বিচার বিভাগ কি জাতীয় সংসদ?

ফরহাদ মজহার
Published : 4 June 2011, 02:56 PM
Updated : 4 June 2011, 02:56 PM

এক. ত্রয়োদশ সংশোধনী সংক্রান্ত রায়

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধান-বিরোধী বা সংবিধানের সঙ্গে 'সাংঘর্ষিক' –তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত রায় দেবার পর এই গীত এখন অনেকেই গাইছেন। তবে আদালতের পূর্ণ রায় আমরা পাই নি, ফলে ঠিক কী যুক্তিতে আদালত এই বিধান 'বাতিল' (declared void) করেছেন এবং ultra viruses the constitution বলেছেন তা আমরা এখনও জানি না। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জাতীয় সংসদ দুই তৃতীয়াংশ ভোটে এই ধরনের ব্যবস্থার জন্য বিধান অবশ্যই প্রণয়ন করতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণার বিরোধিতা করার পেছনে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক চর্চার সঙ্গে এই ধরনের ব্যবস্থার অসঙ্গতি এক কথা আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অসাংবিধানিক বা বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলা অন্য কথা। এই দুই অবস্থানের পার্থক্য আছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও রাজনীতির সঙ্গে অসঙ্গত বলে আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা গ্রহণযোগ্য বলে মনে করি না। তবে বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী আদালত সংবিধানের বিভিন্ন সংশোধনী বাতিল ও আংশিক মার্জনা করতে পারে কিনা সেই তর্ক এড়িয়ে যাবার কোন উপায় নাই।

শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের বিকল্প নাই এই কথাগুলোও নতুন নয়। এখন নতুন করে যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার সঙ্গে সংবিধানের সাংঘর্ষিক চরিত্র আবিষ্কার করছেন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের মহিমা কীর্তন করে মুখে ফেনা তুলে ফেলছেন তাদের এখনকার তামাশায় আমোদিত হতে অসুবিধা নাই। কিন্তু সমাজের রাজনৈতিক, সাংবিধানিক বা আইনী বিতর্ক এখন আর, এই ২০১১ সালে, মোটেও শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে কি থাকবে না সেই বিতর্কে সীমাবদ্ধ নাই। আমরা আরো বড় ধরনের সংকটের মধ্যে পড়েছি। এর মধ্যে রয়েছে বিচারক ও বিচারবিভাগের সংকট। অন্যদিকে আছে বিচার বিভাগ ও জাতীয় সংসদের ক্ষমতা ও এখতিয়ারের প্রশ্ন। অভিযোগ উঠেছে রাজনৈতিক সরকার বা রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের অধীনস্থ ভূমিকা পালন করছে বিচার বিভাগ, সরকার বিচার বিভাগকে দিয়ে জাতীয় সংসদের ভূমিকা পালন করিয়ে নিচ্ছে।

বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনকে নতুন প্রধান বিচারপতি হিশাবে নিয়োগ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। প্রধান বিচারপতি নিয়োগে যোগ্যতা নাকি জৈষ্ঠতার হিশাব করা হয়েছে এবং সেই তর্ক আবারও চাঙ্গা হয়েছে। অনেকে অভিজ্ঞতার প্রশ্নও তুলতে পারেন। তিনি হাইকোর্টে বিচারপতি হিশাবে নিয়োগ পেয়েছেন ২০০৯ সালের ১৭ জুলাই। আগামি ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি তাঁর স্বাভাবিক অবসরে যাবার কথা। বর্তমান প্রধান বিচারপতি এ, বি, এম খায়রুল হকের মেয়াদ শেষ হয়েছে ১৭ মে ২০১১। নতুন বিচারপতি শপথ গ্রহণ করেছেন ১৭ মে তারিখে। হাইকোর্টের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ছিলেন শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান। তাঁকে এবার আবারও ডিঙানো হয়েছে। এ, বি এম খায়রুল হককে যখন প্রধান বিচারপতি করা হয়েছিল তখনও একইভাবে জ্যেষ্ঠ বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানকে টপকে যাওয়া হয়েছিল। আমরা মেনে নিলাম এটা বিচার বিভাগের এখতিয়ার। বিচারপতি নিয়োগের খবরটি এগার তারিখের, পত্রিকায় এসেছে বারো তারিখে। দশ তারিখে দেওয়া আর ১১ তারিখে পত্রিকায় আসা তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর ওপর সংক্ষিপ্ত রায়টি যাঁরা পড়েছেন তাদের নিশ্চয়ই মনে হয়েছে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ব্যাপারটিকে এই রায় থেকে আলাদা বিবেচনা করা যাবে না। দুটো মিলিয়ে পড়তে হবে।

ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণার পরপরই একই রায়ে আদালত বলছে, আগামী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। ত্রয়োদশ সংশোধনী খারিজ করে দেবার কথাটা রায়ে সরাসরি বলা হয় নি। বলা হয়েছে prospectively declared void। তার মানে আগামী দুটো নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে, তারপর ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল হবে। প্রশ্ন হোল, যদি ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলযোগ্য হয়, তাহলে এই ধরনের অবৈধ সংশোধনীর অধীনে দশ ও এগারো সংসদের নির্বাচন হতে পারার সিদ্ধান্ত বিচার বিভাগ কেন দিয়েছেন?

ত্রয়োদশ সংশোধনীর আগে সংবিধানের ৯৯ অনুচ্ছেদে বলা ছিল বিচারকের পদ থেকে অবসর বা অপসারিত হবার পর কোন বিচারক 'কোন আদালত বা কর্তৃপক্ষের নিকট ওকালতি বা কার্য করিতে পারিবেন না…' কিম্বা 'প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোন লাভজনক পদে বহাল হইবেন না"। ত্রয়োদশ সংশোধনী বিচারকদের প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টা বানাবার জন্য এই অনুচ্ছেদ সংশোধন করেছিল। ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল হলে বিচারকদের প্রধান উপদেষ্টা বা উপদেষ্টা বানাবার বিধান আর থাকবে না। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই যদি আগামী দুই নির্বাচন হয় তাহলে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক এবং বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন উভয়েরই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হবার সম্ভাবনা রয়েছে। আদালত এই দুই নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবার কথা বলার মনে হতে পারে প্রধান উপদেষ্টা পদে বিচারপতিরা আগ্রহী। সে কারণে রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসাবে সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের নিয়োগের বিধান সংশোধনের কথা বলছে আদালত। কিন্তু খটকা তবুও থেকেই যায়। বিচারপতিদের প্রধান উপদেষ্টা বা উপদেষ্টা হওয়ার সম্ভাবনাকে একদমই বাদ রাখতে চাইছে না আদালত। বলছে সেই ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার স্বাধীনতা সংসদের থাকবে। তার মানে আদালত বলছে আমরা বিচারকরা অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হতে চাইছি কি চাইছি না সেই সিদ্ধান্ত আমরা নেব না। ক্ষমতাসীন সরকার নিক। সংসদে তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তারা যা ভাল মনে করবে সেটাই হবে। ত্রয়োদশ সংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত রায় বলছে, " The parliament, however, in the meantime, is at liberty to bring necessary amendments excluding, the provisions of making the former Chief Justices of Bangladesh or the Judges of the Appellate Division as the head of the Non-party Care-taker Government"। রায় একথা বলছে না যে সংসদ বিচারপতিদের উপদেষ্টা রাখবার বিধান বাদ দিয়ে আগামি দুই নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করুক। এই ক্ষেত্রে আদালত বলছে, পার্লামেন্ট ইজ এট লিবার্টি – জাতীয় সংসদ, বিচারপতিদের উপদেষ্টা বানাবে কি বানাবে না, সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে স্বাধীন।

অতএব আগামী দুই নির্বাচনে প্রধান বিচারপতির প্রধান উপদেষ্টা হবার বিধান সরাসরি বাতিল না করে সেই সিদ্ধান্ত ছেড়ে দেওয়া হোল সংসদের ওপর। মূলত আওয়ামী লীগের ওপরই। অর্থাৎ কার্যত ছেড়ে দেওয়া হোল মহামান্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর। মহাজোট সরকার চাইলে ১৭ মে তারিখে অবসরে যাওয়া বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে আগামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগ দিতেই পারে। বিরোধী দল তা মানবে না বলে অবশ্য আগেই হুমকি দিয়ে রেখেছে। নিজেদের পছন্দমাফিক প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের এই চেষ্টা বা চর্চা অবশ্য বিএনপির আমলেও হয়েছে। এ চর্চা যখন আছে তখন বিচারপতিদের বঞ্চিত করবার জন্য নতুন আইন করবে কেন আওয়ামী লীগ? এ বি এম খায়রুল হক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা আর পরের বারে বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন প্রধান উপদেষ্টা হবেন। ক্ষতি কী? তাই বলছিলাম প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ব্যাপারটিকে ত্রয়োদশ সংশোধনী সংক্রান্ত রায়ের সঙ্গে মিলিয়ে পড়া দরকার। বিচারপতিদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বানাবার বিধান রাখার অর্থ এই পদের জন্য লোভ উস্কিয়ে দেওয়া। ক্ষমতাসীন সরকার এই মূলা ঝুলিয়ে রেখে বিচার বিভাগকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে। এই অভিযোগ পুরানা এবং ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত। এই রায়ে প্রধান বিচারপতি প্রধান উপদেষ্টা হতে চান না বলে তাঁর নৈতিকতা এবং ঔদার্যের যাঁরা প্রশংসা করেছেন তাঁদেরকে সংক্ষিপ্ত রায়টি মনোযোগের সঙ্গে পড়বার অনুরোধ করব। তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত রায় দেবার মধ্যে – রায়ের ভাষা ও অন্তর্গত নির্দেশনার ক্ষেত্রে বিচারকদের নৈতিক দৃঢ়তা নিয়ে নিশ্চিত হওয়া মুশকিল। একদিকে তারা ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করছেন, অন্যদিকে আগামী দুই নির্বাচনে তাকে এমনভাবে বহাল রাখতে চাইছেন যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হবার সুযোগ তাঁদের পুরাপুরি হাতছাড়া না হয়।

আগামী দুই নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন হতে দেবার পক্ষে যুক্তিগুলি দেখা যাক। বলা হয়েছে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে প্রাচীন কিছু নীতি মেনে (on the age old principles). কী সেই নীতি? তিনটি নীতির কথা বলা হয়েছে যা সংবিধানের অন্তর্গত কোন বিধান নয়। সেই নীতিগুলো হচ্ছে:

এক. quod alias non est licitum necessitus licitum facit (That which otherwise is not lawful, necessity makes lawful)। যা আদতে আইনসিদ্ধ নয়, কিন্তু প্রয়োজন তাকে আইনসিদ্ধ করে।
দুই. salus populi suprema lex (safety of the people is the supreme law) । জনগণের নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন।
তিন. salus republicae est supreme lex (safety of the state is the supreme law). রাষ্ট্রের নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন।

ত্রয়োদশ সংশোধনী সংক্রান্ত রায়ে যেমন আছে তেমনি উদ্ধৃতি দিয়েছি এটা বোঝাবার জন্য যে আদালত সজ্ঞানে যে তিনটি নীতি প্রয়োগ করেছেন তিনটি নীতিই আদালতের কথা অনুযায়ী আইনবহির্ভূত বা অন্য কথায় বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধানের কোন বিধান অনুযায়ী সিদ্ধ নয়। যে দিকটি অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে এই নীতি আদালত প্রয়োগ করেছে অতীতে সংঘটিত কোন ঘটনার বিচার হিসাবে নয়, বরং আগামী দিনের পরিস্থিতি বিচার করে, যে পরিস্থিতি সম্পর্কে আদালতের আগাম অনুমান অবান্তর। বিচার বা আইনশাস্ত্রের দিক থেকে আদৌ আদালত অনুমান-নির্ভর ভবিষ্যত পরিস্থিতি সম্পর্কে এই ধরনের সিদ্ধান্ত দিতে পারে কিনা সেটা এক গুরুতর প্রশ্ন আকারে এখন হাজির হয়েছে। আদালত ধরে নিয়েছে আগামি ভবিষ্যতের দুই নির্বাচনের সময় বে-আইনী হলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের 'দরকার' আছে। এই অনুমানের ভিত্তি কী? আদালত আরো ধরে নিয়েছে আগামী দুই নির্বাচনে জনগণের এবং রাষ্টের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে – এই অনুমানেরও বা ভিত্তি কী? এটা ঠিক যে রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় পরিবর্তন সবসময় সংবিধান বা আইন মেনে চলে না। সেই ক্ষেত্রে অতীতে কোন রাষ্ট্রীয় ঘটনা ঘটে যাবার পরে, সেই ঘটনা সম্পর্কে কেউ নালিশ তুললে আদালত সে নালিশের পরিপ্রেক্ষিতে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে পারে। রাজনৈতিক বিপ্লব, গণঅভ্যূত্থনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা বদল, কিম্বা সামরিক অভ্যূত্থানের মত রাষ্ট্রীয় বা রাজনৈতিক ঘটনা ঘটে গেলে তা আইনবহির্ভূত হলেও সামগ্রিক পরিস্থিতির বিচার করে আদালত তা প্রয়োজনের তাগিদে ঘটেছে বলে 'বৈধ' বলে মেনে নিতে পারে। মেনে নেবার রেওয়াজ আছে। হয়তো মেনে নেওয়া ছাড়া আদালতের উপায় থাকে না। আদালত ইতিহাসের নিয়ন্তা নয়, বিচারকও নয়। বাস্তব প্রয়োজনের এই তাগিদকেই তথাকথিত 'ডকট্রিন অফ নেসেসিটি' বলা হয়। 'ডকট্রিন অফ নেসেসিটি'– বিদ্যমান আইন ও আইনের বাইরের তাগিদ, বাস্তব জগতের বা বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতির দাবি। কিন্তু যে ঘটনা এখনও ঘটে নি, সেই আগামী নির্বাচনের সময় পরিস্থিতি কী দাঁড়ায় তার বিচার আদালত এখন কীভাবে করে? আদালত কী করে এখন বলে যে আগামী দুই সংসদ নির্বাচনে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে যাতে যা আইনসিদ্ধ নয়, অথচ সম্ভাব্য পরিস্থিতির অনুমান করে তাকে আমাদের আইনসম্মত বলে মেনে নিতে হবে? আদালতের যুক্তি বোঝার জন্য এখন আমাদের অধীর আগ্রহে পুরো রায়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

কিন্তু এতে প্রশ্ন আরো গোড়ায় চলে যায়। যদি আগামীতে বে-আইনী বিধানকে ভবিষ্যতের বাস্তবতা অনুমান করে প্রণীত আইনকে 'আইন' বলে মানতে হয়, তাহলে যে-বাস্তব পরিস্থিতিতে ত্রয়োদশ সংশোধনী প্রণীত হয়েছিল অতীতের সেই বাস্তবতাকে আদালত আমলে আনলো না কেন? আদালত কি মনে করে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের কোন বাস্তবতা বাংলাদেশে ছিল না? এই ক্ষেত্রে ডকট্রিন অব নেসেসিটি খাটালো না কেন আদালত? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ন্যায্যতার ভিত্তি কি রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত সম্মতিতে হয় নি? সেই সম্মতির ভিত্তিতেই কি জাতীয় সংসদ ত্রয়োদশ সংশোধনী পাশ করে নি? যা আদতে আইনসিদ্ধ নয়, কিন্তু যেহেতু দরকার তাই সেই দরকারের তাগিদে আদালত যখন কোন কিছুকে আইনসিদ্ধ বলে রায় দেয়, তখন কী বিবেচনায় সত্যিকারের বাস্তবতার প্রয়োজন আদালত অস্বীকার করে, আর কাল্পনিক আগামীর দরকারকে স্বীকার করে নেয়? কীসের অনুমানে আগামীর দরকারকে আমাদের আইনসম্মত বলে মেনে নেবার রায় দেয়? পূর্ণ রায়ে এই সকল বিষয়ে আদালতের ব্যাখ্যার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

রায়ে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ ঘোষণা দিয়েছে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধান থেকে খারিজ করে দেওয়া হলো। রায়ের ভাষায় prospectively declared void and ultra vires the Constitution। ত্রয়োদশ সংশোধনী ultra vires বা সংবিধান অতিক্রম করে গিয়েছে। ল্যাটিন ভাষার এই আইনী টুকরার আক্ষরিক মানে হচ্ছে 'ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়া বা কর্তৃত্ব অতিক্রম করে যাওয়া'। অর্থাৎ ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানের বাইরে চলে গিয়েছে, সংবিধান অতিক্রম করেছে। গণমাধ্যমগুলো যখন ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানের সঙ্গে 'সাংঘর্ষিক' হবার কারণে 'বাতিল' করে দেবার কথা বলে তখন যে আইনী ধারণাগুলোর ওপর দাঁড়িয়ে আদালত রায়টি দিয়েছে সেই দিকগুলো আড়াল হয়ে যায়। এই প্রচারের মধ্যে এই ধারণা প্রতিষ্ঠা পায় যে আদালত চাইলেই জাতীয় সংসদে গৃহীত কোন বিধান বা সংশোধনী 'বাতিল' করে দিতে পারে। পারে কি? বাংলাদেশের সংবিধান কি এই ক্ষমতা আদৌ আদালতকে দিয়েছে?

তবুও আমাদের সৌভাগ্য যে আদালত ল্যাটিন ভাষায় কিছু ধারণা রায় দেবার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছেন। আসলে ultra vires the Constitution কথাটিকে সহজে বুঝতে গিয়ে একে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বোঝার সীমাবদ্ধতা আছে। ultra vires কথাটির আক্ষরিক অর্থের ওপর চোখ বুলালেও দেখি এর মধ্যে নিহিত রয়েছে ক্ষমতা বা কর্তৃত্বের বাইরে যাওয়া, বা অতিক্রম করে যাওয়ার ধারণা। আরো সঠিক মানে দাঁড়ায় সংবিধান জাতীয় সংসদ বা রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন সংস্থাকে যে ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব দিয়েছে সেই ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব অতিক্রম করে যাওয়ার ইঙ্গিত। তাহলে বাংলাদেশের সংবিধান ১৪২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জাতীয় সংসদকে যে ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব দিয়েছে ত্রয়োদশ সংশোধনী প্রণয়নের সময় কি জাতীয় সংসদ সেই ক্ষমতা অতিক্রম করে গিয়েছে? এটাই প্রশ্ন। আশা করি পূর্ণাঙ্গ রায়ে আদালতের কাছ থেকে আমরা এর ব্যাখ্যাও পাবো। অন্যান্য সংশোধনীর ক্ষেত্রেও আমাদের এই দিকটা বিচার করে দেখতে হবে।

সংবিধান অতিক্রম করে যাবার কথা বলে হয়েছে and বা 'এবং' জুড়ে দিয়ে, বাক্যে খারিজ হবার ঘোষণার পরে। সে কারণেও আমরা সংক্ষিপ্ত রায় থেকে বুঝতে পারবো না ত্রয়োদশ সংশোধনী খারিজ হওয়া আর তা সংবিধান অতিক্রম করে যাবার ব্যাপারটা কী ধরণের কার্যকারণ সম্বন্ধে যুক্ত। জাতীয় সংসদ এই সংশোধনী আনতে গিয়ে নিজেদের ক্ষমতার এখতিয়ার বা কর্তৃত্বের সীমা অতিক্রম করার ব্যাপারটিকে 'এবং' দিয়ে উল্লেখ করে খারিজ করে দেবার পক্ষে বাড়তি কোন যুক্তি দেওয়া হলো কি? ক্ষমতার এখতিয়ার বা কর্তৃত্বের সীমার তর্ক বাদ দিয়ে যদি মেনেও নেই যে ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়েছে এবং আদালত এই ধরণের রায় দিতেই পারে তাহলেও এই সাংঘর্ষিকতার বিচার কীভাবে হয়েছে সেটা আমরা পুরো রায় পেলেই কেবল জানব।

দুই. সংবিধানের মূল কাঠামো বা তথাকথিত বেসিক স্ট্রাকচার

অনুমান করি, সংবিধানের তথাকথিত basic structure বা মূল কাঠামোর তর্কের সঙ্গে আদালতের বর্তমান সিদ্ধান্ত জড়িত। 'তথাকথিত' বলছি এই কারণে যে সংবিধানের মূল কাঠামো সংক্রান্ত ধারণা নিয়ে আদালতে যে তর্ক উঠেছিল তার পক্ষে 'রায়' হয়েছে, কিন্তু রাজনৈতিক নিষ্পত্তি হয় নি। তর্কটা রয়ে গিয়েছে। তর্কটা পুরনো। অষ্টম সংশোধনী মামলায় আদালত প্রথম সংসদে পাশ হওয়া বিধান সংবিধানের 'মূল কাঠামো'র দোহাই দিয়ে বাতিল করেছিল। কিন্তু অষ্টম সংশোধনী মামলার রায়ে বিচারপতি এ টি এম আফজাল অন্য বিচারপতিদের সঙ্গে একমত হন নি, ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন। এই জন্যই 'তথাকথিত' লিখলাম। বাংলাদেশের সংবিধানে আছে কি এমন কোন 'স্ট্রাকচার'? আদালত দাবী করবে অষ্টম সংশোধনীর রায় অনুসারে হয়েছে। কিন্তু সে রায়েই তর্ক রয়ে গিয়েছে যে অনুচ্ছেদ ১৪২ শুধু সংশোধনের প্রক্রিয়া অথবা পদ্ধতির ওপর সীমা টেনেছে। কিছু কিছু অনুচ্ছেদের ক্ষেত্রে গণভোটের বিধান আছে। কিন্তু বাংলাদেশের সংসদ চাইলেই যে কোন বিধান প্রণয়ন করতেই পারে। যদি বর্তমান সংবিধান সংসদকে এই ধরনের ক্ষমতা দিয়ে থাকে তাহলে আদালত কীভাবে জাতীয় সংসদে পাশ হওয়া কোন সংশোধনী বা বিধান বাতিল ঘোষণা করতে পারে? হোক সেটা ত্রয়োদশ, পঞ্চম কিম্বা সপ্তম? সেটা পারে বেসিক স্ট্রাকচার সংক্রান্ত ধারণার বলে। দেখা যাচ্ছে সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচার তর্কের সঙ্গে এই সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জড়িত। এই বিষয়ে কয়েকটি কথা বলে রাখা দরকার।

প্রধান বিচারপতি বা বিচারকরা যখন শপথ গ্রহণ করেন তখন বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী তাঁকে স্পষ্ট বলতে হয়, "আমি… প্রধান বিচারপতি ( বা ক্ষেত্র অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের আপীল/হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক) নিযুক্ত হইয়া সশ্রদ্ধ চিত্তে শপথ (বা দৃঢ় ভাবে ঘোষণা) করিতেছি যে, আমি আইন অনুযায়ী ও বিশ্বস্ততার সহিত আমার কর্তব্য পালন করিব; আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করিব; আমি বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিব; এবং আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের সহিত আইন-অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিব"।

কিন্তু যখন সংসদ সদস্য শপথ নেন তিনি একই কথা বলেন না। তিনি বলেন, "আমি…সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইয়া সশ্রদ্ধ চিত্তে শপথ (বা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা) করিতেছি যে, আমি যে কর্তব্যভার গ্রহণ করিতে যাইতেছি, তাহা আইন অনুযায়ী ও বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব; আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করিব; এবং সংসদ সদস্য রূপে আমার কর্তব্য পালনকে ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বারা প্রভাবিত হইতে দিব না"।

অর্থাৎ সংসদ সদস্যরা বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানের শপথ নেন না। এই দিকটি বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই জন্য এই বাক্যটি মোটা ও বাঁকা হরফে উদ্ধৃত করছি যাতে পাঠকরা সহজে ধরতে পারেন। কেন সংসদ সদস্যরা এই শপথ নেন না? কারণ সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী 'এই সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে তাহা সত্ত্বেও (ক) সংসদ আইন দ্বারা সংবিধানের যে কোন বিধান সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন বা রহিতকরণে দ্বারা সংশোধিত হইতে পারিবে'। তবে সংবিধানের প্রস্তাবনা ও কিছু কিছু বিধানের ক্ষেত্রে গণভোটের ব্যবস্থা রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে যাই থাকুক তা সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন বা রহিতকরণের ক্ষমতা সংবিধানই জাতীয় সংসদকে দিয়েছে। এই সবকিছুকেই বাংলাদেশের সংবিধান এক কথায় 'সংশোধন' বলে থাকে। 'সংবিধান ও আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তার বিধানের' শপথ নিলে জাতীয় সংসদের সংবিধান 'সংশোধন' করবার ক্ষমতা খর্ব হয়ে যায়। ফলে দ্বিতীয় যে দিকটা লক্ষ্য করবার বিষয় সেটা হোল, সংসদ সদস্যরা জনগণ দ্বারা 'নির্বাচিত', কিন্তু বিচারকরা রাষ্ট্র দ্বারা 'নিযুক্ত' (appointed)। এটাও গুরুতর পার্থক্য।

তার মানে সংসদ সদস্যরা একই সঙ্গে সংবিধানের ভেতরে এবং বাইরে রয়েছেন। একদিকে তাঁরা সংবিধানের অধীন, কারণ সংবিধানই তাদের সংবিধানের বাইরে যাবার ক্ষমতা দিয়েছে। জাতীয় সংসদকে এই ধরনের ক্ষমতা দেওয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক। নাগরিকদের মৌলিক ও মানবিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করবার মওকা ও ক্ষমতা যেমন এর ফলে জাতীয় সংসদকে দেওয়া হয়, একইভাবে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ভিত্তিকে নড়বড়ে করে ফেলবার সুযোগও থেকে যায়।

তাহলে সেই গোড়ার প্রশ্নে ফিরে আসি। সেটা হলো, বিচারকরা কোন ক্ষমতাবলে জাতীয় সংসদে দুই তৃতীয়াংশ ভোটে গৃহীত হওয়া পঞ্চম, সপ্তম ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করলেন? আবার অনেক কিছু মার্জনা করেছেন? এই সংশোধনীগুলো জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়ে যাবার পর তারা সংবিধানের অংশ বা সংবিধানে পরিণত হয়ে গিয়েছে। তাঁরা তো এই 'সংবিধান ও আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানের' জন্যই রাষ্ট্র কর্তৃক 'নিযুক্ত'। তাঁরা তো শপথ নেবার সময় বলেন নি যে যেহেতু এই সংশোধনী ও আইনগুলো সংবিধানে রয়েছে অতএব এর রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানের শপথ তাঁরা নিতে পারবেন না। বাতিল করে তাঁরা ভাল করেছেন কি মন্দ করেছেন সেটা পরের তর্ক, বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী সংবিধান আদালতকে যে ক্ষমতা দেয় নি, বিচারকরা কি সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন? বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী আদালত ও জাতীয় সংসদের সম্পর্ক এবং উভয়ের ক্ষমতা ও ক্ষমতার সীমা বা এখতিয়ারের প্রশ্ন বিচার ছাড়া আদালতের ভূমিকায় যে ভয়াবহ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়েছে তার গোড়া আমরা খুঁজে পাব না।

বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হবার পর থেকে চতুর্থ সংশোধনীসহ বাংলাদেশে আজ অবধি যতো গণবিরোধী এবং গণতান্ত্রিক ও মৌলিক মানবাধিকার-বিরোধী সংশোধনী ও আইন হয়েছে তার গোড়ায় রয়েছে জাতীয় সংসদের এই ক্ষমতা। একই সঙ্গে বিচার বিভাগের সঙ্গে জাতীয় সংসদের বিরোধের ক্ষেত্রও তৈরি করে রাখা হয়েছে এখানে। জাতীয় সংসদের এই সার্বভৌম ক্ষমতাকে খর্ব করবার জন্য বিচারকদের আবিষ্কার করতে হয়েছে সংবিধানের মূল কাঠামো বা basic structure সংক্রান্ত তত্ত্ব। তর্কটা ভারতের সুপ্রিমকোর্টের বাহাস থেকেই বাংলাদেশে এসেছে। ভারতের সুপ্রিমকোর্টে ১৯৭৩ সালে কেশবানন্দ বনাম কেরালার রাজ্য সরকারের মামলায় সংবিধানের মূল কাঠামো বা বেসিক স্ট্রাকচার নিয়ে যে তর্ক উঠেছিল সেই তর্কই প্রায় হুবহু বাংলাদেশের সুপ্রিমকোর্টে ১৯৮৯ সালে আনওয়ার হোসেন চৌধুরি বনাম বাংলাদেশের মামলায় (41 DLR 1989 App. Div. 165, 1989 BLD (Spl.) 1) উঠেছে। সেটা পরিষ্কার। এই মামলা অষ্টম সংশোধনী মামলা হিশাবেই বেশি পরিচিত।

মূল কাঠামো বা বেসিক স্ট্রাকচারকে বিচারকদের 'আবিষ্কার" বলছি এই কারণে যে সংবিধানে এই ধরনের কিছু আদৌ আছে তা সংবিধানের কোথাও পরিষ্কারভাবে কোথাও উল্লেখ নাই। পরিষ্কার দূরের কথা, আকারে, ইঙ্গিতে, ইশারায় ঘূণাক্ষরেও নাই। বিচারকরা সংবিধানের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিচারকদের সেই ব্যাখ্যার ওপর দাঁড়িয়েই রায় হয়েছে এবং রায়ের পরিপ্রেক্ষিতেই সংবিধানে বেসিক স্ট্রাকচার বা মূল কাঠামো নামক কিছু একটা ব্যাপার আছে বলে কথাটির চল হয়েছে। কিন্তু, মনে রাখতে হবে, এই রায়ে সব বিচারক একমত হন নি। ওপরে আমরা দেখেছি, সংবিধান সংশোধন বা কোন আইন প্রণয়ন করার ক্ষেত্রে জাতীয় সংসদের ক্ষমতা অসীম, অল্প কিছু ক্ষেত্রে শর্ত ছাড়া সংবিধানে আকারে, ইঙ্গিতে ইশারায় এই ক্ষমতা প্রয়োগে কোন প্রচ্ছন্ন সীমা বা বাধা নাই। জাতীয় সংসদের এই ক্ষমতা ঠেকাতেই সংবিধানের মূল কাঠামো বা বেসিক স্ট্রাকচার তর্কের সূত্রপাত। আসলে এই বিষয়ে সর্বসম্মত মীমাংসা হয় নি। ঘাপলা রয়ে গিয়েছে। এই তর্ক বিচারক ও আইনবিশারদদের মধ্যে যেমন, তেমনি আমাদের সমাজেও রয়ে গিয়েছে। আসলে সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জাতীয় সংসদের সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা মূলত সাংবিধানিক ক্ষমতা বা সংবিধান প্রণয়নের ক্ষমতা (constituent power) ; এই ক্ষমতা নিছক আইন প্রণয়ণের ক্ষমতা (ordinary legislative power) নয়।

সংবিধানের মূল কাঠামোর ধারণা নিয়ে জর্মন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও পন্ডিত ড. ডিয়েত্রিচ কনরাড অনেক কাজ করেছেন। এই ধারণা আদালত ব্যবহার করেছে বলে এর ব্যবহারিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে, কিন্তু এই ধারণায় তাত্ত্বিক আদল আর শেষমেষ পরিণতি যে অস্পষ্ট ও বিতর্কিত তিনি তা স্বীকার করেন। বাংলাদেশের বিচারকদের মধ্যে অনেকে, যেমন বিচারপতি মোস্তফা কামাল মনে করেন সংবিধানের মূল কাঠামো বা বেসিক স্ট্রাকচার সংক্রান্ত তত্ত্ব একটা কুয়াশাচ্ছন্ন জায়গার ওপর দাঁড়িয়ে আছে (Bangladesh Constitution: Trends and Issues; p-110) ।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হওয়ার কারণে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাড়বে, ঠিক। রাজনীতি নিয়ে আমাদের আলোচনা করতে হবে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিরুদ্ধে থাকলেও বিদ্যমান সংবিধানে দেওয়া ক্ষমতা ও সীমা আদালত অতিক্রম করে গেল কিনা সেই তর্ক আমাদের অবশ্যই করতে হবে।

২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৮। ৩ জুন ২০১১