত বিশেষজ্ঞের সংখ্যা থাকে শ'খানেক। কথাপ্রিয় বাঙালি আবার মাইক্রোফোন পেলে জমে থাকা কথা উজাড় করে ঝেড়ে দিয়ে নিজেকে হালকা করতে চায়– সে কথা প্রাসঙ্গিক বা অপ্রাসঙ্গিক যা-ই হোক। অনেকেই আয়োজকদের সৌজন্যতা ও বদান্যতার সুযোগ নিয়ে সস্তা জিনিস চড়া দামে বিক্রি করে যান। ফলে যা হবার তা-ই হয়। ওয়ার্কশপটি হয়ে দাঁড়ায় নিয়মরক্ষার কারবার। এই কারবারকে গঠনমূলক ও উপকারি দরবারে পরিণত করা যুগোপযুগী পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

কী কী থাকা উচিত পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়? একটি ভালো পরিকল্পনা সেটাই যা অর্জনযোগ্য সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে নিয়ে প্রণীত হয় এবং যার বাস্তবায়ন খুব সহজেই পর্যবেক্ষণ করা যায়। একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশে যে কোনো পাবলিক পরীক্ষায় কোনো বিষয়ে 'যাহা জান লিখ' ধরনের প্রশ্নের আধিক্য থাকত। এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সেটি পরিকল্পনা দলিলের ক্ষেত্রেও প্রতিভাত হওয়া দরকার। নতুবা তার উপযোগিতা মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়।

বিশ্ব ব্যাংকসহ অন্যান্য দাতারা এক সময় অনুভব করল, তাদের প্রদত্ত অর্থের বিপরীতে কতটুকু উন্নয়ন হয় তা পর্যবেক্ষণ এবং তার ভিত্তিতে উন্নয়ন কৌশলের পর্যালোচনা ও পরিবর্তন দরকার। ২০০৪ সালে এ বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনও করা হয়। তারপর থেকে এ বিষয়ে অনেক আলোচনা-পর্যালোচনা-সমালোচনার পর দাতাগোষ্ঠী একটি ফলাফলভিত্তিক উন্নয়ন কৌশল প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করে আসছে। বিশ্ব ব্যাংকের মতো দাতাদের যে কোনো প্রকল্পের ক্ষেত্রে এই কৌশল অনুসরণ করা হয়। তাতে যেমন প্রকল্পের বাস্তবায়ন সহজ হয়, তেমনি বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণও সহজ হয়।

ভালো জিনিসের অনুকরণ এবং অনুসরণ খারাপ নয়, বরং যত বেশি করা হয় হয় ততই ভালো। 'শেষের কবিতা'য় কবিগুরু তাঁর ভক্তের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন, 'ভালো জিনিস যত বেশি হয় ততই ভালো।' তাই ফলাফলভিত্তিক উন্নয়ন কৌশলের যে ধারা বিশ্ব ব্যাংক চালু করেছে, তার অনুকরণ ভালো বৈ মন্দ তো নয়।

একটি ভালো উন্নয়ন পরিকল্পনার তিনটি বৈশিষ্ট্য কাম্য। প্রথমটি হল, পরিকল্পনাটিতে যে সব লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় তা যেন প্রাসঙ্গিক, যৌক্তিক ও বাস্তবায়নযোগ্য হয়। উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে একটি জাতির জন্য অর্থনৈতিক করণীয়সমূহ পরিবর্তন হয়। সেই পরিবর্তনশীলতা বিবেচনায় আনার বিকল্প নেই। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক।

সত্তর বা আশির দশকে বাংলাদেশে পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন করাই ছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তখন আমরা ছিলাম বহির্বিশ্বের সঙ্গে অর্থনৈতিক সুতার খুব দুর্বল বন্ধনে আবদ্ধ। বিশ্বায়ন এবং বাণিজ্য উদারীকরণ শব্দসমূহের প্রতি আমাদের ছিল প্রগাঢ় অবিশ্বাস। সে অবস্থায় খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার লক্ষ্য আমাদের পরিকল্পনা দলিলের অংশ হওয়াটাই ছিল যৌক্তিক।

এখন প্রেক্ষিত পাল্টেছে। বাংলাদেশ তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় খাদ্য উৎপাদনে বলা যায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। আবার একই সঙ্গে এ কথাও সত্য যে, বর্তমানের যে বাণিজ্য উদারীকরণের বাংলাদেশ, সেখানে বিশ্ববাজারও খাদ্যের উৎস হিসেবে কাজ করতে পারে। এমন প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে উন্নয়ন কৌশলের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়ার সময় এসেছে গুণগত মানসম্পন্ন খাদ্য সরবরাহের উপর, শুধুমাত্র খাদ্যের পরিমাণগত দিকের উপর নয়। একটি মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে জনস্বাস্থ্য এবং পুষ্টির বিষয়টি এখন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় 'অভীষ্ট লক্ষ্য' হিসেবে আসা উচিত। বিষয়টি শুধু উদাহরণ হিসেবেই অবতারণা করা হল।

এ উদাহরণ ধরেই এগোনো যাক। লক্ষ্য স্থির করার পর, দ্বিতীয় যে উপাদান পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় থাকা দরকার তা হল, স্থিরকৃত লক্ষ্য পূরণের একটি সময়রেখা। যেহেতু পরিকল্পনার মেয়াদকাল ৫ বছরের, পুরো সময়টি লক্ষ্যভিত্তিক বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা উচিত। যেমন, এটা খুব স্পষ্টভাবে উল্লিখিত থাকা দরকার যে, পরিকল্পনার প্রথম বছরে স্থিরকৃত লক্ষ্য অর্জনের জন্য সরকার কী কী পদক্ষেপ নিবে এবং সে সব পদক্ষেপের ফলে কী কী সম্ভাব্য ফলাফল আসতে পারে। একইভাবে পরবর্তী এক বছরে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে, তারও একটি সুস্পষ্ট নির্দেশনা পরিকল্পনা দলিলে থাকা উচিত।

এভাবে বিভিন্ন মাইলস্টোন-ভিত্তিক পরিকল্পনার দ্বিবিধ সুফল রয়েছে; এর ফলে স্থিরকৃত লক্ষ্য অর্জনের পথে কতটুকু লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে, তা ধারাবাহিক ও কার্যকরীভাবে পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখা সহজ হবে। আর একই সঙ্গে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নির্ধারিত পদক্ষেপসমূহের সঙ্গে মিল রেখে সরকার তার রাজস্ব বাজেটে খাতওয়ারি সম্পদের বণ্টন করতে পারবে।

যে কোনো মধ্য বা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অন্যতম পূর্বশর্ত হল তার সঙ্গে সমন্বয় ও সামঞ্জস্য রেখে বাজেট প্রণয়ন। সুস্পষ্ট মাইলস্টোর-ভিত্তিক পরিকল্পনা এ কাজ সহজ করবে।

পরিকল্পনার মাধ্যমে সম্পদের খাতওয়ারি বণ্টন নির্ধারণ করা হলেও, চূড়ান্ত বিচারে যে কোনো পরিকল্পনার চুড়ান্ত সাফল্যের মাপকাঠি হচ্ছে এর মাধ্যমে অর্জিত বিষয়গুলো। আর এখানেই এসে যায় যে কোনো পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অত্যাবশ্যকীয় তৃতীয় উপাদানটি। আর তা হল, কী কী বিষয়ের নিরিখে স্থিরকৃত লক্ষ্য অর্জিত হল কি হল না সেটা বিচার করা হবে?

সাফল্য বিচারের জন্য বিভিন্ন পরিমাণগত এবং গুণগত প্রপঞ্চক ব্যবহৃত হয়। কিন্ত সেগুলো খুব সহজ, সংক্ষিপ্ত এবং স্পষ্টভাবে পরিকল্পনা দলিলে সন্নিবেশিত হওয়া দরকার। এর ফলে পরিকল্পনার মেয়াদ শেষে তার সফলতা ও ব্যর্থতার একটি গঠনমূলক, দিকনির্দেশক ও কার্যকরী পর্যালোচনা সম্ভব।

এ বছর ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা শেষ হচ্ছে। বিভিন্ন খাতওয়ারি লক্ষ্যের বিপরীতে এ পরিকল্পনার তুলনামূলক অর্জনসমূহ কী এবং কতটা আশাব্যঞ্জক তার মূল্যায়ন সব খাতের জন্য দুরূহ। কারণ পরিকল্পনা দলিলটি উপরোল্লিখিত কাঠামোয় বিন্যস্ত ছিল না।

একটি পাঁচ বছর মেয়াদী পরিকল্পনা দলিল 'লক্ষ্য, সময়ভিত্তিক পদক্ষেপ এবং সাফল্যের প্রপঞ্চক', এ কাঠামোয় বিন্যস্ত করার কাজ মোটেও সহজ নয়। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় কঠিন এ কাজ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে তারা নিয়মিত ওয়ার্কশপ আয়োজন করে থাকে, যেখানে বোদ্ধাগণ সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার উপর তাদের মতামত দিয়ে সাহায্য করছেন। এসব ওয়ার্কশপে সীমিত অংশগ্রহণের সুযোগপ্রাপ্তির ভিত্তিতেই বলছি, ওয়ার্কশপগুলোর কাঠামো বোধহয় সবার আগে পরিবর্তন করা দরকার যেন আলোচনা আরও কার্যকরী হয় এবং সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত তারা সত্যিকার অর্থেই উপকৃত হতে পারেন।

এ লেখা শেষ করব টেকচাঁদ ঠাকুর রচিত বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস 'আলালের ঘরের দুলাল' থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে। উপন্যাসে বরদাপ্রসাদ বাবুর বিদ্যাশিক্ষা বিষয়ক বিচক্ষণতা তুলে ধরা হয়েছে এভাবে:

"প্রকৃত শিক্ষক হইতে গেলে মনের গতি ও ভাব সকলকে জানিতে হয় এবং কী প্রকারে শিক্ষা দিলে কর্ম্মে আসিতে পারে তাহা সুস্থির হইয়া দেখিতে হয় ও শুনিতে হয় ও শিখিতে হয়। এ সকল না করিয়া তাড়াহুড়া রকমে শিক্ষা দিলে কেবল পাথরে কোপ মারা হয়– এক শত বার কোদাল পাড়িলেও এক মুটা মাটি কাটা হয় না।"

[আলালের ঘরের দুলাল, পৃ: ৭২]

বরদা প্রসাদের বিচক্ষণতা দিয়েই সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার কাজটি করতে হবে। তার জন্য কী ধরনের পরিকল্পনা বাংলাদেশের উন্নয়নে আসতে পারে তা দেখতে, শুনতে ও শিখতে হবে। তাড়াহুড়া করে একটি মোটা দলিল তৈরি করলে কেবল পাথরেই কোপ মারা হবে, এর দ্বারা এক মুঠো উন্নয়নও হবে না।

কোটি টাকা ব্যয়ে এমন অপ্রয়োজনীয় একটি দলিল তৈরি হোক, সেটা আমরা কেউ চাই না।

আবুল বাসার: গবেষক, বিআইডিএস; সাবেক অর্থনীতিবিদ, বিশ্ব ব্যাংক; সাবেক শিক্ষক, উইলামেট বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকা।